যে ক্লাবের সদস্যরা ২৭ বছর বয়সে মারা যায়

  • তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ক্লাব ২৭ সদস্যদের গ্রাফিতি

ক্লাব ২৭ সদস্যদের গ্রাফিতি

একজন মানুষের জন্য ২৭ বছর বয়স হলো জীবন-উপভোগের শ্রেষ্ঠ সময়। যা ইচ্ছা তা করে ফেলা যায়। কেউ ছোট বলে দেয় না, আবার কেউ ‘বয়স হয়েছে’ বলেও আটকাতে পারে না। এ বয়সে দুয়েকটা ভুলকেও সকলে ক্ষমার চোখেই দেখে। বয়সটাই এমন বলে পার পেয়ে যাওয়া যায় অনেক কিছু থেকে। কিন্তু এই বয়সেই যদি মৃত্যু হয়? থেমে যায় একেকটি সম্ভাবনাময় জীবন?

এমনই একটি ক্লাবের নাম ক্লাব ২৭—যে ক্লাবের সদস্যরা মারা যান মাত্র ২৭ বছর বয়সে। এবং এদের বেশিরভাগই হলেন সেলেব্রেটি, আরো নির্দিষ্ট করে বললে তারা একেকজন সেলেব্রেটি মিউজিশিয়ান। বিশ্বব্যাপী খ্যাতি পাওয়ার পর কিসের অভাব তাদের এই আশ্চর্য ২৭ বছর বয়সেই কেড়ে নেয়, সে রহস্য আজও অজানা। তাদের কারো মৃত্যুই স্বাভাবিক ছিল না। কেউ নিহত হয় আততায়ীর হাতে, কেউ বা হয়েছে আত্মঘাতী, তবে বেশিরভাগের মৃত্যু ঘটেছে অতিরিক্ত মাদকগ্রহণের প্রভাবে। ফলশ্রুতিতে, সংগীতাঙ্গনে ২৭ সংখ্যাটি একটি অশুভ সংখ্যা হিসেবে বিবেচিত হয়।

বিজ্ঞাপন

২৭ বছর বয়সে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। ব্রায়ান জোনসকে কে না চেনে? ‘রোলিং স্টোনস’-এর সেই তারকা মারা যান সুইমিং পুলে ডুবে। কিংবদন্তী গিটার-ব্যক্তিত্ব জিমি হেনড্রিক্স, মহিলা রক সংগীতশিল্পী জেনিস জপলিন, তার মৃত্যু অতিরিক্ত মাদকগ্রহণ সূত্রে। একই কারণে মৃত্যু হয় ‘দ্য ডোরস’-এর প্রধান গায়ক জিম মরিসনের। আর এরা প্রত্যেকেই মারা যান মাত্র ২৭ বছর বয়সে। এছাড়াও ২৭-এ চলে গিয়েছেন ‘নির্ভানা’-র কার্ট কোবেইন, জ্যাজ গায়িকা অ্যামি ওয়াইনহাউজ। হেনড্রিক্স এবং কোবেইন ২৭-এ আত্মহত্যা করেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/27/1564221005904.jpg
◤ ১৯৬৮ সালে জার্মানির ফ্রাংক ফুর্টে জিম মরিসন  ◢ 

 

এতক্ষণে অনেকের ধারণা হতে পারে ক্লাব ২৭ সত্যিই কোনো একটি ক্লাব আর এই মৃত ব্যক্তিরা সবাই এই ক্লাবের সদস্য। না, এমন কিছুই নয়। ক্লাব ২৭ বলে অফিশিয়ালি কোনো ক্লাব নেই। তবুও সংগীত অনুরাগীদের একটি দুর্বার আকর্ষণের নাম ক্লাব ২৭, এবং সংগীতজগতে এই ক্লাবটি নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে মারা যান কয়েকজন তরুণ সংগীতশিল্পী। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রায়ান জোন্স, মরিসন, হেনরিক্স এবং উইলসন।

ব্রায়ান জোন্সের মৃত্যু তো সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সুস্থ সবল একটা মানুষ হুট করে পানিতে পড়ে মারা গেলেন। ১৯৬৯ সালের ২ অথবা ৩ জুলাই নিজস্ব সুইমিংপুলের তলদেশে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এর কিছুদিন পরেই শোনা গেল আরেক সঙ্গীত তারকা জন মরিসন মারা গেছেন। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায় হার্ট অ্যাটাক। ধারণা করা হয় অতিরিক্ত মদ্যপানই এর কারণ।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/27/1564221219085.jpg
◤ ব্রায়ান জোন্স  ◢ 

 

খ্যাতিমান ইলেক্ট্রিক গিটারিস্ট জিমি হেনড্রিক্স মারা যান একই সময়েই। যাকে বিংশ শতাব্দীর সেরা গিটারিস্টদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়, তিনিও মারা গেলেন মাত্র ২৭ বছর বয়সে। এক পার্টিতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে তার এক বান্ধবীর বাসায় নেওয়া হয়। সেখানেই পরদিন সকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে জানা যায় অতিরিক্ত ওয়াইন ও ঘুমের ওষুধ সেবনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।

