ফিলিপিনো পরিচালক লাভ ডায়েজ: এশীয় চলচ্চিত্রের এক অনন্য শিল্পী



সৈয়দ কামরুল হাসান
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব দরবারে এশীয় চলচ্চিত্রের আলোচনায় জাপানের আকিরা কুরোসোয়া ও ভারতের সত্যজিৎ রায়ের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত। ভারতের মৃণাল সেন ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তও একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিজয়ী অথবা বিচারকের আসন অলঙ্কৃত করে সুনাম কুড়িয়েছেন। এই অতি-সংক্ষিপ্ত তালিকায় জাপানের অন্তত আরো দুজন পরিচালকের নাম যুক্ত করে নেওয়া যায়। এঁদের একজন টোকিও স্টোরি-খ্যাত ওজু এবং অপরজন কেনজি মিজোগুচি। গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও ইতিহাসচেতনা-সমৃদ্ধ কুরোসোয়া ও ধ্রুপদী শিল্পগুণসম্পন্ন সত্যজিতের উচ্চতর মান আর যিনি বজায় রাখতে পেরেছেন তিনি সম্ভবত ইরানের আব্বাস কিরোয়াস্তামি। ইরানের বেশ কজন গুণী পরিচালকদের মধ্য থেকে মজিদ মাজেদি ও আসগর ফারহাদির নামও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা সমীচীন; যদিও মহসিন মাখবালেফ ও তাঁর কন্যা সামিরা মাখবালেফের নাম যোগ করে এই তালিকা আরো দীর্ঘ করা সম্ভব। ওদিকে চীনের চলচ্চিত্রও যে পিছিয়ে নেই তা বিশ্বের নাম-করা চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে তাদের কৃতিত্ব দেখে সহজে সনাক্ত করা চলে। বিশ্বের তাবত্ চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের স্তম্ভিত করে দিয়ে কান, ভেনিস ও অস্কারে সেরা ছবির পুরস্কার জিতে নেয়—Chen Kaige-এর Farewell My Concubine (1993, Palm De ’or Cannes ), Zhan Immu-এর Raise the Red Lantern(1991, Silver Lion,Venice) এবং Ang Lee-এর Life of Pie (2012, Academy Awards-Best Director) | অতপর এ-কথা বুঝতে আর বাকি থাকে না যে চীনও বিশ্ব চলচ্চিত্রের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। অতি সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রও আলোচনায় উঠে এসেছে। তাদের সেরা পরিচালক কিম কাই দুক নানা উৎসবে সেরা পুরস্কার ঝুলিতে পুরে দেশের জন্য মূল্যবান সম্মান বয়ে এনেছেন। সেখানে রয়েছেন আন হুই সহ আরো কজন কুশলী পরিচালক। গত বছর (২০১৯) দক্ষিণ কোরিয়ার নবপ্রজন্মের পরিচালক বং-জুন-হো তাঁর ‘প্যারাসাইট’ ছবির জন্য যুগপৎ কান ও অস্কার জিতে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন।

আমার সৌভাগ্য যে, নানা দিক থেকে যোগাড় যন্ত্র করে এই কুশলী শিল্পীদের সেরা কাজগুলি ইতোমধ্যে দেখা হয়েছে, সেই সাথে তাদের চলচ্চিত্র ভাবনার সাথেও খানিকটা পরিচিত হয়েছি। কিছুকাল একরকম হাত গুটিয়ে বসে ছিলাম—লক ডাউন সিচিয়ুয়েশনে অফিস ও অন্যবিধ কাজ ঠিকঠাক রাখতে গিয়ে কখনো হাঁফিয়ে উঠলে ইতিহাস-ভূগোলহীন মালায়লাম কিংবা বলিউড বাদশাদের বর্ণোজ্বল কৃত্রিমতায় নিজেকে সঁপে দিয়ে বিনোদন লাভের চেষ্টা করেছি। কখনো সেসব ছবির একটু-আধটু চেখে ফেলে দিতে হয়েছে! এইরকম একটা অস্থিতিশীল সময়ে অনেকটা অলৌকিকভাবে যেন ফিলিপিনো পরিচালক লাভ ডায়েজের খোঁজ পাই। আমার কাছে তিনি যেন গুপ্তধনে-ঠাসা এক নিখোঁজ দ্বীপ। উপরে উল্লিখিত সেরা ধ্রুপদী চলচ্চিত্রকারদের থেকে অনেক দূরে তাঁর অবস্থান। আমার মনে হয়েছে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু, নির্মাণ কৌশল ও বক্তব্য একবারে আলাদা, তিনি পুরোপুরি স্বতন্ত্র এবং বলা যায় চলচ্চিত্রের এক অনন্য শিল্পী।

