জমিলার দেশ কিরঘিজস্তানে
সেই যে কবে সুকুমার রায় লিখেছিলেন না—“পুলিশ এলে ডরাই না আর, পালাই নে আর ভয়ে, আরশোলা কি ফড়িং এলে থাকতে পারি সয়ে।”—আমি কিন্তু তেমন নই। আরশোলা আর ফড়িংকে সয়ে নিলেও, পুলিশকে আমি ষোল আনা ডরাই। তাই কিরঘিজস্তানের রাজধানী বিশকেক শহরের আব্দুররাহমানিভ স্ট্রিটে চলার সময়ে যখন দুজন পুলিশ দু দিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরে, আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। তাদের সাথে আছেন সাদা পোশাকের আরো দুজন পুলিশ। আমাকে তারা এমনভাবে চারদিক থেকে বেষ্টন করে দাঁড়ালেন, চাইলেও সেই চক্রব্যূহ ভেদ করে ভোঁ দৌড় দেবার কোনো উপায় নেই। মুখে তাই সরল একটা অপাপবিদ্ধ অভিব্যক্তি নিয়ে তাদের জেরার অপেক্ষায় সেখানে দাঁড়িয়ে যাই। এ অঞ্চলে শুনেছি পুলিশ খুব একটা সততানিষ্ঠ নয়, তাই আমাকে পাকড়াও করে মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে কোনো পয়সা দাবি করে কিনা, সেরকম একটা সন্দেহও মনে উঁকি দেয়। তো সেই দলে থাকা একমাত্র নারীসদস্য আমার সমস্ত ভুল ভাঙিয়ে আশ্বস্ত করে জানালেন, তারা আসলে ট্যুরিস্ট পুলিশ। কিছুদিন হলো এই বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু কাজ নেই তেমন। ট্যুরিস্ট যেমন কম, তার চেয়েও কম অপরাধের মাত্রা। ফলে ইনাদের একপ্রকার মাছি তাড়াবার অবস্থা। আমাকে দেখে এই দলটির আগ্রহ হয়েছে আমার কাছ থেকে দু চারটি কথা জানবার। এই যেমন কোথা থেকে এসেছি, কদিন থাকব, কেমন লাগছে বিশকেক, কোথায় কোথায় যাবার পরিকল্পনা আছে, এই সব আরকি। সবশেষে তাদের অভিলাষ হলো, আমার সাথে একটি ছবি তুলবেন। বেশ, তুলুন। ভেতরে ভেতরে বেশ উৎফুল্ল বোধ করছি ততক্ষণে। কোথায় ভেবেছিলাম উৎকোচ দাবি করা অসৎ পুলিশ, আর শেষে কিনা আবিষ্কার করলাম সদালাপী বন্ধুভাবাপন্ন ভিন্ন ধরনের পুলিশ, তাই অবাক আর উৎফুল্ল না হয়ে উপায় আছে?
আজ এখানে মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া। ছেড়ে ছেড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। গতকালও এমনই ছিল। তবে বৃষ্টির তেজ ছিল আরো বেশি। তার মাঝেই এয়ারপোর্ট থেকে আসতে হয়েছে। সে-নিয়ে বেশ রকমের ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। বিশকেকের এয়ারপোর্ট মূল শহর থেকে বেশ দূরে, প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের পথ। গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা দু লেনের মন্থর পিচঢালা পথ ধরে সেখানে পৌঁছাতে হয়। আমি এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিইনি। ভূতুড়ে জনমানবহীন সেই এয়ারপোর্টের বাইরে আসতেই দেখা পেয়েছিলাম ‘মারসুতকা’র, যেটি আদতে হলো ভাড়ায় খাটা মাইক্রোবাস। ভাড়া ট্যাক্সির দশ ভাগের এক ভাগ। যদিও যাত্রীবোঝাই হবার জন্যে অপেক্ষা করতে হলো বেশ খানিকটা সময়। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই ঝুমবৃষ্টি। বৃষ্টির ভারি পর্দাকে উপেক্ষা করে জোরসে ওয়াইপার চালিয়ে শম্বুকগতিতে মারসুতকা ছুটে চলে। মিনিট পনের পথ আসার পর দেখি দু পাশটা প্রায়ান্ধকার। ঝুপ করেই যেন নেমে এসেছে বিদায়ীবেলার সন্ধ্যা। আর সামনের রাস্তায় এপাশের মাঠ উপচিয়ে তীব্র গতিতে জল ছুটে যাচ্ছে উল্টো দিকের মাঠের দিকে। এর মাঝ দিয়ে গাড়ি ছোটালে জলের স্রোতে কলার ভেলার মতো ভেসে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। আমাদের ড্রাইভার বিশাল এক সিডার গাছের কোণে গাড়িটিকে দাঁড় করিয়ে পরিস্থিতির ব্যাপকতা কিছুটা বুঝে নেবার চেষ্টা করে। ওখানেই আমরা আটকে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। কিছুটা শঙ্কা জাগে, যদি বৃষ্টি আর না থামে? যদি জলের তোড় এসে পৌঁছায় এ গাড়ি অবধি, তাহলে? আশেপাশে গ্রামের কিছু চাষিবাড়ি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। এখানে বিপদে পড়লে সাহায্য করবার কেউ এগিয়ে আসবে কি?
