প্যারাকজম

  • মাহরীন ফেরদৌস
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

সাঁকো
প্রায় অনেক বছর পর এমন কারো সাথে পরিচয়। পরিচয়টুকু পথে কিংবা গলির মাথায়। বাড়ির সামনের বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে, ব্যাঙের ছাতার মতো সদ্য গজিয়ে যাওয়া রেস্তোরাঁয়। টঙের দোকানে কারো ভীষণ শব্দ করে চায়ে চুমুক দেওয়ায়। ছাদের অলকানন্দা ফুল কিংবা খুলনার ঝপঝপিয়া নদীর তীরে। এতবার পরিচয় কিভাবে হয় ভাবতে পারে সবাই। তবে তা ব্যাখ্যা করা দুর্বোধ্য ও জটিল। তার সাথে দেখা হবার পর থেকেই বারবার, নানা স্থানে হচ্ছে পরিচয়। আমরা দুজন অবশ্য ফেসবুকে বন্ধু নই। ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট কিংবা টুইটারেও আমরা একে অন্যকে দেখি না। কারণ, আমি খুঁজে দেখেছি সে এসব কিছুই ব্যবহার করে না। তারপরেও ক্যামোন অদ্ভুত জায়গায় আমাদের দেখা হয়ে যায়।

যেমন, মৌনতার ঘরের বারান্দা দিয়ে তার ঘর দেখা যায়। জনমানবশূন্য শহরের মতো সেই মস্ত ঘরে সে বই পড়ে সময় কাটায়। সম্ভবত মৃদু শব্দে শোনে গান। বই পড়ার সময় মাঝে মাঝে অল্প মাথা ঝাঁকায়, যেন গল্পকার ও পাঠক দুটো সে নিজেই। তারপর, ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটতে থাকে। তার দেখাদেখি আজকাল আমিও খুব হাঁটতে শুরু করেছি। বাড়ির ছাদে, ঘরের ভেতরে, রাস্তায় কিংবা গলিতে আমি রিকশা না ডেকে, গাড়িতে না চড়ে হাঁটতে থাকি। আমার কেবলই মনে হয় এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই আমাদের একদিন সত্যিই পরিচয় হয়ে যাবে। এ যুগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে জুড়ে না থাকলে একে অন্যকে কাছ থেকে দেখার আর উপায় আছে কি? নেই। তাই আমার মাঝেমাঝে মনে হয় আমি মৌনতার ঘরটা ভাড়া নিয়ে থাকি, কিন্তু তা সম্ভব না। সেজন্য ছুটির দিনগুলোতে খুব ভোরে আমি ওর বাসায় চলে যাই। ওদের বারান্দায় অনেক গাছ। বাড়ির নানা পরিত্যক্ত জিনিস সেখানে বস্তাবন্দী করে ফেলে রাখা। এছাড়াও বারান্দার উপরের গ্রিলের এপাশ থেকে ওপাশে টাঙিয়ে দেওয়া তিন, চারটা লম্বা নাইলনের দড়ি। দিন-রাত সেখানে শত শত রঙ বেরঙের কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়। একটা টুল নিয়েও বসার জায়গা নেই। ঠেস দিয়ে দাঁড়ানোর জন্য কোনো ফাঁকা দেয়ালও অনুপস্থিত। এমন একটা জায়গা থেকে আমি তাকে দেখি। বারান্দা দিয়ে তার ঘরের দেয়ালে ক্রিকেট ব্যাট দেখে মৌনতাকে জানিয়েছিলাম। শুনে ও বলেছিল, ‘হয়তো খেলার মাঠ নিয়ে তার অনেক স্মৃতি আছে। সে হয়তো ক্রিকেট খেলতে খুব পছন্দ করে।’

বিজ্ঞাপন

শুনে আমারও বলতে ইচ্ছা করল, আমার বাড়ির পাশে একটা মস্ত বড় খেলার মাঠ আছে। আর মাঠ পেরিয়েই একটা ঘন সবুজ পার্ক। সেই পার্কের নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসলে নাকি অকারণেই সবার মন খারাপ হয়ে যায়। আমার খুব ইচ্ছা করে খেলার মাঠের পাশের এই পার্কের গল্প আমি তাকে শোনাই, কিংবা ঘর থেকে একটা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে তাকে তুলে নিয়ে এসে বলি, ‘চলো দেখে আসি স্টেশনের শেষ ট্রেনটা কোন গ্রামে যায়। কী আছে সেখানে? অনেক অনেক গাছ, শান্ত নদী, লেবু বাগান, বৃষ্টির পর রংধনু আর সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই ঝিঁঝিঁ পোকাদের ঘোরলাগা গান!’

