ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি : দুই বাঙালি শহীদের গল্প



যাকওয়ান সাঈদ, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি

ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯০৮ সালে মাত্র আঠার বছর বয়সে যে কিশোর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করেছিল, তাঁর নাম ক্ষুদিরাম বসু। ক্ষুদিরাম বসুর সহযোগী ছিল প্রফুল্ল চাকি, ক্ষুদিরামের ফাঁসির মাস তিনেক আগেই যে পুলিশের হাতে ধরা দেবে না—তাই রিভলবারের গুলি নিজের দিকে তাক করে করেছিল আত্মহত্যা। প্রফুল্ল চাকির আত্মহত্যার দিনটি ছিল ২ মে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ, আর ক্ষুদিরাম বসুকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল একই বছরের ১১ আগস্ট। এ দুই বিপ্লবীরই মৃত্যু হয়ে হয়েছিল একটি বিশেষ ঘটনা বা অপারেশনকে কেন্দ্র করে।

এ লেখাটি ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকি আর তাঁদের সেই অপারেশনটিকে কেন্দ্র করে। কয়েকটি উপ-শিরোনামের মধ্যদিয়ে আমরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সেইসব দিনের গৌরবান্বিত ইতিহাসে কিছুক্ষণের জন্য বিচরণ করে আসতে পারি।

ক্ষুদিরামের জন্ম এবং বাল্যকাল

ক্ষুদিরামের জন্ম ১৮৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসের এক বিকেলে, মেদেনীপুরের হবিবপুরে। বাবা ত্রৈলক্ষণাথ বসু জমিদারদের কাছারিতে কাজ করত। মায়ের নাম লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী।

পরপর দুই পুত্রসন্তানকে অল্প বয়সে হারিয়ে ত্রৈলক্ষণাথ বসু ও লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর সংসার-জীবনে একটি গভীর কষ্টের জায়গা তৈরি হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, ক্ষুদিরামের যখন জন্ম হলো তখন তাকে নিয়ে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। যদি না এই সন্তানটিও আবার মারা যায়! এমন অবস্থায়, তৎকালীন একটি সংস্কার, যা শিশুর প্রাণরক্ষার ক্ষেত্রে প্রচলিত ছিল, সেটিই প্রয়োগ করতে হলো ক্ষুদিরামের ওপর। উপাচার অনুযায়ী অল্প কিছু খুদ বা কড়ির বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল ক্ষুদিরামকে। অবশ্য কিনে নিয়েছিল তাঁরই সদ্যবিবাহিত বড়বোন। যেহেতু খুদের বিনিময়ে প্রাণরক্ষা হয়েছিল তাই তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসু।

দুঃখজনক বিষয় এই যে, ক্ষুদিরামের আর মা-বাবার কাছে ফেরা হয়নি, বা তাদের সান্নিধ্য পাওয়াও সম্ভব হয়নি। ক্ষুদিরামের সাত বছর বয়সে, ছয় মাসের অল্প ব্যবধানে তাঁর বাবা-মা মারা গিয়েছিলেন। বড় বোনের সংসারেই বেড়ে উঠেছিলেন ক্ষুদিরাম।

শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল হাটগাছিয়ার গিরিশ মুখার্জী পাঠশালায়। বোনের স্বামী চাকরিসূত্রে হাটগাছিয়ায় থাকতেন। পরবর্তী সময়ে চাকরি বদলি হলে তারা তমলুকে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে ক্ষুদিরাম বসুকে হ্যামিল্টন স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তাঁর বয়স যখন বারো, তখন তমলুকে দেখা দিয়েছিল কলেরা। ক্ষুদিরাম সেই কলেরা-রোধে নেমে পড়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। স্বভাবচরিত্রে ছিল ডানপিটে ধরনের, আর এই ডানপিটে স্বভাব বদলাতে না-বদলাতেই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে পড়তে হয়েছিল তাঁকে।

ক্ষুদিরামের বিপ্লবীজীবনের সূত্রপাত

১৯০৪ সালে বয়স যখন চৌদ্দ, ক্ষুদিরামের চিন্তা-চেতনায় বিপুল পরিবর্তন আসে। এসময় পুনরায় বোনের স্বামীর বদলির কারণে তাঁদের মেদেনীপুর চলে আসতে হয়। ক্ষুদিরামকে ভর্তি করে দেওয়া হয় মেদেনীপুর কলিজিয়েট স্কুলের অষ্টম শ্রেণীতে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ঋষি রাজনারায়ণ বসু—তিনিই ক্ষুদিরামসহ আরো অনেক স্কুলছাত্রের মনে স্বাধীনতার চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

