গন্ধের গহীনে

  • তানিয়া চক্রবর্তী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

PERFUME এই ল্যাটিন শব্দটি “per” অর্থাৎ মাধ্যম এবং “FUMUM” অর্থ ধোঁয়া। প্রাচীন গাছপালার তেল থেকে ধোঁয়ার মাধ্যমে এই সুগন্ধী তৈরি করা হতো। বাইবেল অনুসারে, তিন জ্ঞানী ব্যক্তি যীশুর শৈশবের গন্ধ-রস বহন করত। প্রাচীন মিশরীয়রা বিভিন্ন উপাদান যেমন দারুচিনি, মেহেদি, জল, তেলকাঠ, রেজিন, আঠা মিশিয়ে সুগন্ধি বানাত। আসলে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়স্থ নাসিকায় আমরা খুব প্রখর নয় ঠিক, কিন্তু গন্ধের প্রভাব আমাদের জীবনে অগ্রাহ্য করার মতো নয়। বিভিন্ন পতঙ্গ, পশুরা তাদের প্রজননের মুখ্য আকর্ষণ হিসেবে ফেরোমোন জাতীয় জৈবরাসায়নিকের প্রভাবে প্রভাবিত। বর্তমানে বলা হয়েছে, মানুষের ক্ষেত্রেও নাকি ফেরোমোনের বিশেষ প্রভাব আছে। ছেলেদের স্পার্ম আর ঘামে এবং নারীর মূত্রে নাকি ফেরোমোনের প্রাধান্য থাকে। এমনকি এই তথ্যের প্রয়োগ ঘটিয়ে ফেরোমোন পারফিউম প্রস্তুত করা হয় যাতে নারীর সেন্টে পুরুষের এবং পুরুষের সেন্টে নারীর দেহজ ঘ্রাণের হরমোন প্রদান করা হয়।

সে যাই হোক মোটকথা আমরা রূপ-রস-গন্ধকে কোথাও গৌণ করতে পারিনি। মানুষ যখন থেকে গন্ধ সম্পর্কে শরীরী সচেতনতা বুঝল তখন থেকেই জৈবিক কটূগন্ধকেও চিনতে পারল আর তাকেই প্রতিস্থাপন করতে সুগন্ধী আসলো। ফ্রান্সের প্যারিস আসলেই সুগন্ধির শহর। সেখানকার রাজা চতুর্দশ লুই, সুগন্ধীর প্রতি এত বেশি আসক্ত ছিলেন যে তিনি “SMELLING KING” বা সুগন্ধি রাজা নামে পরিচিত। এখন অবশ্য প্রাকৃতিক নিয়মে পারফিউমের প্রচলন বাড়ছে বৈ কমছে না যেমন—লিলি, ঘাস, মশলা, কাঠ, ফল, রেজিন, শিকড়কে প্রক্রিয়াকরণ করেও সুগন্ধি বানানো হচ্ছে। বিভিন্ন প্রাণী বিশেষত কস্তুরী মৃগের নাভির গন্ধগোকুল থেকে সুগন্ধির উপাদান পাওয়া এক বিশেষ ব্যাপার। একটি ১৫ মিলি পারফিউম সৃষ্টিতে ৬৬০ টির মতো পুষ্ট গোলাপ লাগে। এছাড়াও বেঞ্জিন, অ্যালকোহলের সাহায্যে রাসায়নিক পদ্ধতিতে পারফিউম বানানো হয়েই থাকে।

