ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা : উড়াল জাহাজ



অনুবাদ: বর্ণালী সাহা
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দ্য স্কুনার ফ্লাইট’ ডেরেক ওয়ালকটের একটি দীর্ঘ কবিতা। বর্ণসংকর এক নাবিক, যে আবার কবিও—এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে তার সমুদ্রযাত্রা নিয়ে রচিত এই কবিতা, যেখানে উঠে এসেছে ওই অঞ্চলটির জাতিবৈরিতা এবং ইতিহাসের পরতে পরতে লুকোনো লাঞ্ছনা, প্রত্যাখানের আখ্যান। মূল চরিত্রটি বর্ণসংকর হওয়ার কারণে না কৃষ্ণাঙ্গ না শ্বেতাঙ্গ কোনো গোষ্ঠীতেই তার স্থান হয় না। কালোদের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার আগে সে যেমন শ্বেতাঙ্গদের কাছে পরমানুষ ছিল, ক্ষমতা বদলের পর কালোদের কাছেও যথেষ্ট কালো না হওয়ার দরুণ সে বহিরাগত। আর এর মাঝে প্রেমিকা মারিয়া, সমুদ্র আর আকাশের তারার চেয়েও বিশালসংখ্যক দ্বীপপুঞ্জ তাকে ঘুরিয়ে মারে। তার অতীতচারণা আর বর্তমানের ঘটনাবলী পাঠকদেরকে শুধুমাত্র ক্যারিবিয়ার ইতিহাস আর বর্ণবৈষম্যের সাথেই নয় পরিচয় করিয়ে দেয় সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা সৃষ্ট গভীর-গহন ক্ষতের সাথে। সাম্রাজ্যবাদ যে বর্ণবৈষম্যের ধারণাটি শাদাদের মতোই কালোদের মধ্যেও রোপণ করে দিয়েছে—তার সাক্ষাৎ দলিল ওয়ালকটের এই অমর চরিত্রটি। এই কবিতাটি ডেরেক ওয়ালকটের মহাকাব্য ওমেরস-এর পূর্বে লিখিত। তাই এটি ওমেরসের ভাবনাবলয় সৃষ্টিতেও ওয়ালকটকে সাহায্য করেছে যথেষ্ট পরিমাণে। কবিতাটির সমুদ্রযাত্রা যেন এক মহাকাব্যের সূচনা কিংবা অন্যভাবে মহাকাব্যিক কাঠামোতে লিখিত একটি গীতিকবিতা। কবিতাটি ডেরেক ওয়ালকটের নির্বাচিত কবিতা ১৯৪৮-১৯৮৪ থেকে নেওয়া হয়েছে। - বিভাগীয় সম্পাদক


*
১ বিদায়, কারেনাজ, জলযানশোধনের ঘাট!

অলস আগস্টমাসে যখন সমুদ্র কোমল হয়ে ছিল,
আর এই ক্যারিবিয়ানের কিনারার
সাথে সেঁটে ছিল খয়েরি দ্বীপগুলি
গাছের পাতার মতো, তখন আমি
উড়াল নামের সেই জাহাজে নাবিক হয়ে চড়ব বলে
ফুৎকারে নিভিয়ে দিলাম বাতিখানি—
মারিয়া কনসেপশিওনের নিঃস্বপ্ন মুখের কাছেই যেটা জ্বলতেছিল।
আঙিনাটা পাংশুটে হয়ে যাচ্ছিল, আলো ফুটছিল যেই,
ওইখানে দাঁড়ালাম পাথরের মতো
আর বাকি সবকিছু অনড়, স্থবির,
শীতল সাগর ছোট তরঙ্গ ভাঙছিল, যেন ঢেউটিন,
আকাশের ছাদে গাঁথা পেরেকের ছিদ্রের মতো লাগছিল আকাশের তারাদের,
ততক্ষণে একটা বাতাস এসে গাছেদের সাথে কেমন
গায়ে-পড়া ভাব শুরু করে।
নিজের উঠান ঝাঁট দিচ্ছিল প্রতিবেশিনী,
রসকষ নাই মোটে তার, তাকে পার হয়ে ঢাল ধরে নেমে যেতে যেতে আমি প্রায়
বলেই বসছিলাম, “আস্তে ঝাঁট দে, শালি! ওর ঘুম পাতলা অনেক,”
তবুও সেই মাগি তাকাল আমার দিকে এমনভাবে,
যেন আমি নাই, যেন আমি মরা লাশ।
রুটের ট্যাক্সি এসে থামল, তখনো হেডলাইট জ্বলছিল।
ড্রাইভার ব্যাটা দেখি আমার ব্যাগের আগাপাশতলা দেখল হাসি-হাসি মুখে,
দাঁত ক’টা বের করে বলল, “এবার বুঝি, হাইব্রিড, সত্যই ভাগতেছ তুমি!”
গাধার বাচ্চাটাকে জবাব দিলাম না,
কেবল কোনোরকমে উঠে বসলাম আমি পিছনের সিটে।
ঘুলঘুলি বস্তির ঠিক উপরে
দেখলাম আকাশটা পুড়ছে অরুণিমায় গোলাপি হয়ে,
এমন গোলাপি যেন ঘুমের ম্যাক্সি তার, ঘুমের ভিতর যাকে ফেলে এসেছি।
রিয়ারভিউয়ের আয়নার দিকে চেয়ে দেখলাম,
সেখানে একটা লোক, দেখতে সে হুবহু আমার মতোই,
হাপুসনয়নে কাঁদছিল লোকটা
বাড়িগুলি, পথগুলি,
বালের দ্বীপটা জুড়ে যা আছে সকলই,
সকল কিছুরই জন্য।

যা কিছু ঘুমন্ত,
তা সবে রহম করো পরওয়ারদিগার!
রাইটসন রোডে যেই কুকুরটা পচতেছিল তারে দিয়ে শুরু ক’রে
আমারেও দয়া করো প্রভু,
আমিও তো এইসব রাস্তার কুকুর ছিলাম;
এই দ্বীপপুঞ্জরে ভালবাসবার বোঝা বহন করাই যদি আমার নিয়তি
হয় তবে আমার আত্মাপাখি উড়ে যাক পচনের থেকে।
কিন্তু জান কি, ওরা আমার আত্মাটাতে বিষ ঢালা শুরু করেছিল
ওদের বড় বড় বাড়ি আর গাড়ি আর বড় বড় অঙ্কের লুটপাট দিয়ে,
কুলি আর কালা আর সিরীয় কি ফরাসী দোআঁশলায় গুলজার,
তাই আমি ফেলে যাই এই সবকিছু
ওদের তরে, আর ওদের তামাশা-মোচ্ছবের তরে—
এই করে নিলাম আমি সাগরে গোসল,
এই চললাম পথ ধরে।
এই দ্বীপগুলিরে তো চিনি হাড়হদ্দ
দক্ষিণে মনস থেকে উত্তরের নাসাউ দ্বীপতক,
মগজে মরচে-ধরা নাবিক আমি,
নীলাভ সবুজ চোখ, হাইব্রিড বলে ওরা ডাকে আমাকে,
ভদ্রভাষায় লাল পিঁপড়া বলে যাকে; আমি, হাইব্রিড,
দেখেছি কেমন এই বস্তির মতো সাম্রাজ্যসকল
এককালে বেহেশত ছিল।
আমি এক সামান্য লাল পিঁপড়াই যার সাগর ভাল লাগে,
বিলাতি শিক্ষা ছিল দড়,
আমার মধ্যে আছে একাধারে ডাচ, কাউলা এবং ইংরেজ,
হয় আমি কেউ নই, নয়তো আমিই এক জাতি।