বৃষ্টি থেমেছিল শেষ অবধি, সেই সাথে মন্থর হয়েছিল প্লাবনের তেজ। কিন্তু এতসব ডামাডোলে আমরা যখন আলাতু বাজারের কোণে এসে পৌঁছাই, ততক্ষণে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখান থেকে আমার হোটেল যে কোন দিকে, কিংবা কত দূরে, কিছুই ধারণা নেই আমার। কিছুটা ক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মাথার উপরের বুড়ো ওক গাছ থেকে টপ টপ করে ঝড়ে পড়ে বিকেলের বৃষ্টির জমে থাকা ফোঁটাগুলো। পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ে হঠাৎ এক যুবক দাঁড়িয়ে যায়। আমার অবস্থা আঁচ করতে পেরে নিজ থেকেই বলে, ‘ট্যাক্সি খুঁজে দেব তোমায়?’ আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলি। ছেলেটি পকেট থেকে ফোন বার করে দ্রুত কিছু টেপাটেপি করে জানায়, ‘মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই ট্যাক্সি এসে পড়বে। ততক্ষণ আমি তোমার সাথে আছি। আমি এখানকার টিভি স্টেশনে গ্রাফিক্সের কাজ করি। আজ আমার বিকেলের শিফটে কাজ ছিল। ফেরার সময়ে দূর থেকে দেখলাম, তুমি এখানে সুটকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো। তাই ভাবলাম, তোমার হয়তো কোনো সাহায্য প্রয়োজন।’ অজানা একটি দেশে এমন একজন অপরিচিত জনের কাছ থেকে বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত পেয়ে মুহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল।
আলাতু স্কয়ারের কোণের দিকটায় টিউলিপের বাগান। সকালের বৃষ্টির ফোঁটা লুকিয়ে আছে আধবোজা টিউলিপের জঠরে। সেই সাথে আশেপাশে ফুটে আছে বেশকিছু ধবধবে সাদা ড্যাফোডিল। টিউলিপের বাগানের পেছনেই আইরিশ পাব। তবে সকালের দিক বিধায় পাবের দরজাটি বন্ধ। আর বাগানের শেষপ্রান্তে গোয়ালঘরের মতো দেখতে টিনের চালের লম্বা বারান্দা। বিশাল সেই চাতালে দুজন মাত্র মানুষ নানা আকারের পেইন্টিং এনে ঝুলিয়ে রাখছেন। বিক্রির উদ্দেশ্যে। অবাক হয়ে খেয়াল করি, সেসব পেইন্টিংয়ের মাঝে লেনিন যেমন আছেন, তেমনি বেঁচে আছেন স্তালিনও। কিরঘিজ রমণীদের বেশ কিছু চিত্রকর্ম আছে। তবে তাদের অনেকটিতে শিল্পী নেত্রদানপর্ব সমাপ্ত করেননি। সেটি কোনো ধর্মীয় কারণে কি? এর আগে তাসখন্দে পরিচয় হওয়া একজন চিত্রশিল্পী তেমন একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে এখানে সেসব আলোচনা সম্ভব নয়। কারণ, যে দু যুবক ছবিগুলো চটের ছালা থেকে বের করে ঝুলিয়ে রাখার কাজ করছে, তাদেরকে মূল চিত্রকর বলে মনে হয় না। আর তাছাড়া ওরা মহাব্যস্ত। এই যে আমি খুঁটিয়ে ছবিগুলো দেখছি, এর মাঝে কিন্তু একবারও তারা জিজ্ঞেস করেনি, আমি কোনো সম্ভাব্য ক্রেতা কিনা। অতঃপর তাদেরকে ছুটোছুটিতে ব্যস্ত রেখে আমি মূল স্কয়ারের দিকে এগিয়ে যাই।
