বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত মুক্তির সংগ্রাম



মিনার মনসুর
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের কী দিয়েছে—আমি তাদের কিছুই বলি না। তাদের করুণা করা যেত কিংবা বাংলার বরেণ্য কবি আবদুল হাকিমের ভাষায় বলা যেত, ‘সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। কিন্তু আমি তার কোনোটাই করি না। কারণ আমি তাদেরকে কখনোই করুণা বা ক্রোধ কোনোটারই যোগ্য বলে বিবেচনা করিনি। তবে যারা বলেন যে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই দেননি, আমি তাদেরকে আয়নায় নিজের অবয়বটি দেখতে বলি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগে তিনি কী ছিলেন, আর এখন কী হয়েছেন সেটা দেখলেই তো এ জাতীয় সব কু-তর্কের মীমাংসা হয়ে যায়! কথাটি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। স্বাধীনতার আগের সেই বাংলাদেশ আর এই বাংলাদেশ যে এক নয় সেটা বোঝার জন্য গবেষক-পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, শুধু চারপাশে তাকানোর মতো দুটি নির্দোষ চোখ থাকলেই চলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত সাড়ে চার দশকে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে-অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, আমাদের নিকট অতীতের বাস্তবতার নিরিখে তা অভাবনীয়ই বলা যায়। আর তার বীজ বপিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী হাতেই। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এখানে যে-কথাটি না বললেই নয় তা হলো, যারা স্বাধীনতা ও পরাধীনতার প্রভেদ বোঝেন না তাদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা।

দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্যাদা বোঝেন না। এটা কোনো নতুন কথা নয়। প্রকৃতিদত্ত সহজলভ্য অক্সিজেনের অবারিত সমুদ্রে যার বসবাস, অক্সিজেন-শূন্যতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত না হলে সে অক্সিজেনের মূল্য বুঝবেই-বা কিভাবে? অথচ আমাদের আদিকবিরাও তা বুঝতেন। স্বাধীনতার ধারণা যখন এতটা স্পষ্টভাবে দানা বাঁধেনি, তখনই আমাদের আরেক বাঙালি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে গেছেন, ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়!’ স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। কারণ স্বাধীনতার চেয়ে দামি যে আর কিছুই হতে পারে না তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। স্বাধীনতার জন্যে বিশ্বের দেশে দেশে এখনো যারা হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন তারাই জানেন স্বাধীনতার আসল মূল্য। যুগ যুগ ধরে রক্ত ঝরিয়েও অনেকে আজও স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। সেদিক থেকে আমরা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি, ঘটবে এমনটা কল্পনাও করা যায়নি, সেই অভাবনীয় ঐতিহাসিক কাণ্ডটিই ঘটে গেছে আমাদের জীবনে। আর এই অসম্ভবকে যিনি সম্ভব করে দিয়ে গেছেন তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র ৫৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যদি আর কিছু নাও করতেন, শুধু এই একটি কাজের জন্যেই তিনি অমর হয়ে থাকতেন। তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদিত হয়ে থাকত বিশ্ববরেণ্য নেতাদের তালিকায়।

বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর অবদান শুধু স্বাধীনতার মধ্যে সীমিত নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন এ দেশটিকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর কঠিনতম কাজটিও সম্পন্ন করতে হয়েছিল তাঁকেই। এককথায়, সেটা ছিল এক দানবীয় কর্ম। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে গোটা দেশ ক্ষতবিক্ষত। সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। দেশের প্রধান দুটি সমুদ্র বন্দরই ব্যবহারের অনুপযোগী। অর্থনীতির প্রধান খাত হিসেবে বিবেচিত কৃষি মুখ থুবড়ে পড়েছে। নামমাত্র যে শিল্প ও ব্যাংকবীমা ছিল—তাও দেউলিয়া হয়ে গেছে। খাদ্য নেই। কোষাগারও শূন্য। পুলিশ-প্রশাসন কিছুই নেই। নেই স্বাধীন একটি দেশ চালানোর মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ জনবলও। এদিকে মানুষের প্রত্যাশা তখন আকাশচুম্বী। বেকার তরুণ-যুবকরা অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা দেশে। প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে গিয়েছিল। তারাও ফিরতে শুরু করেছে শূন্য হাতে। অন্যদিকে, আমেরিকা, চীন ও তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অবস্থান স্বাধীনতার বিপক্ষে। দেশের ভেতরেও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো তখনও তৎপর। এরকম একটি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে হাল ধরতে হয়েছিল সদ্যস্বাধীন এ দেশটির। আরো লক্ষণীয় যে তিনি সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিনবছর—১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এটুকু সময়ের মধ্যে তিনি যা করেছিলেন তা দেশ-বিদেশের ঝানু ঝানু বিশেষজ্ঞদেরও চমকে দিয়েছিল। পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতার মধ্যেও গোটা দেশের চেহারাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। তার দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি।