মারিয়া কনসেপশিওন তবু ছিল মোর ভাবনার সমস্তটাই,
সাগরের স্পন্দন, সাগরের ওঠানামা দেখতে দেখতে
জেলেদের ডিঙি আর পালতোলা জাহাজ আর প্রমোদের নাও-
ভেড়া বন্দর যেথা নবীন ছবিতে আঁকা সূর্যের তুলির টানে,
স্বাক্ষর করা তারই নাম সূর্যের প্রত্যেকটা প্রতিচ্ছায়া দিয়ে;
আঁধারের কালো এলোচুল নিয়ে সন্ধ্যা যখন
সূর্যাস্ত-রঙের উজ্জ্বল সিল্ক যেটা মারিয়ার ছিল,
সেটা গায়ে দিত,
আর ভাঁজ করে নিয়ে সমুদ্রটাকে
লুকিয়ে পড়ত চাদরের নিচে মারিয়ার সেই
বিখ্যাত তারা-ঝিলমিল হাসি হেসে,
আমি জানতাম আমি বিরাম পাবো নাকো, ভুলে যাওয়া আর হবে না।
কবরের পাশে বসে মৃতের স্বজনেরা বিলাপ করছে ধর, তখন যদি
পুনর্জন্মের কথা কেউ বলে ওদের কাছে,
ওরা তো চাইবে মৃত মানুষ বেঁচে উঠুক, ঠিক কিনা বল?
আগাগলুইয়ের কাছি খুলে গিয়ে উড়াল যখন
দোলবাজি দিয়ে দরিয়ার মুখে চলে যায়, তখন আমি নিজমনে হাসি:
“সাগরে জাল ছড়ালে মাছের অভাব হয় না—এই কথা
বারবার বলে লাভ কী?
আমি চাই না তাকে অসম্ভোগবিদ্ধা,
ভূষিত চাই না তাকে ফেরেশতানিন্দিত নূরে,
পর্ণমৃগের মতো বর্তুল ওই দু’টি কালো চোখ চাই,
ঘামে ভেজা রবিবার দুপুরে পিঠের ‘পরে নখাঘাতে সুড়সুড়ি দিত যে আঙুল,
ভেজা বালিকে শূলানো কাঁকড়ার মতো,
সে আঙুল চাই ততদিন
যতদিনে না আমি একটু হেলান দেবো, একটু হাসতে পাবো নির্ভাবনায়।”
এই যে কাজের মাঝে দেখছি সমুদ্রকে রেশমের মতো চিরে দিচ্ছে
আগাগলুইয়ের কাঁচি, তাকে পার হয়ে হু-হু ক’রে বাজে-বকা ঢেউ ছুটে আসতেছে,
তোমাদের বলি শোনো কসম খেয়ে –
মায়ের দুধের কিরা, রাত্রির চুল্লির থেকে আজ যত তারা
উড়বে, দোহাই তাদেরও—
ঠিকই ভালোবেসেছিলাম আমি
আমার ছেলেমেয়েকে, আমার বউকে আর ঘরকে আমার;
যেমন কবিরা ভালোবাসে সেই কবিতাকে, যে কবিতা কবিদেরই প্রাণনাশ করে,
যে নাবিক ডুবে মরে—সে যেমন ভালোবাসে সমুদ্রকে।

কখনো কি একাকী সাগরতটে চোখ তুলে
দেখেছ তুমি সুদূরে একটা জাহাজ?
এই যে কবিতাখানি লিখছি, আমার শব্দেরা সব সপসপে নুনে ভিজে যাচ্ছে;
তবে আমি যাই,
টেনে ধরি আর টাইট ক’রে গিঁট দিয়ে বাঁধি একএকটা লাইন এই মাস্তুলে-পালে;
সরল বয়ানে মোর সাধারণ ভাষা হোক পালের বাতাস,
কাগজের পাতা আজ পাল হোক তবে
উড়াল জাহাজের।
আগে তবে বলি শোনো কেমন করে এ কারবার শুরু হলো।

*

২ চরমানন্দ, অতলম্‌!

ও’হারার জন্য স্কচের বোতল কিছু পাচার করেছিলাম, বড় সরকারী চাঁই সে,
দারূবৃক্ষের দ্বীপ সেডরোজ থেকে মেইনল্যান্ডখণ্ডে, তাই
উপকূলরক্ষীরা ধরতে পারেনি আমাদের,
স্প্যানিশ কিশ্‌তি-কোশাগুলির সঙ্গে বরাবর আপস-রফাই হতো,
তবু একটা কণ্ঠ আমায় বলে যেত:
“দ্যাখ্‌ হাইব্রিড, এই ব্যবসাটা কীরকম বোম্বেটেগিরির!”
নিয়তির কথন, সে গেল নাকো খণ্ডানো! সমস্ত কারবার ধসে পড়ল। আর
আমি ধসে পড়লাম একজন নারীর কারণে,
তার ফিতা, জরি, সিল্কের কারণে,
মারিয়া কনসেপশিওন তার নাম।
আর হায়, এরপরই শুনলাম
তদন্ত কমিশন বসবে বিরাট অনুসন্ধানকল্পে, মজার ব্যাপার
হলো ও’হারা নিজেই চেয়ারম্যান হয়ে
অবৈধ মদ পাচারের কেস তদন্ত করবে নিজের।
আমার ভালই জানা ছিল গোয়ামারাটা কে খাবে,
হাঙরের চামড়ায় ঢাকা ওই হাঙরটা নয়, তার সঙ্গের ফেউমাছটা—
তোমার-আমার মতো খাকি প্যান্ট-পরা সাধারণ লাল পিঁপড়াই ছিল সে।
এর চেয়ে আরো বাজে ছিল, মারিয়ার সাথে আমার ঝগড়া চলছিল,
প্লেট-গ্লাস ছোঁড়াছুঁড়ি, জঘন্য, তাই আমি প্রতিজ্ঞা করি: “আর নয়!”
আমার বাড়ির লোক, আমার ফ্যামিলিটাকে চুরে-মেরে শেষ করে দিচ্ছিলাম আমি।
এমনই ফকির আমি হয়ে গেছিলাম,
সানগেলাস একখান আর একখানা শুধু মদের গেলাস
হলেই আমার চলে যেত,
অথবা চারটা করে গেলাস এবং সানগেলাস (যেমন
নাজাত পাওয়ার তরে ধর্মবিশ্বাসীর লাগে),
তাই নিয়ে বসে যাব চার-গেলাসীর রাজধানী শহরে;
পয়সা বলতে মোর ছিল শুধু সাগরের রুপালি কয়েন।