Lavrente Indico Diaz সংক্ষেপে Lav Diaz- এর জন্ম ১৯৫৮ সালে ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত আলোচিত দ্বীপপুঞ্জ— মিন্দানাওয়ে। সমুদ্র ও পাথুরে পর্বতমালায় ঘেরা বৃষ্টিবিধৌত উর্বর দ্বীপটিতে পাহাড়, সমুদ্র ও অরণ্যের বিরল সম্মিলন ঘটেছে। একইভাবে প্রাচীন লোকবিশ্বাস ও জাতিগোষ্ঠী এবং পরবর্তীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টীয় ও মুসলিম ধর্মবিশ্বাস প্রভাবিত করেছে এই জনপদ। বর্তমানে মিন্দানাওয়ের জনগোষ্ঠীর প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী। বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ, অস্থিরতা ও সামরিক শাসনের নিষ্পেষণ এই জনপদের শান্ত ও নিরন্তর জীবনপ্রবাহ বারবার ব্যাহত করেছে। সনাতন ধর্মীয় ও শত বছরের লোকবিশ্বাস বারবার বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় অধিবাসীদের মানসগঠন একটা নিজস্ব অদ্ভুত রূপ পরিগ্রহ করেছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে সমুদ্রতীরবর্তী মানুষের জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের সাথে খাপ খাওয়ানোর ধৈর্য্য ও বেঁচে-থাকার অপরিসীম আশাবাদ। রাজধানী থেকে অনেক দূরের অনগ্রসর এই জনপদ দেশের মৎস্য, ফলমূল (কলা, আনারস) ও কৃষিপণ্যের বড় যোগানদাতা। এই জনপদে চলচ্চিত্রকার লাভ ডায়েজের জন্ম ও বেড়ে-ওঠা। তাঁর খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাসী পিতা গভীর অরণ্যে তাদের বাসস্থান স্থাপন করে অরণ্যের অভ্যন্তরের গ্রামসমূহে ধর্মপ্রচারের কাজে নিয়োজিত হন। লাভ ছোটবেলা থেকে দেখেছিলেন কিভাবে প্রাচীন বিশ্বাস, সংস্কার ও আচার অনুষ্ঠানের সাথে নয়া রীতি ও ব্যবস্থার সংঘাত ঘটে। কিভাবে উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ ও অধিকারবঞ্চিত মানুষ নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। আর কিভাবে প্রকৃতিকে এর অঙ্গীভূত করে নিয়ে গোটা ব্যবস্থা ও মানসগঠন একটা অজানা রহস্যময় আকার পায়—এই মিথস্ক্রিয়া ডায়েজের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। এ-কারণে অর্থনীতির উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন ও হারভার্ডের ফেলো হওয়া সত্ত্বেও ছবির কাহিনী ও পটভূমির খোঁজে তিনি বারবার ফিরে গেছেন জাদুবাস্তবতার আবহে-ঢাকা তাঁর শৈশবের স্মৃতিঘেরা সেই জনপদে। এমনকি এখনো মাকিন যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে বসবাস করলেও সময় পেলেই ছুটে যান সূদূর মিন্দানাওয়ে গড়ে-তোলা তাঁর প্রিয় কৃষি খামারে।