এসব ছাড়াও, আমি মনে মনে অনেকবার ভাবি তার সাথে হঠাৎ করে কোথাও দেখা হয়ে যাবে নাকি? হয়তো ব্যস্ত নগরীতে ভিড়ের মধ্যে সে হুট করে সামনে এসে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বলবে ‘কেমন আছো?’ জানি না তখন আমি কী উত্তর দেব। হয়তো পেছন ঘুরে হাঁটতে শুরু করব বিব্রত ভঙ্গিতে। মুগ্ধতা কিংবা প্রেম যে নামই হোক, আমাকে বিব্রত করে খুব। লুকাতে পারি না, আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতেও ইচ্ছে করে না। আমি জানি আর অল্প কয়মাস পরেই মৌনতারা এই বাসা ছেড়ে দিবে। এরপর তার সাথে দেখা হবে কিভাবে? জানা নেই। যদি ওর প্লে লিস্টের গানগুলো পেতাম হয়তো গানে গানে একটা সাঁকো তৈরি করে ফেলতাম দুজন। সেখানে আমাদের দেখা হতে পারত। মৌনতা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, ‘এই মানুষটাকে নিয়ে তোর পরিকল্পনা কী?’

বিজ্ঞাপন

আমি বিশেষভাবে কিছু বলতে পারি না। এই ভালোলাগা, ঘোরলাগা কিংবা ‘আমাদের মাঝে যেন কী মিল আছে’ ধরনের অনুভূতির পৃথক কোনো সংজ্ঞা আমার কাছে নেই। শুধু জানি তার কথা না ভাবলে মনে হয় এবেলায় আকাশের দিকে তাকানো পাপ। আর মনে হয় সবকিছু এভাবেই থাক। মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পার্ক থেকে গলা বাড়িয়ে দেওয়া ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ ছুঁয়ে দিক তার চিবুক। টঙের দোকানের মস্ত বড় কেতলির বিকট হুইসেল আর বাষ্পগুলো ঝাপসা করে দিক ওর কালো ফ্রেমের চশমা।

আমি শুধু ভুলতে চেষ্টা করে কিছু স্বপ্ন দেখে ফেলি। এই যেমন কিছুদিন আগে একরাতে দেখলাম, এক বিষাদ জাগানো ল্যাম্পপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। পেছনে চেনাজানা বহু মানুষ। আমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, যাওয়ার সময় অকপটে ছুঁয়ে দিলাম তার হাত। কেউ দেখল না, কেউ জানল না। এরপর চলে গেলাম দূরে, বহুদূরে। শান্ত হয়ে এলো চারপাশ।

আবার স্বপ্নে দেখলাম কোনো এক বইয়ের দোকানে দেখা হয়ে গিয়েছে আমাদের। শেলফের শতশত বইয়ের পাতাগুলোর ভেতর থেকে অনবরত পানি ঝরে একটা নদী হয়েছে। সেই নদীতে অল্প অল্প ঢেউ। ভাসছে অজস্র বই। বইয়ের খোলা পাতার ভেতর থেকে ফুটে উঠেছে কচুরিপানা ফুল। আমরা দাঁড়িয়ে আছি দুজনেই। হঠাৎ কী যেন একটা খুঁজতে চলে গেল ও। আমি একলা দাঁড়িয়ে। আমার পায়ে বাড়ছে জড়তা। যেন ডুবে যাচ্ছি আর আটকে যাচ্ছি কোথাও। মনে হচ্ছে, মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই আলো ফুটে উঠবে, আর হারিয়ে যাবে সব। আমি প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করতে থাকি। তারপর ভুলে যাই আমি কেন সেখানে আছি। এমন সময় কোথা থেকে আসা এক অচেনা বাতাসে কচুরিপানা ফুলগুলো দুলতে থাকে। আর নিয়ম করে পুড়তে থাকে আমার স্বপ্নের তারাবাতিগুলো।


