ইনতেজার হুসেইনের গল্প : সহযাত্রী



অনুবাদ: সালেহ ফুয়াদ
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

সে যে ভুল বাসে চড়ে বসেছে তা কিছুটা দেরিতে টের পেল। ছোট্ট একটি সুটকেস নিয়ে এ স্টপেজ থেকেই ওঠা সামনের সিটের একহারা গড়নের ছেলেটি কিছুটা বিচলিত। চারপাশের যাত্রীদের বোকা বোকা চোখে দেখে নিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করে—এ বাস মডেল টাউনে যাবে?
হ্যাঁ, তুমি যাবে কোথায়?
মডেল টাউন, জি ব্লক... যাবে তো?
যাবে—মুখোমুখি বসা টাকমাথার রাশভারি চেহারার বৃদ্ধ ভ্রুক্ষেপ না করেই উত্তর দিয়ে চশমাটা ঠিক করে আবারো খবরের কাগজে ডুবে যায়।

এ বাস তাহলে মডেল টাউনগামী, এটায় কেন চড়ে বসলাম? কিছুটা তাড়াহুড়ো আর কিছুটা অন্ধকারের জন্য সে বাসের নম্বরটা ঠিক খেয়াল করেনি। দূর থেকে দেখল বাস দাঁড়িয়ে আছে। দিল দৌড়। কাছাকাছি পৌঁছতেই কন্ডাক্টর দরজা বন্ধ করে বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছিল। আগপাছ না ভেবে লাফ মেরে চলন্ত বাসের ফুটবোর্ডে ঝুলে যায়। তারপর দরজা খুলে বহু কসরতে পথ তৈরি করে ভেতরে পৌঁছে। পরের স্টপেজে যাত্রী নামলে একটা সিট খালি পেয়ে দ্রুত দখলে নেয়। এখন জানা গেল সে ভুল বাসে চড়েছে।

যাক, মাত্র তো সাত পয়সার মামলা। সামনের স্টপেজে নেমে গেলেই হলো। পরের স্টপেজে নামা এবং ওখানে দাঁড়িয়ে আবারও বাসের অপেক্ষা করার কথা ভাবতে কিছুটা কষ্ট তো অবশ্যই হয়েছে। বাসের জন্য অপেক্ষা করার তার রয়েছে বাজে অভিজ্ঞতা। যতবার স্টপেজে দাঁড়িয়েছে ততবারই দেখেছে নানা রুটের রাজ্যের বাস আসে আর যায়, শুধু তার বাসটাই আসে না। আজব হলো, বাড়ি থেকে শহরে যাওয়ার জন্য স্টপেজে দাঁড়ালে কিছুক্ষণ পর পর শহরফেরতা বাস আসত আর যেত। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও শহরমুখী কোনো বাস আসত না। আবার শহর থেকে বাড়ি ফেরার জন্য স্টপেজে এলে একটার পর একটা শহরগামী বাস আসত আর যেত। শহরগামী বাসের লাইন পড়ে যেত। অন্যদিকে বাড়ির দিককার স্টপেজ শূন্য পড়ে থাকত। বহু দূর পর্যন্ত বাসের কোনো নামনিশানা চোখে পড়ত না। হ্যাঁ, এমনটা আকসার হয়েছে—স্টপেজ থেকে খানিকটা দূরে থাকতেই কাঙ্ক্ষিত বাস তার সামনে দিয়ে শাঁ শাঁ করে চলে গেছে। তারপর আবারও সেই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে পড়া এবং টলতে শুরু করা। আজ সঙ্গে সঙ্গে বাস পেয়ে যাওয়ায় মনে মনে বেশ খুশি হয়েছিল। কিন্তু এখন জানা গেল এ যে ভুল বাস!

