ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ : আশা ও বেদনার যৌথভাষ্য

  • বীরেন মুখার্জী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

‘মা রে, তুই ছাড়া আমার কেউ নাই।... মারে রে কথা কসনা ক্যান? হোন্। জানোয়ারে কিছু কইরলে হে মনে রাখতা নাই। কুকুর কামর দিলে কি মানুষে মনে রাখে, না পা কাইট্যা ফেলে? মানুষের কিছু করইলে অন্য কথা। জানোয়ারকে মানুষ মাফ কইরা দ্যায়।’

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনির নারী ধর্ষণের চিত্র এভাবে অঙ্কন করেছেন শওকত ওসমান তার ‘ক্ষমাবতী’ গল্পে। পাকিস্তানিদের বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন যে কত মর্মস্পর্শী ও ভয়াবহ ছিল তা একাত্তরের নয় মাসের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ করা গেছে। পাকিস্তানি শাসকের শোষণ ও নিপীড়নের জটাজাল থেকে জাতিসত্তা রক্ষা, আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব পুনরুদ্ধারে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বাঙালি জাতি। ‘৫২-এ বাংলা ভাষা রক্ষার বিজয় বাঙালির হৃদয়পটে সাহসের রাজটীকা এঁকে দেয়; সেই সাহসকে ভিত্তি করে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পৃথিবীর মানচিত্রে লাল সবুজের পতাকাবাহী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে সক্ষম হয় বাঙালি জাতি। যুদ্ধের সাফল্য ও গৌরবগাঁথা, ক্লেদ, হতাশা এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রাপ্তির কাঙ্ক্ষা ইত্যাদি প্রপঞ্চ বাঙালির মননে নানামুখী আবেগের সৃষ্টি করে। যার প্রতিফলন পাওয়া যায় সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। বলা যায়, মুক্তিসংগ্রামের ইতিবৃত্ত ও যুদ্ধোত্তর বাস্তবতা সসম্ভ্রমে বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে। শিল্পসংবেদনশীল মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন দেশের সাহিত্যিকগণ এমনকি ভিনদেশি সাহিত্যিকরাও নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজটি করেছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দৃশ্যপট নানান আঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছে ছোটগল্পে।

বিজ্ঞাপন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে যেমন এ দেশের স্বাধীনতাকামী আপামর ছাত্রজনতা, সৈনিক, শ্রমিক-কৃষক, শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী নানাভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তেমনিভাবে এ দেশের কবি-সাহিত্যিকরাও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা ও পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে কলমকে শাণিত রেখেছেন। রচনা করেছেন গান, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটক। এসব সাহিত্যকর্ম একদিকে যেমন যুদ্ধরত বাঙালিকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে অন্যদিকে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকেও করেছে সমৃদ্ধ। ‘সাহিত্যের আরেক নাম জীবন সমালোচনা (Criticism of life) মাধ্যমে জীবনের সত্য, জীবনাতীতের সত্য ভাষার সৌন্দর্যে মণ্ডিত হয়ে সাহিত্যে উদ্ভাসিত হয়।’ সাহিত্যের দর্পণে যদি প্রতিবিম্বিত হয় একটি জাতি তথা একটি রাষ্ট্রের জীবন প্রণালী। প্রতিফলিত হয় সেই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি। তাহলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়েও বাঙালি জাতির আপোসহীন সত্তাকে শনাক্ত করা যায়। 

