সিয়েরভা মারিয়ার স্মৃতি

অপাঠ্য ভ্রমণ



এনামুল রেজা
গ্রাফিক : বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

গ্রাফিক : বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

শহুরে সন্ধ্যার অনেকগুলো নিজস্ব আলো আছে। লালাভ, উজ্জ্বল ছাইবর্ণ, সবুজ। প্রায় অভ্যেসে পরিণত হয়ে যাওয়া নিত্য জীবনে সেই আলোর দিকে আলাদা করে তাকাবার অবসর মেলে কই? আজ তাই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে কাঁপতে থাকা নগরী যখন দিবস শেষের ক্ষীণ আলোটুকুতে ঝিমুচ্ছে, আকাশের দিকে চেয়ে মনে হলো, বেশ, এমন গাঢ় নীল কি হয় কোনো কোনো সন্ধ্যা?

প্লাস্টারবিহীন ছ’তলা-চারতলা দালানগুলোর শরীরে ঝরে পড়ছে নীলের গুঁড়ো, একটু একটু করে আঁধার হচ্ছে চারধার। নীল থেকে কালো হবে পৃথিবী। মিরপুর সি ব্লকের বাস্তুহারা গলিটা দিয়ে আমি মুসলিম বাজারের দিকে যাচ্ছি। আম্মার জন্য পান কিনব। দেখলাম ঘোলাটে নীলাভ আলোয় ঘাড় কাত করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে একটা কুকুর। ঘিয়ে হবে গায়ের রঙ। ও কাছাকাছি আসতে আমি থেমে গেলাম। লুঙ্গিতে নাক ঠেকিয়ে কিছু শুঁকতে চেষ্টা করল কুকুরটা। তারপর যেখান থেকে এসেছিল সেই পুরনো আমলের মিরপুরীয় একতলা টিনশেড ঘরটার দিকে চারপায়ে তেরছা ভঙ্গিতে ফিরে গেল, লোহার বন্ধ দরজার সামনে থাবা গেড়ে বসে ধুঁকতে লাগল জিভ বের করে।

পান কিনতে কিনতে মনে হলো, শৈশবে এমন সামান্য একটা ঘটনারও ক্ষমতা ছিল আমার কয়েক রাতের ঘুম শুষে নেবার। কুকুরভীতি ছিল আমার, কুকুর কামড়ে দিলেই নিশ্চয়ই জলাতঙ্ক হবে। যে প্রাণঘাতী অসুখে আস্ত একটা মানুষ কুকুরে রূপান্তরিত হয়। পানির তৃষ্ণায় চিৎকার করে, কেউ পানি এগিয়ে দিলেই ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে আর আশপাশে যাকেই পায় আক্রমণ করে। গ্রামসূত্রে আমার এক চাচার বউ অমন অসুখে মারা গিয়েছিলেন। কোন এক বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কুকুরের কামড় খেয়েছিলেন সেই চাচী, কেউই গুরুত্ব দেয়নি। অনেকে ধারণা করেছিল, কামড়ের মাস দুয়েক পরেই জলাতঙ্ক থাবা গেড়ে বসেছিল তার শরীরে। মৃত্যুর বহুদিন পরেও যাকে নিয়ে আলাপ করত সবাই। গ্রামে নতুন করে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল নিরীহ গোবেচারা কুকুরের দল।

মুসলিম বাজার থেকে ঘরে ফিরেও কুকুর ও জলাতঙ্ক বিষয়ক ভাবনা মন থেকে সরল না। বরং মনে হলো, সিয়েরভা মারিয়ার স্মৃতি এখনো সতেজ আছে আমার হৃদয়ে। দিন কয়েক আগেই পড়ে শেষ করেছি মার্কেসের উপন্যাস ‘প্রেম ও অন্যান্য দানব’ (১৯৯৪ সালে এসপানিওল থেকে Edith Grossman কৃত ইংরেজি অনুবাদ হওয়া বই, বাংলা অনুবাদক আলী আহমদ)