একই স্কুলের ইতিহাস শিক্ষক—জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, ক্ষুদিরামকে দেখেই টের পান এই ছেলের মধ্যে স্বদেশচেতনা অত্যন্ত গভীরভাবে প্রোথিত আছে। এবার শুধু ছেলেটিকে জাগিয়ে তোলাই কাজ। কাজটি জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু নিজ দায়িত্বে করলেন। ক্ষুদিরামকে তিনি নিজের একজন কাছের ছাত্র করে তুললেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল মেদেনীপুর। জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্যে আসার অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষুদিরাম একটি বিপ্লবী দলে যোগদান করে। এরই মধ্যদিয়ে কিছু রণকৌশলও রপ্ত হয়ে যায় তাঁর। এখানেই লাঠি খেলা, তলোয়ার চালানো, বন্দুক অথবা রিভলবারের ব্যবহার শিখে নেয় ক্ষুদিরাম। যুদ্ধাহত ব্যক্তির প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাপারেও এখান থেকেই ধারণা নেওয়া। বন্যাকবলিত মানুষের আশ্রয়স্থল তৈরিতে এসময় দলের সঙ্গে থেকে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করে ক্ষুদিরাম।

প্রথম জেলে যাওয়া

মেদেনীপুরের বিপ্লবীদের দলপতি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁর সঙ্গে ক্ষুদিরাম বসুর প্রথম জেলে যাবার ঘটনায় একটি প্রাসঙ্গিকতা আছে। ১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, ক্ষুদিরামের বয়স তখন ১৬ বছর।

মেদেনীপুরের পুরনো জেলে একটি কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যেমন, এসেছিল অনেক সাধারণ মানুষও। হঠাৎ সেই প্রদর্শনীতে দেখা গেল এক কিশোর লিফলেট বিলি করছে। কর্তাব্যক্তিদের নজরে এলে দেখা গেল লিফলেটটি মূলত ‘সোনার বাংলা’ নামক একটি পুস্তিকা যা ব্রিটিশবিরোধী প্রচারপত্রগুলোরই একটি। তাৎক্ষণিক ক্ষুদিরামকে গ্রেফতার করে তার নামে রাজদ্রোহের মামলা দিয়ে দেওয়া হয়। কাঠগড়ায় উঠিয়ে তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কে তোমাকে এই পুস্তিকা বিলি করবার দায়িত্ব দিয়েছে?’ উত্তরে ক্ষুদিরাম বসু যেন কিছুই জানে না, এরকম ভাব করে। বলে, ‘তার নাম বলতে পারি না।’ তারপর তাকে আদালতের পুরো কক্ষ ইঙ্গিত করে বলা হলো, ‘দেখো তো এই কক্ষে সেই ব্যক্তিটি আছে কিনা?’ সত্যেন্দ্রনাথ বসু কক্ষেই ছিলেন, মানে তিনিই তাকে পুস্তিকা বিলির কাজটা দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষুদিরাম বসু কম বয়সসুলভ অভিব্যক্তি দিয়েই সত্যেন্দ্রনাথকে সারা আদালত ঘরের কোথাও খুঁজে পেল না। বলল, ‘নাহ, এই ঘরে তো সেই লোককে দেখতে পাচ্ছি না।’ আদালত ভাবল, ছেলেটি হয়তো আসলেও এতটা ভুলমনা, বা বিশেষ ‘ঘাওড়া’ প্রকৃতির, সুতরাং তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো।

তবে হ্যাঁ, এ ঘটনার মধ্যদিয়ে ক্ষুদিরাম কিছুটা হলেও সন্দেহজনক চরিত্র হয়ে উঠল। চিন্তিত হয়ে পড়লেন ক্ষুদিরামের বোনের স্বামী, কেননা পুলিশ যে কোনো সময়ই ঘরে হানা দিতে পারে। যদিও ঘটনার পরপর ক্ষুদিরামকে অন্য এক আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু তবুও ক্ষুদিরামকে কেন্দ্র করে নিজের চাকরিটি হঠাৎ হাতছাড়া হবার আশঙ্কা কাটল না। এমন পরিস্থিতিতে যদিও বোনের স্বামী ক্ষুদিরামকে সরাসরি কিছু বললেন না, কিন্তু কিশোর ক্ষুদিরাম নিজেই যা বোঝার বুঝে নিল আর একদিন না বলে-কয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