মন্ত্রীদেরকে নিশ্চয়ই দেখেছ আজকের বার্তা পত্রিকায়,
গরিবের বাপমা উনারা—ওদের পিঠের
উপর একটা হাত রাখা উনাদের,
আর একখানা পুলিশের দল রাখা
শুধু উনাদের বাড়ি পাহারা দিতেই,
স্কচের নহর বয়ে যাচ্ছে সেই বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে।
এখন আসা যাক সেই মন্ত্রী নামধারী পিশাচের কথায়–
মদ চোরাচালানের হোতা ছিল যে,
শালা আধা-সিরিয়ান গিরগিটি, ওর মুখটা
পুরু পাউডারে মাখানো,
আঁচিলগুলি আর পাথর চোখের পাতাগুলি দেখে মনে হতো
অনাদিকালের কোনো পচাগলা পাঁক চুয়ে চুয়ে
পিণ্ড জমাট বেঁধে গেছে;
ধনদৌলতে চুবিয়ে রাখা সে মুখটা
যখন আমি দেখলাম ঠাডা-পড়া, ক্যামেরার ফ্ল্যাশের নিকটে,
গায়ে জ্বালা ধরে গেল মোর।
বলে উঠলাম আমি, “হাইব্রিড, বুঝলানি, কী বালের এইসব!”,
তাতে ব্যাটা কাকে যেন ডেকে
লাথ মেরে ভাগাল আমারে,
বিদায় করাল তার অফিসের থেকে যেন আমি কোনো ভ্যাগাবন্ড আর্টিস্ট।
হারামির গুমোর কত!
সিংহাসনের থেকে নিচে নেমে এসে
নিজের পা লাগিয়ে লাথিটাও দেন না উনি।
এমন সব জিনিস চোখে দেখেছি,
যেসব দেখলে কেনা বান্দির পোলাদেরও বমি আসবে,
এই ত্রিনিদাদে, এই রক্ত-গন্ধশোঁকা ডালকুত্তাদের
মহাজনপদে।

মাথার ভিতর থেকে সাগরের কোলাহল ঝেড়ে ফেলে দিতে পারলাম না,
কর্ণলতির শঙ্খ শুধুই গাইছিল মারিয়া কনসেপশিওন,
তাই আমি কাজ শুরু করি
এক পাগলাচোদা আইরিশের সাথে উদ্ধারজাহাজের ডুবুরি হিসাবে,
লোকটার নাম ছিল ও’শনেসি, আর
ব্রিটিশ একটা মাল ছিল ‘হেড’ নামে;
কিন্তু এ ক্যারিবিয়ানের জল এমনই
রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে লাশে,
যেই না গলে-গলে মিশে যেতাম আমি পান্নাপানিতে,
মাথার উপরে জলছাদ ঢেউ তুলত
যেন কোনো রেশমের তাঁবু,
দেখতে পেতাম আমি প্রবালের দল: কেউ মগজ, কেউ আগুন, সাগরপাখা,
কেউ মরা মানুষের আঙ্গুল যেন,
আর তারপর, সাক্ষাৎ মরা মানুষ আমি দেখতে পেতাম।
সেনেগাল থেকে সালভাদর পর্যন্ত গুঁড়া-গুঁড়া পাউডার বালি
ওই মরা মানুষের হাড্ডি-চূর্ণ যেন, শাদা গুঁড়া করে রাখা আছে।
তিনডুবে গিয়ে আমি আতঙ্কে ভেসে উঠলাম,
একমাস নৌজীবী-হোস্টেলে থাকলাম। মাছের পাতলা ঝোল, সুরা-নসিহত।
যখনই মনে হতো, বউটারে আমার কী দুঃখ দিয়েছি,
যখনই নিজের যন্ত্রণা দেখতাম ওই অন্য মেয়েলোকটা নিয়ে,
সাগরজলের নিচে কানতাম আমি,
লবণে লবণ মিশায়ে,
রূপ তার তলোয়ার হয়ে পড়েছে এমনই আমার উপরে,
কোপ দিয়ে আলাদা তা করে দিয়েছে আমারে আমার সন্তানের থেকে,
মাংসের ভেতরেরও মাংস ওরা আমার; বাছারা আমার!

সেন্ট ভিনসেন্ট দ্বীপ থেকে আসা একখানা বজরা ছিল, যদিও সেটা
এতই গভীর ছিল, ভাসানো যেত না তাকে আর।
যখন আমরা মদ খেতাম, ব্রিটিশটা
পেরেশান হয়ে যেত ঘ্যানঘেনে কান্নায় মোর,
মারিয়া কনসেপশিওনের জন্য আমি এত কানতাম।
ব্যাটা বলত সে নাকি গাঁটের ব্যথায় ভুগতেছে—
গ্যাসবুদবুদ জমে ডুবুরির দেহে যেটা হয়।
কপাল ভাল ব্যাটার! মারিয়া কনসেপশিওনের জন্য মোর পরানে যে ব্যথা,
যে ব্যথা দিয়েছি আমি বউ আর ছেলেমেয়েদের,
তার চেয়ে ভাল গাঁটে ব্যথা হয়ে মরা।
জলের গভীরে যেই পুলক-সমাধি,
সেখানে এমন কোনো শিলা ছিল না,
যেটার ফাটলে আমি আমার আত্মামণি লুকিয়ে রাখতে পারতাম,
যেমন লুকিয়ে পড়ে উদোপাখি প্রতি গোধুলিতে,
এমন আলোর বালুতট কোনো ছিল না কোথাও,
যেখানে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া যেত, চিতিঠুঁটি পাখিরাও সেটা জানে,
তাই একবার আমি সমাধি নিলাম, আর খোদাকে দেখলাম
কোঁচবেঁধা বোল মাছ যেন, খুনআলুদা রক্তাক্ত শরীর,
দূরের কণ্ঠ এক গুমগুম নির্ঘোষে বলল আমায়, “হাইব্রিড যদি তুই
তারে ছেড়ে যাস যদি তারে ছেড়ে যাস,
তোর হাতে তুলে দেবো ভোরের তারা।”
যখন সে পাগলাগারদ ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম,
ভিন্ন মেয়েলোকের স্বাদ নিতে গেছি, তবু একবার কাপড় খুলত ওরা যেই,
ওদের ছুঁচালো মাঙ সিন্ধুসজারুর ডিমের মতন
লোমকাঁটা দিয়ে দাঁড়িয়ে যেত, তাই আমি
ডুব দিতে পারি নাই আর।
ইমাম সাহেবও এসে ঘুরে গেলেন। আমি পাত্তা দিলাম না।
কোথা আছে বিশ্রামশালা মোর, হায় খোদা? কোথায় আমার বন্দর?
কোথায় বালিশ যার ‘পরে মাথা রাখতে মূল্য চুকাতে লাগবে না?
আর সেই জানালা কোথায়, যার চৌকাঠ জীবনের কাঠামো হয়ে থাকবে,
যেই জানালার থেকে বাইরে তাকিয়ে র’ব আমি?

