মেরি অলিভারের কবিতা

  • ভাষান্তর : কল্যাণী রমা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মেরি অলিভার

মেরি অলিভার

মেরি অলিভার এ সময়ের প্রধান আমেরিকান কবি। হেনরী ডেভিড থরো আর ওয়াল্ট হুইটম্যানের প্রভাব দেখা যায় তাঁর কবিতায়। এমিলি ডিকিনসনের সাথেও তুলনা করা হয় মেরি অলিভারকে। এ পর্যন্ত খুব কম সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। একান্তে থাকতে ভালোবাসেন কবি। মেরি অলিভারের মতে কবিতাই তাঁর কথা বলবে। জন্ম ১৯৩৫ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর, ওহাইও-র এক ছোট শহরে।

কালরাতে বৃষ্টি আমার সাথে কথা বলেছিল

কাল রাতে
বৃষ্টি
আমার সাথে কথা বলেছিল
ধীরে ধীরে, বলছিল,

বিজ্ঞাপন

চঞ্চল মেঘের বুক থেকে
ঝরে পড়তে
কী আনন্দ,
নতুন একভাবে আবার

পৃথিবীতে
সুখী হওয়া!
ঝরে পড়তে পড়তে
এ কথাই সে বলেছিল,

বিজ্ঞাপন

লোহার গন্ধ মাখা শরীরে,
সমুদ্রের স্বপ্নের মতো
উধাও হয়ে গিয়েছিল
ডালপালার ভিতর,

নিচের ঘাসের ভিতর।
তারপর বৃষ্টি শেষ হয়ে গেল।
আকাশ পরিষ্কার।
একটা গাছের নিচে

দাঁড়িয়েছিলাম।
গাছটা এমনই ছিল
যার পাতাগুলো সুখী সুখী,
নিজের মনে ছিলাম আমি,

আকাশে তারা ছিল
সে মুহূর্তে
ওরাও ওদের মতো ছিল
যে মুহূর্তে

আমার ডান হাত
আমার বাঁ হাত ধরে ছিল
যা কিনা গাছটা ছুঁয়ে ছিল
আর গাছটা ভরা ছিল তারায় তারায়

আর নরম বৃষ্টিতে—
ভেবে দেখো! দেখো!
ওইসব দীর্ঘ আর বিস্ময়কর ভ্রমণকাহিনীগুলোর
এখনো বাকি আছে আমাদের নিজস্ব হওয়ার।

[“Last Night the Rain Spoke to Me” কবিতার বাংলা ভাষান্তর।]

১৯৫০ সালের মাঝামাঝি অলিভার অল্প সময়ের জন্য ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি ও ভাসসার কলেজে পড়াশোনা করেন। কিন্তু ডিগ্রি শেষ করেন নি। কবিতার জন্য অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৭০ সালে পেয়েছেন শেলী মেমরিয়্যাল এওয়ার্ড। ১৯৮০ সালে গুগেনহাইম ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ, ১৯৮৪ সালে ‘আমেরিকান প্রিমিটিভ’-এর জন্য পুলিত্‌জার পুরস্কার।

রাজহাঁস

তুমি কি দেখেছো? সারারাত কালো নদীটায় তার স্রোতে ভেসে যাওয়া?
দেখেছো ভোরবেলা? রুপালি বাতাসে তার জেগে ওঠা?
বাহুতে যতটুকু ধরে তা ভর্তি সাদা ফুল,
তার পাখার বাঁধনে ঝুঁকে পড়তেই মহা তুলকালাম রেশম আর লিনেনের মাঝে;
বরফের বাঁধ, তীর ঘিরে লিলিফুল,
কালো ঠোঁট দিয়ে বাতাস কামড়ে ধরে?
তুমি কি শুনেছিলে? বাঁশি আর শিসের মতো শব্দ?
কালো অন্ধকারের তীক্ষ্ণ গান—গাছের গায়ে প্রবল বৃষ্টির মতো সে সুর—
অন্ধকার কিনারায় ঝরনার মতো তার ধারালো নেমে যাওয়া?
আর তুমি কি দেখেছো? অবশেষে? মেঘের অল্প নিচে—
একটা সাদা ক্রস আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, তার পা
কালো পাতার মতো, তার পাখা নদীর ছড়িয়ে পড়া আলোর মতো?
এবং তুমি কি তা অনুভব করেছো? তোমার হৃদয়ের ভিতর, কিভাবে যে তা সবকিছুর অংশ?
এবং শেষপর্যন্ত তুমিও কি খুঁজে পেয়েছো? বুঝেছো সৌন্দর্য কিসের জন্য?
এবং তুমি কি বদলে ফেলেছ জীবনটা তোমার?