এরপর ক্ষুদিরাম বসু যার কাছে আশ্রয় পেল ইতিহাসে তার পরিচয় হিসেবে উল্লেখ আছে, তিনি আবদুল ওয়াহেদ সাহেবের স্ত্রী। এ মহিলা ছোটভাইয়ের মতো স্নেহ ভালোবাসায় ক্ষুদিরামকে গ্রহণ করেছিলেন।

যাই হোক, একটি আঠার বছরের জীবনে আর কতই বা ঘটনা থাকবে! তাই ছোট ছোট এসব বাঁকবদল বাদে ফাঁসির ঘটনাই মূলত ক্ষুদিরাম বসুর জীবনকে অধিকার করে রেখেছে। কেন ও কী কারণে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হলো, বরং সেই আলাপেই প্রবেশ করা যাক।

প্রফুল্ল চাকি, ক্ষুদিরামের সহযোদ্ধা

এই পর্বে ক্ষুদিরামের সহযোদ্ধা প্রফুল্ল চাকিকেও পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আমরা আগেও উল্লেখ করেছিলাম প্রফুল্ল চাকির কথা, পুলিশের কাছে ধরা না পড়ে যে আত্মহত্যাকেই বেছে নিয়েছিল।

অপারেশনকে কেন্দ্র করেই প্রফুল্ল চাকির সঙ্গে ক্ষুদিরামের প্রথম সাক্ষাত হয়। মানিকতলা আখড়ার এই সাক্ষাতের দিনই অপারেশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ক্ষুদিরামকে। আর ক্ষুদিরামের সহযোগী হিসেবে উত্তরবঙ্গ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল প্রফুল্ল চাকিকে। অপারেশনটির স্বার্থে দুজনকেই দেওয়া হয়েছিল ছদ্মনাম—ক্ষুদিরামের নাম হয়েছিল দুর্গাদাস সেন, আর প্রফুল্ল চাকির নাম দীনেশচন্দ্র রায়।

তাহলে কী ছিল সেই অপারেশন?

তাহলে কী ছিল সেই অপারেশন? আঠার বছর বয়সী ক্ষুদিরামকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, এবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করেছিল, ঠিক সেই সময় ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ‘বন্দে মাতরম’ বলা নিষিদ্ধ করে দেয়। আর যখন ‘বন্দে মাতরম’ নিষিদ্ধ হলো, সেসময় কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ছিল মি. কিংসফোর্ড। এমনকি অন্য অনেক ব্রিটিশদের চেয়েও কিংসফোর্ড ছিল একটু বেশি মাত্রারই বেপরোয়া। ‘বন্দে মাতরম’ আইনকে কেন্দ্র করে তখন তার জেলখানায় তিল ধারণেরও ঠাঁই ছিল না।

ইংরেজ-শাসনের নির্যাতন তো ছিলই, সঙ্গে কিংসফোর্ডের বাড়তি নিষ্ঠুরতা যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছিল এক অতিশয় নির্দয় পরিস্থিতির। ফলশ্রুতিতে মেদেনীপুরের বিপ্লবীদের বৈঠকে একদিন সিদ্ধান্ত হলো, মি. কিংসফোর্ডকে শাস্তি দিতে হবে। আর সেই উপযুক্ত শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এই মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়নে এমন কাউকেই খুঁজে পেতে হবে যে একই সঙ্গে বুদ্ধিদ্বীপ্ত এবং তেজি। সম্ভবত ১৯০৮ সালের মেদেনীপুরে অবস্থানকারী সব বিপ্লবী নেতাদেরই ক্ষুদিরামকে কাজটির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে হয়েছিল।

ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীও টের পেয়েছিল, যে কোনো সময় কিংসফোর্ডের ওপর হামলা হতে পারে। তাই এরইমধ্যে কিংসফোর্ডকে বদলি করে মুজফফরপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকি প্রথমে কলকাতা গিয়ে, তারপর সেখান থেকে মুজফফরপুরে রওনা হবে—এমনই প্ল্যান আগে থেকে ঠিক করা ছিল। সে অনুযায়ী তারা দুজন প্রথমে কলকাতায় এসে বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগোর বাসায় অবস্থান নেয়। সেখান থেকে গুলিভর্তি রিভলভার আর টিনের বাক্সে একটি বোমা নিয়ে মুজফফরপুরে চলে গেল। পরিকল্পনামতোই তারা প্রথমে একটি ধর্মশালায় আশ্রয় নেয়।

