কাশ্মিরের ছোটগল্প

ক্ষতচিহ্ন



মুস্তাক আহমদ মুস্তাক
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

অনুবাদ : ফজল হাসান

সিঁড়ি ঝাড়পোছ করার জন্য পিয়ারী এই নিয়ে তিনবার উপরে গিয়েছে। কিছুক্ষণ বসে থাকার জন্য ইতোমধ্যে সেখানে লালা সায়েব নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। পিয়ারীর চোখেমুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠে। সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে লালা সায়েবের দিকে তাকায়, কিন্তু একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। ভীষণ রাগে পিয়ারী ফুঁসতে থাকে। লালা সায়েব ধীরেসুস্থে বসেন। এরই মধ্যে বিকেলটা পশ্চিমে ঝুলে পড়েছে এবং ছায়া এসে ঢেকে দিয়েছে আঙিনা। সূর্যের মলিন আলোয় বাগানের একমাত্র ডালিম গাছের ঝোপের মাথা জ্বলজ্বলে দেখাচ্ছে। সবুজতা ছাড়া এবং পুষ্পবিহীন বেচারা বাগানটা দেখতে একগোছা শুকনো ও মরা ডালপালার মতো লাগে।

বাগানের মধ্যে ক্ষতচিহ্নের মতো দেখতে ডালিম ঝোপের জঞ্জাল কেটে ফেলার জন্য পিয়ারী অনেকবার তার স্বামীকে বলেছে। কিন্তু লালা সাহেব তাদের থামিয়েছেন। লালা সায়েবের সঙ্গে পিয়ারীর প্রায় প্রতিটি বিষয়ে, বিশেষ করে শীর্ণ-জীর্ণ ও শুষ্ক ডালিম গাছের ঝোপ নিয়ে, কথা কাটাকাটি হয়। তারপরও তারা একই বাড়িতে বসবাস করে।

কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে লালা সায়েব পেনশনে আছেন। অবসর নেওয়ার পরে প্রথম দিকে তিনি অফিসের কাছাকাছি সময়ে বাইরে বের হতেন। ঘরের মধ্যে অনেক ধরনের কাজকর্ম সেরে তিনি খবরের কাগজ পড়ার জন্য গ্রন্থাগারে যেতেন। এছাড়া তিনি নাপিতের দোকানে গল্পগুজব করে সময় কাটাতেন এবং সকল আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতেন। অনেক সময় রান্নাঘরে স্ত্রীর কাজেও সাহায্য করতেন। একদিন তার স্ত্রী দেহত্যাগ করে এবং তিনি ‘শর্করা রোগ’-এ আক্রান্ত হন। তাঁর জীবনে এমন এক সময় আসে যখন তিনি আশেপাশে হাঁটাচলা করতে পারেন না, এমনকি পেনশন তুলতেও যেতে পারেন না। তিনি হয় ঘরের মধ্যে বিশ্রাম করেন, নতুবা নির্বিকার বসে গভীর ভাবনায় নিমগ্ন থাকেন। মনের মধ্যে সামান্য পরিবর্তন আনার জন্য মাঝে মাঝে টেলিভিশন দেখেন। যখন কোনো কিছুই ভালো লাগে না, তখন তিনি বারান্দায় বসেন এবং ডালিম গাছের ঝোপের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন।

রোদের বিবর্ণ আলোয় লালা সায়েবের ক্ষণস্থায়ী ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছিল যে শুকনো ডালিম গাছে পুনরায় পাতা ধরবে এবং লাল ফুলে আবার সয়লাব হয়ে উজ্জ্বল দেখাবে। তাঁর মনে পড়ে, ত্রিশ কিংবা পঁত্রিশ বছর আগের দৃশ্য। তখন তাঁর মাটির ঘরের চারপাশে ডালিম ফুলে ভরা থাকত। তিন কন্যা সন্তানের জন্মের পরে ছেলের জন্ম হওয়ার সুবাদে বাড়িতে আনন্দ-উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর সেই শিশু ছেলে স্কুলে যাওয়ার আগে বড় বোনদের সঙ্গে একই ডালিম বাগানে দৌড়াদৌড়ি করত। বোনেরা ছোট ভাইকে শাহজাদাহ্ (রাজকুমার) বলে ডাকত।

