সীমান্তে ১০ মাসে ৩০০ কোটি টাকার চোরাচালানি পণ্য জব্দ
কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরসহ ৪ জেলার ৩শ’ কিলোমিটার সীমান্ত পথের ৪০ রুট দিয়ে দেদারছে ঢুকছে মাদক ও অস্ত্র। ১শ’র বেশী সিন্ডিকেট ওই সীমান্ত পথে তাদের মাদক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ৪৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভারতীয় সীমান্ত। এর মধ্যে ১৮ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া। বাকি ২৮ কিলোমিটার ‘অরক্ষিত’ উন্মুক্ত। সীমান্তের ওই এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠেনি নিরাপত্তা কিংবা সুরক্ষা বেষ্টনী। ফলে উন্মুক্ত সীমান্তের দুর্গম এলাকা দীর্ঘকাল রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাকারবারিরা। গত ১০ মাসে পৃথক অভিযানে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার চোরাচালানি পণ্যের চালান আটক করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, সীমান্তরক্ষীদের কঠোর নজরদারী সত্ত্বেও থামানো যাচ্ছে না কুষ্টিয়া সেক্টরের অধীনে চোরাকারবারী। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, জনপ্রতিনিধি, একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ, ভৌগলিকভাবে নদী পথের আধিক্য প্রভৃতি কারণে এ সেক্টরের অধীনে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরসহ চার জেলার ৩শ’ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা চোরাকারবারীরা একটি সুবিধাজনক রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।
এই বিশাল সীমান্তেৃর বেশীরভাগ উন্মুক্ত থাকায় এই এলাকা দীর্ঘদিন ধরে চোরাকারবারিদের জন্য উপযুক্ত রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সীমান্তে পর্যাপ্ত সুরক্ষা বেষ্টনী না থাকায় চোরাকারবারিরা সহজেই এই পথ দিয়ে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধ পণ্য পরিবহন করছে। এ জেলাগুলোর মধ্যে প্রায় ৪০টিরও বেশী চোরাচালান রুট রয়েছে যেখানে ১০০’র বেশী সিন্ডিকেট রয়েছে।
প্রতিদিন এসব চোরাপথে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তরি-তরকারিসহ শাড়ী, থ্রিপিস, শার্টপিস, চাদর, কম্বল, তৈরী পোশাক, কসমেটিক্স সামগ্রী, কাঠ, চা পাতা, চিনি, সার, কয়লা, মোবাইল ডিসপ্লে, চশমা, সুতা, কারেন্ট জাল, সুপারি, রসুন, পিঁয়াজ, জিরা, যানবাহন, ট্রলি, নৌকা, সিএনজি, ইজিবাইক, বাইসাইকেল আসছে।
অন্যদিকে, মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা ট্যাবলেট, ক্রিস্টাল মেথ আইস, হেরোইন, ফেনসিডিল, বিদেশী মদ, বাংলা মদ, বিয়ার, গাঁজা, বিড়ি ও সিগারেট, নেশাজাতীয় ট্যাবলেট, ইনজেকশন, ইস্কাফ সিরাপ, কোকেন, এমকেডিল, কফিডিল।
বিভিন্ন প্রকার ঔষধ যেমন এ্যানগ্রো, সেনেগ্রা ও অন্যান্য ট্যাবলেট পণ্য অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- পিস্তল, গান জাতীয় অস্ত্র, রাইফেল, রিভলবার, গেনেড, রকেট বোম, গুলি।
অপরদিকে, বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য, সাপের বিষ, ইলিশ মাছসহ অন্যান্য মূল্যবান মালামাল ভারতে পাচার হচ্ছে।
বিজিবির তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত গত ১০ মাসে ২৭৮ কোটি ৭৮ লাখ ৪ হাজার ২৯৫ টাকার চোরাচালানের মালামাল আটক করেছে বিজিবি।
কুষ্টিয়া ব্যাটালিয়ন (৪৭ বিজিবি) সেক্টরের উপ-মহাপরিচালক কর্নেল মো. মারফুল আবেদীন এ তথ্য জানিয়েছে।
এর মধ্যে কুষ্টিয়া সদর সেক্টরের টিম ৮০ বোতল এলএসডি, ক্রিস্টাল মেথ আইস, কোকেন, আফিম, হেরোইন, ইয়াবা, মদ, ট্যাপেনটাডল ট্যাবলেট, ভায়াগ্রা, ফেনসিডিল, সিলডিনাফিল ট্যাবলেট, বিয়ার ও গাঁজাসহ ১৬০ কোটি ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৮ হাজার টাকার মাদক উদ্ধার করেছে।