লাভ ডায়েজের চলচ্চিত্র নির্মানের শুরু ১৯৯১ সালে। ছোট বড় মিলিয়ে লাভ ডায়েজ পরিচালিত ছবির সংখ্যা—২৫, এর মধ্যে ১৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র। সবচেয়ে আলোচিত ও বিশ্ব-চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কাছে সমাদৃত ছবিগুলির মধ্যে কয়েকটির নাম : Naked under the Moon (1999), Evolution of a Filipino Family(2004), Death in the land of Encantos (2007), Melancholie (2008), Norte, the End of history(2013), From What is Before (2014), A Lullaby to the sorrowful mystery (2016), The woman who left (2016), Season of the Devil (2018), The Halt(2019) | লাভ ডায়েজের ছবি Norte, the End of history ২০১৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে UN Certain Regard-সেকশনে প্রদর্শিত হয়। ২০১৪ সালে তাঁর অনবদ্য ছবি—From What is Before—লোকার্ণো উৎসবের সেরা ছবির পুরস্কার জিতে নেয়। ২০১৬ সালে, একই বছরে, তাঁর ২টি ছবি ২টি চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা চলচ্চিত্র হিসাবে পুরস্কৃত হয়। The woman who left—ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন এবং A Lullaby to the sorrowful mystery—বার্লিনে গোল্ডেন বিয়ার পায়। ভেনিসের চলচ্চিত্র জুরি কমিটি ও বোদ্ধাগণ তাঁকে: “the ideological father of the New Phillipine” হিসাবে আখ্যায়িত করেন। পরিচালনা ছাড়াও লাভ ডায়েজ একজন চলচ্চিত্র সমালোচক, কবি ও সংগীতকার। এই ডিসেম্বরে লাভ ডায়েজ ৬২ বছরে পা দেবেন। নতুন নতুন ছবি নির্মাণের ভাবনা তাঁকে সক্রিয় ও সদাব্যস্ত রাখছে। তাঁর ভাষায়: “That’s the urgency to me—having the spiritual Journey,doing my cinema, taking care of my kids and my rice field, it’s the same.”

২.
রাজধানী থেকে অনেক দূরের একটি জনপদ, যার এক দিকে সমুদ্র যেখানে প্রায় সারাদিনই মাতাল ক্ষুব্ধ সাগর প্রচণ্ড গর্জনে বারবার এসে আছড়ে পড়ছে কালো শিলীভূত পর্বতমালায়। পাহাড়ের ঢালের অপর পাশটিতে কয়েকটি খাল, নালার দুইধারে ঘন বাঁশঝাড়, আরো নাম-না-জানা গাছপালায় ছাওয়া ঘন অরণ্যবেষ্টিত ছোট্ট জনপদ। সভ্যতার ছোঁওয়া লাগেনি, মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের খুঁটি বসেছে মাত্র, কবে আলো আসবে কেউ জানে না। ভাঙা সেতু যানবাহনের চলাচল অগম্য করে রেখেছে। অরণ্যের জলমগ্ন ফাঁকা জমিগুলিতে মোষের পাল, টোপর মাথায় তাদের তত্ত্বাবধানে ২/১ জনকে চোখে পড়ে। থকথকে কাদায় হঠাৎ ২/১ জন গ্রামবাসি ছপ ছপ শব্দ তুলে এগিয়ে যায়। আর শব্দ বলতে সারাদিন পাখির কিচিরমিচির, অবিরাম কুকুরের ঘেউ ঘেউ, মোরগ-মুরগির খুঁটে খুঁটে খাবার তোলার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত বিরতিতে ডাক গেরস্থালির আভাস দেয়। নজরে আসে উঁচু উঁচু কাঠের খুঁটির ওপর পাটাতন তুলে এক একটি খড়ে-ছাওয়া ঘরে বসবাসরত মানুষ, কিছু শান্ত স্বল্পবাক মানুষের কষ্টে-সৃষ্টের সংসার। অরণ্যের ফলমূল আহরণ ও পাখি শিকার, সামান্য জমিজিরাতে চাষাবাদ আর খালে-বিলে মাছ ধরা তাদের নিত্য ক্ষুন্নিবৃত্তির উপায়। এই অরণ্যের লতাপাতা তাদের