অফবিট
- ‘তারপর?’
- ‘তারপর আর কিছুই না।’
- ‘ আশ্চর্য! এই সোশিওপ্যাথ ধরনের রহস্যময় মানুষটার সাথে তোর কোনো কথা বা কিছুই হয়নি?’ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে আমার বন্ধু জাহিদ, যাকে আমরা মজা করে জ্যাক বলে ডাকি।
- ‘উঁহু।’ আমি মাথা নাড়ি। আর জ্যাক আমার দিকে একটু সন্দেহজনক দৃষ্টি ফেলে কফিকাপে শব্দ করে চুমুক দেয়।

আমি চুপ করে থাকি। জ্যাককে কিভাবে বলি, মাঝেমাঝে এমন সময় আসে যখন মনে হয় পৃথিবীটা একই সাথে ভয়ংকর সুন্দর এবং প্রচণ্ড বেদনায় ভরপুর। আর তাই, বারান্দায় দাঁড়ালে যখন আচমকা বিপুল বাতাসের ঢেউ এসে সমুদ্রের মতো আমার ওপর আছড়ে পড়ে, তখন আমি দু চোখ বন্ধ করে ফেলি। আজকাল এত দীর্ঘশ্বাস আসে থেকে থেকে, যে মনে হয় ঝড় উঠে যাবে আকাশে। গুমোট, গম্ভীর আর ভারী এই শ্বাসের ভার নিতে পারি না।

আমি কিভাবে ওকে বলি, মৌনতারা বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছে মাসখানেক হলো। আর আমি তবুও ঘুরেফিরে হেঁটে যাই তার বাড়ির সামনে। আর দাঁড়িয়ে থাকি। তবে এখন সম্ভবত আমি জানি যে, সেও জানে আমি হেঁটে যাচ্ছি। আর সম্ভবত তার সাথে আমার একটা গোপন প্রেম আছে। বাস্তবতায় নিয়ন্ত্রিত এবং ফ্যান্টাসিতে অনিয়ন্ত্রিত এক প্রেম। সেখানে জীবনানন্দ দাশের সোনালি ডানার গাংচিলের সাথে আবুল হাসানের সাদা চামেলি ফুলের দেখা হয়ে যায়। অবাস্তব লাগছে? হ্যাঁ, আমারও এমন লাগে।

- ‘সে তোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কোনো?’ জ্যাক আরেক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে আমার পাশে বসতে বসতে বলে। আমি প্রমাদ গুনি। নিশ্চয়ই এটা মৌনতার কাজ। বাড়ি বদলের পর থেকে আমি এখনো ওদের আগের বাড়ির সামনে নিয়মিত যাই এটা বোঝার পর সে অতিরিক্ত চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেই কিছু একটা জ্যাককে বলেছে, আর তাই সবসময় নিজের প্যাঁচানো দুনিয়ায় ব্যস্ত থাকা বন্ধুটি হঠাৎ করেই বেশ সময় দিচ্ছে আমাকে। এমন গ্যাঁড়াকলে পড়ে নিজেকে নিজেরই লাথি মারতে ইচ্ছে হয়।

কপিশপের বাইরের স্বচ্ছ কাচে ঘনিয়ে আসে ছায়া। আকাশে বেশ মেঘ করছে। বখাটে বাতাস রাস্তায়। ধুলা আর ছেঁড়া কাগজ অহেতুক উড়ছে এলোমেলো। আমি আনমনা হই আর জ্যাকের চেহারা ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমশ। আজকাল আমার তাকে নিয়ে ভাবতে আরো ভালোলাগে। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় সে ভীষণ কাছে। এই তো পাশে। চোখ খুললে হারিয়ে যায় সব। এমন তো মনে হয়নি আগে কোনোদিন, বরং আমি অনেকটাই ঠেকে শেখা ও টুকে নেওয়া একলা মানুষ। একটা সময় ছিল যখন শামুকের মতো খুব গুটিয়ে থাকতাম, কিন্তু এই কর্পোরেট কালচার আর সিজিআইতে ভরপুর সেলুলয়েড পৃথিবী আমাকে বদলে দিয়েছে অনেকটুকু। এ কারণে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নিহিলিস্ট হই। নিহিলিজম চর্চাই হবে আমার এগিয়ে যাওয়া। ‘নিহিল’ অর্থ যেমন ‘কিছুই না’ আমিও তেমন ‘কিছুতেই কিছু যায় আসে না’ ধরনের জগতে থাকব। তবে কোথাও যেন তবুও কী বাকি থেকে যায়, সে কারণেই আমি হয়তো নানা জায়গায়, নানা মানুষের মাঝে গল্প খুঁজে বেড়াই। তবে এই পৃথিবীর ৭,৭৮০ মিলিয়ন মানুষের মাঝে হুট করে উল্টা কেউ আমারই গল্পে চলে আসবে, আমার সাথে বসবাস করতে শুরু করবে তা ভাবতে পারি না। তাই যেখানে তার সাথে আমার তিন থেকে পাঁচ মিনিটের জন্যও কোনোদিন মুখোমুখি আলাপ হয়নি, তবুও কিভাবে তাকে নিয়েই এতকিছু ভাবছি, এই ভেবে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরে, ‘আমাদের মাঝে ক্লিক করলটা কোথায়?’