[“The Swan” কবিতার বাংলা ভাষান্তর।]

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/16/1537044989860.jpg

১৯৯২ সালে ‘নিউ এন্ড সিলেক্টেড পোয়েম’-এর জন্য ‘ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড ফর পোয়েট্রি’, ১৯৯৮ সালে ‘ল্যাননান লিটারেরি এওয়ার্ড’-সহ পেয়েছেন আরো নানা পুরস্কার আর সম্মান।

সাদা ফুলগুলো

কাল রাতে অন্ধকারে
মাঠে শুয়েছিলাম
মৃত্যুর কথা ভাববার জন্য,
কিন্তু তার বদলে ঘুমিয়ে পড়লাম,
যেন এক বিশাল আর ঢালু ঘরের ভিতর
ঘরটা ভর্তি সেইসব সাদা ফুলে
সারা গ্রীষ্মকাল ধরে যারা ফুটে থাকে,
আঠালো, এলোমেলো,
উষ্ণ মাঠের মাঝে।
যখন আমি উঠলাম
তারাদের সামনে
ভোরের আলো
মাত্র গলে গলে
পড়তে শুরু করেছে,
আর আমি ঢেকে ছিলাম ফুলে।
কী জানি কিভাবে এমনটা হয়েছিল—
জানি না আমার শরীরটা
মধু-মাখা লতাগুলোর
নিচে ডুব দিয়েছিল কিনা
ঘুমে তীক্ষ্ণ হয়ে যাওয়া
কোনো এক আসক্তিতে
গভীরতার মাঝে, কিংবা
ওই সবুজ প্রকৃতি বুঝি
ঢেউয়ের মতো উঠে এসেছিল
আমাকে মুড়ে দিতে,
আমাকে নিয়ে নিয়েছিল
তার বলিষ্ঠ বাহুর ভিতর।
আমি তাদের ঠেলে সরিয়ে দিলাম,
কিন্তু উঠে দাঁড়ালাম না।
জীবনে কখনো এমন মখমলের পরশ পাই নি
কিংবা এমন মসৃণতা্র
অথবা এমন চমত্‌কার শূন্যতার
জীবনে কখনো ওই সরন্ধ্র রেখার
এত কাছাকাছি যেতে পারি নি
যেখানে আমার নিজ শরীর শেষ হয়েছিল
আর শুরু হয়েছিল শিকড় কাণ্ড আর ফুল।

[“White Flowers” কবিতার বাংলা ভাষান্তর। কবিতাটি “New Poems” বই থেকে নেওয়া। ]

১৯৯৮ সালে ‘আর্ট ইন্সটিটিউট অফ্‌ বোস্টন’, ২০০৭ সালে ‘ডার্টমুথ কলেজ’, ২০০৮ সালে ‘টাফটস্‌ ইউনিভার্সিটি’, ২০১২ সালে ‘মার্কেট ইউনিভার্সিটি’ থেকে ‘অনাররি ডক্টরেট’ দেওয়া হয় তাঁকে।

ম্যাজেলান

ম্যাজেলানের মতো, চলো মরে যাওয়ার জন্য নিজ নিজ দ্বীপ খুঁজে নেই,
বাড়ি থেকে বহুদূরে, চেনাশোনা যে কোনো জায়গা থেকেই দূরে।
কোনো বুনো, আদিম জায়গার ঝুঁকিই না হয় নিয়ে ফেলি
পাছে আরাম আর হতাশায় আমাদের সে পথ না ঢেকে যায়।