অসুখ-বিসুখের নিদানও। আরো আছে অদৃশ্যে ভক্তি, ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস, সমুদ্র যে কালো শিলায় এসে মাথা কুটে মরছে সেখানে দেবতার উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য পেশ, যে দুষ্ট আত্মা তাদের যাবতীয় ভোগান্তির কারণ বলে তারা মনে করে, তাকে তাড়ানোর নানা বিচিত্র কলাকৌশল—যার শেকড় শত সহস্র বছর ধরে তাদের বিশ্বাসের গভীরে প্রোথিত। কিন্তু এরই মধ্যে আছে একের জন্যে অন্যের গভীর সহমর্মিতা, জন্ম ও মৃত্যুতে যুথবদ্ধ আনন্দ ও শোকতাপ, জীবনসংগ্রামের লড়াই, শঙ্কা, হতাশা, সরল ঘৃণা, প্রেম ও পাপবোধ। ১৯৭০-৭২ সালে ফিলিপাইনের এমন একটি প্রত্যন্ত জনপদের প্রেক্ষাপটে লাভ ডায়েজের ছবি From What is Before-র গল্প আবর্তিত হয়েছে। সাড়ে ৫ ঘণ্টার দীর্ঘ ছবি। ঠিক প্রচলিত অর্থে নায়ক-নায়িকা নির্ভর কোনো নাটকীয় কাহিনী এতে নেই—এ যেন গোটা একটি জনপদেরই হারিয়ে যাওয়ার গল্প। সেদিক থেকে বলতে গেলে জনপদই এই ছবির মূল চরিত্র। এমনভাবে ছবিতে গোটা জনপদকে তুলে আনা হয়েছে যাতে আছে সমুদ্রের গর্জন, আকাশে মেঘ ডাকছে, সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজছে সবাই, বাঁশঝোপে বইছে হাওয়া—হাওয়ার সরসর শব্দ, কুপির আলোয় স্বল্পালোকিত রাতের গেরস্থালি—পরিচালক অনেকক্ষণ ক্যামেরা ফেলে রাখেন অরণ্যের ঝোপে-ঝাড়ে, কাদাজমা পথে ঘাটে, বৃষ্টিক্লান্ত বিষণ্ন আকাশে! কখন যে সেই জনপদ দর্শকের মনে ধীরে ধীরে জায়গা করে নেয় ঠিক আন্দাজ হয় না, কেননা সময়ের দিকে খেয়াল থাকে না, অনতিবিলম্বে একটা ঘোর গ্রাস করে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে পরিচালক গল্পের মোড়ক খোলেন। গ্রামের অধিবাসীরা তাদের বাড়ির লাগোয়া জঙ্গলে বিচিত্র কিন্তু ভয়ঙ্কর কিছুর ডাক শুনতে পায়, আতঙ্কে ভরদুপুরে তারা দরজা জানালার খিল তুলে দেয়। একদিন খবর আসে চারণভূমি থেকে তিনটি মহিষ হারিয়ে গেছে, আরেক দিন হঠাৎ দুপুরবেলায় তিনটি বাড়ি আগুনে ভস্মীভূত হয়। একদিন দেখা যায় অরণ্যের ঢালে মাঝবয়সী অচেনা একটা লোকের লাশ পড়ে আছে, তার ঘাড়ের পেছনে গভীর কাটা দাগ। এইভাবে মানুষের মধ্যে দানা বাঁধে অজানা ভয়; এমনকি তারা ভাবতে শুরু করে এসবকিছু তাদেরই কোনো পূর্বকৃত পাপের ফল কিনা। গ্রামের এক বোন তার প্রতিবন্ধী ছোট বোনকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে—এই প্রতিবন্ধী বোনটিকে ভাবা হতো অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন যার কিনা আছে ঝাড়ফুঁকে ম্যালেরিয়া-হিস্টিরিয়াসহ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষগুলিকে সারিয়ে তোলার ক্ষমতা। প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে সেই কাজে লাগানো হয়, দুই বোনের আয়ের উৎসও সেই কাজ। কিন্তু প্রতিবন্ধী বোনটি সবার অলক্ষ্যে এক প্রতিবেশি যুবকের যৌন লালসার শিকার হয়ে একসময় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তার বোনটি তা মানতে পারে না। সে সমুদ্রের যে দেবতার কাছে প্রতিদিন বোনের রোগমুক্তির জন্য প্রার্থণার নৈবেদ্য সাজাত সেই সমুদ্রে বোনকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেয়। ইতোমধ্যে গ্রামে একটি গির্জা বসেছে, যার পাদ্রি এইসব অপচিকিৎসা ও লোকবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারে না, দুই বোন তার সামনেই তাদের আরাধ্য সমুদ্র-দেবতার কাছে আত্মাহুতি দেয়। ওদিকে প্রতিবন্ধী বোনটি যে-যুবকের যৌন লালসার অসহায় শিকার হয়েছিল, সেই যুবকও মানসিক অনুতাপে জর্জরিত হয়ে স্বীকারোক্তির পর ক্রুদ্ধ প্রতিবেশির হাতে নিহত হয়। ভয় ও বিষণ্নতা আরো ভারী হয়ে চেপে বসে গ্রামবাসির পর। একদা গ্রামে সামরিক বাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়ন এসে হাজির হয়। কেন্দ্রে মারকোসের সরকার সামরিক আইন জারি করে, গ্রামবাসি ও স্কুল শিক্ষকদের আপত্তির মুখেও স্থানীয় স্কুলে বসে সেনাদের অস্থায়ী ক্যাম্প। গ্রামে সেনারা কারফিউ দেওয়ার ঘোষণা দেয়; তাদের কাছে খবর ছিল: এদিককার জঙ্গলে গেরিলাদলের ঘাঁটি রয়েছে। এক মহিলা সেনা কর্মকর্তাকে কাপড়বিক্রেতার ছদ্মবেশে গ্রামবাসীদের বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে তন্ন তন্ন করে দেখা হয় কোথাও কোনো ক্লু পাওয়া যায় কিনা। সরল গ্রামবাসির কাছে কিছুই পাওয়া যায় না। কিন্তু একদিন সত্যি একদল সশস্ত্র গেরিলাকে অরণ্যের গহীনে টহলরত দেখা যায়। তারা গ্রামের বাছাই-করা যুবকদের গাছে ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, পথচারীদেরও নানা জিজ্ঞাসায় আতঙ্কিত করে তুলছে। কিন্তু আরো কোনো এক গভীর অজানা ভয়ের ঘোরে কম্পিত ও আবিষ্ট সে জনপদের কেউ তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সামরিক বাহিনীর কারফিউ কিংবা গেবিলাদের প্রহরা অনুমোদন করে না। নীরবে বাড়িঘর রেখে তারা দূরের ভিন্ন কোনো জনপদে পালাতে শুরু করে। শুধু থেকে যায় এক প্রাচীন চাষী আর তার ছেলেবেলার বন্ধু একদা শহরবাসি এক কবি—ক্যান্সারের শেষ দিনগুলিতে তার বাসভূমিতে মরার আকাঙ্ক্ষায় যে ফিরে এসেছে। কবির একমাত্র কন্যা শহরবাসি—কবি সারাদিন তার পুরনো টাইপরাইটারে তার জনপদের এই চাপা আতঙ্ক নিয়ে কবিতা রচনায় ব্যপৃত হয়। বন্ধুকে জানায় মৃত্যুর পর তার অন্তিম ইচ্ছার কথা—না, খ্রিস্টীয় কিংবা কোনো নতুন রীতিতে নয়, তার সৎকার যেন করা হয় পূর্বপুরুষের “মালয়” রীতিতে, বস্তুত এ-কারণেই সে ফিরে এসেছে এই মৃত্যু উপত্যকায়। অনতিবিলম্বে কবির মৃত্যু হয়, খবর পেয়ে কবির শহরবাসি মেয়েটি আসে গেরিলাদলের অনুমোদন নিয়ে। বাড়ির পাশের বয়ে-যাওয়া ছোট নদী, যা গিয়েছে সাগরের ঠিকানায়, সেখানে কলার ভেলায় চিতা সাজানো হয়, চিতায় আগুন দেওয়া হয়। আর কেউ নেই কবির শেষযাত্রায়—শুধু তার ছোটবেলার বন্ধু আর মেয়েটি। হু হু আগুনে কবির শবদেহ পোড়ে, ধীরে ধীরে ভেসে যেতে থাকে কলার ভেলাটি। ক্যামেরার চোখ প্যান করে ঘন অরণ্যের মাথায় ঝুলে থাকা মেঘক্লান্ত আকাশে স্থিত হলে আপাতত যবনিকা নেমে আসে, পরদায় ভেসে উঠে ছবির কলাকুশলীদের নাম।

From What is Before সিনেমার একটি দৃশ্য