জ্যাকের দ্বিতীয় কাপ কফি চলে আসে। এবার দেখতে পাই আমার জন্য বাটারস্কচ আইসক্রিম অর্ডার করেছিল ও। ওয়াফেলের ভেতর থেকে মোলায়েম আইসক্রিম উঁকি দিয়ে বলে, ‘হাউডি!’ কফি হাতে নিয়ে স্মোকিং জোনের দিকে যেতে ইশারা করে ও। আমি ওর পিছু নেই। কী কী যেন বলতে থাকে, আমার কানে আসে না। না শুনেই মাথা নাড়ি।
- ‘তুই কোনো কথাই শুনছিস না তাই না?’ প্রায় ধমকে বলে ওঠে আমার সুদর্শন বন্ধু। আমি শূন্য চোখে তাকাই।
- ‘আমি তোকে বললাম, অফিসে এবার প্রমোশন লিস্টে আমার নাম আসেনি। তুই মাথা নাড়লি যেন এটা খুব স্বাভাবিক। বললাম, বাড়ি বদলাব, নতুন ফ্ল্যাট খুঁজছি, তুই উত্তর দিলি না। এরপর স্মোকিং জোনে আসতে আসতে বললাম, আমার বসের বউয়ের সাথে আমার ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড হয়েছে। মিড লাইফ ক্রাইসিসে ভোগা মহিলা এখন আমার পিছু ছাড়ছে না। এত চরম কথা শুনে তুই শুধুই মাথা নাড়লি। হয়েছেটা কী তোর?’
আমি থতমত খেয়ে যাই। প্রাণপণে মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে মনে মনে নার্সারির একটা হাস্যকর ছড়া কাটি,
“অল দ্য লিটল ফিশেস আর সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার
সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার,
সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার,
অল দ্য লিটল ফিশেস আর সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার
স্প্লিশ, স্প্লিশ, স্প্লিশ, স্প্লিশ, স্প্ল্যাশ”

অল্পক্ষণে ধাতস্থ হই। তারপর জ্যাককে শান্ত করার জন্য বলি, ‘আইসক্রিমটা দারুণ। আর ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড শুনলে আমি আগে ভাবতাম ছেলে-মেয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কিস করেছে। এখন বুঝি এর মাহাত্ম্য। তোর প্রমোশন কি এ জন্যই আটকে গিয়েছে?’

নির্মমভাবে নিজের গালের ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে ও বলে, ‘আসলে রাতে থাকিনি। ডিনারে গিয়েছিলাম শুধু। ডিনার থেকে অন্যকিছু হয়ে যেতে পারে বুঝতে পেরে এড়িয়ে চলে আসছি, কিন্তু মহিলা পিছু ছাড়ছে না। তুই আমার কথাকে পাত্তা দিচ্ছিলি না বলে চাপাবাজি করলাম, কিন্তু লাভ কী? তুই তো দেখছি মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা হয়ে আছিস। যাই হোক, আমি বের হব একটু পর। যাওয়ার আগে তোকে বাড়ির কাছে নামিয়ে যাব?’