জ্যানিস জপলিন, যাকে ‘সুরেলা ডাইনি’, ‘সাইকেডেলিক আত্মার রানি’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়, সেই জ্যানিস জপলিন মারা গিয়েছিলেন হেনড্রিক্সের মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পরেই। তিনি গাইতেন, গান লিখতেন, ছবি আঁকতেন, নাচতেন এবং সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজকও ছিলেন। মাত্রাতিরিক্ত হেরোইন গ্রহণের কারণে বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে মেঝেতেই মরে পড়ে ছিলেন। প্রায় সময়েই বিষাদগ্রস্ত থাকতেন। এই বিষাদই তাঁকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর দিকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে।

ব্লুজ-এর সুরকার ও গায়ক রবার্ট জনসন, যিনি ২৭ বছর বয়সেই ব্লুজ ইতিহাসের অন্যতম সেরা সুরকারের মর্যাদা পেয়েছিলেন। ‘ক্রস রোড ব্লুজ’-এর এই সুরকার মারা গিয়েছিলেন বিষক্রিয়ায়। অনেকের ধারণা তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

পরবর্তী বছরগুলোতে একই বয়সে মারা যান লিন্ডা জোন্স, লেসলি হার্ভে, পিট হ্যাম, ক্রিস বেলসহ আরো অনেকে। ব্যাপারটা সংবাদমাধ্যম অথবা মিডিয়াকে তেমন একটা আকর্ষণ করতে না পারলেও, ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকে সংগীত ভুবনে। ফলে সংগীতাঙ্গনে একটা ভীতিপ্রদ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আবার অনেকে একে ট্রেন্ড হিসেবে ধরে নিয়ে এই বয়সে আত্মহত্যা করেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/27/1564221328959.jpg
◤ রবার্ট জনসনের সমাধি ◢ 

 

এদের মধ্যে পিট হ্যাম ছিলেন ব্যাডফিঙ্গার ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট। নিজের ২৮তম জন্মদিনের মাত্র দুদিন আগ দেখা করেছিলেন ব্যান্ডের আরেক সদস্য টম ইভান্সের সঙ্গে। পিট ইভান্সকে বলেছিলেন, ‘Don’t worry, I know how to scape’। সেদিনই বাসায় ফিরে গ্যারেজে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি একটি সুইসাইড নোটে জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণার কথা লেখেন। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, সাত বছর পরে তার বন্ধু ইভান্সও সুইসাইড করেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/27/1564221511431.jpg
◤ পিট হ্যাম ◢ 

 

উইকিপিডিয়ায় প্রায় ৪৯ জন সংগীতশিল্পীর তালিকা রয়েছে যারা মারা যান ২৭ বছর বয়সে। ক্লাব-২৭ নিয়ে লেখা এরিক সিগালস্টেডের the 27s: The Greatest Myth of Rock and Roll বইতে লেখক ৩৪ জন শিল্পীর জীবনী তুলে ধরেন। কোবেইন এবং হেন্ডরিক্স জীবনীকার চার্লস আর ক্রস লিখেছেন, ২৭ বছরে যারা মারা গেছেন এমন সঙ্গীতশিল্পীদের সংখ্যা নিঃসন্দেহ সত্যিই লক্ষণীয়। জন ক্রেইগির মন্টানা টেল অ্যালবামের ‘২৮’ শিরোনামের গান এ বিষয়ে রচিত। এ গানের তিনটি পদে যথাক্রমে জিম মরিসন, জ্যানিস জপলিন এবং কার্ট কোবেইনের মৃত্যু সম্পর্কে নির্দেশ করে। একই ধারণা পাওয়া যায় এরিক বার্ডনের ২০১৩ সালের অ্যালবাম ‘টিল ইওর রিভার রান্স ড্রাই’ অ্যালবামের ‘২৭ ফরেভার’ গানে। লেটলাইভ কর্তৃক তাদের দ্য ব্ল্যাকেস্ট বিউটিফুল অ্যালবামের ‘২৭ ক্লাব’ গানটিও একই ধারণা থেকে উদ্ভূত।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/27/1564221828058.png
◤ the 27s: The Greatest Myth of Rock and Roll ◢ 

 

এই ক্লাব ২৭-এর সর্বশেষ শিকার ছিলেন বিখ্যাত সঙ্গীত তারকা ব্রিটিশ গায়িকা ও গীতিকার অ্যামি ওয়াইনহাউস। সারা জীবনে অনেকে একবারও গ্র্যামি জিততে পারেন না। কিন্তু এই শিল্পী মাত্র ২৭ বছর বয়সের মধ্যে পাঁচবার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জেতেন। তার প্রতিভার ব্যাপারে তাই বেশি কিছু বলার আছে বলে মনে হয় না। একদিন সকালে তার লন্ডনের বাসায় তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অবশ্য তিনি দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থতায় ভুগছিলেন এবং তাকে প্রায়ই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হতো।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/27/1564221976251.jpg
◤ এমি ওয়াইনহাউস ◢ 

 

ক্লাব ২৭ নামে কোনো ক্লাব না থাকলেও এই ক্লাবের সদস্যদের এমন আকস্মিক মৃত্যু নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত এই রহস্যের কোনো কিনারা পাওয়া যায়নি।