লীসা গাজীর গীতল কবিতা
আমার কাব্য-প্রচেষ্টা কেবলই সুরের সংস্পর্শ খোঁজে, আকুল থাকে গীত হবার। কবিতা-কি-গান যখন ভর করে তখন কোনো একটা বিশেষ পরিচয়ে ধরা দেয় না, একাকার হয়ে হয়ে আসে। কাব্য আর গীতের মধ্যকার যে আরোপিত দ্বন্দ্ব তার থোড়াই তোয়াক্কা করে। লেখার পরে মনে হয় শরীর তো হলো, সুর পেলে যেন প্রাণ পায়। আমার লেখা কিছু গীতল কবিতা! — লীসা গাজী
শাড়ি বন্দনা
লাল আঁচলে চাবি ঘুরে এ ঘর থেকে ও ঘর
সময় তখন ছোট্ট মেয়ে শাড়ির হয়নি বছর
একপ্যাঁচা থেকে কুঁচি শাড়ি শত শতাব্দী পাড়ি
কত রঙে শাড়ি পিন্ধন কন্যা মনোহারি
কুঁচিতে নাম লেখা, আঁচলে পরিচয়
কিচ্ছা তুমি বলো শাড়ি যার যেমন হয়।।
বারো-হাতের-তের-কাহন গাই শাড়ির স্তবগান
ধর্ম গেল শাড়ির ভাঁজে উল্টা মুখের জবান
“বন্ধ করো বেপর্দা এই শাড়ির বিস্তার”
শুনে চিন্তে ঠায় অবাক আবহমান বাংলার সংসার
জমিনে গল্প-গাঁথা, আঁচলে পরিচয়
কিচ্ছা তুমি বলো শাড়ি যার যেমন হয়।।
আঁচল-গিঁঠে পয়সা বাঁধা সাত রাজার ধন
মায়ের গন্ধ শাড়ির ভাঁজে দোয়ার মতো আপন
পুরান শাড়ি, নরম শাড়ি কাঁথার মধ্যে বাস
আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে রাখে মায়ার নির্যাস
বুননে প্রাণ-নক্সা, আঁচলে পরিচয়
কিচ্ছা তুমি বলো শাড়ি যার যেমন হয়।।
[এই কথাগুলি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে ব্রিটিশ বাংলাদেশী ব্যান্ড ‘ক্ষ’-র সোহিনী আলম এবং অলিভার উইক্স। ‘ক্ষ’-র দ্বিতীয় অ্যালবামে গানটি স্থান পাবে।]
জানি না
মন ক্যানো ঘাস হয়ে যায়
চোখ ক্যানো চোখেই হারায়
এই দিন ক্যানো রাতের মায়ায়
রোজ ক্যানো হাওয়া বদলায়
জানি না
ঢেউ ক্যানো বালিতে লুটায়
মাটি ক্যানো আত্মা জাগায়
প্রেম ক্যানো তৃষ্ণায় জল
আয়নায় তোমার আদল
তুমি ক্যানো মৌন নিখিল
স্মৃতি ক্যানো জোছনায় নীল
পায়ে পায়ে পথের মিছিল
মিশে ক্যানো ভুল ঠিকানায়
জানি না
আঁধি ক্যানো রাতের প্রিয়
হাত ধরে আমারে নিও
তুমি ক্যানো জটিল খেলা
জলসায় আমি একেলা
রুহ ক্যানো নাম জপে যায়
সুখ ক্যানো শুধু আঙ্গিনায়
উঁকি দিয়ে ফের চলে যায়
তবু ক্যানো আসে না বাসায়
জানি না
[কথা কয়টি সঙ্গীতশিল্পী লাবিক কামাল গৌরবের সুর-সংযোজনায় গান হয়ে উঠবার অপেক্ষায় আছে।]
রূপা
রূপা রূপা রূপা রূপা রূপা
রূপা রূপা শতরূপে রূপা
হায় রে বুকখান ছিঁড়া যায় নি দেখি
রূপা রূপা শতরূপে রূপা
রূপা রূপা রূপা রূপা রূপা
আকাশ নি ছাই ভাইঙ্গা নামে
রোদন সাঁইসাঁই দিনে