আমি সবগুলো দাঁত বের করে মাথা ঝাঁকাই। খানিক পরেই অল্প বৃষ্টির মাঝে আমি ওর বাইকের পেছনে উঠে বসি।

- ‘সাবধানে বস। পড়িস না আবার।’ সিরিয়াস কণ্ঠে বলে জ্যাক। আর মিনিট দুয়েকের মাঝে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে শোঁ করে উড়ালপঙ্খীর মতো চলতে শুরু করে ওর বাইক। জ্যামের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাইকের এঁকেবেঁকে যাওয়া, সাথে প্রবল বাতাস, একটু আধটু বৃষ্টি আমার মনের গুমোট ভাব অনেকটুকুই দূর করে দেয়।

আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বুজি। সাথে সাথে এটাও খেয়াল রাখি যেন পড়ে না যাই। তবে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের কাছে পৌঁছাতেই আবার আনমনা হই। এখানের ছাতিম গাছটা কি আমার কথা রেখেছে? আমার কথা ভেবে বকুলের ঘ্রাণ সেই মানুষটার পিছু নিয়েছে তো? সে কি জানে, নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে আমি এখন এত কবিতা পড়ি, এত বই পড়ি যে মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। সারাক্ষণ পেছনে বাজতে থাকে নানারকম ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক। মনে হয়, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মোনালিসাকে ভুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে ঠা ঠা করে। আর এই স্টুপিড হৃদয় তার কথা ভাবতে ভাবতে আমার চোখে আনন্দের বাষ্প এনে দেয়। মনে হয় জাদুর শহর, প্রাণের শহর সব চাপাবাজি। ঢাকা নামের এই প্রাইভেসিহীন শহরে আমি এমন কোনো শূন্য রাজপথ খুঁজে পাব না যেখানে শুধু আমরা দুজন থাকব। তার একটা হাত তুলে এনে চেপে ধরতে পারব না আমার রাত জাগা শুষ্ক গালে। সবখানে শত শত মানুষ। আমরা পালাব কোথায়? তারপর আবার প্রশ্ন জাগে, একই রকম দেখতে দুই হাত, দুই পা, ২০৬টা হাড়, একটা হৃদয়, নাক, কান, গলা সমেত একধাঁচের মানুষদের মাঝে আমার কেন তার সাথেই একটা অলীক যোগসূত্র শুরু হলো? এই অতি পুরাতন কিন্তু আধুনিক, আধ্যাত্মিক ব্যাপার শুরু করল কে? আমি নাকি সে?

- ‘এখানে নামাই। বাকি পথটুকু হেঁটে যেতে পারবি নাকি রিকশা নিবি?’ আমার বাড়ির সামনের মূল সড়কে এসে জিজ্ঞেস করে জ্যাক। আমি বাস্তবে ফিরি। এক গাল হেসে বলি, ‘এটুকু পথ, হেঁটেই যাব।’
- ‘সাবধানে যা। আর আমি রাতে ফোন করে কথা বলছি আবার তোর বিষয়ে।’ চোখ পাকিয়ে বলে ও। আমি মনে মনে বলি, ‘নো ওয়ে।’ তবে মুখে বলি, ‘কল করিস। আমি রাতে জেগেই থাকি।’