তিনদিনে একটু একটু করে দেখা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ ছবি দেখা শেষ হলেও উঠে আসতে ইচ্ছা করে না, মায়া পড়ে থাকে। একেবারে আধুনিক কালে অর্থাৎ ২০১৪ সালে নির্মিত হলেও গল্প তথা জনপদের আবহ ঠিক রাখার জন্য ছবিটি শাদা কালোয় তোলা। সবসময় দেখা গেছে আকাশের একটাই রঙ—বর্ণহীন, মেঘাচ্ছন্ন, ঘোলাটে। বেশির ভাগ সময় জুড়ে বৃষ্টিপাত। কেউই যেন অভিনয় করেনি ছবিতে, গাঁয়ের একেবারে চাষভূষোরা উঠে এসেছে ফ্রেমে। সময় নিয়ে, শ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে কথা বলে ওরা; ক্যামেরা অপেক্ষা করে ততক্ষণ। ছবিতে কোনো যৌনতা নেই, ইঙ্গিতে বোঝানো হয়েছে অবৈধ যৌনতা। সবচেয়ে বড় সাতন্ত্র্য এই ছবিতে কোনো আবহ সংগীত নেই। অরণ্যের নানান আওয়াজ, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, মোরগের বাঁক, মুরগি ছানাদের উচ্ছ্বসিত ছুটে চলার আওয়াজ, পাখির কিচিরমিচির, বাঁশবনে রাত্রিভর হাওয়ার চলাচল, পাহাড়ের ঢালে সমুদ্রের ক্রুদ্ধ গর্জন—বাস্তবের সব শব্দ জড়ো করে নিপুণভাবে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরিচালক যেন বলতে চেয়েছেন জীবনের মধ্যেই রয়েছে এর নিজস্ব স্বর ও সুর। এইভাবে জনপদ নিজেই হয়ে উঠেছে এক জীবিত সত্ত্বা, বয়ে-চলা জীবন যার চরিত্র। এক নিরাসক্ত ভঙ্গিতে লাভ ডায়েজ যেন শুধু তাকে তার নিজের মত করে বয়ে যেতে দিয়েছেন ।

ভেনিসে পুরস্কারপ্রাপ্ত তাঁর ২০১৬ সালের ছবি—The woman who left-ও শাদা কালোয় চিত্রায়িত। সেখানেও তা ছিল ছবির গল্পের চাহিদা কিংবা দাবি। সেখানে গল্প অনুসরণ করে ক্যামেরা নেমে গেছে দূর গাঁয়ে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যে আসলে চারপাশের অনুষঙ্গে রয়েছে—এটা বলা যায় তাঁর একটি আবিষ্কার। এই কৌশল মোক্ষমভাবে তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর আরেকটি দুর্দান্ত ছবি Norte, the End of history-তে। ৪ ঘণ্টা ১০ মিনিটে সমাপ্ত ছবিটি যদিও রঙিন, কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসাবে সেখানেও ব্যবহার করা হয়েছে জীবন থেকে নেওয়া শব্দাবলি—রাতে কাজ করে ফেরা শ্রমিকদের পায়ের আওয়াজ, রাত্রির নিঃসঙ্গ পথের কুকুর, তারা ডাকছে; কখনোবা সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ বেলাভূমে এসে আছড়ে পড়ছে। এই ছবিও ফিলিপাইনের জনজীবনের বাস্তবতা, রাজনীতি ও ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। এখানেও গল্পের প্রেক্ষিত হিসাবে লাভ ডায়েজ বেছে নেন শহরের বাইরে (এমনকি শহরতলীরও নয়) ছিটকে-পড়া ছিন্নভিন্ন মানুষ—আধপেটা খেয়ে হাইওয়ের ধারে গভীর রাতে কোনো রোয়াকে বসে যারা দূর শহরের আলোকমালার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। এক শ্রমিকের পরিবার যার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দুর্ঘটনায় পতিত হলে তার স্ত্রী, তাদের দুই শিশু সন্তান ও তাদের ওপর নির্ভরশীল স্ত্রীর ছোটবোনসহ গোটা পরিবারটি শোচনীয় অবস্থার মুখোমুখি হয়। বাধ্য হয়ে তারা স্থানীয় মহাজন তথা পেশাদার অর্থলগ্নীকারী এক মহিলার দারস্থ হয় এবং তার কাছে সংসারের প্রয়োজনে ঘরের মালামাল বিক্রি