বিরতি থেকে বিচ্ছেদ অবধি

  • তানিয়া চক্রবর্তী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

ভলতেয়ার বলেছিলেন “FRIENDSHIP IS THE MARRIAGE OF THE SOUL, AND THIS MARRIAGE IS LIABLE TO DEATH”—প্রেম তো শর্তহীন হওয়া উচিত এবং তা থেকে উদ্ভূত সম্পর্কও। ২০১২ সালে ব্রিটিশ কলম্বিয়ান ইউনিভার্সিটির সার্ভে জানায় মানুষ মনোগ্যামাস সম্পর্কে থাকাকালীন অনেক বেশি সুস্থ। এর বহু আগে থেকেই মানুষ বিবাহে বিশ্বাসী হয়েছে কিন্তু সেই সম্পর্ক, বিবাহ—সত্যি কি টিকছে, নাকি এই ভেঙে পড়ার পেছনে আমাদের ছদ্মহাত রয়েছে। ভালোবাসা যখন সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদী গঠনের মধ্যে ঢুকে পড়ে তখন তা শর্তহীন থাকে না, কারণ আমাদের গোটা যাপন তো শর্তের বাইরের নয়। একটা গোটা জীবনের মৌলিক গঠন ধরে নেন দার্শনিকরা জৈবিক ভিত্তি—বন্ধন> নির্ভরতার প্রয়োগ> দর্শনের উত্তরণ> সূত্রমাফিক চলন। বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল বুলেটিন থেকে জানা যায় বিবাহিত পরিবারের ছেলেমেয়ের মানসিক অবস্থা এবং বিচ্ছেদগ্রস্ত দম্পতির ছেলেমেয়েদের মনের ফারাক বিশাল। যদিও আক্ষরিক অর্থে প্রথম বিবাহ-বিচ্ছেদ হয় ম্যাসাচুসেটস শহরে, কিন্তু তার আগে থেকেই এর প্রভাব আমেরিকায় আসতে শুরু করে। আঠারশো শতাব্দী থেকেই কোর্টের অনুমতি নিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ ব্রিটিশদের মধ্যে শুরু হয়েছিল। পরে অবশ্য ১৮৫৭ সাল থেকে এটা আইনমাফিক রূপ নিতে শুরু করে। আমেরিকায় ইদানীংকালে বিচ্ছেদের পরিমাণ কমলেও বিশ্বের বিচারে এখানে সাম্ভাব্য পঞ্চাশ শতাংশ হারে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়।

এই সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলার জায়গা এটা নয়। কারণ মানুষ যেখানে সুস্থ বোধ করে না সেখান থেকে বেরোনো তার অধিকার। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, অর্থ, সংস্পর্শজনিত অভাব, বিনা কারণে তর্ক, সমসাময়িকতার যুদ্ধ এইসমস্ত বৈধ কারণের বাইরেও আমাদের সহিষ্ণুতার কারণ বেঁচে থাকে সম্পর্কে। যাতে আমরা বুঝতে পারি একটা অযথা অসামাজিকতার সূত্র আমরা নই তো। এমন মানুষ দেখেছি সুস্থ, সবল তথাপি মনের অন্তরে বাবা-মায়ের সংস্পর্শ না থাকার কারণে অদ্ভুত অসামাজিক মনোভাব তৈরি হয়ে আছে এবং সেখান থেকেই ভয়ঙ্কর অসামাজিকতাও তৈরি হয়। ব্যক্তি ততক্ষণ ব্যক্তিগত যতক্ষণ তার অসুবিধে সামাজিক কারণের মধ্যে পর্যায়ভুক্ত নয়। ফলে ব্যক্তিগত অশান্তি বা বিচ্ছেদ যখন একটি সামাজিক গঠনের অন্তরায় হয় তখন সেইদিকে তাকাতেই হয়।

