হারুকি মুরাকামির বক্তৃতা

  • অনুবাদ | এমদাদ রহমান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

‘বাতাস যেখানে গান গায়’ নামে মুরাকামি তার প্রথম উপন্যাসটি লিখেছিলেন ’৭৯ সালে, তারপর টানা ৩ দশক মানুষের মনোজগতকে তিনি আশ্চর্য দক্ষতায় পর্যবেক্ষণ করেছেন। শুধু জাপান নয়, মুরাকামি বিশ্বজুড়ে পরিচিত নাম। বিশ্বের কয়েক কোটি পাঠক তার লেখা পড়েন। ইতোমধ্যে পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার বইগুলি। পাঠককে অদ্ভুত ও পরাবাস্তব পরিস্থিতির মুখোমুখি করতে চান এই পোস্ট মডার্ন লেখক। ২০০৫-এ বেরিয়েছে তার বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘কাফকা অন দ্য শোর’। মুরাকামি টোকিওর ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চলচ্চিত্রের প্রতি প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়, যদিও তার পড়ার বিষয় ছিল নাটক। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় সঙ্গীত নিয়ে সেজি ওযাওয়া’র সঙ্গে আলাপচারিতার বই ‘অ্যাবসোলিউটলি অন মিউজিক’।

জে. ডি স্যালিঙ্গারের ‘দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই’, এফ. স্কট ফিটজিরাল্ডের ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ বই দুটি তিনি অনুবাদ করেছেন। ফিটজিরাল্ডের উপন্যাসটিকে তিনি তার লেখক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই বলেছেন। লেখালেখির শ্রমসাধ্য দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে তিনি ভিডিও গেমস প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, লিখতে বসে কখনো মনে হয় ভিডিও গেম ডিজাইন করছি। আমিই প্রোগ্রামার, আমিই প্লেয়ার। এক বিচ্ছিন্ন খেলোয়াড়। দৌড়বিদ হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। ২০০৮-এর জুনে দ্য নিউইয়র্কারে মুরাকামি’র ‘দৌড়বিদ উপন্যাসিক’ লেখাটি প্রকাশিত হয়, একই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর জীবনস্মৃতি ‘হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং’।

বিজ্ঞাপন

মুরাকামির জন্ম ১৯৪৯ সালে, জাপানের কিয়োটোয়। তিনি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক, সাংবাদিক। ‘ড্যান্স ড্যান্স ড্যান্স’, ‘আফটার দ্য কোয়েক’, ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ লাইব্রেরি’, ‘ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইম্যান’, ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’, ‘নরওয়েজিয়ান উড’, ‘দি উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল’, ‘কাফকা অন দ্য শোর’, ‘স্পুটনিক সুইটহার্ট’, ‘ওয়ানকিউএইটফোর’ ইত্যাদি তাঁর অন্যতম সৃষ্টি।

‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ উপন্যাসটি লেখার শৈলি নিয়ে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলি ইনস্টিটিউটে তিনি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, ১৯৯২-এ। ‘হারুকি মুরাকামি এন্ড দ্য মিউজিক অব ওয়ার্ডস’ বইয়ে জে. রুবিন এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন, সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ নিয়ে গদ্য লিখেছেন ঔপন্যাসিক লাওরি পেই, তার ব্লগ ‘অন দ্য ওয়ে টু রাইটিং’-এ।

বিজ্ঞাপন

***
‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ যেভাবে  লিখেছি, লিখতে লিখতে অনুভব করছিলাম এর গল্পটি ‘মোনোগাতারি’, মুখে মুখে কথিত হয়েছে, আমি কিছু সৃষ্টি করিনি; আবার এই গল্পটি এমন কিছু যেন তাকে আপনি নিজের ভেতর থেকে বের করছেন। গল্পটি আপনার ভেতরেই আছে। আপনি তাকে গড়বেন, তাকে বের করে আনবেন। আমার কাছে শেষ পর্যন্ত যে ব্যাপারটি সত্য, তা হলো গল্পের স্বতঃস্ফূর্ততা। আমার ক্ষেত্রে, গল্প হচ্ছে একটি চলন্ত গাড়ি, যে গাড়ি তার পাঠককে কোথাও না কোথাও নিয়ে যায়। যাত্রাপথেই আপনার যা কিছু বলার বলবেন, পাঠকের সংবেদনে যতটুকু কম্পন তোলার তুলবেন, অনুভূতিকে তীব্র করবেন, কিন্তু প্রথমেই যা করতে হবে, তা হচ্ছে পাঠককে গাড়িতে তুলতে হবে, তারপর গল্পটি এমনভাবে বলে যেতে হবে যাতে পাঠককে বিশ্বাস করানোর ক্ষমতাটি আপনার থাকে। এ শর্ত গল্পটিকে অবশ্যই পূরণ করতে হবে।

আমি যখন ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ লেখা শুরু করি তখন আমার কাছে আগে থেকে ভেবে রাখা কোনো আইডিয়া ছিল না। প্রথম অধ্যায়টি টানা লিখে গেছি। এমনকি তখনও আমার ধারণা ছিল না কিভাবে আর কোন জায়গা থেকে গল্পটি শুরু করব! নির্ভার নিরুদ্বেগে লিখতে থাকলাম। শুধু এই অনুভূতিটি হতে থাকল যে গল্পটি আমার ভেতর কোথাও আছে, আমি সেটা জানি; ধীরে ধীরে গল্পটি খাড়া হচ্ছে, নিজের ভেতরে আমি তার রূপটা দেখতে পাচ্ছি। তখন আমি ভূগর্ভস্থ ধাতু সন্ধানকারী যন্ত্রের সেই অলৌকিক দণ্ড যে কাদামাটির ভেতর অনুসন্ধান করছে। আমি অনুভবে জানতাম কোথায় সেই কাদামাটি, জানতাম বলেই খনন শুরু করতে পেরেছিলাম। 

‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ উপন্যাসটির নির্মাণ কাঠামো [স্ট্রাকচার] চ্যান্ডলারের গোয়েন্দা কাহিনীগুলির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। চ্যান্ডলারের বইগুলির আমি এক উন্মুখ পাঠক, তার কয়েকটি বই বারবার পড়েছি। আমি আমার নতুন উপন্যাসে তার ‘প্লট স্ট্রাকচার’কে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম উপন্যাসের মুখ্যচরিত্রটি হবেন শহরের বসবাসকারী এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তি যিনি কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। খুঁজে বেড়ানোর পুরোটা সময় তিনি বিভিন্ন ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে পড়বেন। অবশেষে তিনি যখন তার আরাধ্য জিনিসটিকে খুঁজে পাবেন, ইতোমধ্যে তা হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এটা স্পষ্টতই চ্যান্ডলারের নিজস্ব পদ্ধতি, একেই আমি ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’-এ ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম।

‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’-কে, আমি যা-ই বলি না কেন, কখনো রহস্যোপন্যাস হিসেবে লিখতে চেষ্টা করিনি। এসব উপন্যাসে হয় কী—একটি রহস্য থাকবে, সমগ্র উপন্যাস জুড়ে চলবে সেই রহস্যের সুলুকসন্ধান, উন্মোচনের খুঁটিনাটি, কিন্তু আমি তো কোনোকিছুর সমাধানের চেষ্টা করছি না। আমি যা করতে চেয়েছিলাম তা হচ্ছে রহস্যময়তার জন্ম দেওয়া। রহস্য থাকবে অমীমাংসিত। উপন্যাসে ‘শিপ ম্যান’ চরিত্রটি সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে চাইনি, সেই মেষটি সম্পর্কেও কিছু প্রকাশ করতে চাইনি যার পেছন দিকে আছে একটি তারা; কিংবা ‘র‌্যাট’ চরিত্রটির ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল সে সম্পর্কেও আমি নিশ্চুপ। আমি রহস্যোপন্যাসের কাঠামোকে ব্যবহার করেছি কিন্তু তাতে ভরে দিয়েছি অপরিচিত মালমসলা। এর বেশি বলতে হলে বলব—এই উপন্যাসের গঠন কাঠামোটি এমন যেন এক কলের গাড়ির ইঞ্জিন।

প্রথম কয়েক অধ্যায়ে আমি আমার আরাধ্য পথটিকে খুঁজেছি, অন্ধের মতো, কিন্তু তখনও আমি অনিশ্চিত গল্প কোথায় যাচ্ছে, কিভাবে নির্মিত হচ্ছে ভেবে; বিপুল অন্ধকারে ডুবে থাকা পথটিকে শুধু অনুভব করছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। কখন আর কোথায় মেষদলের গল্পের সঙ্গে উপন্যাসের অন্য গল্পটি পরস্পরকে একত্রে জড়িয়ে নেবে, ছেদ করবে তারপর আবারও এগিয়ে যাবে? ভাবছি ভাবছি, হঠাৎ অজানা কিছু একটা ক্লিক করল, নিকষ কালো অন্ধকারের সামনে দীপ্তিময় কিছু দেখা যাচ্ছে যেন! তার মানে—আলো আছে! আর আলো এখানেই ছিল। কেউ যেন আমাকে বলে দিচ্ছে এদিকে নয়, ওদিকে যাও, হ্যাঁ, এবার বাঁক নাও...এবার আমাকে দেখে দেখে পা ফেলতে হবে, পদক্ষেপে যেন ভুল না হয়, যেন অসাবধানতায় হোঁচট না খাই, ভুলে যেন গর্তে না পড়ি।

লেখালেখির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। গল্পটি বলার শক্তি, জলের বুকে তীব্র আলোড়ন আর পাজলের এলোমেলো টুকরোগুলিকে একসঙ্গে জুড়ে দেবার তীক্ষ্ণতা আপনার থাকতে হবে। এই আস্থা ছাড়া আপনি এক লাইনও এগোতে পারবেন না। লেখালেখি ব্যাপারটা মুষ্টিযুদ্ধের মতো। একবার যদি রিঙের মধ্যে ঢুকে পড়েন তাহলে আর ফিরতে পারবেন না, ম্যাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে লড়ে যেতে হবে।

উপন্যাসগুলো আমি এভাবেই লিখি আর সেই ঠিক এভাবে লিখিত উপন্যাসগুলোই পড়তে পছন্দ করি। আমার কাছে স্বতঃস্ফূর্ততাই সব।

[নোট : ‘মোনোগাতারি’ জাপানি সাহিত্যের একটি বিশেষ ফর্ম। যেসব উপাখ্যান মহাকাব্যের সাথে তুলনীয়, গল্প বলার ‘ওরাল ট্র্যাডিশন’, বিশেষত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী পুনঃকথনকে ‘মোনোগাতারি’ বলে।]