নিমপাতা
ইচ্ছেডানার উড়ান এই ব্লগের মধ্যে সাধারণত বিবৃতিমূলক কিছু লেখা হয়ে থাকে কিম্বা লিখি। আজ এই ছোট অণুগল্পটি পাঠকদের জন্য এখানে সংযুক্ত করলাম। গল্প পড়ার আগে গল্পের মূল মাত্রা পাঠককে বলে দেওয়া উচিত নয় কিন্তু এটি যেহেতু এই ব্লগে সংযুক্ত করলাম তাই কিছুটা বলে দিচ্ছি শরীর, লিঙ্গভিত্তিক সম্পর্ক, প্রেম, নারীপুরুষ, নারী-নারী, পুরুষ-পুরুষ এই সমস্ত সম্পর্কের গভীরেই অমীমাংসিত রহস্য আছে। শরীর আর মনের মধ্যে যে বৃহত্তর ফারাক আছে তা মানুষ কখনো কখনো নিজেই বুঝতে পারে না। ফলে গোলমেলে পরিস্থিতির এক উত্তরণ হিসেবে যারা অস্তিত্ব সংকটে ভোগেন নিজেদের শরীর এবং মনকে কেন্দ্র করে এই গল্প তাদের জন্য হয়ত এই গল্প আমাদের সকলের জন্যই অন্য মাত্রায় প্রতিভাত; বাকিটা পাঠক খুঁজে নেবেন। আজ একটু অন্যরকম রূপে “ইচ্ছেডানার উড়ান”.....
হাড়-জিরজিরে বাবার হাড়-জিরজিরে ছেলে। ছেলে অশোকের ষোলো-সতেরো বছর বয়স। শরীর খুব দুর্বল। মা সংসার ছেড়ে কবে চলে গেছে তার ঠিক মনে পড়ে না! অশোক শুয়ে শুয়ে চিত্রাঙ্গদার কথা ভাবে। নিজের নাম রাখে টগর। বাবা আর ছেলের জিরে-আঁদা-কালোজিরে পাতলা ঝোলের সংসার। বাবা দুটো রান্না করে অফিসে চলে যায়। অফিস যাওয়ার সময় বাবা খেতে বসে,পাশে অশোকও। সাদা ভাতের ওপর সবুজ নিমপাতা দেয় বাবা। অশোক ভাতের দলা গিলে নেয়। অশোক চুপচাপ বাবার দিকে তাকায় আর মনে মনে বলে “বাবা তুমি বোঝোনা কেন আমি টগর? সাদা নরম ফুলের ওপর তুমি কেন ঢেলে দাও নিমপাতা?”।
অশোক বই পড়ে। কাগজের কুইজগুলো খেলে এবং জিতেও যায়। অশোক স্বপ্ন দেখে এক অশোকবনে, ছোট ছোট টগরগাছে গায়ে এত এত নিমপাতা এসে পড়েছে। কেন এমন স্বপ্ন আসে বুঝতে পারে না অশোক! আসলে বাবা খুব নিমপাতা ভাজে আর ভাতে ছড়িয়ে দেয়। তাকে খেতেই হয়, অনেকেই বলেছে খাওয়া জরুরি। ভাড়া ফ্ল্যাটের তিনতলায় একটা রাজার মতো ছাদ। সেখানে অবশ্য অসভ্য শিক আর দড়িতে ঝোলানো থাকে মোটা ব্রা আর রং চটে যাওয়া শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ, নাইটি, জাঙিয়া আরো কত কী! এরাই অশোকের অপরিচিত প্রতিদিনের দেখা হওয়া লোকজন। মেয়েদের পোশাকদের থেকে সে দূরে থাকতে চায়, তবু পারে না! বাকি জামাকাপড় পরিচিত কিছুটা তবু তারা কেমন জোর করে চেপে বসে গায়ে। তাদের জীবন আলাদা বলে অশোকের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব হয় না। অশোক নীচে নেমে আসে। আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুম। এইভাবে নিমপাতা খেতে খেতে একদিন অশোক বড় হয়ে যায়। অশোক একটি কোম্পানিতে চাকরি পায়। অশোকের বাবা শ্যাম এখন রিটায়ার্ড। টিভি ঘোরাতে ঘোরাতে ফ্যাশন চ্যানেলটা চলে আসে। শ্যাম দেখে, ভাবে, তারপর শ্বাস ফেলে। সুগার বেড়েছে। অশোক নিমপাতা কিনে এনেছে বাজার থেকে। অশোকের নিমপাতা ছাড়া ভাত মুখে ওঠে না আর। শ্যাম নিম ভাজে আর খায় । খুব তেতো লাগে, আগে এতো তেতো লাগত না! শ্যাম শুধু ভাবে “শ্যাম রাখি না কূল রাখি”! শ্যাম খেয়ে এসে বারান্দায় বসে। উল্টোদিকের বারান্দায় এক মহিলার শায়া মেলা।।শায়ার দড়ি দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ে। শ্যামের খুব ইচ্ছা করে ঐ শায়াটা ধরে ভাল করে চিপে দিয়ে আসে। এভাবে জল পড়লে তো শায়া পচে যাবে আর একদিন তা কোনো অজানা বালতি বা গামলাওয়ালা নিয়ে চলে যাবে। যেমন চলে গেছে অশোকের মা। অশোক ফিরে আসে অফিস থেকে, শ্যাম আর অশোক বারান্দায় চা খায়। শ্যাম বলে “অশোক, বাবা বিয়ে করবি না”?। তুমি করলে, করব বাবা! শ্যাম বলে আমি শায়া-শাড়ি চিনতে পারি না তো! অশোক বলে, বাবা আমিও না। শ্যাম বলে, তবে করিস না টগর । নিজের দেওয়া একান্ত লুকানো নাম বাবার মুখে শুনে চমকে ওঠে অশোক! শ্যাম শুধু তাকিয়ে হাসে, প্রসন্ন আদুরে ভালবাসার হাসি।
অশোক কথা ঘোরায়, “একটা নিমের মাজন এনেছি বাবা । কাল দাঁত মেজো কেমন”। শ্যাম বলে কিরে মিষ্টি তো পেস্টটা?
হ্যাঁ বাবা খুব মিষ্টি, মেজেই দেখো....