এখানে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, স্বাধীনতাপরবর্তী গত সাড়ে চার দশকে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। তার পরও আমরা খাদ্যে স্বনির্ভরতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নসহ সামগ্রিক জীবনমানের ক্ষেত্রেও। মানুষের আয় ও আয়ু দুটোই বেড়েছে। সর্বোপরি, মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যে-বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই বাজেটের আকার ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ কোটি অতিক্রম করে গেছে। বাংলাদেশের সামনে এই যে অপরিমেয় সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বার খুলে গেছে, আলাদীনের সেই আশ্চর্য চেরাগটির নাম হলো স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু কেবল সেই স্বাধীনতাই এনে দেননি, একই সঙ্গে নির্মাণ করে গিয়েছিলেন অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মহাসড়কও। সেই মহাসড়ক ধরেই আমরা এখন তরতর করে এগিয়ে চলেছি। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতার পরপরই যে-সংবিধানটি তিনি জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন, তা এখনো বিশ্বের অন্যতম সেরা সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গণতন্ত্র শুধু নয়, সর্বপ্রকার মৌলিক অধিকারেরই নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে সেই সংবিধানে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক হলো জনগণ।

২.
প্রাথমিক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে দেশ যখন সামনের দিকে চলতে শুরু করেছিল—ঠিক তখনই হানা হয় চূড়ান্ত আঘাত। সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে। কারা কেন মানবেতিহাসের এ ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞটি সংঘটিত করেছিল তা ইতোমধ্যে সকলেরই জানা হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, ষড়যন্ত্রকারীরা যে-বাকশালকে তাদের যাবতীয় আক্রমণের মূল ঢাল বা বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছিল, সেটি ছিল পরীক্ষামূলক একটি কর্মসূচি। কিছুটা যুগান্তকারীও বলা যায়। এর গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক ছিল। প্রথমত, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা সংক্ষেপে ‘বাকশাল’ গঠন। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিটিই ছিল আসল। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রথম বিপ্লবটি ছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জন। তার নেতৃত্বেই সেটি সফল হয়েছে। বাকশাল ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, এ বিপ্লবের লক্ষ্য হলো—‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’।

নানা প্রসঙ্গে নানাভাবে সে-কথা বারবার বলেছেনও তিনি। এও বলেছেন যে, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ দুটি কথা বলেছিলেন একই নিঃশ্বাসে। সেটি হলো, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয়েছে কিন্তু প্রকৃত ‘মুক্তি’ অর্জিত হয়নি। শত শত বছরের শোষণ-বঞ্চনার নিগড় থেকে দেশের কোটি কোটি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করার কাজটি যে কতটা কঠিন তা তিনি অন্য যে-কারো চেয়ে ভালো জানতেন। তিনি বলেছেন, তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য হলো—অর্থনৈতিক মুক্তি। তাঁর ঘোষিত বাকশাল তথা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের ভুখানাঙ্গা মানুষকে শোষণ-বঞ্চনা ও দারিদ্র্যের বংশানুক্রমিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা সম্ভব বলে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করতেন।

