অস্তিত্ব সংকটে প্রাণসায়ের খাল
সাতক্ষীরা শহরের বুক চিরে প্রবাহিত প্রাণসায়ের খাল বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। প্রাণ সায়ের খালের প্রাণই এখন উষ্ঠাগত। ফলে খালটিকে এখন শহরবাসীর দুঃখ বলে উল্লেখ করছেন অনেকে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের সব আবর্জনা গিলে খাচ্ছে খালটি। তবে এই খালের প্রাণ রক্ষায় বিভিন্ন সময় নাগরিক আন্দোলন হলেও বন্ধ করা যাচ্ছে না দখল আর দূষণ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও তা কার্যত আলোর মুখ দেখে না।
প্রভাবশালীরা খালটি দখল করায় এখন সরু নর্দমায় পরিণত হয়েছে খালটি। এছাড়াও খালের দুই মুখে অপরিকল্পিতভাবে স্লুইস গেট নির্মাণ, দুই তীর জবরদখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতি স্থাপন, খালে বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা ফেলাসহ নানা কারণে খালটি হুমকির মুখে। বর্তমানে খালটিতে সীমিত পরিমাণে পানি প্রবাহ রয়েছে।
জানা গেছে, ১৮৬৫ সালে অবিভক্ত বাংলার সাতক্ষীরার জমিদার প্রাণনাথ রায় শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পিএন হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধার্থে প্রাণসায়ের খাল খনন করেন। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খেজুরডাঙ্গি বেতনা নদী থেকে সাতক্ষীরা শহর হয়ে এল্লারচর মরিচ্চাপ নদী পর্যন্ত এ খালের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার।
প্রথমাবস্থায় এ খালের চওড়া ছিল ২০০ ফুটের বেশি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় বাণিজ্যিক নৌকা এসে ভিড়তো এ খালে। ফলে সাতক্ষীরা শহর ক্রমশ সমৃদ্ধ শহরে পরিণত হয়। কিন্তু ১৯৬৫ সালে স্থানীয়দের মতামত আমলে না নিয়ে বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণের নামে খালের দুই মুখে স্লুইস গেট নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে খালে স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় ২০১২ সালে খালটি খনন করা হয়। ৯২ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় ১০ কিলোমিটার খাল সংস্কারের টেন্ডার পায় ঢাকার মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্স। অভিযোগ উঠে, নামেমাত্র খনন করে প্রকল্পের সিংহভাগ টাকাই লোপাট করে পানিউন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। খালের দুই ধারে শতশত গাছ কেটে ফেলা হয়।
২০১৪ সাল থেকে প্রাণ সায়ের খাল রক্ষা কমিটি আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। ২০১৮ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর হাতিরঝিলের আদলে প্রকল্প উদ্বোধন করেন। কিন্তু সেটিও আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে, গত নভেম্বরে জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল শহরের সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের নেতাদের নিয়ে প্রাণ সায়ের খাল রক্ষায় জনমত গড়ে তুলতে পদযাত্রা শুরু করেন। জেলা প্রশাসক খালটির দিকে নজর দেওয়ায় আশার আলো দেখা দিয়েছে। খালটির দুই পাড়ে গড়ে তোলা হবে দৃষ্টি নন্দন পার্ক। নাগরিক নেতা অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বার্তা২৪কে বলেন, ‘খালের প্রাণ না বাঁচলে শহরও বাঁচবে না। শহরের অস্তিত্ব নির্ভর করে এ খালটির উপর। দখল ও দূষণে আজ খালটি মৃতপ্রায়।’
অধ্যাপক আনিসুর রহিম বলেন, ‘খাল রক্ষায় সবার আগে দরকার জনসচেতনতা। তারপর ভূমিদস্যুদের উচ্ছেদকরে খালটির ম্যাপ অনুযায়ী নকশা বুঝে নিতে হবে।’
পরিবেশকর্মী অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী বলেন, ‘রুমাল নাকে ধরে খাল পার হতে হয়। দুর্গন্ধময় পরিবেশের প্রভাবে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে খালটি সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।’
সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতি বার্তা২৪কে বলেন, ‘প্রাণসায়ের খাল দখলমুক্ত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খাল রক্ষার্থে মাইকিং করে ইতোমধ্যে পৌরবাসীকে জানানো হয়েছে, যাতে কেউ কোনো ময়লা আবর্জনা খালে না ফেলেন।’
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বার্তা২৪কে বলেন, ‘জরুরিভিত্তিতে খালটি খননের চেষ্টা করছি। দৃষ্টিনন্দন প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।’