কংক্রিটে ঢাকা বিশাল উন্মুক্ত সেই স্কয়ারটিকে অভিভাবকের মতো আগলে রেখেছে উঁচু বেদিতে ঘোড়া ছুটিয়ে চলা এক বীর। এই বীর পৌরাণিক কাব্যগ্রন্থ ‘মানাস’-এ উল্লিখিত বীর। এই কিরঘিজ দেশটির নানা ক্ষেত্রে মানাস-এর উজ্জ্বল উপস্থিতি। এদের এয়ারপোর্ট, এমনকি জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থার নামও মানাস। দূরদেশের রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে কী করে বিজয়ীর বেশে ফিরেছিলেন সেই বীর, সেটি-ই কাব্যের ছন্দে শত শত বছর ধরে পঠিত হয়েছে ধূসর স্তেপের দেশ কিরঘিজস্তানে।
আজ উদ্দাম হাওয়াকে উপেক্ষা করে স্কয়ারের উন্মুক্ত স্থানটিতে বেশ কিছু লোকের সমাগম। তারা মুগ্ধ হয়ে দেখছে সামরিক বাহিনীর কসরত। তাদের দু দিকে ব্যান্ড দলের বাদ্যের তালে তালে নাচছে স্কুলের একদল কিশোর কিশোরী। কিশোরদের মাথায় ঐতিহ্যবাহী কিরঘিজ টুপি—কালপাক। তাদের কয়েক জনার হাতে স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র কমুজ। ত্রি-তার বিশিষ্ট কমুজ দেখতে অনেকটা গিটারের মতোই, তবে আকারে অনেক ছোট আর শীর্ণ। সেনা আর সেই স্কুলের কিশোর কিশোরীদের সাজ সাজ রব দেখে বোঝা যাচ্ছে, সামনের কোনো এক দিনে হয়তো উৎসব পালনের ঘটা আছে। তাই প্রস্তুতি হিসেবেই এই মহড়া। আমি নিজেও হাওয়া উপেক্ষা করে কিছুক্ষণ শিশুদের মহড়া দেখি।
এই স্কয়ারটির পেছন দিকে একটি সবুজ উদ্যান। নাম—দুবভি পার্ক। সে উদ্যানের সমুখেই আকাশের দিকে উদ্বাহু হয়ে সপ্রতাপে দাঁড়িয়ে আছেন লেনিন। মধ্য এশিয়ায় টিকে থাকা একমাত্র লেনিন-ভাস্কর্য। বাকিগুলোকে অনেক আগেই ধনতন্ত্রের আগমনের মধুলগ্নে সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে। কিন্তু এখানকার এরা সমাজতন্ত্র থেকে মুক্তি নিলেও বোধকরি অতীত স্মৃতিকে এক ঝটকায় ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। এমনকি স্বাধীনতার বেশ কিছুকাল পর অবধি লেনিন ভাস্কর্যটি স্কয়ারের সম্মুখ চত্বরেই ছিল। এই কিছু বছর আগে ওটিকে সরিয়ে এনে স্থান দেওয়া হয় ভবনের পেছন দিকে। লেনিনের প্রতি মানুষের মায়ামোহ এখনো যে কিছুটা টিকে আছে, তার আরেক প্রমাণ হলো—ভাস্কর্যের বেদিতে পড়ে থাকা গোলাপ আর টিউলিপের ম্লান গুচ্ছ।