মি. কিংসফোর্ড ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল, যে কোনো সময় তার ওপর হামলা হতে পারে। সবসময় তাই সাথে বন্দুকধারী নিয়ে চলাফেরা করত। কোর্টে কাজের সময় বাদে প্রায় পুরাটা সময় থাকত বাসায়। মাঝেমধ্যে সন্ধ্যার পরে ক্লাবে গিয়ে তাশ খেলে আসা। বলা চলে বন্দুকধারী-বেষ্টিত দিনাতিপাত করছিল কিংসফোর্ড।

দুই কিশোরের জন্য ব্যাপারটা কঠিনই হয়ে পড়ছিল। একটানা ১৯/২০ দিন সুযোগ-সন্ধানের পরও কোনোভাবেই কিছু ঘটাতে না পেরে ভেতরে ভেতরে কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে তারা। এই অস্থিরতা থেকেই ২৯ তারিখ তারা সিদ্ধান্ত নেয়, পরের দিন অপারেশন বাস্তবায়ন করবেই, যা হবার হবে। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাস।

পরদিন, ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকেই কিংসফোর্ডের বাড়ির আশেপাশে গিয়ে তারা দুজন অবস্থান নেয়। প্রথমে একজন প্রহরী ব্যাপারটি লক্ষ করে তাদের চলে যেতে বলে। তারা সে নির্দেশ অগ্রাহ্য করে আরেকটু গোপনীয়তা যোগ করে একটি গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। কিংসফোর্ড কখন বাসা থেকে বের হয়, সেটাই তাদের দেখার বিষয়। কিংসফোর্ডকে একবার হত্যা করতে পারা গেলে তাদের ভোগ্যে যা হয় হবে।

তবে সবশেষ ক্ষুদিরাম তার হাতের মুঠোয় থাকা বোমাটি ছুড়ে মারলেও সেই বোমায় কিংসফোর্ড নয়, মারা গিয়েছিল দুজন নির্দোষ ব্রিটিশ নাগরিক। এ দুজন ছিল ব্যারিস্টার কেনেডি নামক এক ব্যক্তির স্ত্রী এবং কন্যা।

রাত সাড়ে আটটার দিকে ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল কিংসফোর্ডের বাসা থেকে একটি গাড়ি বেরিয়ে আসতে দেখেছিল। মূলত, এই দেখার বিষয়টিতেই তাদের আরো পরিপক্বতার, মনোনিবেশের ও অপেক্ষার প্রয়োজন ছিল। তারা গাড়ির মধ্যে কে আছে সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই গাড়ি উদ্দেশ্য করে বোমা ছুড়ে মারে।

যদিও কে মারা গেল, কিংবা কিংসফোর্ড যে মারা যায়নি এসব ব্যাপারে জানবার কোনো সুযোগ তাদের রইল না। তারা বোম্বিং করবার সাথে সাথেই সেখান থেকে প্রস্থান করে।

ঘটনার পরে কেউ কেউ বলল এখানে তারা দুজন কিশোরকে দেখেছে। কে কীরকম দেখতে ছিল, সেসবও বলাবলি হলো। ফলত সব জায়গায় ঘোষণা করে দেওয়া হলো, এরকম কাউকে দেখলেই তাকে যেন পুলিশে সোপর্দ করা হয়। ঘোষণার ফলস্বরূপ সর্বত্র নিরাপত্তা জোরদার করে ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্লকে ধরতে সচেষ্ট হলো পুলিশ এবং পরদিন সকালেই ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে গেল।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/29/1567077539571.jpg
◤ ক্ষুদিরাম, ধরা পড়ার পরে ◢


প্রফুল্ল চাকির আত্মহত্যা

প্রফুল্ল জামাকাপড় পাল্টে সমস্তিপুর এলাকার দিকে যাচ্ছিল। এসময় একজন তাকে ডেকে জানতে চাইল, ‘কোথায় যাও?’ প্রফুল্ল জানালে রেলস্টেশনে যাচ্ছে, লোকটি বলল, এখন তো কোনো ট্রেন নেই। লোকটি প্রফুল্লকে তার বাসায় বিশ্রাম নেওয়ার আমন্ত্রণ জানায় আর যখন ট্রেন আসবে তখনই স্টেশনের দিকে যেতে বলে। প্রফুল্লও এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।