মাথায় হেলমেট ঠিক করে একটা স্যালুট দেওয়ার ভঙ্গি করে বিদায় নেয় ও। আর খুব ধীর পায়ে আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। মূল সড়ক থেকে বাড়ি ফেরার এই পথটুকু আমার খুব চেনা, খুব আপন। বাড়ি থেকে ক্রমশ ফ্ল্যাটবাড়ি হয়ে ওঠা কৃত্রিম দালান, ওষুধের দোকানের পাশের নর্দমা, মুদি দোকানের অলস আনিস চাচা, একটা জারুল, দুইটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আর পিচঢালা মসৃণ অথচ সরু পথ আমার খুব পরিচিত। কত কত বছর ধরে এখানে আমি পায়ের ছাপ ফেলে যাচ্ছি। বাড়ি ফিরছি, বাড়ি ছাড়ছি। ওদের মতো করে এই শহরের আর কোনো পথ কি আমাকে চেনে? অবশ্য মৌনতাদের বাড়ি সামনের পথটুকু আজকাল আমাকে একটু একটু করে চিনতে শুরু করেছে। সে পথকে কি আমি প্রশ্ন করতে পারি, কেন দিনের খুব ক্ষণস্থায়ী কিছু মুহূর্তে আমার দেজাভু হয়? কেন মনে হয় তার সাথে আমার হয়তো পরিচয়টা আগেই ছিল। কথা হয়েছিল, দেখা হয়েছিল, কিন্তু আসলে তো এসব কিছু হয়নি। আমার মস্তিষ্কের ‘টেম্পোরাল লোব’ কেন আমার সাথে এমন বেইমানি করছে? কেন পৃথিবীর সব ফুলের রঙ আমার কাছে হয়ে যাচ্ছে তীব্র সুন্দর? কেন বহু দূরে অচেনা কোনো পাখি ডেকে গেলেও আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় প্রচণ্ড সচেতন হয়ে ওঠে? মধ্যরাতে ঝিঁঝিঁ পোকারা একসাথে কোরাস গাইতে শুরু করলে কেন ইচ্ছে হয় আমি ওদের মাঝে গিয়ে মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়ে থাকি? ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতে, আর ভাবি, ‘এই অবেলায় সে করছে কী?’ তারপর আবার মনে হয়, ‘আমাদের ক্লিক করল কোথায়? কিউপিড কি সত্যি আছে পৃথিবীতে?’

বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে একটা গাড়ি চলে যায় আমার পাশ দিয়ে। আর ঠিক তখনই ব্যাগে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। সম্বিৎ ফিরে আসে আমার। বাসা থেকে ফোন। কলটা ধরে মৃদু স্বরে বলি, ‘আর দুই মিনিট লাগবে।’

হাতঘড়ি দেখি। রাত প্রায় আটটা। এ সময় সেও কি বাইরে থেকে নিজের বাড়ি ফেরে? আবার এমন কি হতে পারে, আমার যা হচ্ছে তা হলো প্যারালাল ইউনিভার্সের সংঘাত। অর্থাৎ, আমরা এ জগতে অচেনা থাকার পোশাক পরে আছি আর অন্য জগতে একসাথে বইয়ের দোকানে খুব ঘুরছি। সে কারণেই তার প্রতি আমার এত টান। আমার ইচ্ছে করে সে যখন খাবার খাবে, আমি সেই খাবারের দারুণ কোনো স্বাদ হয়ে তার মাঝে থাকি। সে যখন প্রিয় গান শোনে, সেই গানের সুর হয়ে কানের ভেতর প্রবেশ করি। কিংবা, আমি তার কোনো বেদনার স্মৃতি হই। সে যখন কাঁদবে, সেখানে আমিই কারণ হব।

আবার মোবাইলটা বেজে ওঠে। আমি কলটা কেটে দিয়ে মাথা ফাঁকা করতে করতে দ্রুত পা চালাই।

নিজের ঘরে এসে ক্লান্ত লাগে খুব। কাঁধের ব্যাগ ছুড়ে ফেলি বিছানায়। তারপর সোজা চলে যাই শাওয়ার নিতে। অনবরত মাথার ওপর বৃষ্টির মতো ঝরে যাওয়া এই জলের সাথে আমার একান্ত সময়। এই সময়টা আমি সবচেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি সবকিছু থেকে। প্রতিটি জলের ফোঁটা আমার ক্লেদ, ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা মুছতে থাকে। দীর্ঘ সময় তাই অকারণেই ঝর্নার নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রায় মিনিট চল্লিশেক পর বের হই। হালকা লাগে ভীষণ। ডাইনিং টেবিল থেকে প্লেটে অল্প কিছু খাবার নিয়ে নিজের ঘরে চলে এসে একটা সিরিয়াল ছেড়ে দিই। আসলে ওটায় মন নেই শুধুই সফট নয়েজের জন্য চালিয়ে রাখা। আশা করছি জ্যাক রাতে ফোন করবে না, প্রাক্তন প্রেমিকা, অফিসের ক্যাচাল নিয়ে এমনিতেই সে সবসময় খুব চাপে থাকা মানুষ। আজ বহুদিন পর দেখা হলো, আগে প্রতি সপ্তাহেই আড্ডা হতো। সেই দিনগুলো হারিয়ে গেলেও বন্ধুত্ব ঠিকই টিকে আছে। জানি না মৌনতা আমাকে নিয়ে ঠিক কতটুকু বলেছে ওকে। তবে, আমার নিজের কথা কাউকে বলতে ভালো লাগে না। একদমই না।