বিজ্ঞাপন

প্যারিসের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিশিষ্ট, বিখ্যাত জাদুঘর “MUSE`E DU PARFUM MUSEUM”, এটি আসলে সুগন্ধীর জাদুঘর। পারফিউমের আগমন নিয়ে মতানৈক্য আছে। কেউ বলে মেসোপটেমিয়া, ইজিপ্ট শহর কেউ বলে আরব থেকে এর আগমন। যদিও আরব শহরকে “land of perfumes” নামেই লোকজন জানে। সিন্ধু সভ্যতায় হিন্দুদের কাছে সুগন্ধীর প্রচলন হয় ৩৩০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ১৩০০ খ্রিঃ পূঃ পর্যন্ত। হিন্দুশাস্ত্রে চক্রসংহিতা ও শুশ্রুতসংহিতায় আতরের উল্লেখ ছিল। ১৩৭০ সালে রানী এলিজাবেথ ইউরোপে এর প্রচলন করেন, যা সেই সময়ে হাঙ্গরি ওয়াটার নামে পরিচিত ছিল। ইজিপ্টবাসিরা একপ্রকারে পারফিউমের ভক্ত। ইজিপ্টে পারফিউমের দেবতা হলেন “নেফেরটাম”, ফ্যারাওদের জীবনের বিশেষ গুরুত্বের জিনিস ছিল পারফিউম। পারস্যের রাজার হাতের স্থাপত্যেও পারফিউমের বোতলের ছবি ফুটে ওঠে বিশেষভাবে। প্রাচীন গ্রিক ও রোম সাম্রাজ্যে পারফিউমের ব্যবহার শুনলে অবাক হতে হয়। বিশিষ্ট প্লিনি দ্য এল্ডারের বই ন্যাচারাল হিস্টোরিতে এর কথা আছে। বলা হয় এই যুগে বসেও নাকি তাদের মতো অপূর্ব সুগন্ধী বানানো সম্ভব কারণ তারা পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করে গেছে। অলিভ পাতার তেল দিয়ে সে এক অভিনব সহজ প্রক্রিয়ায় সুগন্ধী প্রস্তুতের নিয়ম তারাই বানিয়েছে। সাইপ্রাস শহরে পৃথিবীর প্রাচীনতম পারফিউমের কারখানা অবস্থিত, যা আসলে ভালোবাসার দেবতা অ্যাফ্রোদিতির স্থান।

বলা হয় বর্তমানে ডাকিনীবিদ্যার বিশেষ কিছু প্রয়োগে যেখানে আত্মার সংযোগ স্থাপন করা হয় সেখানেও নাকি বিশেষ পদ্ধতিতে বিভিন্ন সুগন্ধীর ব্যবহার করা হয়। নবম শতাব্দীতে আরবের অ্যালকেমিস্ট আল-কিন্দি তাঁর “CHEMISTRY OF PERFUME AND DISTILLATIONS” বইতে পারফিউম তৈরির ১০৭টি পদ্ধতির কথা বলছেন। ইসলাম ধর্মেও শুক্রবার করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার সঙ্গে সুগন্ধী ব্যবহারের ধর্মীয় নীতির উল্লেখ আছে। ইসলাম ধর্মে সাগ্রহে যে আতরের ব্যবহার আছে তা আবার গ্রিক সংস্কৃতির ওষুধেও ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন গাছের গন্ধ তেল থেকেই মূলত আতর প্রস্তুত হয়। বলা হয় আতরের গন্ধের সুসম্মত প্রয়োগে অতিপ্রাকৃত ভালো ও মন্দ শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পথ রয়েছে। মিশরীয় প্রাচীন সভ্যতায় মৃতদেহে সুগন্ধ দিয়ে তা ঈশ্বরের কাছে দেওয়া হতো। সেন্ট তৈরির পেছনে সঙ্গীতের ছন্দের একরকম সাদৃশ্য আছে অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের উপাদানের কার্যকারিতা অনুযায়ী সুগন্ধীর গন্ধ যথা লেবু একধরনের, গোলাপ বা লেমনগ্রাস একধরনের, অ্যাম্বার, চন্দন এরা আবার আরেকধরণের। বিভিন্ন সেলিব্রিটিরা বিভিন্ন বিলাসিতায় বিভিন্ন প্রকারের পারফিউম ব্যবহার করেন। অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো ঘুমের আগে বিশেষ পারফিউম না মেখে ঘুমোতে পারতেন না। প্রাসঙ্গিকতায় হলিউডের বিশিষ্ট ক্রাইম থিলার “পারফিউম” ছবির কথা মনে পড়ে। কেবল গন্ধ, চরাচরব্যাপী গন্ধের প্রভাব একটা পরিবেশকে কীরকম মোহের খেলায় ডুবিয়ে দিতে পারে। ছবির শেষ দৃশ্যে রুমালের গায়ে লাগা একবিন্দু সুগন্ধী একটা ভারসাম্যকে কিভাবে মিলিয়েমিশিয়ে একাকার করে দেয়। তখন বোঝা যায় এই গন্ধের খেলা কী অতিপ্রাকৃতের মতো...

বিজ্ঞাপন