*
৩ হাইব্রিড ছেড়ে যায় মহাজনপদ

এখন আমার
আর কোনো দেশ নাই কল্পনা ছাড়া।
এখন তো ক্ষমতা কালাদের দিকেই ঝুঁকেছে,
ক্ষমতার দোলাচল ঘটার আগে
যেমন শাদারা চাইত না,
কালারাও একইভাবে চায় না আমাকে।
প্রথমজন এসে আমার হাতদুটোকে শেকলে বাঁধল আর মাফ চেয়ে বলল,
“ইতিহাস”;
দ্বিতীয়জন এসে বলল আমাকে আমি যথেষ্ট কালো নই,
জাতিগৌরবের যোগ্য হতে যতটা কালো হওয়া লাগে।
আচ্ছা বল দেখি,
কিসের কী ক্ষমতা-টমতা এই অচিন প্রস্তরের ভুঁয়ে—
পিচকারি-প্লেনওলা বিমানবাহিনী আর ফায়ার ব্রিগেড,
লাল ক্রস, পাইক রেজিমেন্ট,
দুইটা কি তিনটা পুলিশ-কুকুর
তোমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবে
যতক্ষণ না তুমি হাঁক পেড়ে সারো,
“প্যারেড, সাবধান!”?
ইতিহাস সাহেবের সাথে একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল,
যদিও আমাকে উনি চিনতে পারেন নাই, পার্চমেন্ট—মানে
পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি কাগজ হয় যেমন, তেমন উনি
শাদা সেটেলারজাত শাদা ক্যারিবীয়,
শরীরে বৃদ্ধ এক সিন্ধুবোতলের
মতো ছিল অজস্র আঁচিল,
কাঁকড়ার মতো গুড়ি দিয়ে চলছিলেন
গ্রিল থেকে ছায়া যেই জালের মতন পড়ে বারান্দাতে, সেই জালের ফাঁকে।
ক্রিমরঙা লিনেনের কাপড়জামা, হ্যাট একই রঙ, লেফাফাদুরস্ত।
তাঁর মুখোমুখি হয়ে হেঁকে বললাম, “হুজুর, আমি হাইব্রিড!
ওরা বলে আমি আপনার নাতি। আপনার কি মনে আছে
আমার দাদীকে একটুও, আপনার
রাঁধুনি ছিল, জাতে কালো?”
হারামিটা খক্‌ করে থুতু ফেলল।
এরকম এক থুতু অগণন কথার সমান।
হারামজাদারা তবু আমাদের জন্য
বাকি রেখেছে তো শুধু ওই:
কথা আর কথা।

আমি আর বিপ্লবে বিশ্বাস করতাম নাকো।
নিজের মানবী বলে যাকে জানতাম তার ভালবাসার থেকে
বিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল।
আলেক্সান্দর ব্লককে পড়েছি, তাঁর ‘ওরা বারো জন’ কবিতায়
ওই মুহূর্তটাকে পষ্ট করেই দেখিয়েছেন।
এক রবিবার দুপুরে,
মেরিন পুলিশ ব্রাঞ্চ আর ভেনেজুয়েলানা হোটেলের মাঝে আমি ছিলাম।
জোয়ান ছেলের দল ওদের গায়ের শার্ট খুলে পতাকা বানিয়েছিল,
ওদের বুক খোলা—বিদীর্ণ হয়ে যাবে সে অপেক্ষায়।
পাহাড়ের ভিতর এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা দুর্বার, আর
যেই না সমুদ্রের ফেনা উঠে গেঁথে গেল বালির মর্মস্থলে,
ওদের কলধ্বনি থেমে গেল, আর
বৃষ্টির মতো ডুবে গেল তারা উজ্জ্বল পাহাড়ে,
প্রত্যেকে নিজ-নিজ বাদলা মেঘ সমেত ঝরে গেল, আর
রাস্তায় ফেলে গেল গায়ের জামা,
এবং ক্ষমতার প্রতিধ্বনি
রেখে গেল সরণির শেষ মাথাতে।
বেঁটে পাখাওলা ফ্যান ঘোরে সংসদীয় উচ্চসভার উপরে;
বিচাপতিরা নাকি, দুর্মুখে এও বলে, এখনো ঝরান
রঞ্জক-কেমিক্যাল মেশা লাল ঘাম,
ফ্রেডরিক সরণিতে গোঁফখেজুরের দল মিছিলযাত্রা করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চল,
নতুন বাজেট আসে, পাতা ওল্টাও এবে। সাড়ে বারোটার
সিনেমা দেখতে গিয়ে হলের প্রোজেক্টর নষ্ট না-হলেই বাঁচোয়া,
নইলে বিকল্প আছে: গিয়ে বিপ্লব দেখ!
পর্দার সামনের তৃতীয় সারিতে
আলেক্সান্দর ব্লক এসে বসে যান চকলেট কোন খেতে খেতে,
স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন ঘরানার ছবি শুরু হবে একটু পরেই, ক্লিন্ট ইস্টউড
আছে এই ছবিতে; নামভূমিকায় আছে লী ভ্যান ক্লিফ।

*
৪ উড়াল পেরোয় রজকিনী গ্রাম

গোধূলিবেলা।
উড়াল পেরিয়ে যায় রজকিনী গ্রাম।
চাকার মতন যত সমুদ্রচিল।
আবার বন্দুকের ঘায়ে ফেনা শাদা থেকে বাদামী স্ফটিকরঙা হয়,
আকাশের তারাগুলি লাইটহাউজের সাথে শুরু করে দোস্তি জমানো,
প্রতিটি সাগরতটে এসে শেষ হয়ে যায় সুদীর্ঘ দিন,
সেখানে, বালির সেই বিস্তারে, তার শেষভাগে
একটি রিক্ত সৈকতে যেথা আলো ছাড়া আর কিছু নাই,
কার যেন গাঢ় হাত কালো সমুদ্রটার জালের খেপ ধরে টানা শুরু করে,
টেনে নিয়ে যেতে চায় তারে
গভীর, গভীর স্থলভাগে।

*
৫ (আদিদাস পন্থের) মজঝিম পাথারের মুখোমুখি হাইব্রিড

তার পরদিন ভোরে রান্নাঘরের দিকে হেঁটে গেলাম আমি, কিছু তাড়া ছিল,
একটু কফি বানাতে হবে;
সাগরের থেকে কুয়াশার কুণ্ডলী উপরের দিকে উঠছিল
ধোঁয়া বের হওয়া কেটলিখানার মতো,
কেটলিটাকে নামিয়ে রাখলাম ধীরে, অতিধীরে,
কারণ নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না:
দিগন্ত যেইখানে রুপালি এক অবচ্ছায়া হয়ে ছিল,
কুয়াশা সেইখানে পাক খেয়ে, ফুলে গিয়ে, হয়ে উঠেছিল
নৌবহরের পাল, এত কাছে যে
চাক্ষুষ দেখলাম ওইগুলি নৌকার পালই ছিল বটে,
চুল খাড়া হয়ে গেল, খামচে ধরল মোর খুলি,
কী যে ভয়ঙ্কর সেটা, তবু যে কী সুন্দর!
জাহাজের বহর তো নয় যেন মর্মর-পাতার জঙ্গল,
পালগুলি শুকনা কাগজ,
তারই মাঝ দিয়ে ভেসে গেলাম আমরা,
কাচের এপার থেকে দেখি আমি ওখানে মানুষ—
মরিচাধরা ওদের চোখের গর্ত,
কামানের খোলের মতন,
অর্ধ-উলঙ্গ ওই নাবিকেরা
সূর্যকে পাড়ি দিল যেই—
সূর্যের রশ্মিতে তুলে ধরা পাতা যেমন দেখা যায়—
ঠাহর করলে তুমি তেমনই দেখতে পেতে নাবিকগুলির হাড়গোড়
চামড়ার কলা ভেদ করে;
ফ্রিগেট, বার্কেনটিন—বিখ্যাত জাহাজ এসব—উজানের ঢেউ ক্রমশ তাদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
দেখলাম ডেকের উপর
বড় বড় নৌসেনাপ্রধানেরা উদ্ধত দাঁড়িয়ে আছে,
রডনি, নেলসন, ডে গ্রাস প্রমুখ,
হুকুম করছে ওরা বাজখাঁই গলায় ওই জাহাজের হাইব্রিডদের,
জঙ্গলের মতো সেই মাস্তুলের ঝাড়
উড়ালকে ভেদ করে ভেসে চলে গেল, তারপর
জমিন ঘেঁষে বাতাস বয়ে গেলে পরে ঘাস শনশন করে যেরকম,
সেরকম অশরীরী শব্দ উঠল ঢেউয়ে, আর জাহাজের পাছাড়িতে
জড়ানো জলজ আগাছাগুলি
হিসহিস করল
ঢেউ যেই ওগুলিকে হিঁচড়ে নিয়ে গেল,
আর কিছু শোনা গেল না;
ঢেউগুলি ভেঙে ধীরে দোলা দিয়ে চলে গেল পুব থেকে পশ্চিম দিকে,
যেন এই গোলাকার পৃথিবীটা কোনো
হাতল-ঘোরানো এক জলচাকা কল,
কাঠের ছেঁওতি-বালতির মতো যেন তায় প্রতিটা জাহাজ—
অঝোরে ঢালছে জল, অতল তলের থেকে সেঁচা;
আমার অতীতস্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছিল আমার অগ্রজ
সকল নাবিককে কেন্দ্র করে,
তারপর সূর্য দিগ্বলয়ের অঙ্গুরিটাকে তাতিয়ে তুলল আর
বাষ্প হয়ে গেল ওরা।