গত শতাব্দীতে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের খুবই প্রিয় একটি স্লোগান ছিল—‘এ সমাজ ঘুণে ধরা/ এ সমাজ ভাঙতে হবে’। দশকের পর দশক ধরে স্লোগানটি এ-দেশের মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিতও করেছে। গতানুগতিক অর্থে বঙ্গবন্ধু বিপ্লবী ছিলেন না। সব ধরনের হঠকারিতা বা চরমপন্থা থেকে তিনি নিজেকে সযত্নে দূরে রেখেছেন আমৃত্যু। তবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু নিজেও সম্ভবত উপলব্ধি করেছিলেন দুঃখী মানুষের ভাগ্য বদলাতে হলে ঘুণে ধরা সমাজ ভাঙা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাঁর ভাষায়, ‘আমি কেন ডাক দিয়েছি? এই ঘুণে ধরা ইংরেজ আমলের, পাকিস্তানি আমলের যে শাসনব্যবস্থা তা চলতে পারে না। একে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তা হলে দেশের মঙ্গল আসতে পারে। না হলে আসতে পারে না। আমি তিন বছর দেখেছি। দেখেশুনে আমি আমার স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছি।...’ (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণ: ২৬ মার্চ, ১৯৭৫)।

আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে বিদ্যমান ঘুণে ধরা সমাজ ভাঙার বলিষ্ঠ কিছু উপাদানও ছিল। তিনি তাঁর মতো করে সমাজ-ভাঙার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। বিশেষ করে কৃষি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধুর মনে। পঁচাত্তরের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় প্রদত্ত দীর্ঘ ভাষণে সেটা তিনি বলেছেনও খোলাখুলিভাবে। তাঁর ভাষায়—“এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না। ...পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। ...কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষকে কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদেরকে বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি যে পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশো থেকে হাজার ফ্যামিলি নিয়ে কম্পালসারি কো-অপারেটিভ হবে।”

[পুরো ভাষণ শুনতে ইউটিউব লিংকে ক্লিক করুন]

মূলত দ্বিতীয় বিপ্লবের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যই তিনি গঠন করেছিলেন বাকশাল নামক নতুন রাজনৈতিক দল। এটাকে তিনি বলেছিলেন জাতীয় দল বা প্লাটফরম। দল-মত নির্বিশেষে সকলেরই যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল এ দলে। সামরিক-বেসামরিক বহু সরকারি কর্মকর্তা সেই সুযোগ গ্রহণও করেছিলেন। গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য হিড়িক পড়ে গিয়েছিল তখন। নানাভাবে দেনদরবারও চলছিল। শোনা যায়, যাকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর হাস্যকর চেষ্টা চালানো হচ্ছে দীর্ঘদিন যাবৎ সেই সেনা কর্মকর্তাও ছিলেন এই দলে। ছিলেন আরো অনেকেই। বাকশালের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় এখনো থামেনি। বলা হয় যে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন! বিসর্জন দিয়েছিলেন গণতন্ত্রকে! সে জন্যই নাকি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল! বহু ‘নিরপেক্ষ’ বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিতের মুখেও আমি এমন কথা বহুবার শুনেছি। এ প্রচারণা যে সুপরিকল্পিত, বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অনেকটা হরিণের পানি ঘোলা করার সেই গল্পের মতো। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। দেশি-বিদেশি অনেকেই জড়িত ছিলেন এ-ষড়যন্ত্রের সঙ্গে। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য। ঘাতকরা তাদের লক্ষ্যে এতটাই অবিচল ছিল যে, বঙ্গবন্ধু বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণা না করলেও পরিস্থিতির কোনো হেরফের হতো বলে আমার মনে হয় না।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/03/1564835607561.jpg
◤ বাকশাল ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ◢

 

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাই যদি বঙ্গবন্ধুর মূল উদ্দেশ্য হতো তার জন্য বাকশাল গঠনের প্রয়োজন ছিল না। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তিনি আরো বহুদিন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। আমার জানা মতে, বঙ্গবন্ধুর ঘোর বিরোধীরাও নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার অসম্ভব দাবি কখনোই করেননি। সব দল মিলেও যে সেটা সম্ভব হতো না তা তারা ভালো করেই জানতেন। এমনকি চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের সেই কঠিন দিনগুলোতেও সকল বিচারেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সেটা তিনি নিজেও জানতেন। যেখানেই তিনি যেতেন, সেখানেই মানুষের ঢল নামত। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর কষ্ট ছিল অন্য জায়গায়। তিনি নিজের সঙ্গেই এক কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নিজেকে, নিজের চারপাশের সব সীমাবদ্ধতাকে, ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু তাঁর সারা জীবনের স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিশেষ করে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ তাঁকে খুব বিচলিত করে তুলেছিল।