মানুষের পৃথিবীতে কে আসল দানব? ছোট্ট বইটায় এ প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল শব্দের পর শব্দে। উপন্যাসটির শুরু হয় র‍্যাবিজ আক্রান্ত এক কুকুরের কামড় থেকে। অমন গল্পে ঘোর তৈরি না হবার কোনো কারণ আসলে নেই।

পড়তে পড়তেই দেখতে পাওয়া যায় আঠারশো শতকের সেই সমুদ্রলাগোয়া জনবহুল বন্দর শহরটি। দাস বেচাকেনা হচ্ছে। বহু আকাঙ্ক্ষিত দাসবাহী এক জাহাজের অনেকেই মারা গিয়েছে অজ্ঞাত কারণে, সেসব মৃত নিগ্রো আর তাদের প্রভুদের ফুলে ওঠা দেহ ও দূষিত রক্তে লাল হয়ে উঠেছে সমুদ্রের জল। ওসবের মাঝখানেই নিজের দ্বাদশতম জন্মদিন উপলক্ষে কেনাকাটা করতে আসা সিয়েরভা মারিয়াকে দেখতে পেলাম, উন্মত্ত একটা কুকুর আরো তিনজন মানুষসহ তাকেও কামড় দিল। বাজার ভর্তি লোকজন দেখল ক্ষীয়মান তবু ক্ষমতাশীল এক জমিদারের কন্যা সিয়েরভা মারিয়ার এই দুর্ঘটনা। র‍্যাবিজ আক্রান্ত কুকুরের কামড়ে বাকি তিনজন একে একে মারা গেলেও সিয়েরভা মারিয়ার কিছু হলো না, কোনো অসুখের চিহ্নই দেখা দিল না তার মধ্যে। মধ্যযুগের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো শহরবাসী, প্রবল প্রতাপশালী চার্চ, যে দুজন নর-নারীর ঘৃণাজর্জর সঙ্গমে মেয়েটির জন্ম, তারা সবাই কি এই অস্বাভাবিক সুস্থতা মেনে নিতে পারবে?

২.
লেখকের অন্যান্য বইয়ের মতোই কাহিনীটা বলা হচ্ছে উঁচু থেকে। নইলে একটা গ্রামোফোন রেকর্ডে বেজে চলেছে দূরবর্তী এক রহস্যময় পুরুষকণ্ঠ। যিনি পড়ে যাচ্ছেন এমন এক কিশোরীর শোকগাথা, যার লালচে ঝাঁকড়া চুল জন্মের পর আর কাটা হয়নি। বড় হতে হতে যে বিস্ময়কর চুলের রাশি মাটি ছুঁয়েছে, যার মা জন্মের পর থেকেই তাকে ঘৃণা করেছে, মেয়েটা বড় হয়েছে কৃতদাসদের তত্ত্বাবধানে, তাদের সঙ্গেই। সমাজের চোখে মানুষ বা মানুষের চোখে সমাজ, দুটোই দুটির কাছে যে বন্দী, তার নিদারুণ জলরঙ আঁকতে চেষ্টা করে এই উপন্যাস।

সময়টা আঠারশো শতক, এ তো আগেই বলেছি। সিয়েরভা মারিয়ার বাবা একজন মার্কিস বা জমিদার। যদি সমাজের শীর্ষস্থানীয় একজন লোকের মেয়ে জলাতঙ্কে মারা যায়, গোটা শহরের কাছে পরিবারটি অপমানিত হবে ও ছোট হয়ে যাবে, এই তাদের ধারণা। সম্মান ধরে রাখতে অনেক কিছুই করতে হয় মার্কিসকে, অথচ এমন নয় যে কিছু না করে থাকাটা অসম্ভব ছিল তার পক্ষে।