চোরাকারবারিদের দমন ও সীমান্তের নিরাপত্তায় দুই-তিন কিলোমিটার পরপর স্থাপিত বিওপিতে বিজিবি নিযুক্ত থাকলেও আইনের চোখ এড়িয়ে দুর্গম চোরাপথে আসছে মাদকের বড় বড় চালান, আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলিসহ অন্যান্য পণ্য সামগ্রী। অবৈধ এসব চালানের একাংশ ধরা পড়লেও থামছে না চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য। মূলত দেশের অভ্যন্তরে মাদকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ফলে মাদকের ছোবলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যুবসমাজ ও শিক্ষার্থীরা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দৌলতপুর উপজেলার ধর্মদহ, প্রাগপুর, বিলগাথুয়া, জামালপুর, মহিষকুন্ডি মাঠপাড়া, মুন্সীগঞ্জ, চল্লিশাপাড়া, চরপাড়া, চিলমারী, চরচিলমারী, উদয়নগর, ডিগ্রিরচরসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে মাদক পাচারকারীরা গোপনে বিভিন্ন কৌশলে ফেনসিডিল, গাঁজা ও মদসহ বিভিন্ন মাদক পাচার করছে। আর এসব মাদক হাত বদল হয়ে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।
এছাড়া সীমান্তের একাংশের মানুষ চোরা কারবারকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। ফলে ঝুঁকি সত্ত্বেও বেশি আয়ের উৎস হিসেবে তারা ঝুঁকছে চোরাকারবারিতে। সীমান্তে বসবাসরত স্থানীয়রা জানান, চোরাপথে মাদক আমদানি একটি মারাত্মক অপরাধ। এছাড়া দেশ-জাতির জন্য চরম ক্ষতিকর মাদক ও অবৈধ পণ্য আমদানি বন্ধসহ চোরাকারবারিদের দমনে আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দেন সংশ্লিষ্টরা।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর এলাকার অনেকেই বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে ভারত থেকে মাদক পাচার করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু বিজিবি, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর প্রচেষ্টায় মাদক পাচার রোধ করা কঠিন। যেহেতু ভারত থেকে মাদক আসছে, তাই সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের আন্তরিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সীমান্ত নিয়ে কাজ করেছেন কুষ্টিয়ার বেসরকারি সংস্থা রবীন্দ্র সংসদের নির্বাহী পরিচালক সাথী নজরুল ইসলাম জানান, সীমান্তবর্তী অঞ্চলের কিছু মানুষ চোরাচালানকেই প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে, যা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য উচ্চ ঝুঁকি গ্রহণে প্রলুব্ধ করছে। ফলে চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম ও স্থানীয় চাহিদা কমানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এদেরকে নানাভাবে সুরক্ষা দেয়া হয়। এই সুরক্ষাদাতারা হলেন এলাকার একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি যারা নিজেরাও চোরাচালানের সাথে জড়িত।
কুষ্টিয়া জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) এর নেতৃবৃন্দ বলেন, ভারতীয় সীমান্তে অরক্ষিত-উন্মুক্ত জায়গা দিয়েই প্রতিদিন আসছে মাদক। অথচ যে পরিমাণ বিজিবি মোতায়েন করা দরকার লোকবলের অভাবে তা সম্ভব না হওয়ায় মাদক চোরাচালান থামানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়া এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল ও জনপ্রতিনিধিরাও এই মাদক পাচারের সঙ্গে সংশিষ্ট থাকায় মাদক চোরাচালান থামানো যাচ্ছে না।
কুষ্টিয়া ব্যাটালিয়ন (৪৭ বিজিবি) কুষ্টিয়া সদর সেক্টরের উপ-মহাপরিচালক কর্নেল মো. মারুফুল আবেদীন জানান, অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে বিজিবি সদস্যরা সব সময় রয়েছে সজাগ। চলতি বছরের গত ১০ মাসে মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র-গুলি, স্বর্ণসহ চোরাপথে আসা বিপুল পরিমাণ পণ্যের চালান আটক করা হয়েছে। চোরাচালান রোধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হয়েছে। আইনের চোখ এড়িয়ে কেউ ছাড় পাবে না বলে তিনি জানান।