অর্থ-বিত্ত নয়, বিদ্যা ও সুকুমার কলাই ছিল সুনীলের উপাস্য
বেঁচে থাকলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের [জন্ম:৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪-মৃত্যু: ২৩ অক্টোবর ২০১২] বয়স হতো ৮৫ বছর। মৃত্যুর পরেও তার প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত। জনপ্রিয়তা ও পাঠক-পছন্দের দিক থেকে তিনি পেয়েছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য।
বাংলাদেশের মাদারীপুরের সন্তান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে আছেন। গদ্য, পদ্য ও অন্যান্য রচনা সম্ভারে তিনি অর্জন করেছেন নিজস্ব জায়গা।
সাহিত্যের দরবারে বহুজন তৎপর হলেও কালোত্তীর্ণ লেখক খুব বেশি আসেন না। একই ভাষার লেখক হলেও সবার দাপট সর্বত্র সমান থাকে না। সব লেখক সর্বত্র গ্রাহ্য হবেন, এমনও নয়। সব লেখকের সীমানা সমান হয় না। হুমায়ূন আহমেদ বা সুনীল সীমানা ভেঙেছিলেন। নিজের মতো করে তারা সীমানা বানাতে পেরেছিলেন। আকাশের ঔদার্য নিয়ে তারা বাংলা সাহিত্যের অসীমান্তিক দিগন্ত গড়েছিলেন।
বহুমাত্রিক, সৃষ্টি-প্রবল সুনীল সীমানা ভেঙে নিজের বিশাল সীমান্ত রচনা করেছিলেন। সুনীল কলকাতায় বসবাস ও সাহিত্যচর্চা করলেও তার লেখায় অন্যতম উপজীব্য হয়েছে ভূতপূর্ব পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ। মাদারীপুরের কালকিনির মাইজপাড়ার জন্মের টানেই তিনি সেটা করেছেন। বাকিটা জীবন টেনেছেন কলকাতার স্মৃতি। এই করতে গিয়ে বাংলার দুই পারের মানুষকেই তিনি তার সাধ্য মতো ধরতে চেষ্টা করেছেন।
সাহিত্যে কেরামতি তিনি আরও দেখিয়েছেন। বিষয়কে ধরতে পারা, ভাষাকে নাচিয়ে দেওয়া সুনীলের এক মহৎ গুণ। এ কারণেই তিনি ঈসা খাঁ বা লালনকেও ছাড়েননি। রবীন্দ্রনাথ ও প্রিন্সেস রানু মুখার্জিকেও ‘রানু আর ভানু’তে নিয়ে এসেছেন। এভাবেই সুনীল পরিণত হন জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক চরিত্রে।
কলকাতার শেরিফের পদও লাভ করেন তিনি। একজন অভিবাসী ও উদ্বাস্তু লেখকের জীবন-সংগ্রামের এমন অনবদ্য, হৃদয়গ্রাহী, সংগ্রামী সাফল্যের উপাখ্যান দেশান্তরী কমিউনিস্ট, আক্রান্ত ইহুদি বা ফিলিস্তিনি লেখক ছাড়া বিশ্বসাহিত্যে সচরাচর দেখা যায় না। এই সাফল্য তিনি আর্থিক বা রাজনৈতিক পথে নয়, পেয়েছেন জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে।
তিনি যে আগাগোড়াই জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর আনুকূল্য নিয়েই থাকতে চেয়েছিলেন, অর্থ-বিত্ত নয়, বিদ্যা ও সুকুমার কলাই ছিল তার উপাস্য, শেষ উপন্যাসে বিধাতা তাকে দিয়ে সেই জীবন সত্যটিই ব্যক্ত করালেন। বিদ্যাদেবী তার ভক্ত সুনীলকে মরণেও পায়ের কাছেই ঠাঁই দিয়েছেন।
যদিও ব্যক্তিগত, তবু উল্লেখ করি, ঠিক যে রাতে (২৩ অক্টোবর) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন মারা যাচ্ছেন, আমি তখন সে বছরের (২০১২) শারদীয় দেশ-এ প্রকাশিত তার উপন্যাস ‘সরস্বতীর পায়ের কাছে’ পড়ছি। সকালে মৃত্যু সংবাদ পড়ে আমি বিমূঢ়। আবার চোখ বুলালাম তার সর্বশেষ উপন্যাসটিতে।
ঔপনিবেশিক আমলের প্রেক্ষাপটে মাদারীপুর অঞ্চলের আবহে এক ব্রাক্ষণ পরিবারের বিদ্যার্থীর অভিবাসী-জীবন-সংগ্রামের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে উপন্যাসটিতে। আগেও তিনি মাদারীপুর-ফরিদপুর অঞ্চল এবং প্রাচীন ব্রাক্ষণ সমাজের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন। এ উপন্যাসে তিনি বিদ্যার্জন ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহের যে প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেটা অনন্য।
উপন্যাসে একটি বাড়ি পালানো নব্য-যুবক মেট্রিক পাস করার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্য চায়। গ্রামে গ্রামে ঘুরে অবশেষে সেই সাহায্য মিললো কলকাতার বেশ্যাপল্লীর একটি প্রায়-বন্দি জীবনে। অধ্যবসায় শেষে ছেলেটি তার গ্রামের প্রথম মেট্রিক পাস হিসাবে গণ্য হলো। শিক্ষার সংগ্রামে সে হারালো পুরনো প্রেমিকা, যৌবনের দাবি এবং ভোগের উপাচার।
তবু সে সার্থক, তৃপ্ত। উপন্যাসের এক পর্যায়ে পালানোর পথে স্টিমারের অন্ধকার এক প্রকোষ্ঠে একটি ভাঙা মূর্তির পা চেপে ধরেছিল ছেলেটি। সে তখন বুঝতে পারেনি, সেটি লক্ষ্মী না সরস্বতী। কিন্তু না বললেও বোঝা যায়, পুরো উপন্যাস জুড়েই সুনীল সরস্বতীরই আরাধনা করেছেন।