করে দিয়েও বিপুল দেনা অপরিশোধ্য থেকে যায়। এই প্রেক্ষাপটে, এলাকায় বসবাসরত আইনের এক মেধাবী ছাত্রের (যে কিনা আইনের কোর্স শেষ করার ব্যাপারে ইতোমধ্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এবং অথলগ্নীকারী পূর্বোক্ত মহিলার কাছে যারও কিছু দেনা আছে) হাতে মহিলা ও তার কন্যা খুন হয়। ঘটনাক্রমে পুলিশ এসে সন্দেহবশত পূর্বোক্ত দুর্ঘটনাকবলিত শ্রমিককে গ্রেফতার করে, পুলিশের ধারণা দেনাপাওনা নিয়ে মহিলার সাথে আগে সংঘটিত এক বচসার জের হিসাবে এই খুন সেই করেছে। মিথ্যা অভিযোগে শ্রমিকের সশ্রম কারাদণ্ড হয়, ওদিকে ছোট দুই শিশু সন্তান ও নিজের বোনকে বাঁচানোর জন্য শ্রমিকের স্ত্রী ফেরি করে বাড়ি বাড়ি সবজি বিক্রি করার কঠোর জীবিকা বেছে নেয়। একদিন জেল থেকে স্বামীকে দেখে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় তারও প্রাণহানি ঘটে। ওদিকে প্রকৃত খুনি আইনের ছাত্রটি তীব্র অপরাধবোধে তাড়িত হয়। ধীরে ধীরে সে মানসিক সুস্থতা হারিয়ে ফেলে। মাত্র ৩/৪টি চরিত্র নিয়ে সাজানো গল্প গোটা মানবজীবনের গভীরে আলো ফেলেছে। অপরাধ, বিচার বিভাগের তদন্তে দুর্বলতা, অপরাধবোধে সংকটাপন্ন মনস্তত্ত্ব নিয়ে অসাধারণ ছবি। মুখ্য চরিত্রটি বারবার দস্তয়েভস্কির “ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট”-এর নায়ক রাসকলনিকভের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু পরিচালক গল্প শেষ করেন না—খুনের মিথ্যা অভিযোগে দণ্ডিত শ্রমিকের কারাগারে দিন কাটে, তার স্ত্রীর বোনটি ছোট ছোট ২টি শিশু নিয়ে নতুন সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, ওদিকে প্রকৃত খুনি আইনের ছাত্রটি স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে ধরা দেয় না, কিন্তু মানসিকভাবে নিজের মধ্যে অপরাধবোধে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এই গল্পের কোনো পরিণতি কিংবা সমাধান নাই, এমনকি আশুকালে আশা করা যায় এমন কোনো সমাধানের আভাসও নাই ছবির শেষে। বোধ হয় তা দেখানো পরিচালকের অন্বিষ্টও নয়, হয়তো বা তিনি মনে করেন এই গল্পের কোনো সহজ পরিণতি থাকতে পারে না। একজন শিল্পী হিসাবে তিনি শুধু পারস্পেক্টিভটা তুলে ধরতে পারেন। তিনি ছবির নাম দেন ইতিহাসের অন্তিমের ধারাভাষ্য। এই ইতিহাস বলতে হয়তো তিনি তাঁর নিজের দেশের ইতিহাসকেই বুঝিয়েছেন, কিন্তু সিনেমা নির্মাণে তাঁর দক্ষতা ও শক্তি ছবিটিকে যে মাত্রায় উন্নীত করেছে তা বিশ্বমানের।

Norte, the End of history সিনেমার একটি দৃশ্য

লাভ ডায়েজকে আলোচকরা Slow cinema movement-এর অগ্রপথিক বলেছেন। তাঁর কোনো কোনো ছবির দৈর্ঘ্য ১০ ঘণ্টারও বেশি। তার ছবি দেখতে বসে মনে হয় এ-যেন পড়ছি দীর্ঘ কোনো উপন্যাস, কোনো তাড়া নেই—একেকটি ছবি বইয়ের পাতা মুড়ে রাখার মতো, বিরতি দিয়ে দিয়ে ২/৩ দিনে দেখা শেষ হয়। আবার ঠিক তা সিকোয়েল দিয়ে গাঁথা ধারাবাহিক মেজাজেরও নয়। কেননা সবটা মিলে, সবটা জুড়ে তাঁর ছবি। লাভ ডায়েজের ছবি আমাদের অভ্যস্ত চলচ্চিত্র দর্শনে এবং উপভোগে একটা দারুণ ঝাঁকুনি দেয়। কিন্তু আশ্চর্য কুশলতার সাথে