বছরের পর বছর সাধারণ এলেবেলে পথের মাঝে আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছি,
আর রাতে পাল তুলে বেড়িয়ে পড়ে এমন জাহাজের স্বপ্ন দেখে গেছি।
চল বীরের মতো এগিয়ে যাই, কিংবা আমাদের ভিতরে বীরভাব যদি নাও থাকে,
চলো খুঁজে ফেলি তাদের যারা আমাদের পিছনে পিছনে হেঁটে আসবে, উজ্জ্বল গরিমায়।

প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফেরা ছাড়া জীবনের আর কী মানে আছে? আর
বিকশিত হওয়াকে অস্বীকার ক’রাই কি মৃত্যুর মানে নয়?
ম্যাজেলানের একটা স্বপ্ন ছিল যার পিছনে পিছনে সে চলেছিল।
সমুদ্র বিশাল, ওর জাহাজগুলো অপটু, ধীরে ধীরে চলে।

আর যখন জ্বরের জন্য সে গিয়ে দাঁড়াতে পারত না তাঁর রোগা পটকা নাবিকদের মাঝখানে, চিত্‌কার ক’রে বলে যেত, ‘পাল তুলে এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো!’
ওরাও এগিয়ে চলত, এভাবেই এক পলকা স্বপ্নকে ঘরের দিকে বয়ে নিয়ে।
আর এভাবেই ম্যাজেলান বেঁচে আছে, যদিও সে মারা গিয়েছিল।

[“Magellan” কবিতার বাংলা ভাষান্তর। কবিতাটি  “The River Styx, Ohio and Other Poems” বই থেকে নেওয়া।]

মেরি অলিভারের কবিতায় বারবারই মানুষ এবং প্রকৃতি একজন আর একজনের শরীর জড়িয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর সে মানুষ জীবন-মৃত্যু-অস্তিত্বের সব প্রশ্নের মাঝ দিয়ে নির্ভয়ে এক অপূর্ব শান্তির পথে হেঁটে গেছে।

বাড়ি থেকে একটা চিঠি

সে আমাকে ব্লু-জে পাখি, নীহারকণা,
তারা আর এখন টিলার উপরে উঠে যাওয়া
যে কোজাগরি পূর্ণিমার চাঁদ—তার খবর পাঠায়।
কথাচ্ছলে বলে ঠান্ডার কথা, বেদনার কথা,
যা কিছু এতদিনে হারিয়ে গেছে তার ফর্দ বানায় সে।
এখানে আমার জীবন কঠিন, ধীরে ধীরে চলে তা,
আমি পড়ে চলি দরজার পাশে
স্তূপীকৃত আরক্ত তরমুজের কথা,
ঝুড়ি ভর্তি ফেন্‌ল্‌, রোজমেরি, ডিল,
আর এদিকে যা কিছু সে তুলতে পারেনি
কিংবা যা পাতার ফাঁকে লুকিয়ে ছিল, তা কালো হয়ে ঝরে যায়।
এখানে আমার কঠিন আর অদ্ভুত জীবনে
আমি ওর পাগল করা আনন্দর কথা পড়ি
যখন তারা ফোটে, নীহারকণা ঝরে পড়ে, ব্লু-জে গান গায়।
বিক্ষিপ্ত সময় তার প্রাজ্ঞ আর ঘূর্ণি খাওয়া হৃদয়ে
কোনো ছাপই ফেলবে না;—
সে জানে কিভাবে মানুষ তাদের জীবন কাটানোর নানা পরিকল্পনা করে
আর তারপর তেমন জীবন সে কোনোদিন কাটায় না।
সে কাঁদে কিনা তা কখনো আমায় বলবে না।

আমি ওর নামের পাশের ক্রসগুলো ছুঁয়ে যাই।
উঠতে গিয়ে পৃষ্ঠাগুলো ভাঁজ করে রাখি।
খামটা একপাশে কাত করতেই বাতাসে ভেসে বেড়ায় টুকরো টুকরো
বর‍্যাজ, উডবাইন আর রু।

[“A letter from Home” কবিতার বাংলা ভাষান্তর। কবিতাটি “No Voyage and Other Poems” (১৯৬৩ এবং ১৯৬৫) বই থেকে নেওয়া।]