কথাসাহিত্যে, বিশেষ করে ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক প্রতিফলন লক্ষণীয়। সৃজনশীলতার প্রশ্নে একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কিত থাকায় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বার্থে নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ উজিয়েও অপরাপর ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সংগ্রামের সোপানতলে একীভূত হয়েছে—অস্তিত্বের লড়াইয়ে। বিভিন্ন সময়ে ঔপনিবেশিক শক্তির দীর্ঘ ও ধারাবাহিক শাসন-শোষণে ভঙ্গুর আর্থ-সামাজিক অবস্থায় নিমজ্জিত বাঙালির মধ্যবিত্ত মানস যুদ্ধচলা সময়ে দু’টি বিপরীতমুখিন দর্শন অবলম্বন করে স্পষ্ট হয়। প্রথমত ধর্মীয় ভীরুতা, স্বাচ্ছন্দ ও সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ ও তোষণের সনাতন রূপ এবং দ্বিতীয়ত সমস্ত পঙ্কিলতা ও সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তীর্ণ হবার চেতনা। প্রথম ধারার সমর্থকরা সত্য ও যুক্তিনিষ্ঠ দ্বিতীয় ধারার বিপরীতে অবস্থান করলেও ঘটনার প্রবহমানতা ও প্রতিক্রিয়ায় একসময় মুক্তিকামী চেতনায় মিলিত হয়। মানবিক উন্নয়ন ঘটে। ব্যক্তির অভিজ্ঞানসঞ্জাত, মর্মস্পর্শী উপলব্ধি নিয়ে বশীর আল হেলাল-এর গল্প ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’। পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ঢাকা শহরের অর্ধেক মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম রসুল তার পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। শিক্ষকের তরুণ পুত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী হলেও পিতার অনুমতি পায়নি। কিন্তু ঢাকা শহরে অবস্থান ও প্রতিদিন নির্যাতন, হত্যা প্রত্যক্ষ করে তার বিদ্রোহী সত্তার জাগরণ ঘটে। বয়সের ভারে নিজে যুদ্ধে যেতে না পারলেও ওই শিক্ষক পুত্রকে চিঠি লিখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেয়।

বিজ্ঞাপন

হানাদার বাহিনীর মানবতা বিরোধী হত্যা-নির্যাতন ও দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়া এক যুবকের বীরত্বগাঁথা নিয়ে রচিত জহির রায়হানের শ্রেষ্ঠ গল্প ‘সময়ের প্রয়োজনে’। গল্পের মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রের যুবক জীবনত্যাগী বীর সহযোদ্ধাদের কথা ভেবে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ে আবার একই সঙ্গে পাকবাহিনীকে হত্যা করে উল্লাসে ফেটে পড়ে। গল্পের চূড়ান্ত পর্যায়ে সে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নিজের জীবনও উৎসর্গ করে। তবে ধরা পড়ার পূর্বে সে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের কারণ অনুসন্ধান করে। গল্পটি একজন মুক্তিযোদ্ধার দিনলিপি হিসেবে ধরা যায়। বাঙালি জাতি সেদিন কোন সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়েছে? বর্তমানের বাস্তবতায় দ্বিধান্বিত জাতির সামনে সেই সত্যটিই কি নানা মাত্রিকতা নিয়ে দৃশ্যমান নয়? গল্পটিতে লেখকের শক্তিমত্তা পূর্ণমাত্রায় সমর্থনযোগ্য। আবেগী, তারল্যপূর্ণ লেখকদের মতো মুক্তিযুদ্ধকে তিনি শুধু নারী-লাঞ্ছনা হিসেবে দেখেননি। পাকসেনা ও এদেশীয় বর্বরদের যৌনলিপ্সা যুদ্ধখণ্ডের একটি প্রপঞ্চমাত্র। যে বাস্তবতা, কাঙ্ক্ষা নিয়ে একাত্তরের যুদ্ধে অংশ নেয় সাধারণ জনতা, তার মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন গল্পটিতে পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত।

প্রায় সমজাতীয় বাস্তবতা নিয়ে রচিত হারুন হাবীবের ‘লালশার্ট’ গল্পটি। কামালপুর নামের এক অখ্যাত অঞ্চলের রণক্ষেত্রের প্রকৃত অবস্থা এ গল্পে পূর্ণরূপে ফুটে ওঠে। এলাকার পাকিস্তানি ঘাঁটির নিকটবর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কার পাহারারত জলিল, সতিশ ও মোতালেব নামের তিন মুক্তিযোদ্ধার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ গল্পে। পাকসেনারা বাঙ্কার আক্রমণ করলে তিনজনের একজনও ফিরে আসে না। পরদিন খুঁজতে গিয়ে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় এক বাঁশঝাড়ের মধ্যে স্থির বসে থাকতে দেখে সহযোদ্ধা তাহের। ওই আক্রমণে সতিশ ও মোতালেব নিহত হয়। জলিল আহত হলেও মৃত দুই সহযোদ্ধার অস্ত্র দু’টি যুদ্ধের কাজে লাগবে বলে সে সঙ্গে নিয়ে আসে। জলিলও ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগুতে থাকে। এ সময় তার মনে পড়ে মা আর বোনের কথা। যাদের না বলে সে যুদ্ধে অংশ নেয়। স্বাধীনতা প্রত্যাশায় জীবন উৎসর্গকারী এই যুবক যোদ্ধা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও নিহত সহযোদ্ধাদের অস্ত্র, তাদের রক্তাক্ত লালশার্টের ছেঁড়া অংশ বহন করে দেশমাতৃকার প্রতি অগাধ ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ দেশমাতৃকার সম্মানই গল্পে নিঁখুত ভাবে উঠে আসে।