লালা সায়েব এবং তাঁর স্ত্রীর মনে হতো তারা দু জনেই জীবনের সমস্ত সুখ-শান্তি পেয়েছেন এবং সবটুকু আনন্দ উপভোগ করেছেন। তাঁদের কোনো কিছুতেই অভাব ছিল না, এমনকি কোনো ব্যাপারে তাঁরা নিঃসহায়ও ছিলেন না। দিনে দিনে শাহাজাদাহ্ বড় হতে থাকে। যেখানে ডালিম গাছের ঝোপ ছিল, সেখানেই লালা সায়েবের ভাইয়েরা নতুন বাড়িঘর তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ডালিম গাছ কেটে ফেলে।

প্রথমে সাবা লালা নিজের জন্য বাড়ি তৈরি করেন। তারপর বাড়ি নির্মাণ করেন গোলাম রসুল এবং সব শেষে লালা সায়েব। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পরে লালা সায়েবের কাছে যা অর্থকড়ি অবশিষ্ট ছিল, তা দিয়ে তিনি পাকা বাড়ি তৈরি করেন। তার কারণ ছিল, শাহজাদা যেন চাচাত ভাইবোনের তুলনায় কখনোই নিজেকে গরীব না ভাবে।

বাড়ি তৈরি করার সময় প্রায় সবগুলো ডালিম গাছ কাটা হয়। বর্তমানে ডালিম ঝোপের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা বাড়ির সীমানার একপাশে। লালা সায়েবের স্ত্রী দেখভাল করার কারণে বর্তমানের গাছগুলো কাটা হয়নি। কংক্রিটের দেওয়ালের পাশে থাকা সত্ত্বেও গাছগুলো প্রতিবছর ডালপালা গজিয়ে তরতাজা হতো। কিন্তু লালা সায়েবের স্ত্রী স্বর্গের পথে যাত্রা করলে গাছগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যেতে থাকে।

লালা সায়েব অথৈ ভাবনার গভীরে হারিয়ে গেলে তাঁর চোখ আটকে থাকে শুষ্ক ডালিম গাছের ঝোপে। অকস্মাৎ পিয়ারী ঘরের ভেতর টেলিভিশন চালু করে। তখন সন্ধ্যার খবর হচ্ছিল। লালা সায়েব খবর শুনে চমকে ওঠেন যখন তিনি স্পষ্ট শুনেছেন, ‘মানবতার কারণে আজ দুইশ যুবককে চাকুরি দেওয়ার হুকুম জারি করা হয়েছে।’

‘তাহলে শেষপর্যন্ত সরকার একটা কিছু করার পদক্ষেপ নিয়েছে। আল্লাহ যদি সহায় থাকেন, তাহলে আমাদের শাহজাদাহ্ জীবনে সুস্থির হতে পারবে’—লালা সায়েব স্বগোক্তির মতো করে বললেন। একটু থেমে তিনি আপনমনে আরো বললেন, ‘বৃদ্ধ বয়সের প্রতিটি দিনই পাহাড়ের মতো ভারী মনে হয়। এখন আমি অন্য দুনিয়ায় যেতে চাই। কিন্তু সে কী করবে? সে একটা দোকান শুরু করেছে, কিন্তু কোনো সাফল্য নেই। আমি খুশি যে, সে আমার পেনশন থেকে সামান্য অর্থকড়ি নিয়ে কোনোভাবে চলছে। আমি আশাকরি সে শীঘ্রই একটা চাকুরি পাবে। তাহলে আমি শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারব।’

এসব ভাবনা-চিন্তা মাথায় নিয়ে লালা সায়েব পুনরায় শুষ্ক ডালিম ঝোপের দিকে তাকান। গোধূলির আলো প্রায় নিভে গেছে। লন এবং সারিবদ্ধভাবে লাগানো ফুলগাছের সঙ্গে জরাজীর্ণ ডালিম ঝোপের শুকনো অংশ সত্যি বেমানান লাগছিল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে তিনি দেওয়ালে ভর করে উঠে দাঁড়ান এবং শোবার ঘরে প্রবেশ করেন।

একটু পরে পিয়ারী এসে তাঁকে ঔষধ খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করে। লালা সায়েব ঔষধ সম্পর্কে কিছুই বললেন না, বরং তিনি পিয়ারীকে জিজ্ঞেস করলেন সে খবর শুনেছে কি না।