পরের স্টপেজে এসে আচ্ছা মুসিবতে পড়া গেল, সে নামবে কি নামবে না ঠিক বুঝতে পারে না। একবার ভাবে এ তো সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ। এখানে তার রুটের বাস কোথায় পাবে। পায়ে হেঁটে পেছনের স্টপেজে পৌঁছতে হবে এবং সেখানে গিয়ে আবারও সেই বাসের অপেক্ষা করতে হবে। নামার জন্য দাঁড়িয়েও আবার বসে পড়ে। কিন্তু আমি এ পথ ধরে সামনেই বা কেন যাচ্ছি। এভাবে তো আমি আমার পথ থেকে আরো দূরে সরে যাব। আবারও নেমে পড়তে চায়। কিন্তু দাঁড়ানোর আগেই বাস ছেড়ে দেয়। সেও উঠতে উঠতে বসে পড়ে। বাসের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হতে থাকে যে, নিজের পথ ছেড়ে সে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। এ ভুল বাস আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে। খালিদের কথা মনে পড়ে। খালিদ মডেল টাউনে বাস করত। ও থাকলে কোনো ভয় ছিল না। তার বাসায় আনন্দে রাতটা কেটে যেত। খালিদ, নাইম পাথার, শরিফ কালিয়া; তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুগ্রুপের কথা মনে পড়ে। সবাই এক নতুন বিশ্বের খোঁজে পাকিস্তান ত্যাগ করেছে। সবার শেষে গিয়েছে খালিদ। নাইম আর শরিফ দুই মহামূর্খ স্কলারশিপ যোগাড় করে এখন আমেরিকায় আছে। খালিদ বলেছিল, দোস্ত, স্কলারশিপ না হোক কিছু টাকা পেলেই লন্ডন চলে যাব। এখানে কিছু হবে না। হোটেলে থালাবাসন পরিষ্কার করতে হলে তাও করব। তবু এখান থেকে তো বেরুতে পারব। তার বুঝে আসত না খালিদ এখান থেকে বেরুনোর জন্য এত উতলা কেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে খালিদ ঠিক কাজটাই করেছে। এখানে তো বাসে যাতায়াত করাটাও মহাফ্যাসাদের।

বাসে ভয়ঙ্কর রকমের ভিড়। দরজার কাছে এত যাত্রী দাঁড়ানো যে, সামান্য জায়গার জন্য একজন আরেকজনকে ধাক্কাচ্ছে। একেকজনের গা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। জামা থেকে পচা গন্ধ ভদভদিয়ে বেরুচ্ছে। কিছুটা ভর পাওয়ার জন্য গায়েবি কিছু খুঁজে পেতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে হাতগুলো। রাগে মুখগুলো সঙ্কুচিত, কারো মুখেই হাসি নেই।

টাকমাথার রাশভারি চেহারার বৃদ্ধ মনোযোগের সাথে খবরের কাগজে ডুবে ছিল। কিন্তু সে বেচারাও কাগজ গুটিয়ে তা দিয়ে হাতপাখা চালানো শুরু করল। একহারা গড়নের ছেলেটি আগের মতোই বিচলিত রয়েছে। প্রতিটা স্টপেজেই জেনে নিত—এটা মডেল টাউন কিনা। না-বাচক উত্তর পেয়ে কিছু সময়ের জন্য নিশ্চিন্ত হতো। কিন্তু পরের স্টপেজ আসতে না আসতেই অস্থিরতা বেড়ে যেত। পাশের সিটে বসা ময়লা জামাপরা যে লোকটা অনেকক্ষণ ধরে ঝিমুচ্ছিল এবার বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে সে অবাক হলো। এত শোরগোল আর চেঁচামেচির ভেতরেও লোকটা কী আরামসে ঘুমোচ্ছে, আশ্চর্য!
বাসের গতি বেড়ে গেছে। ইতোমধ্যে কয়েকটা স্টপেজ ফেলে এসেছে। এখান থেকে কি কোনো যাত্রী ওঠানোর ছিল না? উদ্বিগ্ন হয়ে দেখল পরের স্টপেজে খুঁটির নিচের আলোয় একদল মানুষ দাঁড়িয়ে; যেন ঘরদোরহারা উদ্বাস্তুক্যাম্প। সবার চোখ বাসের দিকে। বাসের গতি কিছুটা কমেছিল, কিন্তু কন্ডাক্টরের ‘আ-গে চলিয়ে উস্তাদ’ বলামাত্র আবার বেড়ে গেল। সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে থাকে এতগুলো মুখের সমাবেশে কতটা দ্রুত আশা প্রাণ পেয়েছিল আর কতটা দ্রুতই সে আশায় গুড়েবালি পড়েছে। কতটা দ্রুত মুখগুলো নৈরাশ্যে ঢেকে গেছে, কতটা দ্রুততায় ক্রোধ ছড়িয়ে পড়েছে মুখগুলোয়। কেউ কেউ মনখারাপ করে পায়ে হাঁটা শুরু করেছে। এদেরই একজন লাফ মেরে ফুটবোর্ডে ঝুলে যায়। তারপর জোর করেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যেতে থাকে। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে-থাকা যাত্রীদের বেজায় রাগ হয়। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। কন্ডাক্টর বাঁশি ফুঁকলে বাস থেমে গেল। ‘বাবু উতর যা, মেঁ কাহতা হুঁ উতর যা’। ভেতরে প্রবেশকারী লোকটা বিষঢালা চোখে একবার কন্ডাক্টরের দিকে আরেকবার মজমার দিকে তাকায়। তারপর রাগে ঠোঁট কামড়ে নিচে নেমে পড়ে।

