তদন্ত চালু আছে
উৎসর্গ আগা শাহিদ আলী
কবি পরিচিতি ও ভূমিকা
ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান কবি কল্পনা সিংহ-সিতনিশ পেশাদারী জীবনে এক সময় ছিলেন অভিনেত্রী, মডেলিংও করেছেন কিছুকাল, ফিল্মের পরিচালক এবং প্রযোজক হিসাবেও আছে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি। শিল্পকলায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৪ সালে রাজীব গান্ধী গ্লোবাল এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড দ্বারা সন্মানিত হন। তাঁর জন্ম ভারতের বিহার রাজ্যে, পড়াশোনা করেন প্রথমে ভারতের মগধ বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং পরে নিউ ইয়র্ক ফিল্ম একাডেমিতে। ‘চান্দ কি পরিভান্দ’ নামক কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি রাজ্যসভা পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪ সাল থেকে কবি স্থায়ীভাবে বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
উপস্থাপিত সাতটি কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরের শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত মানুষের জীবনযাপন। কবিতায় নক্সাকৃত চরিত্ররা সকলেই সীমান্তে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার শিকার, বাস্তুহারা হয়ে এরা আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থীদের জন্য সাময়িকভাবে তৈরি ছাউনিতে। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘তাফতেশ জারি হ্যায়’ বা ‘তদন্ত চালু আছে’ শিরোনামের কাব্যগ্রন্থ থেকে পদাবলিগুলো চয়ন করা হয়েছে। নির্বাচিত সাতটি কবিতা কবি স্বয়ং হিন্দি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। বাংলায় ভাষান্তরের সূত্র ইন্টারনেট।
এক.
ওখানে পড়ে থাকা বৃক্ষের কাণ্ডে
বসে আছে যে মা
তার নাম বললে চিনবে না তেমন কেউ,
ইনি হচ্ছেন সেই নারী—
যার পুত্রটিকে বৈদ্যুতিক করাতে
কেটে কেটে হত্যা করা হয়েছে,
শরণার্থী শিবির ছাড়া অন্য কোনো
পরিচয় বা ঠিকানা নেই তার।
দুই.
বাড়িঘর, গেরস্থালী উষ্ণ করার উনুন
ও তন্দুরে আধ-সেঁকা রুটি ফেলে
যে রাতে তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিল—
কে তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছিল
বাড়ি ছাড়ার ঠিক আগের রাতটিতে?
তারপর থেকে অন্য কারো জন্য
কেন তারা খোলেনি দরোজা কিংবা জানালা?
আমাদের কাছে ঘটনাটি খুলে বলারও আগে—
কেন তারা তাদের মেয়েগুলোর
চোখে সরাসরি চোখ রেখে তাকাতে পারছিল না,
সে থেকে এখন অব্দি?
একটি চেনার বৃক্ষ উপড়ে পড়ে
সৃষ্টি করেছে কর্কশ আওয়াজ
তারা কিন্তু কখনোই বলতে পারবে না
সমস্ত কিছু—
যা তারা আসলেই বলতে চায়.. ..।
তিন.
তাদের স্মৃতিতে চিত্রার্পিত হয়ে আছে
তাদের ঘরবাড়ি,
আর একমাত্র যে ফুলটি
ফুটেছিল পেছনের আঙিনায়,
যে রাতে তারা পালিয়েছিল—
একটি খাটিয়া উঠানে পড়ে
ভিজছিল বৃষ্টিপাতে।
তাদের স্মৃতিতে বাঙ্ময় হয়ে আছে
দৈনন্দিন কথাবার্তা, সংলাপ ও হাস্যরোল
এবং মিঠে রোদ,
এছাড়া অন্য কিছু তারা
সাথে করে নিয়ে আসতে পারেনি,
তাদের শিশুগুলো বাইরে মাঠে খেলছিল
তারা আর ফিরে যেতে পারেনি
তাদের বসতভিটেয়,
অই দিনের পর—
উপত্যকায় যখন তুষার গলে গলে
পথরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠছিল!
চার.
তারা শিকড়ে বিস্ফোরক গুঁজে দিয়ে
তা আলগা করে দেয় তাদের ভূমি থেকে,
আমি ভাবি, ফিসফিসিয়ে কী বলছিল
তাদের কানে,
আর বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল
তাদের ভূমি থেকে।
তুষারঝড়ে আক্রান্ত হয় উপত্যকা
বিক্ষত হয় বিপুলভাবে চেনার বৃক্ষরাজি
পতিত চেনার গাছগুলো এখন যাবে কোথায়?
পড়ে থেকে থেকে বিশুষ্ক হবে তারা
জ্বলে ওঠবে তাতে অগ্নি একদিন
এ বিষয়টা আমরা জানি,
আমরা এটাও জানি যে,
তাদের পোড়া ছাই ফিরে যেতে চাইবে
শুধু তাদের নিজস্ব উপত্যকায়।
পাঁচ.
ছোট্ট বালিকাটি
খেলছিল তার তাঁবুর বাইরে,
যদিও আমরা অজস্রবার
তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি
সে আসেনি আমাদের কাছে।
সে চকিতে ছুটে যায় তার তাঁবুতে
আর দাঁড়িয়ে থাকে দোরগোড়ায়,
দরোজার দড়িটির দুই দিকে
শক্ত হাতে মুঠো করে,
এমনভাবে দড়ি ধরে দাঁড়িয়েছে যে—
মনে হয়—সে আর কাউকে
তার ঘরে ঢুকতে দেবে না,
মুখগুলো সে শনাক্ত করতে পারে না,
এ আগন্তুকরা তার নতুন ঘরটি
ধূলিস্মাত করতে পারবে না আর।
ছয়.
যারা খোলা-দিলে ওখানে
আমাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছে,
মনে হয়—জয় করে নিয়েছে
তারা সকল ভয়,
পাইন বৃক্ষের মতো সুঠাম
এবং খোলের ভেতর
আখরোটের নরোম শ্বাসের মতো
অই পুরুষগুলো!
সাত.
কনে এসেছে ঘরে
সামান্য কয়েক পা হেঁটে
এক তাঁবু থেকে অন্য তাঁবুতে,
যারা গতকাল অব্দি
একে অপরকে চিনত না,
আজ তারা একত্রে
গাইছে বিয়ের গান,
সামান্য সময়ের জন্য
বিস্মৃত হয়েছে
পর্বত থেকে গড়িয়ে পড়া পাথরের শব্দ,
কনের রাত,
চাপুছিতে বলকানো
জাফরানের মতো।