নানা সূত্রে এখন জানা যাচ্ছে যে, দ্রুত কিছু একটা করার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। নানা জন নানা পরামর্শ দিয়েছেন তাঁকে। বলেছেন, ভেবেচিন্তে ধীরেসুস্থে পা ফেলতে। পরিণতি সম্পর্কে সতর্কও করে দিয়েছেন। ফিডেল ক্যাস্ট্রোর মতো নেতারাও ছিলেন পরামর্শদাতাদের দলে। কিন্তু একাত্তরের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোর মতো এবারও বঙ্গবন্ধু স্বীয় সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। কারো কথাই শোনেননি তিনি। এমন নয় যে, পরিণতির ব্যাপারে তিনি খুব উদাসীন ছিলেন। ঘাতকের বুলেট যে-কোনো সময়ে তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দিতে পারে তাও তাঁর অজানা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। সত্য যে কঠিন—নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনেই তা তিনি উপলব্ধি করেছেন পদে পদে। স্বধর্মে অবিচল থাকা যে আরো কঠিন তাও তিনি জানতেন। তবু যুধিষ্ঠিরের মতো তিনিও স্বধর্ম পালনে কখনোই কুণ্ঠিত হননি। যুধিষ্ঠির চলতেন নিজের বিবেচনা ও বিশ্বাস অনুযায়ী। বিবেকের নির্দেশকে শিরোধার্য জ্ঞান করতেন। এটাই হলো স্বধর্ম। শত ঝড়ঝঞ্ঝা সত্ত্বেও এ-পথ থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি যুধিষ্ঠির। এ জন্য বুদ্ধদেব বসু মহাভারতের নায়কের শিরোপাটি তুলে দিয়েছিলেন তাঁর মাথায়। বলেছিলেন—মহাবীর অর্জুন নন, যুক্তিবাদী যুধিষ্ঠিরই হলেন যথার্থ নায়ক। বঙ্গবন্ধুও তাই। বলা যায়, সম্পূর্ণ সজ্ঞানেই ঘাতকের উদ্যত সঙ্গীনকে অগ্রাহ্য করে একাত্তরের মতো আবারও বিবেকের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। এটাই তার স্বধর্ম। তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমি রাজা ইডিপাসেরও মিল খুঁজে পাই—কোনো কিছুই যাকে নিজ জনগণের মঙ্গলসাধনের ব্রত থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। খুঁজে পাই আমাদের কালের ট্রাজিডির অনন্য এক মহানায়ককে।

বলা বাহুল্য, সপরিবারে আত্মাহুতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু এ-দেশের হতদরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যে-সংগ্রামের সূচনা করে গেছেন, তাকে সফলভাবে সমাপ্ত করার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের ওপর। এখানে ব্যর্থতার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের সৌভাগ্য যে, তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত মুক্তির সংগ্রাম সমাপ্ত করার পথে ইতোমধ্যে আমরা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছি। দেশে-বিদেশে সর্বত্রই বাংলাদেশ আজ এক যথার্থই বিস্ময়ের নাম। জাতির পিতার সোনার বাংলা এখন আর কেবল স্বপ্নমাত্র নয়, পদ্মা সেতুর মতোই তার অবয়ব ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে দিনদিন।

মিনার মনসুর
পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

   

অনন্তকাল দহন



আকিব শিকদার
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
:অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

১২৫তম জন্মবর্ষ

মুক্তির অন্বেষী নজরুল



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নজরুল জীবনের ‘আর্তি ও বেদনা’র সম্যক পরিচয় পেতে হলে সেকালের মুসলিম সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কিছু আলোচনা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নজরুলের আবির্ভাবকালে মুসলমানদের সামাজিক আবহাওয়া এমনই জীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ ছিল যে, কোনো শিল্পীরই সেই আবহাওয়াতে আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার সম্ভব ছিল না। জীবনের প্রথমদিকে তাই কামাল পাশা প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত বীর মুসলিমেরা নজরুল-মানসকে আচ্ছন্ন করেছিল।