যে ব্যক্তি প্রফুল্লকে এ সহযোগিতা করেছিল, তার পরিচয় জানা যায়নি। হয়তো তিনি প্রফুল্লের আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরেই দয়াপরবশ হয়েছিলেন। এমনকি হয়ে থাকবে, তিনি বুঝতেও পেরেছিলেন এই ছেলে সেই দুজনেরই একজন, যারা গতকাল কেনেডির স্ত্রী আর কন্যাকে হত্যা করেছে। যখন এই ব্যক্তির আশ্রয়স্থল রেখে প্রফুল্লকে ট্রেনে উঠে পড়তে হলো, তখন থেকেই ঘটতে শুরু করে বিপত্তি।

প্রফুল্ল চাকি যেই কামরায় ওঠে, একই কামরায় সাদা পোশাকে একজন পুলিশসদস্য উঠেছিল। নাম নন্দলাল ব্যানার্জী। সাদা পোশাকে তাকে দেখেও বোঝার উপায় ছিল না সে একজন পুলিশ। কিন্তু প্রফুল্লকে দেখেই তার সন্দেহ হলে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করার মধ্যদিয়ে তাঁকে নিজের নজরদারিতে আটকে রাখে ওই পুলিশসদস্য।

ট্রেন যখন স্টেশনে পৌঁছায় তখন ভোর। আশেপাশে কোনো কুলি ছিল না। প্রফুল্লই নন্দলালের ব্যাগপত্র মাথায় নিয়ে কুলির কাজটি করছিল। মাথা থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখতেই প্রফুল্ল টের পেল নন্দলাল ব্যানার্জী সেখানে নেই। এদিক ওদিক তাকাতে একটু পরে দেখা গেল, তিনি পাঁচজন পুলিশসদস্যকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। আর প্রফুল্ল চাকিকে জানানো হচ্ছে—‘আপনাকে আমরা গ্রেফতার করলাম।’

পকেটে থাকা রিভলভারটি বের করে সঙ্গে সঙ্গেই প্রফুল্ল নন্দলালকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। উত্তেজনায় গুলিটি লক্ষভ্রষ্ট হয়। পরক্ষণেই, যখন ধরা পড়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই, রিভলবার গলায় ঠেকিয়ে নিজেকেই গুলি করে দিলেন প্রফুল্ল চাকি।

ক্ষুদিরামকে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর ফাঁসির নির্দেশ

ফাঁসির মঞ্চ এবং তার আগে আদালতের জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও ক্ষুদিরাম বসু নিতান্ত স্বাভাবিক আচরণ করছিল। এ দেখে তখন কারোরই আশ্চর্যের কোনো সীমা ছিল না। যেহেতু ক্ষুদিরাম জানত না তাঁর সহযোগী প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেছে, কাজেই প্রফুল্লকে বাঁচাবার জন্য শেষপর্যন্ত পুরো অপারেশনটির দায়ভারও নিজের কাঁধেই রাখছিল। এর বাইরে কোনো সংগঠন বা ব্যক্তির নাম বলা দূরে থাক।

মামলাটি শুরু হয়েছিল মে মাসের ২১ তারিখ। ক্ষুদিরামকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল জুন মাসের ১৩ তারিখ। ফাঁসির রায় শুনেও ক্ষুদিরাম যথাস্বাভাবিক আচরণেই বহাল থেকেছিল। আদালত কর্তৃক তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘তুমি কি বুঝতে পেরেছো তোমাকে কী শাস্তি দেওয়া হয়েছে?’ ক্ষুদিরাম বসু বলল ‘হ্যাঁ আমি বুঝতে পেরেছি, এবং আমি আবার আসব।’

১৯০৮ সালের আগস্ট মাসের ১১ তারিখ ভোর ছয়টায় ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।

   

হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেলেন ৫৪ বছর পর!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

৫৪ বছর পর হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি খুঁজে পেয়েছেন ম্যারিলিন বার্চ (৭৬)। তিনি যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের পন্টারডাউইর বাসিন্দা।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