গোড়মুখি কাল মাতমরত
পাষাণ কানে কানে
হায় রে বুকখান ছিঁড়া যায় নি দেখি
রূপা রূপা রূপা রূপা রূপা
রূপা রূপা শতরূপে রূপা
চক্ষু আন্ধা দুনিয়া আন্ধা
আন্ধা বান্ধা গীত
একখান দুইখান কয়খান রূপা
জবাব প্রশ্নাতীত
হায় রে বুকখান ছিঁড়া যায় নি দেখি
রূপা রূপা রূপা রূপা রূপা
রূপা রূপা শতরূপে রূপা
[মধুপুরে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে নিয়ে লেখা।]
সময়
সময়ে সকলই বদলায়
চায়ের কাপের মালিক বদলায়
বন্ধু বদলায়
বন্ধুর চেহারা বদলায়
সময়ে জেনো সকলই বদলায়
সময়ে সকলই মানায়
কাঁচা বয়সের দম্ভ মানায়
স্বপ্ন মানায়
স্বপ্ন-বুকে দিক-শূন্য বৈঠা মানায়
সময়ে জেনো সকলই মানায়
সময়ে সকলই সয়ে যায়
চুলের ঢেউয়ে রুপালি সয়ে যায়
অপ্রেম সয়ে যায়
অপ্রেম ক্লিষ্ট জীবন সয়ে যায়
সময়ে জেনো সকলই সয়ে যায়
সময়ে সকলই বিলীন
অরণ্য পথে জ্যোৎস্না বিলীন
তুমি বিলীন
তোমার মোহন রূপের অর্থ বিলীন
সময়ে জেনো সকলই বিলীন
সময়ে সকলই নিরুদ্দেশ
শত শতাব্দীর নদী নিরুদ্দেশ
মায়া নিরুদ্দেশ
মায়াময় চোখের স্পর্শ নিরুদ্দেশ
সময়ে জেনো সকলই নিরুদ্দেশ
সময়ে সকলই সরল
গরল সম্পর্কের আদল সরল
জীবন সরল
বহুরঙ্গা জীবনের অনুবাদ সরল
সময়ে জেনো সকলই সরল
সময় সকলই উল্টায়
দাগি শাসকের বিচার উল্টায়
ইট উল্টায়
ইট-চাপা ঘাসের গল্প উল্টায়
সময় জেনো সকলই উল্টায়
সময় সকলই সামলায়
ভিসুভিয়াসের আগুন সামলায়
মানুষ সামলায়
মানুষের বেদনা সামলায়
সময় জেনো সকলই সামলায়
তারাবাত্তি জ্বলে
তারাবাত্তি জ্বলে রে তারাবাত্তি জ্বলে
মানুষ নামের কলে রে তারাবাত্তি জ্বলে
তারাবাত্তি ঢলে রে তারাবাত্তি ঢলে
মন যমুনা তলে রে তারাবাত্তি ঢলে
তারাবাত্তি জ্বলে, হাউই উইড়া চলে
মানুষ নামের কলে রে তারাবাত্তি জ্বলে
উথাল পাথাল নীলা রে পুঞ্জ পুঞ্জ সুখ
অতল ঢেউয়ের খেলা রে, বানে ভাসে বুক
সাতমহলা বাড়ি তার কুঞ্জে গুঞ্জে পাখি
জিগান মালিক নাই রে হুদাই হাঁকাহাঁকি
আট বেহারা পাল্কি রে হুহুম স্বরে ডাকি
তারাবাত্তি ঘরে রে জিগান মালিক নাকি!
তারাবাত্তি জ্বলে, হাউই উইড়া চলে
মানুষ নামের কলে রে তারাবাত্তি জ্বলে
তারাবাত্তি ঢলে রে তারাবাত্তি ঢলে
মন যমুনা তলে রে তারাবাত্তি ঢলে
তারাবাত্তি জ্বলে রে তারাবাত্তি জ্বলে
মানুষ নামের কলে রে তারাবাত্তি জ্বলে।।
[সঙ্গীতস্রস্টা মৌসুমী ভৌমিকের সুর-সংযোজনায় এবং গায়কীতে তারাবাত্তি গান ‘রাইজিং সাইলেন্স’ ছবির ভাব-সঙ্গীত হিসাবে ব্যবহৃত হয়।]