‘তারা বলেছে যে, সরকার দুইশ যুবককে চাকুরি দেওয়ার হুকুম দিয়েছে’—পিয়ারী বলল। বলার সময় তার কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠে।
‘তাহলে তুমি শাহজাদাহকে বলছো না কেন যে সে কিছু অর্থকড়ি রোজগার করে এবং নিজের জীবন শুরু করে। সেটা আমার মৃত্যুকে সহজ করে দিবে’—লালা সায়েব খুবই ভীত গলায় বললেন।
‘কীসব আজেবাজে বলছেন? এই অশান্ত সময়ে যারা আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছে, দুইশ চাকুরি তাদের জন্য’—মুখ ঝামটা দিয়ে বলল পিয়ারী। তারপর সে আরো বলল, ‘আলতামাশ, শাহজাদাহ্’র বন্ধু, আপনি ওকে চেনেন, চাকরির নিয়োগপত্র পেয়েছে। আপনি তো জানেন, ওর বাবা পেনশনের টাকা তুলতে ব্যাংকে যাচ্ছিলেন এবং পথেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আলতামাশ শুধু চাকুরিই পায়নি, তার সঙ্গে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লক্ষ রুপিও পেয়েছে’—বলেই পিয়ারী আরেকবার মুখ ঝামটা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

পিয়ারীর কথা শোনার পরে লালা সায়েবের সারা শরীরে ঠান্ডা ঘামের স্রোত বয়ে যায়। তিনি রীতিমতো স্তম্ভিত, হতবাক। তিনি অনুভব করতে শুরু করেন যে, কয়েকজন ক্রুদ্ধ লোক কুঠার নিয়ে এসে শুষ্ক ডালিম গাছের ঝোপ কেটে পরিষ্কার করছে।

সমকালীন কাশ্মিরী সাহিত্যের অন্যতম লেখক মুস্তাক আহমদ মুস্তাক। তিনি একজন ছোটগল্প লেখক। এছাড়াও তিনি কাশ্মিরের একজন প্রসিদ্ধ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয় ছোটগল্প সংকলন ‘দ্য স্কার’-এর জন্য তিনি ২০১৮ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমির ‘শ্রেষ্ঠ গল্পগ্রন্থ’ পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প সংকলন এবং প্রকাশের পরপরই পাঠক সমাজে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর জন্য তিনি ২০১৪ সালে ‘জম্মু ও কাশ্মির অ্যাকাডেমি অব আর্ট, কালার এবং লেঙ্গুয়েজ’ থেকে কাশ্মিরের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প সংকলন পুরস্কার অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি শ্রীনগরে বসবাস করেন এবং সেখানে রেডিও কাশ্মিরের আঞ্চলিক সংবাদ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে পেশাগতভাবে নিয়োজিত আছেন।

‘ক্ষতচিহ্ন’ গল্পটি মুস্তাক আহমদ মুস্তাকের ‘দ্য স্কার’ গল্পের অনুবাদ। কাশ্মিরী ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন প্রফেসর শাফি শৌক। ইংরেজিতে গল্পটি ‘কাশ্মির লিট’ সাহিত্য ম্যাগাজিনে (৩০ জানুয়ারি ২০১৯) প্রকাশিত হয় এবং বাংলায় অনুবাদের জন্য সেখান থেকেই নেওয়া হয়েছে।

   

আলো অচেনা



কামাল হোসেন টিপু
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

তুমি কি গো সে
হেমন্তের রাতে চলে গেছে যে!
হিজলের তলে কেন আনমুখী
রয়েছ বসে আজ একাকী?

অনেক সুখের ছিল দিনগুলো সেই,
তার কিছু আছে মনে, কিছু নেই!
অনেক মায়ায় মাখা দিনগুলো
অভিমানে সবই হারালো?
তার কিছু বুঝি আজ পড়েছে মনে
তাই কি গো এলে এতো পিছনে?

আঁধারে যার রাজত্ব রোজ
তার কাছে পাবে কি আলোর খোঁজ?
অশ্রু যে ঝরাও আজ এতো
মূল্য কী পাবে তার ততো?
কতই-বা দীর্ঘ তোমার অশ্রুনদী
সইতে কী পারবে, নদী আমার দেখ যদি?