এরপর পার হই বাণিজ্যতরী—ক্রীতদাস চালান দেওয়ার।
সব জাতিরাষ্ট্রের পতাকাখচিত,
পাটাতনের এত গভীরে সেঁধিয়ে আছে আমাদের পিতা-পিতামহেরা,
আমাদের হাঁকডাক শুনবে না মনে হয়। হাঁকডাক আমরা থামাই তাই।
কে জানে কে কার দাদা? নাম জানা সে তো আরো দূরের কথা।
কাল আমাদের গন্তব্যস্থল হবে বারবাডোজের তটরেখা।

*
৬ নাবিক ঝাউগাছকে গানের জবাব দেয় গানে

উনাদের দেখা যায় বারবাডোজের নিচু পাহাড়ের গায়ে
বাতাসেরে ঠেকা দিতে জড়া বেঁধে থাকেন,
ঝড়ে ফোলা বাতাসের মুখে তাঁরা এক একটা সুঁই,
সার বেঁধে ঢাল বেয়ে নেমে যান, ঠিক মাস্তুলের চেহারা,
আশেপাশে ছেঁড়া মেঘগুলি ছেঁড়া পালের মতন;
উনাদের মতো আমি সবুজ ছিলাম একদিন, সেসময়ে ভাবতাম
সাইপ্রেস বলে ডাকে যাঁরে,
সাগরের গায়ে হেলে পড়া যেই গাছগুলি সাগরের কোলাহল উর্ধ্বশাখায় বয়ে নেন,
আসলে সে গাছগুলি সাইপ্রেস নন, উনারা ঝাউগাছ।
কাপ্তান দেখি ক্যানেডিয়ান সেডার নামে ডাকে।
সেডার কি সাইপ্রেস কিবা ঝাউগাছ
যারা এইসব নামকরণ করেছিল, তারা জেনেবুঝেই করেছিল,
হয়তো দেখেছে তারা নুয়ে পড়া গাছেদের দেহ
হুহু ক’রে নারীদের মতো হাহাকার করে উঠছে ঝড়ের পরে—
হয়তো কোনো জাহাজ ঘরে ফিরেছে
আর সাথে নিয়ে এসেছে
আরো একজন নাবিকের ডুবে মরার সংবাদ।
একটা সময় “সাইপ্রেস” শুনতেই বেশি লাগসই মনে হতো সবুজ “ঝাউগাছ” এর চেয়ে,
যদিও বাতাসের
কাছে বেশকম নাই, যে শোকেই মূহ্যমান হয়ে তাঁরা নুয়ে পড়ে থাকুন না কেন,
যেহেতু উনারা তো গাছই মাত্র,
বেহেশতি ঝাঁপ আর কবর পাহারা দেওয়া ছাড়া
কী নিয়েই বা ভাবতে হয় উনাদের?
নামে তাই কী বা আসে যায়?
তবু দেখ, অবিকল তেমনই হয় জীবন—নাম যেরকম হয়ে থাকে।
বাঁচতে হবে তোমাকে বহিরাগত কোনো প্রভুর নিচে
বুঝতে হয় যদি নামের তফাত কত প্রকার ও কী কী,
জানতে হয় যদি কোন্‌ সে বেদনা ইতিহাসের যা শব্দেরা বহন করে,
বাসতে হয় যদি ভাল ওই বৃক্ষগুলিরে
হীনতর ভালবাসা দিয়ে, হয় যদি
বিশ্বাস করতে যে: “ওই ঝাউগাছেরা সাইপ্রেস গাছেদের মতো নুয়ে পড়েন,
নাবিকের বউদের মতো উনাদের চুল বৃষ্টিতে নিচে ঝুলে পড়ে।
বিশুদ্ধ বৃক্ষ উনারা, আর আমরা,
আমরা যদি কেবল আমাদের প্রভুগণ খুশি হয়ে যে নাম দিয়েছেন,
সেই নাম মোতাবেক বেঁচে থাকি, সাবধানে কপি করে যাই,
মানুষ হওয়ার কিছু চান্স তাতে আমাদের থাকলেও থাকতে পারে বটে।”

*
৭ উড়াল নোঙর ফেলে ক্যাস্ট্রিজ বন্দরে

যখন ক্যাস্ট্রিজের উপরে ছেয়ে থাকা তারাগুলি ছিলেন তরুণ,
শুধু তোমারেই আমি ভালোবেসেছিলাম আর ভালোবেসেছিলাম আমি সমস্ত ভুবন।
আমাদের দু’জনের আলাদা জীবন, তাতে কী বা আসে যায়?
আলাদা আলাদা সন্তান আমাদের, তাই তাদের ভালবাসার দায়ভার আছে?
যখন ভাবি তোমার বাতাসে বিধৌত
কাঁচা ঢলোঢলো মুখখানি,
তোমার গলার স্বর—সাগরের করাঘাত লেগে, আহা, সেই মধুহাসি?
সব বাতি নিভে গেছে লা টক-এর সিঁড়ি-অন্তরীপ জনপদে,
শুধু হাসপাতালের বাতিটা জ্বলছে।
ওদিকে ভিজির তটে প্রমোদতরণীদের ঘাটে
বাতিগুলি পাহারা দিচ্ছে। আমি কথা রেখেছি,
নিজের সম্পত্তি একটাই মোর,
তোমারেই সেটা দিয়ে যাই—
আমার কবিতা— তোমারেই,
সকলের আগে ভালোবেসেছি যারে।
আমরা এখানে শুধু একরাত আছি।
উড়াল আগামীকাল বিদায় নেবে।