প্রথমত, মার্কিস চিকিৎসকের কাছে যান গোপনে। জানতে পারেন কুকুরে কামড়াবার কয়েকদিনের মধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে ভিকটিমেরা। একে একে মারাও গিয়েছে সবাই। এমনও হতে পারে সিয়েরভা মারিয়ার হবেই না জলাতঙ্ক। চিকিৎসক আব্রেনুনসিওর কথাতে ভরসা মেলে না তার। ধীরে ধীরে মার্কিসের সুস্থ মেয়েটিকে প্রায় অসুস্থ করে তুলতে চায় স্থানীয় চিকিৎসক ও কবিরাজের দল। কেন এই মেয়েটি অসুস্থ হচ্ছে না? কুকুরের কামড়াবার পর অবশ্যই জলাতঙ্ক হবার দরকার ছিল তার, যেহেতু তা হয়নি, শহরের মানুষেরা বিশ্বাস করতে শুরু করে দীর্ঘ চুলের রহস্যময় কিশোরিটি স্বাভাবিক কেউ না, নিশ্চয়ই সে একটা অশুভ শক্তি বা অশুভ কোনো কিছুই তার ওপরে ভর করেছে। এমন অবস্থাতেই কাহিনীতে প্রবল বিক্রমে প্রবেশ করে চার্চ। বিশপ। নান। কনভেন্ট।

৩.
লেখক হিসেবে মার্কেস তার চরিত্রগুলো কিভাবে নির্মাণ করেছেন?
এখানে স্বভাবতই লোকটা ব্যবহার করেছেন তার চিরচেনা কৌশল। চরিত্রগুলোকে অনবরত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের খণ্ডখণ্ড গল্প। উপন্যাসের একমাত্র প্রগতিশীল চরিত্র আব্রেনুনসিও। এই চিকিৎসক শহরটিতে কিংবদন্তি এবং চার্চ ও স্থানীয় অন্যান্য চিকিৎসকেরা তাকে শত্রু মনে করে। এর পেছনে কারণ হিসেবে আমরা জানতে পারি রোগী কখন মারা যাবে তার ঠিকঠিক ঘোষণা দেন আব্রেনুনসিও। তিনি এমন একটা ট্যাবলেট আবিষ্কার করেন যেটা খেলে সারা বছর সুস্থ থাকা যায়। কিন্তু সেবনের প্রথম কয়েকদিন রোগী হয়ে যাবে উন্মাদ। যে কারণে ওই বিদঘুটে ট্যাবলেট আব্রুনেনসিও নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই খাওয়াতে পারেন না।

সিয়েরভা মারিয়া যাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে এলো, সেই মার্কিস আর তার দ্বিতীয় স্ত্রী বের্নাদা-র পটভূমি প্রায় নারকীয়। যার রেশ পুরো উপন্যাস জুড়েই চলতে থাকে, আমরা অনুমান করতে পারি কেন বের্নাদা নিজের জন্ম দেওয়া কন্যা সন্তানকে এত ঘৃণা করেন, আর মার্কিসই বা কেন নিজের মেয়েকে স্বাভাবিক ভালোবাসাটুকু দিতে না পারার যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত দগ্ধ হন।

আরো পড়ুন ➥ গেরাসিম কেন মুমুকে হত্যা করে?

পিতা-মাতার ঘৃণ্য দাম্পত্য জীবনের পাশাপাশি আমাদের সামনে উন্মোচিত হয় চার্চের গ্রন্থাগারিক কায়েতানো দেলাউরার সঙ্গে সিয়ের্ভা মারিয়ার প্রেম। চার্চ মনে করে কনভেন্টে বন্দী মারিয়ার ওপর ভর করেছে এক দানব, আর সেই দানব তাড়ুয়া হিসেবে নিয়োগ পায় দেলাউরা। চরিত্র হিসেবে দেলাউরা নিজের অর্জিত বিবেক আর নিয়তির সঙ্গে অনবরত সংগ্রামরত এক যুবক। সম্ভবত চিকিৎসক আব্রেনুনসিওর পর এ উপন্যাসে সে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র। ছত্রিশ বছর বয়সী এ যুবক একই সঙ্গে যুক্তিবাদী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। দুটি বিষয়ের একটা চিরন্তন দ্বন্দ্বে প্রতি মুহূর্তে বিধ্বস্ত হতে থাকে সে। ধর্মে বিশ্বাসী যে হৃদয় নিয়ে সে ভাবে প্রেম হলো আদিমতম পাপ, আবার প্রেমের সুতীব্র তাড়না তাকে করে তুলতে চায় বিদ্রোহী, হয়তো করেও তোলে শেষের দিকে?