এরচেয়ে মনে মনে তার সাথে কথা বলা ভালো। আমি কি তার সাথে কথা বলতে যাব? একদিন সরাসরি সামনে গিয়ে বলে বসব, ‘আমাদের কথা বলা উচিৎ।’ সে নিশ্চয়ই চোখেমুখে বিশাল বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে ফেলবে। আর আমাকে পালানোর পথ খুঁজতে হবে। নাকি কোনো পাঞ্চ লাইন দিয়ে জিজ্ঞেস করব, ‘হ্যালো, তুমি কি কোনো বিখ্যাত ব্ল্যাক কফি? তোমাকে ভাবলে তাহলে আমার ঘুম আসে না কেন?’ ছিঃ! খুব বাজে ছিল। এসব কেন ভাবছি? বাদ, সব বাদ। বরং পরিকল্পনা করি, আজকে আগে আগে ঘুমিয়ে যেতে চেষ্টা করব। তবে তা সম্ভব হয় না, আমাকে ভুল প্রমাণ করে, ঠিক মধ্যরাতে জ্যাক ফোন করে। ওর কলটা ধরব না ভেবেও ধরে ফেলি।

- ‘তুই কী কিছু বলবি আমাকে আর ওই বিষয়ে?’ ফোন করেই গম্ভীর স্বরে বলে জ্যাক।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি।
- ‘কিছু তো বল। হালকা লাগবে। ওই বিখ্যাত সিনেমাটা দেখিসনি, যেখানে প্রশ্ন করা হয় মানুষ নিজের গোপন কথা কাউকে বলতে না পারলে কী করবে? উত্তর দেওয়া হয়, শহরের শেষ প্রান্তের কোনো গাছের ভেতর গর্ত করে, সেখানে ফিসফিস করে নিজের মনের কথা বলে গর্তটা মাটিচাপা দিয়ে বন্ধ করে দিবে। তোর তো এত খারাপ দিন আসেনি। আমাকেই একটা গাছ হিসেবে ধরে নিয়ে কিছু তো বলতে পারিস।’ বলতে বলতে জ্যাকের কণ্ঠ নরম হয়ে আসে কিছুটা।
আমিও ঢোঁক গিলি, সময় নিই। তারপর বিড়বিড় করে বলি, ‘আমার রোজকার কাজে সে নিয়ত আসা-যাওয়া করতে থাকে।’
- ‘আর?’ প্রশ্ন করে জ্যাক।

আমি চুপ করে যাই। আর মনে মনে ভাবি, এভাবেই তাকে নিয়ে প্রাণপণে অভ্যস্ত হতে চেষ্টা করছি। যেভাবে আমি প্রথম অভ্যস্ত হয়েছিলাম যখন আমাকে মাইনাস পাওয়ারের চশমা নিতে হয়েছিল। আগে আমি ভাবতাম চশমা একটা কদাকার বস্তু, মানুষের চোখ হবে বাহুল্য ছাড়া। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, চশমাটা আমার চেহারায় মানিয়ে গেল। গত পনের বছরে সেই বাহুল্যকে আমি আপন করে নিয়েছি। তবে আমার চশমা আমাকে পীড়া দেয় না। সে দেয়। আমার খালি মনে হয় সেও আমাকে দেখে, খালি দেখে। সে কি অন্যজগতে আটকা পড়া মানুষ? কথা বলতে পারে না? তবে সে কথা বলতে আসলে হয়তো আমি ইশারায় বলতাম, ‘সসসসস...’ তারপর তার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম কয়েক ঘণ্টা। আমাদের হয়তো তখন কথা হতো, কিন্তু হতো না কোনো শব্দ। এমন যোগাযোগ চলত যা শুধু আমরাই শুনতাম।