বিজ্ঞাপন

বহু মনোবিদদের মতে যেসব সম্পর্কের প্রারম্ভে রোমান্টিকতা চূড়ান্ত থাকে, অনেকসময় দেখা গেছে সেইসব সম্পর্ক শীঘ্র ভেঙে গেছে। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মনোভাব বদলায় অথচ মনের ইচ্ছে প্রারম্ভিক ব্যবহারকেই পরবর্তীতেও পেতে চায় কিন্তু সেটার স্বাভাবিক হালকা প্রভাবের জন্য বিচ্ছেদের সম্ভাবনা বাড়ে। zelder paradox অর্থাৎ দম্পতির মধ্যে একজনের অনিচ্ছাসত্ত্বেও যখন বিচ্ছেদ ঘটে। আইনের আওতায় এর বহুদিক আছে কিন্তু মানসিক দিক থেকে এটি বিরতি, এবং এই বিরতি কার জীবনে কতক্ষণ স্থায়ী তার ওপর তার আবেগ নির্ভর করে। মনোবিদরা বয়সের যদিও একটা সীমা নির্ধারণ করে রেখেছেন যাতে বিচ্ছেদের হার কমে, যেমন কুড়ির নিচের বয়স এবং চল্লিশের ওপরের বয়সে সাধারণত বিচ্ছেদের হার বাড়ে। একক্ষেত্রে মানে অল্প বয়সে পরিণতবোধের অভাব আর আবেগের প্রাধান্য এর জন্য দায়ী আর বেশি বয়সে অতিরিক্ত আত্মসচেতনতা ও মুক্ত থাকার অনুভূতি এর প্রধান কারণ। জীবনের বহু ক্ষেত্রে ব্যক্তিরা একক পিতা মাতা হয়ে জীবনধারণ করেন কিন্তু সেক্ষেত্রেও তার প্রভাব শিশুদের ওপর পড়ে কারণ আপেক্ষিক পরিস্থিতির সমাহার। জিউসদের একটি প্রবাদ আছে সেখানে বলা হয় যখন দুই বিচ্ছেদযুক্ত মানুষ পুনরায় বিবাহ করেন তখন আসলে চারটে মানুষ একটি বিছানায় আসেন অর্থাৎ তারা মনের অস্তিত্বের দিকে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টি রেখেছেন। কার্ট কোবেন বলেছেন তার নিজের  শৈশব কিভাবে বিচ্ছেদের প্রভাবে প্রভাবিত “I HAD A REALLY GOOD CHILDHOOD UP UNTIL I WAS NINE, THEN A CLASSIC CASE OF DIVORCE REALLY AFFECTED ME.” জিম মরিসন বলেছেন “ THE BIGGEST FINANCIAL PITFALL IN LIFE IS DIVORCE.AND THE BIGGEST REASON FOR DIVORCE IS MARRIAGE” জিম মরিসনের কথা বলতে গিয়ে এই প্রসঙ্গে অন্যতম বিদূষীর কথা মনে পড়ে গেল—সিমোন দ্য বোভেয়ার, যিনি প্যরিসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং “নারীবাদ” বলে যদি কিছু হয় তা বোধ করি তিনিই পূর্ণাঙ্গ রূপে লিখতে পেরেছেন। মায়ের একঘেয়ে জীবন দেখা এই মেয়ে নিজের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন বিবাহ করবেন না। বিশববন্দিত লেখক জ্যাঁ পল সাঁত্রে সেইজন্য কেবল তার প্রেমিকই থেকে গেছেন আজীবন।

ইদানীংকালে একটি “মানসিক গঠনজনিত বিষয়ের” টিভি চ্যানেল শো করতে গিয়ে এক মহিলার পরিচয় পাই যিনি সিঙ্গল প্যারেন্ট হয়ে জীবনের বাধাকে তুড়ি মেরে ওড়াচ্ছেন অথচ দাম্পত্য বললেই তার গলা শুকিয়ে আসছে। আসলে এই বিচ্ছেদ, বিবাহ এগুলো জীবনের কিছু উপকরণ। উপকরণ গোলমেলে হলে জীবনকে অপরিহার্য ভেবে বিকল্প নিতেই হয়। উদ্দেশ্য কেবল সভ্যতাকে সভ্যের আচরণগতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

বিজ্ঞাপন