*
৮ জাহাজে দাঙ্গা-ফাসাদ

এক হারামি ছিল জাহাজে, সে আমাকে নিশানা বানিয়েছিল—
জাহাজের কুক। চুতিয়াটা ছিল গ্রেনাডার মাল।
চামড়াটা ছিল যেন খইয়া বাবলা,
খসে খসে পড়া লাল গাছের বাকল,
ঝাপসা আবিল নীল চোখ; সে আমাকে একটুও তিষ্ঠাতে দিত না,
ভাবখানা যেন উনি শাদা মহাজন।
একটা খাতা ছিল আমার, এই যে এই খাতাটাই, যেটায় কবিতা লিখতাম,
তো একদিন এই শালা আমার হাত থেকে কেড়ে নিল সেটা,
ডানে-বাঁয়ে লোফালুফি শুরু করল সে,
অন্য নাবিকদের দিকে চিৎকার করে ছুঁড়ে দিয়ে বলল সে, “ধর্‌!”
ঠমক-লচক দিয়ে আমার হাঁটা দেখাল যেন আমি একটা মুরগি,
শুধু কবিতা লেখার দোষে।
কিছু কেস ঘুষির লায়েক,
দাঁড়ের গোঁজটা দিয়ে দু’ঘা দিলে কিছু কেস চুকেবুকে যায়,
কিছু কেস আছে যাতে ছুরি দরকার হয়ে পড়ে—
এইটা তেমনই কেস ছিল। আমি প্রথমে তো মিনতি করেছি,
বলেছি ফেরত দিতে খাতা, দিল নাকো,
উল্টো সে খাতা খুলে পড়তে লাগল, “অয়ি অর্ধাঙ্গিনী! মম সন্তানসন্ততি!”
আবার রঙ্গ করে কান্নার ভং ধরল সে যাতে নাবিকেরা হাসে;
হঠাৎ কী চলে গেল উড়ুক্কু মাছের মতন?
রুপার ছুরি আমার, ইস্পাতের ফলা
হামলা করল তার উপর, তার পায়ের ডিমের নধর মাংসটা বরাবর,
ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেল শালা, আর শাদা হয়ে গেল,
যতটুক শাদা সে নিজেকে ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি শাদা।
আমি বাপু মনে করি মানুষে-মানুষে এইসমস্ত হওয়া প্রয়োজন।
ন্যায্য না, তবু যেটা যেমন, সেটা তেমনই। যন্ত্রণা পায়নি ততটা,
কেবল প্রচুর রক্ত,
ভিন্সি আর আমি ধরো খাস দোস্তো,
তবু আর কোনোদিন ওদের মধ্যে কেউ আমার কবিতা নিয়ে চুদুর বুদুর করবে না।

*
৯ মারিয়া কনসেপশিওন আর খোয়াবনামা

উড়ালের উপর যে ফাটা-বাঁশ বিমানটা চিল্লাচ্ছিল,
অতীতের একখানা পর্দা সে খুলে দিচ্ছিল।
“ঐ দেখা যায় ডমিনিকা!”
“এখনো ওখানে আদিবাসী পাবা।”
“একদিন আসবে যেদিন শুধু বিমান থাকবে, কোনো নৌকা রবে না।”
“আল্লাহ্‌ কি আকাশে উড়ার লেগে আদমেরে বানাইয়েছে, ভিন্স?”
“উন্নয়ন, হাইব্রিড, উন্নয়ন।
উন্নয়নই তো মূল কথা।
উন্নয়ন পিছে ফেলে যায় আমাদের মতো ছোট-দ্বীপ শরিকেরে।”
জাহাজ চালাচ্ছিলাম আমি, ভিন্স পাশে বসে ছিল
বর্শায় মাছ ধরছিল আর বাজে বকছিল।
শীতশুখা, চনমনে দিন আর চঞ্চল সাগর।
“উন্নয়ন কী জিনিস ঐ আদিবাসীদের জিজ্ঞেস কর।
ওদের তো ধরে ধরে নিকেশ করেছে লাখে লাখে, কিছু যুদ্ধে মরেছে,
বাদবাকি কিছু গেছে বেগার খাটুনি খেটে খনির ভিতর
রুপা খুঁজে খুঁজে,
তারপর কালাদের পালা; ল্যাও, আরো উন্নয়ন।
যতদিন না-দেখব সুস্পষ্ট প্রমাণ,
মানবজাতি যে বদলাবে, ভিন্স, এই কথা আমাকে বলো না।
উন্নয়ন—সে তো
হলো ইতিহাসের এক নোংরা তামাশা।
ঐ দেখো কাছে আসে দ্বীপের সীমানা, কী বিষণ্ণ সবুজ, তাকে জিজ্ঞেস কর।”
সবুজ দ্বীপগুলি দেখতে এমন যেন ফিটকিরিতে জারানো আমের ফালি,
এমন কড়া লবণে আমার ক্ষতরও কিছু উপশম হোক,
সমুদ্রনাবিক আমি, সতেজতা স্বভাবে আমার।
আকাশ ঝলকেছিল বরফের মতো সেই রাতে, এক আগুনে।
আদিবাসী যেন আমি, ছুটলাম ডমিনিকাময়,
নাকের রন্ধ্র মোর আটকে উঠল ধোঁয়াধূমার স্মৃতিতে;
আগুনে পুড়ছিল যে শিশুরা আমার,
আহারে, ওদের চিৎকার কানে শুনতে পেলাম,
খেয়েছি ব্যাঙের ছাতা (মগজের মতো) আর ছত্রাক নামই যার ‘শয়তানের ছাতা’
কুষ্ঠরোগে পচন ধরেছে এমন শাদা পাথরের তলে সেই ছাতা জন্মায়;
সকালের খানা ছিল আধাপচা পাতা
তলাফুটো ভেজা জঙ্গলে,
পাতাগুলি তার ইয়া বড়—মানচিত্র মাফিক,
যেই শুনি সৈন্যসামন্তের হইচই
এগিয়ে আসছে ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে, উঠে দিই ছুট
লালকাঁটা গাছের ফলকদের মাঝখান দিয়ে
(বর্শার চে’ও বেশি ধার),
যদিও কলিজা ফেটে যাচ্ছিল মোর;
শরীরে আমার স্বজাতির রক্ত বয়, তাই নিয়ে
ছুটলাম আমি, ভাই রে, ছুটলাম যেন পটে আঁকা পাখি
ক্ষিপ্র পায়ের তলা শ্যাওলা-ত্বরিত;
তারপরে আমি পড়ে যাই, তবে পড়ি এক বরফঝোরার পাশে যেটা
ছিল সুশীতল এক ফার্নের ঝরনার নিচে। দেখি এক টিয়াপাখি,
চিৎকার দিতে দিতে গাছের শুকনা ডাল পাকড়ে ধরে সে আর আমি শেষমেশ
ধোঁয়ার গোটাকয়েক পেল্লায় আছড়ানো ঢেউয়ে ডুবে যাই;
যখন সেই কালো ধোঁয়ার সেই মহাসাগর সরে যায়,
আর আকাশ শাদা হয়ে যায়,
তখন সেখানে উন্নয়ন ব্যতিত আর কিছুই ছিল না,
যদি বা উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি একটা গোসাপ,
সূর্যের আলোপড়া কচি পাতার মতন প্রশান্ত স্থির।
মারিয়া এবং ওর খোয়াবনামার তরে হাউমাউ করে কাঁদি আমি।