দেখ, শেষ হয়ে এলো গোধূলি বেলা
আরো কিছু পরে নামবে সন্ধ্যা খেলা।
আলোর যেটুকু রয়েছে বাকি
তারে সাথে লয়ে যাও ডাকি;

রাত্রির সব রঙ অচেনা তোমার
হারাবে পথ, পথে আবার
আঁধার ভীষণ কালো, অন্ধকার
সে নহে তোমার যোগ্য উপহার

;

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সময়ের লড়াকু বুদ্ধিজীবী



আজফার হোসেন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আজীবন বিরাজমান নিপীড়ক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে গেছেন। আর ওই ব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই, অর্থাৎ মানুষের মুক্তির স্বার্থেই তিনি তাঁর লড়াকু প্রশ্ন ও চিন্তাকে অন্যের কাছে নিয়ে গেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। আমি মনে করি, এটাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাজে-চিন্তায় শুধু চিন্তাই থাকে না, প্রশ্ন কেবল প্রশ্নেই থাকে না, সেগুলো হয়ে ওঠে মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের হাতিয়ারও।

২৩ জুন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৯তম জন্মদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে তিনি ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। প্রথমে তাঁকে দেখেছি দূর থেকে, তারপর দেখেছি শ্রেণিকক্ষে, যেখানে তাঁর একেকটি বক্তৃতাকে মনে হতো একেকটি মহাকাব্যিক ঘটনা, যার সম্পূর্ণ তাৎপর্য বুঝে ওঠার ক্ষমতা তখনো অর্জন না করলেও পরিষ্কার বুঝতাম যে আমার এই অসাধারণ বাগ্মী শিক্ষক শুধুই বলেন না, দেখানও। আর বিষয়কে একই সঙ্গে সহজ ও সুন্দর করে উপস্থাপনও করেন, যেখানে তাঁর নিজস্বতা সব সময় স্পষ্ট হয়ে থাকে। দেশে ও বিদেশে আমি নিজেই ইংরেজি সাহিত্য পড়েছি এবং পড়িয়েছি। অবশ্যই বলতে হবে যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো মনীষাসম্পন্ন ও প্রতিভাবান ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক খুব কম দেখেছি। কিন্তু এখানে শুধু শিক্ষক হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রশংসা করা আমার উদ্দেশ্য নয়; বরং তাঁর কাজের সমগ্রকে বিবেচনায় রেখেই এই রচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁর বিশাল কর্মকা-ের দু-একটি তাৎপর্য সামনে আনতে চাই।

ইংরেজি সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষক তো বটেই, তিনি একাধারে সংস্কৃতি সমালোচক, সমাজ বিশ্লেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক, ইতিহাসবেত্তা, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কলামিস্ট, সম্পাদক, অ্যাকটিভিস্ট, সংগঠক। এমনকি তিনি কিশোরদের জন্য গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখেছেন বিস্তর। তাদের জন্য বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদও করেছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা একশত ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে তাঁর অসংখ্য অসংকলিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ-রচনা। অর্থাৎ প্রায় সারা জীবন তিনি ক্লান্তিহীনভাবে লিখে চলেছেন। তাঁর অপ্রতিরোধ্য লেখনীশক্তি তাঁর তারুণ্যকে চিহ্নিত করে রেখেছে এই বয়সেও।

পরিষ্কার যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনেক এলাকায় বিচরণ করেছেন। তবে বিষয়ের বিবেচনায় তাঁর কাজের বড় এলাকা হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য। কার্ল মাকর্সের প্রিয় প্রবচন ছিল, ‘যা কিছু মানুষের তা আমার অনাত্মীয় নয়।’ কথাটা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজের ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যবহার করা যাবে। বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন যে বুদ্ধিজীবী কেবল বিশেষজ্ঞ নন, সব ব্যাপারেই আগ্রহ তাঁর। হ্যাঁ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শুধু বিশেষজ্ঞ নন, চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে তিনি বুদ্ধিজীবী। জোর দিয়েই বলা দরকার তাঁর সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে যে পরিচয় স্পষ্ট হয়ে থাকে, তা হচ্ছে বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর পরিচয়। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবী। আর বুদ্ধিজীবী বলেই তিনি দায়বদ্ধ। সেই দায় দেশের ও দুনিয়ার মেহনতি মানুষের প্রতি, যার পক্ষে তিনি তাঁর চিন্তায় ও কাজে, লেখায় ও কথায়, লড়ে গেছেন আজীবন। এভাবেও বলা যায়, তাঁর লেখা ও লড়াইয়ের মাঝখানে কোনো বিভাজন রেখা নেই।

বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে বিশ শতকের বুদ্ধিজীবীরাই লিখেছেন তাঁদের দায় ও দায়িত্ব নিয়ে। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যাবে ইতালীয় মাকর্সবাদী আন্তোনিও গ্রামসির কথা; আরো বলা যাবে পরবর্তী সময়ের নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড সাঈদের কথা। এঁরা সবাই তাঁদের মতো করেই লড়াকু, প্রতিরোধী, দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবীকে আলাদা করে দেখেছেন বিশেষজ্ঞ ও এমনকি সনাতন বুদ্ধিজীবী থেকে। এই ঐতিহ্যেই আমাদের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও লিখেছেন বুদ্ধিজীবীর দায় ও দায়িত্ব নিয়ে, তাঁর একাধিক রচনায়। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর অসাধারণ প্রবন্ধ ‘বুদ্ধিজীবীদের কাজকর্ম ও দায়দায়িত্ব’। এই প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন যে বুদ্ধিজীবী তিনি, যিনি মানুষের মুক্তির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ বলেই বিরাজমান নিপীড়ক ও আধিপত্যবাদী ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেন সেই ব্যবস্থাকে বদলাবেন বলেই; তিনি ক্ষমতাকে দাঁড় করিয়ে দেন সত্যের মুখোমুখি। শুধু তা-ই নয়, তিনি তাঁর লড়াকু চিন্তাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতেও সচেষ্ট থাকেন নিরন্তর।

বুদ্ধিজীবী নিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এসব চিন্তা তাঁর নিজের কাজের বেলায়ও খাটে বটে। তিনি আজীবন বিরাজমান নিপীড়ক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে গেছেন। আর ওই ব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই, অর্থাৎ মানুষের মুক্তির স্বার্থেই তিনি তাঁর লড়াকু প্রশ্ন ও চিন্তাকে অন্যের কাছে নিয়ে গেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। আমি মনে করি, এটাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাজে চিন্তা শুধু চিন্তাই থাকে না, প্রশ্ন শুধু প্রশ্নই থাকে না, সেগুলো হয়ে ওঠে মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের হাতিয়ারও।

কিন্তু কোন ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী? এখানেও তিনি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেন বিরাজমান ব্যবস্থাকে। বলা দরকার, স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা শুধু তাঁর অনন্ত পাঠযোগ্য গদ্যের শৈলীগত বৈশিষ্ট্যই নয়, তা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রশ্নও। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজ বারবারই প্রমাণ করে যে শৈলীর প্রশ্নও রাজনৈতিক প্রশ্ন। সরাসরি যাঁরা বিরাজমান ব্যবস্থাকে স্পষ্ট করে চিহ্নিত করতে পারেন না, তাঁরা তো কোনো না কোনোভাবে ওই ব্যবস্থার পক্ষেই অবস্থান নেন। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথার চরকিবাজিতেও যাঁরা সত্য বলতে চান এবং ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতে চান, তাঁরা আসলে সত্যের প্রতি অবিচারই করেন এবং পরোক্ষভাবে হলেও বিরাজমান ব্যবস্থার পক্ষেই থাকেন। এঁদের বিপরীতে দাঁড়িয়েই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিরাজমান ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করে এসেছেন দীর্ঘসময় ধরেই। এসব ব্যবস্থা হচ্ছে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ/উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পিতৃতন্ত্র/পুরুষতন্ত্র।

স্পষ্ট করেই বলা দরকার যে আমাদের সময়ের প্রধান পুঁজিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, উপনিবেশবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও পিতৃতন্ত্রবিরোধী লড়াকু লেখক ও বুদ্ধিজীবীর নাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি মনে করেন যে এসব নিপীড়ন ও শোষণের ব্যবস্থাকে বদলানো ছাড়া এবং সেগুলো থেকে মুক্তি ছাড়া জনগণের মুক্তি সম্ভব নয়। এও স্পষ্ট করে বলা দরকার যে তাঁর প্রায় সব কাজের কেন্দ্রে থাকে জনগণের মুক্তির প্রসঙ্গ, যে কারণে বিপ্লবী রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে অংশগ্রহণ অক্ষুণœ থেকেছে আজীবন। আর এই বিপ্লবী রাজনীতি মানে শুধু বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিরোধিতা করা নয়, তার অর্থ পক্ষাবলম্বনও। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্পষ্টত সমাজতন্ত্রের পক্ষে। সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার অটুট থেকেছে আজীবন, যিনি মনে করেন, সত্যিকার গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। সমাজতন্ত্রী বলে তিনি গণতন্ত্রীও; গণতন্ত্রী বলেই তিনি সমাজতন্ত্রীও।

সমাজতন্ত্র নিয়ে বস্তাপচা ভুল ধারণার আধিপত্যের সময়ে এবং তথাকথিত বামপন্থিদের সুবিধাবাদের এই দুঃসময়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের অনেকের জন্য নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণা। আর যাঁরা সমাজতন্ত্রী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে না চেনে বা সেই পরিচয়কে বাদ দিয়ে তিনি যে কত ভালো শিক্ষক বা কত ভালো লেখক এই প্রশংসায় গদগদ করেন, তাঁরা আসলেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রতি অবিচার করেন বলেই আমি মনে করি। আর গ্রামসির মতোই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর কাজের ভেতর দিয়েই বুঝিয়ে দেন যে আমরা কোন বিষয়ের ওপর জোর দিই আর কোন বিষয়ের ওপর দিই না, কোন বিষয়কে উহ্য রাখি আর কোন বিষয়কে যুক্ত রাখি, তা রাজনৈতিকভাবে বা মতাদর্শিকভাবে মোটেই নিরীহ বা নিরপেক্ষ নয়।


ফিরি জনগণের মুক্তি প্রসঙ্গে, যা আগেই বলা হয়েছে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজের কেন্দ্রীয় বিষয়। শুধু বিষয়ই নয়, নিরিখও বটে। অর্থাৎ জনগণের মুক্তির নিরিখেই তিনি সাহিত্য সমালোচনা করেন, সংস্কৃতিকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেন, সমাজকে বিচার-বিশ্লেষণ করেন, যেমন তা করেন রাজনীতির ও ইতিহাসের পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও। এসব প্রসঙ্গে পরে ফেরা যাবে। তবে ওই প্রশ্নটা এখন তোলা জরুরি : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্য জনগণ কারা? সবাই তো জনগণের নামে কথা বলতে চান। আমাদের শাসক শ্রেণি জনগণের নামে কথা বলে, ব্যবসায়ীরাও জনগণের নামে কথা বলেন, এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও জনগণের নামে কথা বলে থাকে। উদারনৈতিক মানবতাবাদের ঐতিহ্যেও ‘জনগণ’ বা ‘মানুষ’ কথাটা বারবার ফিরে আসে মানবপ্রেমের নামে, যে প্রেম আমরা দেখেছি, বিরাজমান অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক বা অসম শ্রেণি-লিঙ্গ-বর্ণ-জাতি সম্পর্ককে ধোঁয়াশা করে থাকে। বলাই বাহুল্য, এই উদারনৈতিক মানবতাবাদ জনগণের বিপ্লবকে ভয় পায় এবং সে কারণেই তার কোনো সম্ভাবনাকে সে প্রশ্রয় দেয় না।

ঠিক এই ধারার বিপরীতেই ‘জনগণ’কে বা ‘মানুষ’কে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ফাঁকা বুলি হিসেবে না নিয়ে উদারনৈতিকতাকে শুধু তুমুল সমালোচনাই করেন না; তিনি বিভিন্ন রচনায়; বরং জনগণকে বা মানুষকে দেখেন বিরাজমান অসম উৎপাদন-সম্পর্ক ও ক্ষমতা-সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে; তাঁদের দেখেন তিনি শ্রেণি-লিঙ্গ-বর্ণ-জাতির অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের নিরিখে, যাতে সাম্যবাদী বিপ্লবী রাজনীতির স্বার্থেই বিরাজমান অসমতাকে চিহ্নিত করা যায় এবং তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। অন্য কথায়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্য ‘জনগণ’ বা ‘মানুষ’ তারাই, যারা বাংলাদেশে ও বিশ্বে অধিকাংশ মানুষÑযারা শোষিত ও নিপীড়িত, যারা পুঁজি ও সাম্রাজ্যের সবচেয়ে নির্মম শিকার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই জনগণ হচ্ছে কৃষক, শ্রমিক, নারী, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা। সিরাজুল ইসলাম এঁদের পক্ষেই আজীবন লিখেছেন, বলেছেন, লড়াই করেছেন। কেননা তিনি বুঝে গেছেন এবং বুঝিয়েও দিয়েছেন যে এদের মুক্তি ছাড়া মানবতার সার্বিক মুক্তি সম্ভব নয়।

মুক্তির বিষয়টা কেন্দ্রীয় বলেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য নিয়ে প্রচুর লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমাদের জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের অর্জনগুলোকে চিহ্নিত করেই অনেকের আগেইÑসেই সত্তরের দশক থেকেই বলে এসেছেন যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অসমাপ্ত। এ কারণে ১৯৯৩ সালে জাহানারা ইমাম এক কথোপকথনে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজ আমাদের দিকনির্দেশনা দেয় এবং আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে। আমরা জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ঘোষিত নীতি ছিল।