লেনিন ভাস্কর্যের উল্টোদিকের সেই পার্কটির একটি বেঞ্চে গিয়ে বসি। বাঁ ধারে কিরঘিজ নারীর প্রমাণ সাইজের ভাস্কর্য। মধ্যবয়েসি এক নারী। মাথায় হেঁসেলের পাতিলের মতো দেখতে প্রথাগত মেয়েলি কিরঘিজ টুপি—এলিশেক। প্রায় দশ হাত দীর্ঘ সূতি কাপড় পাগড়ির মতো করে পেঁচিয়ে তৈরি করা হয় এ টুপি। তবে বিশাল সাইজের এই কেশাচ্ছাদনকারী পরে হাঁটতে এযাবত কোনো নারীকে এ শহরে দেখিনি। হয়তো গাঁ গ্রামে এখনো এর কিছু চল থাকতে পারে। তবে পাথরের বেদির উপর সেই স্মিতহাস্যময়ী নারীর ভাস্কর্যটি দেখে আমার হঠাৎ জমিলার কথা মনে হয়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক চিঙ্গিস আইৎমাতভ সৃষ্ট অমর চরিত্র—জমিলা। বলা চলে, জমিলার গল্পের মাধ্যমেই এই কিরঘিজ দেশটির সাথে আমার পরিচয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জমিলার স্বামী মায়ের কাছে বৌকে রেখে ফ্রন্টে যায়। সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উপনীত জমিলার সঙ্গী হয়ে থাকে বালক বয়সের দেবর। এর মাঝেই গ্রামের সমবায় ফার্মে কাজের জন্যে ডাক পড়ে তার। গ্রামের পুরুষরা যেহেতু সবাই যুদ্ধে, তাই সমর্থ নারীরা শস্যভাণ্ডার না সামলালে ফ্রন্টের সৈনিকদের মুখে খাবার জুটবে কী করে? জমিলা কাজে যোগ দেয়, সাথে বন্ধুর মতো লেগে থাকে সেই দেবরটি। এর মাঝেই সেখানে উদয় হয় জমিলার সমবয়েসী আরেক যুবক। জমিলা আর সেই যুবক দুজনেই একে অপরের প্রতি নৈকট্য অনুভব করে। আর সেভাবেই কাহিনী গড়ায়। ছোট গল্প। কিন্তু কী গভীর তার আকুতি! কিরঘিজ গ্রামীণ সমাজের সেই সময়কার চিত্রকে যেন জমিলার জীবনের কাহিনীর মধ্যদিয়েই আইৎমাতভ উপস্থাপন করেছেন আমাদের সামনে। আমি সেই ভাস্কর্যটির দিকে তাকিয়ে ভাবি—তুমিই কি তবে গিরিপথ পেরিয়ে গ্রাম ছেড়ে প্রেমিকের হাত ধরে দূর দেশে পালিয়ে যাওয়া সেই জমিলা?
ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা অব্যাহত থাকায় চায়ের তেষ্টা জেগে ওঠে। আমি রাস্তা পেরিয়ে স্কয়ারের উল্টোদিকে যাই। ওদিকটাতে বেশ কিছু ক্যাফে-বেকারির দোকান আছে। বলা চলে, এ রাস্তাই শহরের সবচেয়ে বনেদি এলাকা। খুব বেশি দূর হাঁটতে হয় না। অল্প দূরেই লোহার দরজা ঘেরা মেট্রো পাব নজরে আসে। সেটির বাইরে চক বোর্ডে লেখা—‘তুমি+আমি+কফি= আনন্দ’। যদিও আমার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, আমি আছি, কফিও হয়তো থাকবে, কিন্তু কোনো ‘তুমি’ নেই। তাই আনন্দের সঙ্কুলান হবে কিনা, জানি না। তবুও অনন্যোপায় না থাকায় সেই দশাতেই ভেতরে ঢুকতে হয়। ভেতরটা গুমোট অন্ধকার। বাইরের দরজার সাথে মিল রেখেই চারধারে ছড়ানো লোহার টেবিল চেয়ার। সড়কের দিকে মুখ করা জানালাগুলো ঘোলাটে কাচে ঢাকা। দেয়ালে টানানো নোটিশ বোর্ডে লেখা—টেবিল ছেড়ে উঠে গেলে মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখুন। কোণের