ওর ঘুমে নোঙ্গর ফেলত খোয়াবনামা-বই,
অনিদ্রারোগীর বাইবেল,
ময়লা পুস্তিকা এক কমলা রঙের, ডমিনিক প্রজাতন্ত্র থেকে এ,
মাঝখানে একচক্ষু দানবের চোখ। খরখরে পাতাগুলি
যথারীতি কালো হয়ে ছিল ফালনামা আর ভবিষ্যবচনে,
উচ্চকিত স্প্যানিশে;
খোলা এক হাতের তালুও ছিল, ভাবী
সময়ের রায় দিতে, বিভাজিত, সংখ্যাচিহ্ন আঁকা
কসাইয়ের দোকানে
পশুর ছবি যেমন থাকে।
এক রাতে; জ্বরগায়ে, অসুখে জ্যোতির্ময়ী বলে উঠল সে,
“বইখানা নিয়ে আস, কেয়ামত এসে পড়েছে।”
বলে “স্বপ্নে দেখেছি ঝড় আর কতগুলি তিমি,”
কিন্তু সে স্বপ্নের অর্থ সে বইয়ে ছিল না।
পরে এক রাতে দেখি তিন বুড়ি স্বপ্নে,
রেশমপোকার মতো অবয়বহীন, তারা সেলাই করতেছিল ভাগ্য আমার,
চিৎকার করে আমি বাড়ির থেকে ওদের ভাগাতে গেলাম,
ঝাঁটা দিয়ে মেরে খেদিয়ে দিতেও চাইলাম,
কিন্তু তারা যতই বেরিয়ে যাচ্ছিল,
ততই আবার বুকে হেঁটে ফিরে আসছিল,
ততক্ষণে আমার চিৎকার ও কান্না শুরু হয়ে গেল,
শরীর বেয়ে বৃষ্টির মতো ঘাম ঝরতেছিল, মারিয়া
তন্নতন্ন করে ঘাঁটল সে বই স্বপ্নের অর্থের সন্ধানে;
কিছু মেলে নাই;
স্নায়ুগুলি গলে গেল মোর, জেলিফিশ ছাতাঝুরির মতন—
এই সেই সময় যখন আমি পুরোপুরি ভেঙে গেছিলাম—
ওরা খুঁজে পেয়েছিল মোরে
স্যাভানায়; তৃণমরু ঘিরে
তারস্বরে চিৎকারে রত:

আমারে তোরা সবে বাতাসের সাথে কথা বলতে দেখিস তাই,
ভেবেছিস বুঝি আমি উন্মাদ। ওরে,
এই হাইব্রিড দরিয়ার ঘোড়াদের মুখে লাগাম দিয়েছে;
তোরা তো দেখিস আমি সূর্যের দিকে চেয়ে থাকি
চোখের মণিদুটো ঝলসায় না যতক্ষণ,
তাই ধরে নিস হাইব্রিড উন্মাদ হয়ে গেছে, যত পাগলের দল!
শোনো, শোনো, তোমাদের ধারণাও নাই কত শক্তি আমার।
নারিকেল গাছগুলি দ্যাখ,
দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা আমার সৈন্য, প’রে হলদেটে খাকি,
অপেক্ষা করতেছে ওরা কবে হাইব্রিড এই দ্বীপসমুদায় দখল করবে,
ভয় কর্‌ সেদিনকে বরং, যেদিন আমি মানুষ রবো না আর, সুস্থ হয়ে যাব,
সেই ভাল হবে।
সকলের অদৃষ্ট এ আমার হাতে,
মন্ত্রী, ব্যবসাদার—হাইব্রিড সকলেরে কব্জা করেছে,
মুঠোয় ধরা বালির মতো, মামা, তোমাদের জীবনকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেবো আমি,
এই আমি যার কাছে কোনো অস্ত্র নাই,
আছে শুধু কবিতা আর আছে তালগাছ
(বল্লম তরবারি ওরাই আমার)
আর আছে চকচকে ঢাল সাগরের!

*
১০ গভীরতা, আয়ত্তের বাইরে

পরদিন, সাগর আন্ধার। গোয়ার ব্যথার মতো ভোর।
“বালের বাতাস
বদলায় হুটহাট, মাইয়ালোকের মন যানি।”
ধীরে ওঠানামা ঢেউ, বড় চূড়াগুলি
বরফধবল গিরিশৃঙ্গের মতো।
“হেইও, সারেং, আসমান এত কালো!”
“আশ্বিনে এই ভাব ঠিক লাগে নাকো।”
“এই আলো অদ্ভুত, এমন ঋতুতে
আকাশ থাকার কথা মাঠের মতন ফকফকা।”

চিলশঙ্কর মাছ ডিঙদৌড় দিলো
চাবুকের মতো লেজ বাড়ি দিয়ে সমুদ্র কেটে,
লম্বা শুঁড়ের মনোয়ার মাছ উপকূলপানে ভেসে গেল
লেত্তির পাক খোলা লাটিমের মতো,
লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া তীরন্দাজির সই উড়ুক্কু মাছ
আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে ছুটে গেল,
তুড়ুক্‌ তুড়ুক্‌!
ভিন্স বলে উঠল: “দ্যাখ্‌ মনা দ্যাখ্‌!”
কাউলা-কেশর এক তুমুল তুফান
হামলে পড়ল এসে পালের উপর
কুকুর খুবলে নেয় পায়রা যেভাবে, তারপর মটকালো ঘাড়
উড়াল জাহাজের, মাথা থেকে লেজ-অব্দি কাঁপিয়ে সে দিলো।
“খোদার কসম, কখনোই দরিয়াকে এত খেপতে দেখি নাই এত অল্প সময়ে!
ভগমান সাহেবের পিছ-পকেট থেকে এ বাতাস এসেছে!”
“কাপ্তান যায় কোথা? কানাচোদা নাকি!”
“মরার থাকলে মরবই, ভিন্স, কী বাল আসে যায়?”
“দোয়া পড়্‌, হাইব্রিড, জীবন যদি বা দোয়া না ভুলিয়ে থাকে!”

যথেষ্ট ভালোবেসেছি যাদের, তাদের ওটা ভালোবাসা নয়।
জলের পর্বতগুলির ফাঁকে উড়াল জাহাজ সই করে
শুরু হলো বৃষ্টির ঢিল-পাটকেল,
এর চেয়ে ভাল ছিল জোড়া পায়ে লাথি দেওয়া ডুবো-অগ্নিগিরির খাত।
ভয় লেগেছে কি?
পানির ফোয়ারা যেন তাঁবুর খুঁটি
হয়ে আকাশের সাথে করে কোলাকুলি,
মহাটলোমলো,
মেঘেদের সেলাই খুলে ও ছিঁড়ে যায়
আর আকাশ পানি ঢেলে ভেজায় আমাদের,
নিজের কান্না শুনি, “মারিয়ার খোয়াবনামার আমি সেই
সারেং, যে ডুবে মরে।” মনে পড়ে ছায়া-নৌযান,
প্যাঁচশূল দিয়ে বিঁধে ছিপি খুলে দিই যেন আমি সাগরের,
তলা ছেয়ে আছে যেথা সাগরের কীট,
একবাঁও দুইবাঁও, চোয়াল কঠিন হয় মুঠির মতন,
একটা জিনিসই শুধু ধরে রাখে কেঁপে-কেঁপে ওঠা এ আমারে—
নিরাপদে ঘরে আছে আমার ফ্যামিলি।
সেরকমই শক্তি এক মোরে গ্রাস করে, আর সেই শক্তি বলে:
“পিছিয়ে-পড়া জাতের মানুষ আমি,
যারা আজো খোদা-ভগবানেরে ডরায়।”
ঈশ্বর নিজে এসে কুপোকাত করুন
এ বিশাল সাগরদানোরে,
দরিয়ার তলে বিছানা পেতে যে দড়ি ফেলে দি’ছে,
ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বেঁধে তুলে ফেলে দিন এই জন্তুরে;
এই সেই বিশ্বাস শিশু থেকে যেটা ক্রমে হালকা হয়েছে,
(বাটালি গলিতে সেই মেথডিস্ট চার্চ ছিল, ক্যাস্ট্রিজ শহরে)
তিমির ঘণ্টা যেই গেয়ে গেছে প্রার্থনাগান,
তিমির দেহের মতো খাঁজকাটা বেঞ্চিতে বসে, শোকগর্বভরে,
আমরা গেয়েছি গান কীভাবে যে টিঁকে আছে আমাদের জাত
সাগরের মুখগহবরে, সেই নিয়ে,
আমাদের ইতিহাস, বিপন্নতা নিয়ে, আর এখন,
এখন প্রস্তুত আমি, মরণ যা চায় তা-ই হোক।
কিন্তু এ ঝড় যদি কোনো শক্তি ধরে,
সেই শক্তি কাপ্তানের মুখে:
দাড়িতে পুঁতির মতো পানি লেগে আছে, চোখ অশ্রুতে নোনা।
জায়গায় আটকে আছে সে ক্রুশবিদ্ধ যেন বা,
শক্ত হাতে সে ব্যাটা ধরে আছে চাকা, ক্রস যেরকম খ্রিষ্টকে ধরে ছিল,
দু’চোখে আঘাত যেন কাঁদছে দু’চোখ শুধু আমাদের তরে,
তার মুখে ঢেলে দিতে থাকি শাদা রাম,
প্রতিটা জলের চূড়া সাগরদানোর হাতে চাবুক হাঁকায়,
উড়ালকে পিছনে হটায়,
দুই ক্রিমিনাল যেন আজ যুযুধান। সারা রাত্রি, বিরামহীন, থেকে ভোরবেলার
মতো লাল চক্ষু নিয়ে আমরা দেখি যে
প্রাণান্ত ক্লেশ বুঝি ফিকে হতে থাকে,
ফিকে হয়ে যায়,
আর তারপর দেখি কোনো ঝড় নাই।
দুপুরে সমুদ্র এত শান্ত হয়,
প্রভুর রাজ্য যেন প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