ম্যারিলিন বার্চ স্কাই নিউজকে বলেন, এতো বছর পর আংটিটি খুঁজে পাওয়া সত্যিই অবাক করা বিষয়। ১৯৭০ সালে পারিবারিক খামারে গরুকে খড় খাওয়ানোর সময় আংটিটি হারিয়ে গিয়েছিল। পরে অনেক খোঁজার পরও না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবে নিয়েছিলাম এটা আর কখনো পাবো না।

তবে শনাক্তবিদ কিথ ফিলিপসের মনে ছিল অন্য কিছু। তিনি খামারের লোকজনকে বিভিন্ন সময় সেখানকার ভূমি খননের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তাঁর হিসাবে, সেখানে মাটির নিচে অনেক মূল্যবান জিনিস থাকতে পারে।

সেখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন মুদ্রা এবং বিটের টুকরা আমাদের দেখাতেন। কিন্তু আংটিটির খোঁজ মেলেনি। 

ম্যারিলিন বলেন, ‘এক সন্ধ্যায় ফিলিপস যখন খামার ত্যাগ করছিলেন, আমি তাঁকে ঠাট্টাচ্ছলে বলি, ফিলিপস শোনো, যেসব আবর্জনা তুমি উদ্ধার করেছ এসব ফেলো। যাও, আমার বিয়ের আংটিটি খুঁজে বের করতে পার কি না, দেখো।’

এ কথা শোনার পর তারা দুজনেই তখন হেসেছিল। তবে এক সপ্তাহ বা তারও কিছু সময় পরে ফিলিপস ম্যারিলিনের আংটিটি নিয়ে হাজির হন।

ম্যারিলিন বলেন, আংটিটিকে খামারের মাঠে মাটির প্রায় ৮ ইঞ্চি নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে সেটিকে তিনি ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করেছেন এবং তখন থেকেই তিনি এটিকে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছেন।

মিসেস বার্চের স্বামী পিটার বার্চ গত জানুয়ারিতে ৮০ বছরে পা দিয়েছেন। সে উপলক্ষে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। কিন্তু এমন ঘটনার পর সব আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। এখন সবকিছু এই আংটিটি ঘিরেই হচ্ছে।

;

সাংবাদিকের ফেসবুকে পোস্ট: মিললো আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর, ইজিবাইক



রাকিবুল ইসলাম রাকিব, বার্তা২৪.কম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) করেসপন্ডেন্ট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

৭৭ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের স্ট্রোক হয়েছে একাধিকবার। এই বয়সে যখন তার বিছানায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম করার কথা, তখন তাকে একটি রিকশার প্যাডেল মেরে অবিরাম ছুটে চলতে হয় ঢাকার রাস্তা-ঘাটে।

দিন শেষে যা আয় হয়, তার একটা অংশ নিজের জন্য রেখে, বাকিটা পাঠাতেন গ্রামে থাকা বৃদ্ধ স্ত্রীর কাছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এভাবেই চলছিল তার দিনকাল।

হাবিবুরের ইচ্ছে ছিল, শেষ বয়সের সময়টা তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কাটাবেন। কিন্ত সেখানে থাকার মতো ঘর ও জীবিকার নিশ্চয়তা না থাকায় বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতে হতো তাকে।

হাবিবুরের দুরবস্থার খবর জানার পর সে বিষয়ে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক জ. ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন।

সে পোস্টটি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তার উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর উপহারের সুখবর পান হাবিবুর। পাশাপাশি হাবিবুরের কর্মসংস্থানের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী তাকে একটি ইজিবাইক উপহার দেন।

এতে করে গ্রামের ফেরার ইচ্ছা ও গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলেছে এই অসহায় বৃদ্ধের।

হাবিবুর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সহনাটি ইউনিয়নে সোনাকান্দি গ্রামে।

বৃহস্পতিবার (২ মে) বিকেলে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে জেলা প্রশাসকের দেওয়া উপহারের ইজিবাইকের চাবি হাবিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। পাশাপাশি সোনাকান্দি গ্রামে এই বৃদ্ধের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার তাগিদে ১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন হাবিবুর রহমান। সংসারে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের সবাই গরিব ঘরে বিয়ে হওয়ায় বাবাকে দেখার সামর্থ্য নেই তাদের। স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে মাত্র আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই হাবিবুর রহমানের। সে কারণে বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় রাত্রিযাপন করতেন রাস্তায় রাস্তায়।

এদিকে, রিকশাচালক হাবিবুর রহমানের দুরবস্থা নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল সাংবাদিক জ.ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। পোস্টটি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের। এরপরই নির্দেশনা আসে হাবিবুরকে তার এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার।