আর সিয়েরভা মারিয়া? সে বুনো একটা ঝড়ের মতো। মিথ্যে বলার ওস্তাদ। সৌন্দর্যে অলৌকিক। ক্রীতদাসদের সঙ্গে বড় হয়ে উঠবার কারণে যে কোনো স্বাভাবিক আদপ-কেতা জানে না, বড়দের শত্রু মনে করে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়েও মেয়েটা ভালোবাসার কাঙাল। তাকে মনে হয় প্রকৃতির একটা বন্য শক্তি, প্রাণের উৎস। বয়স যাকে বড় করে তোলে প্রতিদিন, আর সৌন্দর্য করে তোলে রহস্যময়। যে রহস্য তার আশপাশের কেউই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না।

৪.
প্রেমের গল্পের আবরণে হয়তো মার্কেস কুসংস্কারের কুড়ালে ছিন্নমস্তক সব হতাভাগ্য মানুষের গল্পই করতে চেয়েছেন ছোট আকারের এই আখ্যানে। নর-নারীর প্রেম, গুরু-শিষ্যের প্রেম, জ্ঞানের সঙ্গে জ্ঞানীর প্রেম।

প্রত্যেকটি প্রেমের গল্পেই আমাদের এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, প্রেমই কি সেই দানব যা মানব জীবনকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়? নাকি আসল দানবেরা লুকিয়ে আছে মানুষের মাঝেই, যারা প্রেমের মতো স্বর্গীয় ব্যাপারটিকে চিরকাল অপবিত্র করতে চেয়েছে, ধ্বংসের পক্ষ নিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছে?

পুরাতন শিষ্য কায়েতানোকে কুষ্ঠরোগীদের হাসপাতালে পাঠান বিশপ, প্রেম হেরে যায়। চার্চের আদেশে প্রিয় কন্যাকে কনভেন্টে পাঠান মার্কিস, প্রেম হেরে যায়। কিন্তু দেলাউরা আর সিয়ের্ভা মারিয়া? তাদের প্রেমের পরিণতি চিরন্তন। সেখানে কল্পনার কোনো আশ্রয় নিতে হয় না।

৫.
সবশেষে তাহলে কী অবশিষ্ট থাকে? নিখাদ গল্পই। চার্চ তার পূর্বেকার ক্ষমতা হারায়। প্রাচীন সেই কনভেন্ট পরিণত হয় হাসপাতালে, তারপর যা ভেঙে তৈরি হবে সুপার মার্কেট।

এক তরুণ সাংবাদিক কনভেন্টের নিচে ঘুমিয়ে থাকা অজস্র কঙ্কালের মাঝে আবিষ্কার করেন সিয়েরভা মারিয়াকে, যাকে সময় পুরোপুরি গিলে নিতে পারেনি, রয়ে গেছে তার আগুনরঙা ও শতাব্দীর দীর্ঘতম চুলের বহর। কবর খুঁড়তে থাকা আবেগহীন শ্রমিকদের ফোরম্যান সাংবাদিকটিকে জানান, ‘সে কি আপনি জানেন না? মৃত্যুর পর প্রতি মাসেই তো মানুষের চুল এক সেন্টিমিটার করে বাড়ে?’

যা নেই তাকে ফিরিয়ে আনতে মানুষ অনন্ত সংগ্রাম করে। আর যা আছে, তাকে বিলুপ্ত করতেও মানুষের প্রচেষ্টা তুলনাহীন। কথাগুলো অনবরত মাথার ভেতরে শাফল হয় আর সুদূর দ্বীপের হতভাগ্য রাজকন্যা সিয়েরভা মারিয়ার জন্য আমার মন কেমন করে।

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;