সেগুলো হলো সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সেই প্রথম দিককার বই নিরাশ্রয় গৃহী (১৯৭৪) থেকে শুরু করে তাঁর স্বাধীনতা স্পৃহা ও সাম্যের ভয় (১৯৮৮)-এর ভেতর দিয়ে বিচ্ছিন্নতায় অসম্মতি (২০১৪) পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে মুক্তিযুদ্ধের ওই তিনটি ঘোষিত নীতি কখনো হয়ে উঠেছে সরাসরি বিষয়বস্তু এবং প্রায়ই থেকেছে বিচার-বিবেচনার লিপ্ত নিরিখ। এদিক থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে একজন সার্বক্ষণিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও গণ্য করা চলে।


সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথমত ও প্রধানত বাংলাদেশের লড়াকু বুদ্ধিজীবী বলেই বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের সমস্যা ও সংগ্রাম তাঁর অসংখ্য রচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পিতৃতন্ত্র ছাড়াও তাঁর প্রিয় বিষয় হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। এখানে তাঁর জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত ধ্যানধারণার বিশদ মূল্যায়ন পরিসরের স্বল্পতার কারণে সম্ভব নয়। তবে অবশ্যই বলা যাবে যে তিনি আমাদের সময়ে জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক। তিনি যেমন ঐতিহাসিক কারণে জাতীয়তাবাদের ভেতরে ক্ষেত্রবিশেষে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও উপনিবেশবাদবিরোধী উপাদান শনাক্ত করেছেন, তেমনি তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের সমালোচনাও করেছেন, এটা বুঝিয়ে যে সব জাতীয়তাবাদ এক ধরনের নয়।

কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আন্তর্জাতিকতাবাদীও। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনা বিপ্লব, কিউবার বিপ্লব, ভিয়েতনামের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুক্তির লড়াইসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াই নিয়েও লিখেছেন তিনি। প্রমাণ করেছেন যে বিপ্লব ও সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা ব্যতিরেকে বিপ্লবী রাজনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পথ শনাক্ত ও প্রশস্ত করা সম্ভব নয়। তবে শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ স্পষ্ট হয়ে থাকে, যেমন তা থাকে ইংরেজি সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তাঁর বিস্তর আলোচনায়। এ ক্ষেত্রে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেছেন বটে।

এবার তাঁর কাজের বিষয় নিয়ে আরো কয়েকটা কথা বলে নেওয়া যাক। আগেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে অসংখ্য বিষয় নিয়ে লিখেছেন তিনি। এখানে তাঁর কিছু প্রিয় বিষয়বস্তুর একটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া যেতে পারে এভাবেÑবাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি, সাম্য ও স্বাধীনতা, বামপন্থী রাজনীতি, বিপ্লবী রাজনীতি, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পিতৃতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন, সমাজ ও সংস্কৃতি, শ্রেণি ও সাহিত্য ইত্যাদি।

যদিও বর্তমান রচনার প্রধান বিষয়বস্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাহিত্য সমালোচনা ও সংস্কৃতি সমালোচনা নয়, তবু এ বিষয় নিয়ে দু-একটা কথা না বললেই নয়। তিনি সমান দক্ষতায় বিচরণ করেছেন বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের সমালোচনার এলাকায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি বিশিষ্ট প্রশ্ন তোলার জন্য। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি প্রধান সাহিত্যিকদের নিয়ে তিনি লিখেছেন প্রচুর। লিখেছেন তিনি বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দসহ অসংখ্য লেখককে নিয়ে। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রায় সমান্তরালবিহীন। কিন্তু তিনি আরো বিশিষ্ট এই কারণে যে সাহিত্যিক মহারথীদের বন্দনা করা বা আনুগত্যের সংস্কৃতিতে তিনি সাহিত্যিক এস্টাব্লিশমেন্টকে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন করেছেন সাহস নিয়ে।