তিনি তার দর্শকদের ধরে রাখেন। একেকটি ছবি অন্যটির তুলনায় বিষয়বস্তু ও বক্তব্যে, তার কাব্যিক গভীরতায় কখনো এতটাই বিশিষ্ট যে, তাঁর দীর্ঘ ছবিগুলি জুরিরা দেখেছেন (বলা চলে দেখতে বাধ্য হয়েছেন) ও পুরস্কার প্রদানের স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। হালফিল জমানায় যেখানে দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠেছে ছবির কাহিনী, কি নাটকীয়তায়, কি চোখ ধাঁধানো রঙে, যৌনতায়, ডিজিটাল কারিগরি সম্বল করে যেভাবে দর্শককে দু আড়াই ঘণ্টার প্যাকেজে মুড়ে ফেলা হয়েছে, সেখানে একবিংশ শতকে এসেও লাভ ডায়েজ বলছেন স্থিতধী হতে ; তাঁর মতে ‘ধৈর্য্য’ প্রাচ্যের বৈশিষ্ট্য, তিনি বলছেন—পাশ্চাত্যের সঙ্গে ঠিক এখানে আমাদের তফাতও বটে। ২০১৭ সালে Sight & Sound Magazine-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: “Art is a commitment to the beauty of the Soul.” আর সব মহান শিল্পীর মতো তিনিও আমাদের জানান “আত্মার সৌন্দর্যই” তাঁর অন্বেষা । আর তাঁর স্থির বিশ্বাস হলো এই অন্বেষণে চাই গভীর অভিনিবেশ ও ধৈর্য্য।

৩.
From What is Before—ছবিটির কাছে আবার ফিরে যাই। যেখানে এক রহস্যময় জনপদে বাস্তবতা ও ফ্যান্টাসি, জীবন ও মৃত্যু, সত্য ও কিংবদন্তী মুখোমুখি হয়েছে। এই ছবি দেখতে গিয়ে বারবার আমার তারাশংকরের “হাঁসুলী বাঁকের উপকথা” উপন্যাসের কথা মনে পড়ছিল। এক অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম, যুগ পরিবর্তনের সাথে তাদের অর্থনীতি, আচার অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম এবং পরিশেষে তাদের অসহায় আত্মসমর্পণ ও হাঁসুলী নদীর বাঁকে সেই জনপদের বিলুপ্তি নিয়ে এটি বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম সেরা কাজ। উপন্যাসটি নিয়ে ১৯৬২ সালে পশ্চিম বঙ্গের গুণী পরিচালক তপন সিনহা ছবি বানিয়েছিলেন। শাদা কালোয় তোলা ছবিটি দেখতে গিয়ে আমি এর খারাপ প্রিন্টে বিরক্ত হয়েছি বারবার, সংলাপও অস্পষ্ট।

আমার মনে প্রশ্ন জমেছে; আমাদের এখানে (বাংলাদেশে) কি এমন ছবি তৈরি হয়েছে? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর “কাঁদো নদী কাঁদো” উপন্যাসে বাকাল নদী মরে যায়—জনপদের মানুষ রাতে শুনতে পায় কারুর কান্নার শব্দ, শহীদুল জহিরের “সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো” উপন্যাসে জোছনারাতে খুন সংঘটিত হয় আর ঘুমের মধ্যে এক নারী হেঁটে গিয়ে বিলের পানিতে নগ্ন হয়ে নেমে গোসল করে ফিরে আসে; কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “খোয়াবনামা”র কাৎলাহার বিলের তীরের পাকুড় গাছে আরূঢ় মুন্সীর ইশারায় বিল পাড়ি দেয় গজার মাছের ঝাঁক, তমিজের বাপ বিলের পানিতে দাঁড়িয়ে তা অবলোকন করে রাতভর! এইসব নিয়ে কি তৈরি হয়েছে আমাদের এখানে কোনো ছবি?

আমাদেরও তো গল্প আছে, কিন্তু তা নিয়ে বানাতে হলে চাই লাভ ডায়েজের মত শক্তিমান পরিচালক, চাই প্রয়োজনীয় পৃষ্টপোষক। আর হ্যাঁ সেই সঙ্গে চাই তেমনি রুচিবান দর্শকও!

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;