হাসান আজিজুল হকের ‘আটক’ গল্পটি যুদ্ধখণ্ডের আরেক বাস্তবতা নিয়ে বিকশিত। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে বাঙালি যোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে দিশেহারা পাকসেনারা। রাতের আঁধারে তাদের পশ্চাদপসরণ নিখুঁতভাবে বিবৃত হয়েছে। তার ‘ভূষণের একদিন’ গল্পে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার নির্যাতনে বাঙালির বিধস্ত জীবনের চিত্র ও বাঙলার প্রত্যন্ত জনপদের বিবর্ণ ছবি ফুটে ওঠে। গল্পে তিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরের বাস্তব অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। নামহীন গোত্রহীন গল্পটি বিকশিত হয়েছে থমথমে ও ভয়াবহ পরিস্থিতিকে সামনে রেখে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক বর্বরতার ছবি তিনি এ গল্পে শিল্পসম্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘সে’ নামের এক চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ প্রেক্ষাপটে রচিত অপরাপর গল্পের ভেতর ভিন্নতা নির্দেশ করে।

বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়’ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়েছে একথাও সত্য। কিন্তু এর জন্যে বাঙালি জাতিকে যা হারাতে হয়েছে তার পরিমাণও নিতান্ত কম নয়। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত ছোটগল্পগুলোতে বিজয়ের পাশাপাশি বেদনারও ভয়াবহ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। বিজয়ী বেশে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন দেশের মাটিতে ফিরে এলেও তাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে নিষ্ঠুর বাস্তবতার। ভয়াবহ যুদ্ধের কারণে মা হারিয়েছে সন্তান, নারীরা বিসর্জন দিয়েছে সম্ভ্রম, প্রিয়জনের মৃতদেহ মাড়িয়েও যুদ্ধ করতে হয়েছে সতীর্থ যোদ্ধাদের। নিজ জন্মভূমি ছেড়ে উদ্বাস্তু, উন্মুল হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে সাধারণ মানুষদের। গল্পগুলোতে এসব মানুষেরও অসহায়ত্বের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ফুটে উঠেছে মানবিক সকরুণ আর্তি। সেলিনা হোসেন তার পরজন্ম গল্পে যুদ্ধ যন্ত্রণায় নিঃসঙ্গ ও বেদনাজর্জর এক পিতার করুণ আর্তি তুলে ধরেছেন। বৃদ্ধ কাজেম আলীর মুক্তিযোদ্ধা চার সন্তান এক অপারেশনে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তার চোখের সামনেই পাকসেনারা তাদের গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর নিঃসঙ্গ কাজেম আলীর স্ত্রী পুত্রশোকে মারা গেলে বৃদ্ধ কাজেম আলী আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে।

হরিপদ দত্ত’র বাস্তব সত্যদর্শন ‘কাকজোছনার বনপুদিনা’ গল্পটি। মুক্তিযুদ্ধকে নিকট থেকে দেখার অভিজ্ঞতা এবং গল্পে বিবৃত সত্য ঘটনাটি তিনি সৃজনশীল চেতনার মিশেলে শিল্পঋদ্ধ ফসল হিসেবে উপস্থাপন করেন। যুদ্ধে ধর্মীয় ভীরুতা ও আখের গোছাতে উৎসাহী এক অর্থলিপ্সু অধ্যাপক পিতা ও যুদ্ধশেষে পাকক্যাম্প থেকে ফিরে আসা কন্যার বেদনাদায়ক সংলাপ গল্পের চুম্বকীয় অংশ হিসেবে গল্পটিকে বিশিষ্টতা দান করে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি নিয়ে লিখিত এটি একটি সার্থক ছোটগল্প।