কিন্তু তিনি প্রশ্ন করার জন্যই শুধু প্রশ্ন করেননি। প্রশ্ন করেছেন বঙ্কিমকে, শরৎচন্দ্রকে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে রবীন্দ্রনাথকেও, জনগণের সমষ্টিগত মুক্তির আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই। ইংরেজি সাহিত্যের সমালোচনার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। যখন ইংরেজির ডাকসাইটে অধ্যাপকরা আইরিশ-ইঙ্গ-মার্কিন আধুনিকতাবাদীদের, অর্থাৎ ইয়েটস, পাউন্ড, এলিয়ট, লরেন্স, জয়েস্ প্রমুখকে বন্দনা করতে ব্যস্ত, ঠিক তখন বিস্ফোরণের আকারে প্রকাশিত হয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বই ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে’, যেখানে তিনি অসাধারণ দক্ষতাসহকারে ওই সব সাহিত্যিক মহারথীর ফাঁক ও ফাঁকি চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাঁদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক অবস্থানের সমস্যাগুলো চিনিয়ে দেন। হ্যাঁ, তিনি ‘ক্রিটিক’-এর পর ‘ক্রিটিক’ হাজির করেছেন, সেগুলো বাংলাদেশে সাহিত্য সমালোচনার শুধু ‘নতুন দিগন্ত’ই উন্মোচন করেনি, সেগুলো জনগণের মুক্তির সংগ্রামে হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

জনগণের মুক্তির সংগ্রামের স্বার্থেই আমাদের সময়ের অন্যতম প্রধান লড়াকু বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আরো দীর্ঘ জীবন কামনা করি। তাঁকে জানাই লড়াকু অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা তাঁর ৮৯তম জন্মদিনে।

আজফার হোসেন: কবি, লেখক-গবেষক, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক 

;

কোরবানি



শাহেদ শফিক
কোরবানি

কোরবানি

  • Font increase
  • Font Decrease

আমি তো হাজির হে আমার রব
তোমার প্রিয় ঘরে
উজাড় করে দিতে পারি সব
প্রভু তোমার তরে।

নত মনে আজ তোমার চরণে
সঁপেছি এই শির
তুমি তো মহান, চির অম্লান,
মালিক ধরিত্রীর।

আজ দূর হয়ে যাক মনের পশু
ধুয়ে যাক সব জিদ
জাগ্রত হোক কণ্ঠে সবার
বাজুক তোমার গীত।

তুমি তো আমায় দিয়েছিলে রব
জগতের সব কিছু।
আমি তো ছুটেছি জীবন জুড়ে
পাপের পিছু পিছু।

কী দিয়ে তোমার, সুধিবো ঋণ
নেই যে কিছু আর
তাই তো প্রভু তোমার সকাসে
ছুটি বারং বার।

আজ দূর হয়ে যাক সব ভেদাভেদ
পড়রে কালিমা
হিংসা বিভেদ, ফাসাদ ভুলিয়া
ছড়াক মহিমা।

১৭ জুন ২০২৪।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

;

কদম



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঋতুটি শরৎ এখন পঞ্জিকার পাতায়।
বর্ষার আমেজ কাটেনি বুঝি, সারাটি আকাশ
কালো করে নামে বৃষ্টি।
একটানা ভিজে শালবন, মহুয়ার কিশলয়। সতেজ হয়-
লতানো পুঁইয়ের ডগা।

এ বর্ষণ দেখার সৌভাগ্য আমার নেই। দূর পরবাসে
বসে আমি ভাবি- আহ, কি সহজেই ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম
প্রিয় ফুল কদমের কথা...!
পড়ার টেবিলে দুটো কদম, আষাঢ় শ্রাবণে তরতাজা দুটো কদম
জিইয়ে রেখেছি কতো-
কাচের বোতলে। ভেজা বাতাসে কদমের হালকা সুবাস।
তিনটে বছর, মাত্র তিনটে বছর
ভুলিয়ে দিলো চব্বিশ বছরের বর্ষার স্মৃতি, যেন চব্বিশ বছর
পরাজিত তিন বছরের পাল্লায়।

পরিজন ফোন করে খবর নিতে- ‘কি পাঠাবো বল...?
কাঠালের বিচি ভাজা, চিনে বাদাম, ঝুনা নারকেল
নাকি আমের আচার...?’-ওদের তালিকায়
আমার পছন্দ অনুপস্থিত।

সাহেবদের বিলেতী ফুলের ভীড়ে
ঠাঁই নেই কদমের-
যেমন আছে কাঁদা মাটির সুঁদাগন্ধ ভরা বাংলায়।
ক্যালেণ্ডারের পাতায় দেখি
ফুটফুটে কদমের শ্বেত রেণু বিনিময়, আর অন্তরে অনুভবে
রূপ-রস-গন্ধ।

;