একজন অভিমানী জয়নাল আবেদীন
নীলফামারী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন একজন সফল সংগঠকের নাম। জনকল্যাণের ব্রত ধারণ করেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন সব সময়। একাধারে রাজনৈতিক, ক্রীড়া সংগঠক, শ্রমিক নেতা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অগ্রসৈনিক।
মুক্তিযুদ্ধে ছিল তার সাহসী ভূমিকা। মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর ডেপুটি লিডার ছিলেন, অংশগ্রহণ করেন গেরিলা যুদ্ধে, যেন যুদ্ধ করাই তার নেশা। বাঙালির মুক্তির সনদ ৬৬'র ছয়দফা, ৭১'র মহান মুক্তিসংগ্রামে জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন লাল সবুজের পতাকা।
পঁচাত্তরে জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে যখন আত্মগোপনে, তখনো রাজপথে সরব থেকেছেন জয়নাল আবেদীন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে আড়াই বছর জেল খেটেছেন তিনি।
বর্তমানে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতির দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করছেন। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড নীলফামারী ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদানের পর ১৯৯৪ সালে নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জয়নাল আবেদীন। দায়িত্বভার গ্রহণ করে জেলা আওয়ামী লীগের ভঙ্গুর অবস্থা থেকে পুনর্গঠন করেছেন তিনি, সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সীমাহীন ভূমিকা রয়েছে তার। জনশ্রুতি আছে জয়নাল আবেদীনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আজ নীলফামারীর মাটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
শুধু রাজনীতিতে নয়, ১৯৯৩ সালে জেলার ৪২টি শ্রমিক সংগঠন নিয়ে নীলফামারী জেলা শ্রমিক ঐক্য সংগ্রাম পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন নীলফামারীতে প্রথমবারের মতো শ্রমিকদের মধ্যে জাগরণের সৃষ্টি করেন। ১ মে তে ঐতিহাসিক ভাবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করে ‘শ্রমিক ঐক্য’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত শ্রমিক অধিকার আদায়ে নানা সময়ে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা অর্জন করতে সক্ষম হয় তারা।
শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও শ্রমিক অধিকার সম্পর্কিত অসংগতির বিরুদ্ধে হক আদায়ের জন্য ভূমিকা রেখেছিলেন জয়নাল আবেদীন। তাই আজও নবীন ও প্রবীণ শ্রমিকদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আছেন তিনি।
জয়নাল আবেদীন সম্পর্কে জানতে চাইলে নীলফামারী কুলি ইউনিয়নের সদস্য আব্দুল মালেক বলেন, ‘আবেদীন চাচা মাথার ওপর ছাতা হয়ে আছেন বলেই আমরা চিন্তামুক্ত থাকতে পারি।’
ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে জয়নাল আবেদীনের বেশ পরিচিতি ছিল দেশব্যাপী। নীলফামারী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন একটানা প্রায় তিন দশক। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশন, বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন আপোষহীন। জামায়াত-শিবিরের দুর্গ বলে খ্যাত নীলফামারীর জলঢাকায় দলটির পক্ষ থেকে একাধিকবার জীবননাশের হুমকি দিলেও তোয়াক্কা করেননি জয়নাল আবেদীন। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে দিয়ে নীলফামারী ও জলঢাকার মাটিতে জনসভা করিয়েছিলেন তার নেতৃত্বে। চেয়েছেন ৭১'র যুদ্ধাপরাধী, ঘাতক-দালালদের বিচার। ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নীলফামারী জেলা সভাপতি।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আদলে নীলফামারীতে 'জনতার মঞ্চ' তৈরি করে বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়ার অবৈধ নিয়ম-নীতি, অপশাসনের বিরুদ্ধাচরণ করেন তিনি। ঘরে ঘরে গিয়ে ছাত্রদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে জেলা ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছিলেন। জেলার প্রতিটি উপজেলায় আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করেছিলেন তিনি।
খালেদা জিয়ার ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন পণ্ড করেছিল নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগ। আর এটি করা হয়েছিল জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বেই। সারা জেলায় সকল মানুষের কোনো ক্ষতি সাধন ছাড়াই, জেলার জনমানুষকে সম্পৃক্ত করে প্রহসনমূলক নির্বাচন প্রতিহত করেছেন তিনি।
১৯৯৬ সালে নৌকার কান্ডারি ছিলেন জয়নাল আবেদীন। নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়েছেন, গণজাগরণের সৃষ্টি করেছিলেন নৌকার পক্ষে। পরাজিত হয়েছেন মাত্র ৪৩৯ ভোটে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আরও জোরদার করেন তিনি। কিন্তু এরপর আর পাননি দলের মনোনয়ন। সহস্র নির্ঘুম রাত, ঘাম ঝরানো দিন, শীত-রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যে দল গুছিয়েছিলেন, তার ফল না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পরেন জয়নাল আবেদীন। অভিমানী হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
পরবর্তী সময়ে নিজের অভিমানী মন সায় না দিলে তিনি ছেড়ে দেন জাতীয় পার্টি। নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবেই ধরে রাখতে চেয়েছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত।
নীলফামারীর মাটি ও মানুষ এই আপোষহীন নেতাকে ঠকায়নি কখনই। নীলফামারীর মানুষের রায়ে দুই দুইবার (১৯৮৬ ও ২০০৮) সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে নীলফামারী জেলার আপামর জনতার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। নানা অভিধায় সিক্ত এই মানুষটির মূল পরিচয় তিনি নীলফামারীর গণমানুষের নেতা।
রাজনীতিতে দল পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে জয়নাল আবেদীন বলেন, 'অনেক কষ্টে নীলফামারীর আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করেছি। তৃণমূল আওয়ামী লীগ আমাকে চেয়েছে। তাই আমি জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করেছিলাম।'
তিনি বলেন, 'আমি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিশ্বাস করি। ২০০১ পরবর্তী সময়ে আমি জাতীয় পার্টি ছেড়ে দেই। ২০০৮ সালের উপজেলা নির্বাচনে আমি স্বতন্ত্রভাবে অংশগ্রহণ করি এবং বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করেছিলাম। সর্বশেষ জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদেও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে বিজয় লাভ করেছি। নীলফামারীর সাধারণ জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি বারবার।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমি কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পথ চলি। আওয়ামী লীগের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রেখে বাকি জীবন চলতে চাই।’
নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের হাল ধরে সুসংগঠিত করেছেন, প্রায় দুই দশক রয়েছেন সক্রিয় রাজনীতির বাইরে। আবারো আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতিতে আসতে চান কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জয়নাল আবেদীন বলেন, 'বর্তমানে জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ন্যায়-নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছি। দলের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা যদি চান, তাহলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চাই।’