দিকটিতে বার। তবে সেটি বোধ করি জমজমাট হয়ে ওঠে আঁধার নামার পর। এই ভর দুপুরবেলায় কেই-বা এখানে মদ গিলতে আসবে? ওয়াটার এগিয়ে এলে আমি চায়ের অর্ডার করে পাশের টেবিলের দিকে তাকাই। সেখানে মাঝবয়েসী দু মার্কিন ভদ্রলোক আলাপ করছেন। নিচুস্বরে কথা বলায় তাদের আলাপন আমি ডিকোড করতে পারি না। ভাবতে থাকি এরা কি কোনো কনট্রাক্টর? একথা ভাবছি, কারণ, ঠিক এই মুহূর্তে না হলেও কয়েক বছর আগ অবধি এই বিশকেক শহরটিতে আনগোনা ছিল বিপুল সংখ্যক মার্কিনীর। নাইন ইলেভেনের পর আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযান শুরু হলে তারা কিরঘিজস্তানের মানাস এয়ারপোর্টে বিমান বাহিনীর ঘাঁটি বানাবার জন্যে জায়গা চেয়ে বসে। চরম অর্থনৈতিক মন্দা চলতে থাকা কিরগিজস্তানের পক্ষে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তারা রাজি হয়ে যায়। সেই থেকে বিমান বাহিনীর লোক, তাদেরকে কেন্দ্র করে সাপ্লায়ার কোম্পানি ইত্যাদি নানা সংস্থার কাজ করা বিপুলসংখ্যক লোকেদের মচমচে পয়সায় গড়ে ওঠে এ এলাকার হোটেল, ডিস্ক, পাব, আর ক্যাফেগুলো। তবে কয়েক বছর আগে ক্ষমতায় আসা নয়া কিরঘিজ সরকারের চাপে মার্কিন বিমান বাহিনী এখানকার ঘাঁটিটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বিদেয় নিলে মাথায় হাত পড়ে এ এলাকার ব্যবসায়ীদের। তারা সরকারের কাছে আর্জি জানায়—ফিরিয়ে আনুন আবার সেই মার্কিনীদের। নয়তো আমরা চলব কী করে? তাদের এই উদ্বিগ্নতার হেতুটা আমি বুঝি। এ পর্যন্ত বিশকেক শহরের নানা পথে হেঁটে যতদূর বুঝেছি, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরুবার পর এখানকার নতুন কোনো শ্রীবৃদ্ধি হয়নি। বিদ্যুৎচালিত যে সরকারি বাসগুলো রাস্তায় চলছে সেগুলো রঙচটা, লক্কড়-ঝক্কর মার্কা। রাস্তায় এখানে-ওখানে খানাখন্দ। রাজধানীর পাড়াগুলো শ্রীহীন। দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকা উষর, চাষাবাদ-অনুপযোগী। খনিজ সম্পদের মধ্যে আছে একটি ছোট সোনার খনি। ভারি শিল্প নেই বললেই চলে। সে কারণেই দেশটির বিপুল জনগোষ্ঠী কাজের সন্ধানে ছুটে যায় রাশিয়ায়। অর্থনীতির এমন একটি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় মার্কিন ঘাঁটির প্রস্থানে তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বিচলিত না হয়ে পারেনি। তবে ঘাঁটিটি গুটিয়ে নিলেও সব কর্মকাণ্ড হয়তো পুরোপুরি বিদেয় নেয়নি। কিছু কনট্রাক্টর, কিছু ফড়ে দালাল হয়তো এখনো রয়ে গেছে। অদূরের টেবিলে ভুঁড়ি ঠেকিয়ে বসা সেই দুই মার্কিনী তেমন কেউ কিনা কে জানে!