- ‘ হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস? কথা বলছিস না কেন?’ ফোনের অন্যপাশ থেকে ডাকতে থাকে আমার চিন্তিত বন্ধু। আমি তবুও চুপ করে থাকি।
- ‘আমার সাথে কথা বল। মৌনতা আমাকে সব বলেছে। এসব ফ্যান্টাসি থেকে বের হয়ে আয়।’ ঠান্ডা স্বরে বলে ও।
- ‘কী বলেছে?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি আমি।
যা বলার বলেছে, ‘তুই হয় আমাকে সব বলে নিজেকে হালকা কর। নয়তো মাথা থেকে সব ঝেড়ে দে। এসব কিছুই নেই।’
- ‘নেই মানে?’ খেই হারিয়ে ফেলার মতো প্রশ্ন করি আমি।
- ‘নেই, এমন কোনো মানুষ নেই। ও বাসাটা খালি। বহুদিন থেকেই। মৌনতা আগেই বলেছে তোকে, তুই একাই নানাকিছু ভেবে যাচ্ছিস। এসব তোর নিজের প্যারাকজমের প্যারা। নিজের কল্পজগত। বাদ দে। আমি জানি চেষ্টা করলেই পারবি।’

আমার মাথায় উঠে যায় ঝড়। একটা তুমুল কালো মেঘময়, বিষণ্ণ ঝড়। সেই ঝড়ে জ্যাকের কথা আবছা হয়ে আসে। আমি শুধু ভাবি, আমার আজকাল খুব ঘুম পায়, কিন্তু শান্তিমতো ঘুমাতে পারি না। সেকি শিশুর মতো ঘুমায়? আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করি এবং বুঝি, যে যাই বলুক, বোধ থেকে বোধের, সুর থেকে সুরের আর ঠিক-বেঠিকের সীমারেখা পেরিয়ে যে গাঢ় সবুজ মাঠ আছে, সেখানে তার সাথে আমার যোগসূত্র। সে আমাকে দেখেছে কিন্তু আসলে শুধু আমাকে দেখেনি, সে আমার ভেতরের বইটার হার্ড কভারে হাত বুলিয়ে পড়ার জন্য পাতা উলটে ফেলেছে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত লকারে রেখে দেওয়া সেই বই কেউ দেখে ফেলেছে বুঝতে পেরে আমি ভেতরে ভেতরে থতমত খেয়ে কেঁপে উঠেছি। আমি তার হাত ধরতে চাই চাহিদা থেকে না, তার সাথে যোগাযোগ করতে, অনুভব করতে। কপালের সাথে কপাল ঠেকাতে চাই চিন্তাগুলো ছড়িয়ে দিতে। একটা মন্থর, স্পন্দিত নদীর মতো।

- ‘হ্যালো... তুই ঠিক আছিস? কথা বল প্লিজ।’ জ্যাক আবার ডেকে যায়।

আমি কিছুই শুনি না। হ্যাঁ, হয়তো ওরা ঠিক। আসলে হয়তো তার সাথে আমার কিছুই নেই। আসলে এই পৃথিবীতে সে নেই। মৌনতার উল্টা দিকের বাসাটা বরাবর খালিই ছিল। সেখানে গেলে সবাই হয়তো দেখতে পাবে, ‘ভাড়াটিয়া চাই’ নামে ঝুলছে বিবর্ণ কোনো সাইনবোর্ড। এইসব আমার ঘুণে ধরা মস্তিষ্কের ‘প্যারাকজম’। আমার লিখতে না পারা ভালোবাসার ১০০ সনেট। আমার আশ্চর্য সাম্রাজ্য, সুখী ফানুস। তাতে কী? আমার জন্য তো এসব সত্যি। ভীষণ সত্যি। আর তাই এই প্রত্যাখ্যাত হবার খালি খালি ভাব নিয়ে যখন আমি হাওয়ায় ভেসে যাওয়া কোনো বিষণ্ণ শুকনো পাতার মতো উড়তে থাকি, তখনই জেনে যাই আমাদের মাঝে যোগসূত্রটা আসলে কোথায় এবং কিভাবে। জেনে যাই, বনভূমি লোকালয় থেকে কেন এত দূরে থাকে। হ্যাঁ, ঠিক সে কারণে, সেই একই কারণে সে আর আমি পাশাপাশি থাকি; কাছাকাছি থাকি…

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমাকে আমার কাছের কেউ বারবার ডেকে যায়। আমি উত্তর দিই না। বরং, দূরের কারো জন্য আমি সবকিছু ছেড়ে তার সাথেই জলের মতো ঘুরতে থাকি।