কিন্তু অচিরেই তিনি বাঙালির জাগরণের পথিকৃতে রূপান্তরিত হন। বাংলার জাগরণ গ্রন্থে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অগ্রণীজন কাজী আবদুল ওদুদ জানাচ্ছেন, ‘নজরুলের অভ্যুদয়ের পরে ঢাকায় একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর অভ্যুদয় হয়; তাঁদের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং যারা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং বাঙালি মুসলমানের চেতনার জগতে নাড়া দিলে সচেষ্ট হয়েছিলেন।’

চরম দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন কবি নজরুল, ছবি- সংগৃহীত

উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক ও ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। সংগঠনটির সঙ্গে ‘সাহিত্য’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি গতানুগতিক ও মামুলি কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল না। ‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বৃহত্তর পরিসর ও অর্থে গ্রহণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। ফলে, তাঁদের কাছে সাহিত্যচর্চা ছিল জীবনচর্চার নামান্তর। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে তাঁরা অভিহিত করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই (১৯২৭) সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র হিসেবে সাময়িকী ‘শিখা’ প্রকাশ করে, যে কারণে এদের ‘শিখা গোষ্ঠী‘ নামেও অভিহিত করা হয়।

শিখা প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ বছর (১৯২৭-১৯৩১)। বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যা তথা শিক্ষা, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা করেছেন এই সমাজের লেখকগণ। ‘বুদ্ধির মুক্তি ও কবি নজরুলকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

বুদ্ধির মুক্তি, মানব মুক্তি, সমাজের মুক্তি তথা মানুষের শির উচ্চতর করার বাণী উৎকীর্ণ করেছিলেন নজরুল। গেয়েছিলেন মানবতার জয়গান। অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের গানে মুখরিত ছিল তাঁর জীবন ও কর্ম। মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিল না তাঁর কাছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। মানবতার জয়গান গেয়ে লিখেছিলেন-'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ …’।

মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’। আবার তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান- ‘জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত’।

শুধু যে কবিতাই লিখেছেন তা তো নয়। তিনি এমন অনেক প্রবন্ধও রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আজও অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে।

সাম্য ও মানুষের কবি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম, ছবি- সংগৃহীত

‘সাম্য, সম্প্রীতির কবি নজরুল তাঁর হৃদয়মাধুর্য দিয়ে সব শ্রেণিবৈম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে জাত–ধর্ম ছিল হৃদয়ের প্রেমধর্ম; যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে ওঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সবরকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী ছিলেন নজরুল।

তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের সব সদস্য এবং আপামর বাঙালি এই সত্য নিত্য উপলব্ধি করেন।

১২৫তম জন্মবর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য মুক্তির অন্বেষী। তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী।

কেননা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত এবং যুদ্ধ ও আগ্রাসনে জর্জরিত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার, হামলা, নির্যাতন।

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন।

এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। কারণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি ও মানবতার মহান সাধক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম আর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।'

উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর কবরস্থানের স্থান নির্ধারণ নিয়ে নানাজন নানামত দিতে থাকেন। এ অবস্থায় স্থাননির্ধারণী সভায় রফিকুল ইসলাম প্রস্তাব করেন নজরুল তাঁর এক গনে লিখেছেন-

‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’॥

সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর কবর হোক। তাঁর এ প্রস্তাব সভায় গৃহীত হলো। পরবর্তীকালে এ কবর পাকা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে ভারত থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, ছবি- সংগৃহীত

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির একটি 'বিদ্রোহী', যা স্পর্শ করেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক।

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক ‘প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক ‘সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ‘ধূমকেতু’তে (২২ আগস্ট, ১৯২২) ছাপা হয়।

বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল ‘চির উন্নত শির’ রূপে বিরাজমান।

পুরো বাংলা ভাষা বলয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন শাণিত প্রতিবাদ তুলনাহীন। বিদ্রোহীর শতবর্ষকে ‘জাগরণের শতবর্ষ’ রূপে উদযাপন করা হয়, বাংলা ভাষাভাষী পরিমণ্ডলে আর ১২৫তম জন্মবর্ষে মুক্তির অন্বেষী নজরুলকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করে সমগ্র বাঙালি জাতি!

 ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

;

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;