ছোটগল্প লেখকরা নানারৈখিক চিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলোকে মাত্রিক, ব্যঞ্জনাঋদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকসেনা কর্তৃক নারী ধষর্ণের চিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি তুলে ধরেছেন বাঙালি নারীর গুপ্তচরবৃত্তির সফল কাহিনী। নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে পাকসেনাদের নিষ্ঠুরতা মেনে নিয়েছে আবার বিষধর ছোবল দিয়েও তাদের প্রাণ সংহারে ব্রতী হয়েছে। পাকসেনাদের নির্যাতনে অন্তঃসত্ত্বা এবং সন্তান প্রসব করে মাতৃত্বের অপমানের প্রতিশোধ হিসেবে সেই সন্তানকে মেরে ফেলার দৃশ্যও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে। শক্তিশালী গল্পকার শওকত ওসমান ‘দ্বিতীয় অভিসার’ গল্পে এইভাবে বাঙালি নারীর প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবৃত্তিকেই সফলভাবে চিত্রায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

এছাড়া শওকত ওসমান-এর ‘দুই ব্রিগেডিয়ার’, ‘ক্ষমাবতী’, ‘জননী: জন্মভূমি’, ‘দ্বিতীয় অভিসার’, বশীর আল হেলাল-এর ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, ‘রণকৌশল’, জহির রায়হান-এর ‘সময়ের প্রয়োজনে’, আবু জাফর শামসুদ্দীন-এর ‘ছাড় দেয়াল’, ‘চাঁদমারি’, হাসান আজিজুল হক-এর ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘রাফি’, ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’, ‘আটক’, কায়েস আহমেদ-এর ‘নচিকেতাগণ’, ‘বাংলাদেশ কথা কয়’, মঈনুল আহসান সাবের-এর ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, শাহরিয়ার কবির-এর ‘একাত্তরের যীশু’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর ‘অপঘাত’, মাহমুদুল হক-এর ‘বেওয়ারিশ লাশ’, ‘কালো মাফলার’, আলাউদ্দিন আল আজাদ-এর ‘আমাকে একটি ফুল দাও’, হরিপদ দত্ত-র ‘কাকজোছনার বনপুদিনা’, সেলিনা হোসেন-এর ‘পরজন্ম’, হারুন হাবীব-এর ‘লালশার্ট’, কাজী ফজলুর রহমান-এর ‘২৫ শে মার্চ’ গল্পগুলো সন্ধানী পাঠশেষে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত সার্থক ছোটগল্প হিসাবে উল্লেখ করা যায়।

পরিশেষে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের আবেগ, উপলব্ধি, তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা নিবিড়ভাবে ধরা পড়েছে বাংলা ছোটগল্পের জমিনে। গল্পগুলোতে চিত্রায়িত হতে দেখি যুদ্ধখণ্ডে বাঙালির নিজস্ব উপলব্ধি, স্বাধিকার প্রশ্নে আত্মোৎসর্গকারী জনতার নির্লোভ মুখ। বিবৃত হয় এদেশীয় স্বাধীনতা বিরোধী ও পাক হানাদার বাহিনীর যৌথ যৌনলিপ্সা। অপরাপর ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে সম্ভ্রম হারানো নারীর হৃদয়। লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও শক্তিশালী কল্পনার মিশেলে পুষ্ট গল্পগুলো আবেগসঞ্চারী বাক্যবিন্যাসে মূর্ত হয়ে ধরা দেয় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত যাবতীয় হতাশা, দীর্ঘশ্বাস, আশা, প্রাপ্তিসহ নানাবিধ প্রপঞ্চ। লেখকের শক্তিমত্তা, বুননশৈলীতে শব্দচিত্রে ভাস্বর হয় অসহায়-অনাহারী আমজনতার দীর্ঘশ্বাস ও দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। গল্পে বিবৃত ঘটনারাশি তাই পারস্পরিক সহমতের নিরিখে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে পাঠক চেতনায়। গল্পগুলোতে অঙ্কিত বিভিন্ন চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক অভিব্যক্তি ঘটনা পরম্পরায় মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস হয়ে ওঠার দাবি রাখে।

দোহাই
১. মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ছোটগল্প, মুহম্মদ হায়দার, বাংলা একাডেমি, মে ২০০৩
২. বাংলাদেশের ছোটগল্প (গবেষণা গ্রন্থ), খালেদা হানম, চট্টগ্রাম