*
১১ ঝড়ের পরে

যেকোনো ঝড়েরই পরে আসে এক কাঁচা আলো,
সাগর তখনো বিধ্বংসী যদিও;
জাহাজের পিছে তায় জেগে ওঠা উজ্জ্বল ফেনাতে
আমি দেখি ঘোমটায় মুখ ঢেকে মারিয়া কনসেপশিওন
দরিয়ারে বিয়ে করে দিয়েছে রওয়ানা;
স্রোতে ভেসে যায় পিছে ক্রমাগত প্রসারিত শাড়ির পাছাড়ি,
শাদা শঙ্খচিল, শাদা জলকুক্কুট মিতকনে-সখীসনে।
তারপর একেবারে গেল।
সেদিনের পরে আর কিছু চাই নাই।
মুখে মোর আড়াআড়ি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল,
সূর্যের মুখে যেবা পড়ে।
শান্ত পারাবার।

আয় ধীরে, বৃষ্টি আয়, সমুদ্রের উদগ্র মুখে
পড়্‌ ছোট মেয়েদের গোসলের মতো; এই দ্বীপগুলি ধুয়ে জ্যান্ত করে দে
হাইব্রিড এককালে যেমন দেখেছে! সব পদচিহ্ন আর সব তপ্ত পথ
থেকে আজ গন্ধ উঠুক মারিয়ার হাতে
সদ্যই ইস্তিরি করা আর জলছিটা পড়া কাপড়ের। আমি শুয়ে স্বপ্ন শেষ করি:
যা কিছু বৃষ্টিতে ভেজে আর সূর্য করে ইস্তিরি—
শাদা মেঘ, সাগর, আসমান—একটা সেলাইয়ে জোড়া
মোর নগ্নতার তরে তেমন কাপড়জামা যথেষ্টই জামা।
যদিও উড়াল মোর পার হয়না কখনো জোয়ারের ঢেউ, যেটা ওঠে
অন্তিম বাহামার সশব্দ তট ছেড়ে সসাগরা জনস্থানমধ্যে এইখানে,
মোর খেদ নাই,
যদি এই হাত কোনো জাতের বেদনারে ভাষা দিয়ে থাকে।
মানচিত্র খুলে দেখো মিয়া,
টিনের থালের ‘পরে খোরাকির দানা যতগুলি,
তারো চেয়ে বেশি দ্বীপ দুনিয়াতে আছে—
ভিন্ন ভিন্ন সাইজ,
এক বাহামাতেই তো আছে এক হাজার
পর্বতের থেকে নিয়ে প্রবালপ্রাচীরে যত টুনি গাছ-ঝাড়,
সেসবের থেকে, আর এই পাল-বেঁধে-রাখা জাহাজের নাক থেকে
সকল শহরকেই দোয়া করি আমি,
আরো দোয়া করি সেই শহরের পিছনের পাহাড়ের ধোঁয়াতে যে নীল ঘ্রাণ থাকে
তারে, আর নিচের ঘরের চালা অব্দি ধীরে চলে যাওয়া এক ছোট রাস্তারে,
কাছির মতন সেটা; আমার জীবনে সার বলতে তো শুধু আছে এই:

এই মাস্তুল, দিকচিহ্ন, এ পিপাসা,
আর এই ঝাঁপ দেওয়া হৃদয়ের ক্রিয়া—
নিশানাকে সই করে এই উড়ে যাওয়া যার লক্ষ্য কভু মোদের জানা হবে না,
শুধুশুধু খুঁজে মরা একখানা দ্বীপ যার বন্দরে গেলে নাকি সব ব্যথা সারে,
আর এক নিষ্কলুষ দিগন্তরেখা,
কাঠবাদামের গাছ যেখানে বালিকে
ছায়া ফেলে ব্যথা দেয় না।
কত কত দ্বীপ!
ততগুলি দ্বীপ আছে, রাতের গাছের ডালে যত তারা ধরে।
শাখায়িত গাছটাতে ঝাঁকি লেগে উল্কা ঝরে পড়ে,
ফলের মতন খসে পড়ে চারিধারে
উড়ালকে ঘিরে।
সবকিছুকেই তবু ঝরে যেতে হয়,
আজীবন তেমনই ঝরেছে,
এক ধারে মঙ্গল, আরেক দিকেতে শুকতারা
ঝরে আর পড়ে আর রহে এক হয়ে এই পৃথিবীও অবিকল যেমনটা এক
ছোট দ্বীপ, তারাদের দ্বীপপুঞ্জমাঝে।
আমার প্রথম বন্ধু ছিল সাগর। আর এখন সে-ই শেষের বন্ধু।
এবার কথা থামাই। কাজে যাই, কিছু পড়া করি,
মাস্তুলের সাথে গাঁথা লণ্ঠনের নিচে বসে জিরাতে জিরাতে।
ভুলে যেতে চেষ্টা করি সুখ, কী ছিল তা,
তাতেও যদি বা কাজ হয় নাকো, তারাদের দেখি।
কখনো আমিই শুধু থাকি আর থাকে ফেনা নরম-কাটারি,
ডেক ক্রমে শাদা হয়ে যায়,
চাঁদাভাই খুলে দেয় একখানা মেঘের দরোজা,
মাথার উপরে শাদা চাঁদঢালা আলোপথ, সেই পথটা আমারে বাড়ি নিয়ে যায়।
হাইব্রিড তোমাদের গান শুনিয়েছিল
সাগরের অন্তস্তল থেকে।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;