চট্টগ্রামে জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা বৃহস্পতিবার
ঐতিহ্য আর লোকজ সংস্কৃতির শেকড়ের টানে বছর ঘুরে চট্টগ্রামে শুরু হচ্ছে শত বছরের লোকক্রীড়ার আসর জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা। তিন দিনব্যাপী এ মেলার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) থেকে। তবে বুধবার (২৪এপ্রিল) সকাল থেকে হরেক রকম পণ্যের পসরায় বিক্রেতা আর সংস্কৃতিপ্রাণ দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটে।
ঐতিহ্যবাহী এ খেলায় প্রতিবছর সারা দেশ থেকে নামকরা বলীরা অংশ নেন। নগদ টাকা ছাড়াও বিভিন্ন পুরস্কার দেওয়া হয় বিজয়ীদের। আর এ বলী খেলা দেখতে লাখো মানুষের ভিড় জমে লালদিঘী ময়দানে।
১৯০৯ সালে বিট্রিশবিরোধী আন্দোলনকে তরান্বিত করতে চট্টগ্রামের যুব সমাজকে রণপ্রস্তুতির লক্ষ্যে বলীখেলার প্রচলন করেছিলেন প্রয়াত আব্দুল জব্বার। তাঁর মৃত্যুর পরেও এমন দৃপ্ত শপথ আর বাঙালির সংস্কৃতির টানে প্রতিবছর এ আয়োজন হয়ে আসছে। বাংলা বছরের ১২ বৈশাখে এই মেলারও রেওয়াজ হয়ে আসছে।
নগরীর আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ থেকে শুরু করে লালদিঘী হয়ে এক বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ক্রেতারা। সার্বজনীনভাবে অনুষ্ঠিত ঐতিহ্য বজায় রেখে মেলায় গৃহস্থালি পণ্য, মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বাঁশের তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জাম, আসবাবপত্র, নকশিকাঁথার কাপড়, হরেক রকমের নাড়ু, জিলাপি, মিষ্টান্ন, বিভিন্ন স্বাদের আচার, প্লাস্টিকের জিনিসপত্র নার্সারির গাছের চারা, তবলা, একতারা, বাঁশি থেকে শুরু করে কাপড়ের সুই সুতো হরদম কেনা-বেচা হয়।
মেলা ঘুরে দেখা গেছে, আন্দারকিল্লা সড়কের দু’পাশ থেকে শুরু হওয়া মেলায় দর্শনার্থীরা ভিড় জমিয়েছেন। আবার অনেক দোকানি গোছানোর কাজ সারছেন। কেউবা মাটির তৈজসপত্র আরও আর্কষণীয় করে তোলার জন্য ধুয়ে মুছে রাখছেন।
মেলার মূল আর্কষণ লালদিঘী মাঠে বলীখেলার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সারছেন আয়োজকরা। সেখানে প্রস্তুতির কাজ দেখতে ভিড় করছেন দর্শকরা। এরপাশে নাগরদোলায় চড়ছে কিশোর-কিশোরী আর স্কুল শিক্ষার্থীরা।
ঘর গোছানোর জন্য মাটির তৈজসপত্র কিনতে বান্ধবীসহ মেলায় আসেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারিয়া মিম। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘প্রতিবছর বলীখেলা আর এমন একটি মেলার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকি। দেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা সংস্কৃতির গন্ধ পাই। তাই প্রথমদিনই মাটির হাড়ি পাতিল কেনার জন্য এসেছি।’
একই ভিড় দেখা যায় বিভিন্ন নাড়ু, মিষ্টান্নে আর নকশিকাঁথার স্টল এবং মহিলাদের স্টলে।
বংশ পরপম্পরায় ৪০ বছর ধরে চট্টগ্রামের বলীখেলার মেলায় বসছেন ঢাকার শ্যামপুর এলাকার বাসিন্দা মো. মুসলিম ব্যাপারী। প্রথমদিকে কেবল মাটির তৈজসপত্র নিয়ে মেলায় আসলেও সময়ের পরিক্রমায় দশ বছর ধরে নার্সারির ব্যবসায় সংযুক্ত রয়েছেন। তিনি বার্তা২৪.কমকে সময়ের কথা বলতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। কিছুক্ষণ পর সাল হিসেব করে জানালেন ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে মেলায় আসছেন।
তিনি জানান, মেলা বৈশাখে হলেও ফাল্গুন মাস থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়। ঢাকার শ্যামপুর এলাকায় তৈরি হয় এসব তৈজসপত্র সামগ্রী। বড় আর ছোট ছেলেও এই ব্যবসা তাকে সহায়তা করেন।
তিনি বলেন, ‘আজ তেমন বেচা বিক্রি না হলেও মেলার সময় বাড়া সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি বাড়বে।’
বাদল সরকার নামে আরেক ব্যবসায়ী ২০ বছর ধরে বিভিন্ন নাড়ু, মোয়া, জিলাপিসহ বিভিন্ন মিষ্টান্ন খাবার নিয়ে মেলায় বসেন।
আয়োকজ সূত্রে জানা গেছে, এবারের ১১০তম আসরে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মাদককে না বলুন’। এর অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বলির খেলোয়াড়রা অংশ নেন। এবারের ১৫০ জন খেলোয়াড় তালিকাভুক্ত করা হলেও এর মধ্যে ৫০ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করবেন মেলা কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বলিখেলার উদ্বোধন করবেন সিএমপি কমিশনার মাহবুবর রহমান। এছাড়া বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্তার বিতরণ করেবেন সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
এ বিষয়ে বলিখেলা ও বৈশাখী মেলার সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে মেলার ৭০ শতাংশ প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। মেলার সার্বিক ব্যবস্থা নিরাপত্তা মনিটরিংয়ের জন্য বেশ কিছু জায়গায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। বলিখেলায় অংশ নেওয়াদের পুরস্কার ও সম্মানিও এবার বাড়ানো হয়েছে। আশা করছি মেলা সার্বজনীন উৎসবে রূপ নেবে।’
দীর্ঘদিন ধরে চলা আসা এমন আয়োজনকে বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান দেওয়ার চেষ্টা করছে আয়োজক কর্তৃপক্ষ। গত বছর এমন একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এ বিষয়ে প্রয়াত আব্দুল জব্বারের নাতি ও মেলা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শওকত আনোয়ার বাদল বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এটি যদিও আমার নানার নামে হয় কিন্তু এটি সবার প্রাণের উৎসব। বিট্রিশবিরোধী আন্দোলনের সময় এমন একটি আয়োজন তরুণদের মাঝে সাহসের উদ্দীপনা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের জন্য গতবছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলাম। এরপর আমরা কোনো অগ্রগতি দেখিনি। আমরা সাংবাদিকদের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।’