ওয়েটার চা এনে রেখে যায়। চায়ের প্লেটে দুধবিহীন লিকার চায়ের পাশে রাখা থাকে মুসুম্বির কয়েকটি টুকরো। আমি সেই টুকরো দুটোকে চায়ে ভাসিয়ে দিই। সেই সাথে ভাবতে থাকি—দুপুরের খাবারটা সারা যায় কোথায়? খাবার নিয়ে এ অঞ্চলে বেশ হুজ্জতে পড়েছি। ইংরেজি জানা লোক এখানে নেই বললেই চলে। সবজি চাইলে এনে দেয় মাংস, আর মাংস চাইলে এনে দেয় সবজি। যেটা বুঝলাম, নিজের ইচ্ছেমতো খাবার চাইলে এ দেশে আসবার আগে টুকিটাকি রুশ শিখে আসাটা বাধ্যতামূলক। ও হ্যাঁ, এরা কিন্তু এখনো রুশ ভাষাকেই ধরে রেখেছে। আর এদের বর্ণমালাও সিরিলিক বর্ণমালা।
কফি পান শেষে আমি এগলি-ওগলি হেঁটে হায়াত রিজেন্সি হোটেলটা খুঁজতে থাকি। না, এ গরিব বান্দার সেখানে ওঠবার মতো সামর্থ্য নেই। আমি আসলে ওটি খুঁজছি, কারণ এর ঠিক পেছনেই নাকি কিরঘিজ জাতীয় নাট্যশালা। সেখানে যাবার কারণ আছে। সকালে হোটেলের খাবার ঘরে প্রাতরাশ সারার পর বেরিয়ে আসার সময়ে শুনছিলাম ম্যানেজার মেয়েটি কাকে যেন বলছে—আজ এখানে বিরাট অপেরা কনসার্ট হবার কথা। ভিয়েনা থেকে এদ্রিয়ান আর হাইদেমারিয়া নামক দুজন স্বনামধন্য শিল্পী আসবেন। সাথে থাকবে স্থানীয় বাদ্যযন্ত্রীদের একটি দল। তারা বাজাবেন—পিয়ানো, চেলো, ভায়োলিন আর বাস। অপেরা শিল্পীরা কিন্তু অনেক সময় গানের সুরের সাথে কোনো একটি অভিনয়ও মঞ্চস্থ করেন। অনেকটা আমাদের গীতিনাট্যের মতো। তবে ভিয়েনা থেকে আসা অপেরা শিল্পীরা কেবলই গাইবেন, অভিনয়ে অংশ নেবেন না। এর আগে ভিয়েনায় গিয়ে পথেঘাটে এই অপেরা কনসার্টের টিকিট বিক্রি হতে দেখেছি। সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকে টিকেট বেচা দালালদের মতোই ওখানকার থিয়েটারগুলোর আশেপাশের রাস্তায় আছে বেশ কিছু টিকেটবিক্রেতা। ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণের নিমিত্তে তাদের অনেকের পরনে পুরনো আমলের ঝলমলে পোশাক। এমন কয়েকজনের কাছে টিকেটের মূল্য শুনে আমার একেবারে অক্কা পাবার দশা হয়েছিল। প্রায় দেড়শ ইউরোর নিচে ভালো কোনো টিকেটই নেই। তাই অপেরা কনসার্টের তীর্থস্থল ভিয়েনায় অবস্থানকালে সেটির সুধা আস্বাদন আর সম্ভব হয়নি। তবে সেখানকার শিল্পীরা এখানে এসে অনুষ্ঠান করায় আমি অনুমান করি—টিকেটের মূল্য হয়তো তেমন একটা আকাশচুম্বী হবে না। ম্যানেজার মেয়েটিকে কোথা থেকে টিকেট কাটা যায়, এ নিয়ে প্রশ্ন করলে সে কিছুটা তাগিদের কণ্ঠে জানায়, “আজ রাতের এই শো যদি ধরতে চাও, তাহলে তোমাকে দুপুরের মধ্যে গিয়ে টিকেট কেটে আসতেই হবে। শোয়ের ঠিক আগে ওখানে টিকেট পাবে না।” মেয়েটির সেই কথাকে আমলে নিয়েই আমার এই নাট্যশালা খুঁজতে পথে নামা।
গথিক স্থাপত্যে নির্মিত বিশাল সেই নাট্যশালাটি দু গলি পরেই পেয়ে যাই। চূড়োতে এখনো নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে যাওয়া তারাটি দেখেই বোঝা যায়, দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের এই ভবনটি সোভিয়েত সময়ের অবদান। সামনের বারান্দায় উঠে দেখি, সেখানে এসে প্রতিফলিত হচ্ছে ভেতরের প্যাসেজে জ্বলতে থাকা ঝাড়বাতির আলোকছটা। সেই আলোর রেখা অনুসরণ করে ভেতরে যাবার মুখে কাঠের ভারি দরজাটির হাতলে চাপ দিই। কিন্তু সেটি আমার প্রত্যাশাকে প্রত্যাখ্যান করে। আমি বুঝে যাই, সন্ধ্যের আগে এই দোর খুলবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে টিকেট পাব কোথায়? নাকি এতটা পথ এসে আশাহত হয়ে ফিরে যেতে হবে? সেই সময়ে খেয়াল করি, বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে দু পাল্লার জানালা। একটি পাল্লা খোলা, অপরটি বন্ধ। মুখে হাসি ফুটে ওঠে আমার, টিকেটের একটা বন্দোবস্ত হয়তো হয়ে গেল।