ওপর থেকে নির্দেশনা আসার পর গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ সোনাকান্দি গ্রামে গিয়ে হাবিবুর রহমানের বাড়ি পরিদর্শনে করে দেখেন, তার মাত্র আধা শতাংশ জমি রয়েছে। এটুকু জমিতে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিপত্তি বাধে। এ সময় হাবিবুর রহমানের জমির পাশেই দুই শতাংশ জমি দানের ঘোষণা দেন সহনাটি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. দুলাল আহমেদ। ইতোমধ্যে, জমির দলিল সম্পাদন হয়ে গেছে। শিগগিরই ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

হাবিবুর রহমান বলেন, সারাজীবন কষ্ট করেছি। আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া নিজের আর কিছুই ছিল না আমার। সাংবাদিক মামুন ভাইয়ের লেখালেখির কল্যাণে এখন বাড়ি ও একটি ইজিবাইক হয়েছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আমার দিন ‘রাজার হালে’ কাটবে। আমি অনেক আনন্দিত ও খুশি। সেইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাসহ যারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ বলেন, বৃদ্ধ বয়সে হাবিবুর রহমানের রিকশা চালানো নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জ.ই. মামুনের একটি পোস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হয়। তার প্রেক্ষাপটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাবিবুরকে নিজ গ্রামে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি ইজিবাইক উপহার দিয়েছেন। এছাড়াও হাবিবুর ও তার স্ত্রীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ারও উদ্যোগ নে্ওয়া হয়েছে।

 

;

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: রসে সেরা, স্বাদে সেরা!



আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

চমচমের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে! তারপরে যদি হয় সেই টাঙ্গাইলের চমচম! তাহলে তো কথাই নেই! ছোট-বড় সব বয়েসি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে- টাঙ্গাইলের চমচম।

কথায় আছে, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো সবারই জানা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই।

বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্টি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম, স্বাদে সেরা, মানে সেরা, ছবি-বার্তা২৪.কম

এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে, চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুয়ায়ী, চলতি বছরের (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত শত শত কারিগর কাজ করছেন। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্বাল হচ্ছে চমচমের। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় কারিগররাও খুশি।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে, মান ভেদে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

মিষ্টি কিনতে আসা সাগর বার্তা২৪.কমকে বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য ও আমাদের গর্বের। টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারে আসলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। ছোট বড় সবাই টাঙ্গাইলের মিষ্টি পছন্দ করেন।

মিষ্টি কিনতে আসা আরেকজন হরিপদ সরকার বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমি যেমন টাঙ্গাইলের মিষ্টির জন্য এসেছি, আমার মতো অনেকেই টাঙ্গাইলের মিষ্টি নিতে এসেছেন। এই মিষ্টির স্বাদ অন্যরকম! না-খেলে বোঝা যাবে না।

মিষ্টি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ কর্মকার বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম। প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলে পোড়াবাড়ির মিষ্টি তৈরি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে। আমাদের পোড়াবাড়ির চমচমে ভেজাল কোনো কিছু যুক্ত করা হয় না। চমচম স্বাদ হওয়ার কারণ খাঁটি দুধ, ছানা ও ময়দা দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করা হয়। এজন্য এত স্বাদ! প্রতিদিন দোকানগুলিতে ৫ থেকে ১০ মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা, ছবি- বার্তা২৪.কম 

মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ বলেন, আমি ৪০-৪৫ বছর ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। মিষ্টির স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মিষ্টি দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো। আমাদের মিষ্টি চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।

সরকারের কাছে দাবি, বিদেশে এই মিষ্টি রফতানি করার ব্যবস্থা করলে আমাদের বিক্রি আরোও বাড়বে। তখন আমরা আরো বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারবো।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, সারাদেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অনেক খুশি। এই মিষ্টি যদি বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরো প্রসার পাবে।

তিনি বলেন, আমার বাবা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই মিষ্টির ব্যবসায় আসা। আমি করছি। আমার ছেলেও এই পেশায় আছে। পোড়াবাড়ির চমচমের ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। টাঙ্গাইলের চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে, গাভির দুধ চরাঞ্চল থেকে আসে। এখানকার দুধ অনেক ভালো হয় আর জলেরও একটা বিষয় আছে! দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয় অন্যরকম। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

;

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;