যে মসজিদের মাটি-পানি মহৌষধ!
বিয়ের বারো বছর পর সন্তানের মুখ দেখেছেন জেসমিন সুলতানা। সন্তানের মুখে প্রথম ভাত দিতে খুলনার ফুলবাড়ি গেট থেকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভালুকা চাঁদপুরে অবস্থিত সাড়ে চারশ বছরের ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদে এসেছেন তিনি।
এ মসজিদে আসার কারণ জানতে চাইলে জেসমিন সুলতানা বলেন, ‘বারো বছর নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। ওই সময় সৃষ্টিকর্তার কাছে একটি মানত করেছিলেন। আর সেটি হল- যদি তার সন্তান হয় তবে ভালুকা চাঁদপুর জামে মসজিদে মানিক চৌধুরীর (রহ.) দরগায় একটি খাসি কোরবানি দিয়ে সন্তানের মুখে ভাত দেবেন।
সৃষ্টিকর্তা তার ডাক শুনেছেন। জেসমিনের কোলে এখন ৯ মাসের ফুটফুটে কন্যা সন্তান। তার মুখে ভাত ও খাসি কোরবানি করতে সপরিবারে এসেছেন মানিক চৌধুরীর (রহ.) দরগায়। বছর দেড়েক আগেও একাধারে তিন সপ্তাহ (তিন শুক্রবার) এসেছিলেন তিনি। একটি বিশেষ নিয়ম মেনে মসজিদের মাটি ও পানি ব্যবহার করতেন জেসমিন সুলতানা।
জেসমিনের বিশ্বাস এভাবে পরম ভক্তিতে মাটি-পানি ব্যবহার করায় আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে মনের আশা পূরণ করেছেন। মেয়ের নাম রেখেছেন রুবাইয়া সুলতানা। রুবাইয়ার সুস্থতা কামনা করেছেন তিনি।
মনের আশা যাতে পূরণ হয় সে কারণে এখানে এসেছেন আশাশুনির কুল্যা এলাকা থেকে লুৎফর রহমান, একই উপজেলার শোভনালী এলাকার জয়নাল আবেদীন, সদরের ফিংড়ী এলাকার মহিদুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ, শিমুলবাড়িয়া থেকে রহমত আলী, আনারুল ইসলাম, দেবহাটার কুলিয়া এলাকার জাকির হোসেনসহ শতশত পরিবার।
এদের কেউ এসেছেন নিঃসন্তান থেকে সন্তানের আশায়, কেউ এসেছেন রোগমুক্তির আশায়, কেউ এসেছেন নতুন ফসলের ভালো ফলনের আশায়। ভক্তদের আগমনে প্রতি শুক্রবার এখানে মেলা বসে। কেউ আসেন মোরগ নিয়ে, কেউ আসেন ক্ষেতের প্রথম ফসলের অংশ নিয়ে, কেউ বাগানের ফল, কেউ ঘেরের প্রথম ধরা মাছ, কেউ গরু-ছাগল নিয়ে। এভাবে ভক্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয় ভালুকা চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ প্রাঙ্গণ।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভক্তরা দিঘির পানিতে গোসল শেষে বোতলে পানি ভরে রাখছে মসজিদের সামনে। এরপর মসজিদের সামনের প্রাচীরের গোড়া থেকে মাটি নিয়ে রাখছে বোতলের পাশে। নামাজ শেষে সেই পানি-মাটি পরম ভক্তিতে ব্যবহার করছে তারা। এ দৃশ্য দু-এক বছরের নয়। এটি সাড়ে চারশ বছর ধরে চলছে।
জানা যায়, প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহর ইউনিয়নের ভালুকা চাঁদপুর গ্রামে মানিক চৌধুরী নামে এক সিদ্ধ পুরুষ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভালুকা চাঁদপুর জমিদার বংশের সন্তান।
জনশ্রুতি আছে, এই গ্রামে খালাস সরদার নামে এক দরিদ্র ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি ছিলেন অতি পরহেজগার ও খোদাভক্ত। অলৌকিকভাবে তিনি বহু গুপ্ত সম্পদের অধিকারী হন। এ সম্পদ দিয়ে তিনি নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নিকট থেকে তার ছেলে আজমত উল্যাহর নামে একটি জমিদারি পরগনা ক্রয় করেন। পরগনা কেনার সম্মানে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার নাম দেন আজমত উল্যাহ চৌধুরী।
পরগনা কেনার পর তা রক্ষার জন্য একশ বিঘা জমির চারপাশে একটি খাল খনন করেন। যা 'গড়' নামে পরিচিত। আকারে ছোট হওয়ায় একে গড়ের গাভীও বলা হয়। এই গড়ে ১৬ জন মাঝি নৌকায় করে দিনরাত পরগনা পাহারা দিত।
কারণ সে সময় পাশের সুন্দরবনসহ বহিরাগত ডাকাতদের উপদ্রব ছিল। জমিদার আজমত উল্যাহ চৌধুরীর ছিল ৭ ছেলে। তারমধ্যে মানিক চৌধুরী ছিলেন একজন। তিনি ছিলেন অলিয়ে কামেল এবং বিশিষ্ট দরবেশ। জনসাধারণের নামাজের সুবিধার্থে তিনি ভালুকা চাঁদপুর গ্রামে নির্মাণ করেন তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ।
২৬ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ হাত প্রস্থ বিশিষ্ট এ মসজিদের দেয়াল ৪০ ইঞ্চি পুরু। মসজিদের পাশেই আড়াই বিঘা আয়তনের কবরস্থান। মসজিদের দক্ষিণপাশে বিশাল দিঘি রয়েছে। দিঘিটির আয়তন সাড়ে চার বিঘা। সাড়ে চারশ বছর পরও মানুষ এ দিঘির পানি মহৌষধ হিসেবে ব্যবহার করে।
ওই মসজিদের সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে প্রতিদিন শত শত মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। শুক্রবার এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানত আদায় ও মানত করতে দশ থেকে বারো হাজার মানুষ আসেন। বেশি আসেন নারী। মসজিদে পুরুষের পাশাপাশি পৃথকভাবে নারীদেরও নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা আছে। এখানে এক সঙ্গে দুই হাজার পুরুষ ও ৫০০ জন নারী এক জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন।