মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত যশোর
ইতিহাস, ঐতিহ্য সাংস্কৃতিক উর্বর ভূমি ও দেশের প্রথম শত্রু মুক্ত ডিজিটাল জেলা যশোর। বাংলা-বাঙালির ‘নানা রঙের ফুলের মেলা খেজুর গুড়ের যশোর জেলা’ এই ঐতিহ্যর সঙ্গে জেলাটিতে ভাষা আন্দোলন থেকে মহান স্বাধীনতার ঐতিহ্য-স্মৃতি বহন করছে স্বগৌরবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জীবিত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভিত্তিক নানা ভাস্কর্য ও ম্যুরাল দিয়ে সাজানো হয়েছে শহরের বিভিন্ন চত্বর, দেয়াল, স্কুল-কলেজের ক্যাম্পাসগুলো। ফলে নতুন প্রজন্মসহ সাধারণ মানুষ খুব সহজেই জানতে পারছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শহরের সৌন্দর্যও।
যশোর শহরের প্রাণ কেন্দ্র দড়াটানায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল। দাঁড়িয়ে থাকা এই ম্যুরালটি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে উচ্চারিত হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা। শিল্পীর শৈল্পিক ভাবনায় তুলে ধরা হয়েছে ২৫ মার্চের ভয়াল কালো রাতে পাকিস্তানি হায়েনাদের বর্বরতার চিত্র।
যশোর শহরের প্রবেশদ্বার পার হলেই মনিহার সিনেমা হলের ঠিক সামনেই যশোরের বিজয় স্তম্ভ । বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে ১৯৭২ সালের ২৬ ডিসেম্বর এর ভিত্তি স্থাপন করেন। এখানেই রাখা হয়েছে মুঘল যুগের একটি কামানও।
সেখান থেকে যশোর শহরের পুরাতন কসবায় গেলে দেখা মিলবে একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের। কাঁধে রাইফেল, আর স্বপরিবারে শান্তির পায়রা উড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছে স্বগৌরবে। ‘জাগ্রত বাঙালি’ নামের এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন ভাস্কর রকিবুল ইসলাম শাহিন। এক যুগ পূর্বে নির্মিত এই ভাস্কর্যে মুক্তির জন্য যুদ্ধ এবং শান্তির বার্তা ঘোষণা করা হয়েছে।
পালবাড়ি মোড় এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে যশোরের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্যটি। এই পথেই যৌথ বাহিনী যশোর শহরে প্রবেশ করেছিল পাক বাহিনীর পলায়নের পর। বিজয়ের পর সেই স্মৃতি অমরতা পেয়েছে এই ভাস্কর্যে। বাংলাদেশের বিশাল একটি পতাকা বহন করে চলেছেন তারা। আনন্দের আতিশয্যে হাতের রাইফেল থেকে গুলি ছুড়ছেন শূন্যে। ঊর্ধ্বমুখী মুষ্টিবদ্ধ হস্তে প্রতিফলিত দৃঢ় অঙ্গীকার, দেশ মাতৃকার পুনর্গঠনের সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্তির প্রত্যয়ে প্রতীক্ষায়। বহুদূর থেকে দৃষ্ট অত্যন্ত ‘দৃষ্টিনন্দন বিজয় ৭১’ নামে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করে যশোর এস এ সুলতান আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ ভাস্কর খন্দকার বদরুল ইসলাম।
এর পরেই সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় কলেজে স্থাপিত হয়েছে ‘চেতনায় চিরঞ্জীব’। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কলেজ থেকে অংশ নেওয়া শিক্ষক, শিক্ষার্থীর যারা যুদ্ধে শহীদ হয় তাদের স্মৃতিতে নির্মাণ হয় এই ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যটি চারুপীঠের অধ্যক্ষ মাহবুব শামীম নির্মাণ করেন।
যশোর মহিলা কলেজে স্থাপিত হয়েছে ‘প্রদীপ্ত স্বাধীনতা ভাস্কর্য’। খন্দকার বদরুল ইসলাম এই ভাস্কর্যে সাদা, কালো, লাল ও সবুজ রঙ ব্যবহার করেছেন প্রতীক হিসেবে। সেখানে বিধৃত হয়েছে একই সঙ্গে শ্যামল বাংলার বুকে রক্তের হোলিখেলা, শোক, বিজয়ের আনন্দ এবং শান্তির বাণী।
শহরের পাশেই টাউন হল ময়দান। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই ময়দানে স্বাধীন বাংলার প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি যে মঞ্চে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই মঞ্চের নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্বাধীনতার উন্মুক্ত মঞ্চ’ । সেই সময়ে ভাষণে তাজউদ্দিন আহমেদ জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আর ধ্বংস নয়, যুদ্ধ নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে।
দেশের অন্যতম বধ্যভূমি যশোরের শঙ্করপুর হাঁস-মুরগির খামার। এ হাঁস-মুরগির খামারটি আইয়ুব খানের শাসন আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বধ্যভূমিতে একাত্তরে বিহারিরা শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। স্বাধীনতার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী এখান থেকে কয়েক ট্রাক হাড়-কঙ্কাল সরিয়ে নিয়ে গেছে। ১৯৯২ সালে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই বধ্যভূমির পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তি নির্মাণ করে।
স্বাধীনতাকামী যশোরে মানুষের আন্দোলন সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরে তৈরি এসব ভাস্কর্য ও মুর্যাল একদিকে শহরে সৌন্দর্য বাড়িয়েছে, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরছে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। এতে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এমনটাই দাবি যশোরের সচেতন মহলের।
সেলিম রেজা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন ,যশোর জেলা প্রথম শত্রু মুক্ত জেলা। এই জেলায় ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে তার প্রমাণ এই ভাস্কর্যগুলো। আমরা যারা নতুন প্রজন্ম আছি তারা এসকল ভাস্কর্য দেখে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবো।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য সর্ম্পকে জানতে চাইলে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার রাজেক আহমেদ বার্তা২৪.কমকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি উৎসাহী হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ও মোড়ে এই ভাস্কর্যগুলো স্থাপন করেন। যাতে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে জীবন ধারণ করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই ভাস্কর্যগুলো সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই। যখন কোন জাতীয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস আসে তখন পৌরসভার এইগুলো পরিস্কার পরিছন্ন করার প্রয়োজন দেখা দেয়। স্বাধীনতার স্মৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আরও ভাস্কর্য নির্মাণ ও সংরক্ষণ করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।