সে ভাবে, তারও নেমে পড়া উচিত। নিশ্চিত সে ভুল বাসে সওয়ার হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে বাস ছুটতে শুরু করেছে। তাছাড়া দরজাটাও প্রচুর লোক ঘিরে রেখেছে। আর সিটের সামনে তো এক মানবপ্রাচীর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদের সবার বিরুদ্ধে তার ভেতরে ঘৃণা সৃষ্টি হতে থাকে। চিল্লাচিল্লি-ধাক্কাধাক্কি করে ঘামে ডুবন্ত এ নোংরা লোকগুলোকে তার মনে হয়, মনুষ্যত্বহারা প্রাণী। সে এদের প্রতি এতটাই ঘৃণা পোষণ করছিল যে, তার বাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সে এখুনি দরজা খুলে লাফ দিত। ঘুমন্ত লোকটির মাথা তার কাঁধে ঢলে পড়েছিল। একরাশ ঘৃণা নিয়ে ওই ময়লা মাথা আর ঘামে ডুবন্ত কালো ঘাড়টাকে দেখে সে। আধো জেগে লোকটা নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক হয়ে বসে। কিন্তু অল্প সময় পরেই আবারও বেচারার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। লোকটার বুজে-আসা চোখ আর টক্কর-খাওয়া মাথা দেখে তার ঘেন্না লাগে। মনে হয় লোকটা আবারও তার কাঁধে মাথা রাখতে চাইছে। সে মুচকি হেসে একেবারে জানালা ঘেঁষে সরে বসে। ঘুমন্ত লোকটা মাথা রাখার ভর না পেয়ে অল্প সময়ের জন্য জেগে ওঠে। মুহূর্তেই আবারও লোকটার চোখ বুজে আসে। ফের সেই ময়লা মাথা এবং ঘামে ডুবন্ত সেই কালো ঘাড় তার দিকে তেড়ে আসে। মনে হয়, গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা এ যাত্রীদল, প্রচণ্ড এ ভিড় এখনই তার ওপর ভেঙে পড়বে। দম বন্ধ হয়ে আসে। সুখে থাকুক সেই বন্ধুরা যারা এই দেশ থেকে বেরিয়ে গেছে। খালিদ, নাইম পাথার এবং শরিফ কালিয়ার প্রতি তার ঈর্ষা হয়। এরা সবাই দেশভাগের সময় ভারত ছেড়ে তার সঙ্গে ‘স্পেশাল ট্রেনের’ যাত্রী হয়েছিল। একই রকমের ভয় অতিক্রম করে সবাই একই অবস্থায় পাকিস্তানে পৌঁছেছিল। আর এখন তাদের পথ কতটা আলাদা। তার দশা যেন এ লক্করঝক্কর বাসের মতোই, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঝপথে কোথাও গরগর করে অচল হয়ে পড়ে। সমস্ত যাত্রী নেমে গিয়ে নানারকম যানবাহনে চড়ে নানা জায়গায় পৌঁছে যায়।
এটা মডেল টাউন?
না—রাশভারী চেহারার লোকটা আবারও ভ্রুক্ষেপ না করেই উত্তর দিল। বাস আবার চলতে শুরু করেছে। অদ্ভুত কন্ডাক্টর, একবারও এ-মুখো হয়নি। একবার ভাবে নিজেই ডাক দিয়ে কন্ডাক্টরের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। কিন্তু আবার এও ভাবল এটা তো কন্ডাক্টরের কাজ, তারই তো এসে টিকিট কেটে যাওয়ার কথা। কন্ডাক্টর যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে বারবার ঘুরছিল। শেষমেশ সামনের মহিলা আসনের দিকে এগিয়ে যায়। বেশ সময় নিয়ে তাদের টিকিট কাটে। দীর্ঘ ব্লাউজ পরা ভারী নিতম্বের লম্বা মেয়েটি এখন আর দৃষ্টিসীমার ভেতর নেই। রোগা ছেলেটির সামনের আসনটি সে পেয়ে গেছে। যখন মেয়েটির দাঁড়িয়ে থাকাটা তার কাছে উপভোগ্য ছিল তখন বসার জন্য আসন পাওয়াটা তার কাছে আনন্দের হতে পারে না। এখন শুধু মেয়েটির উজ্জ্বল গ্রীবা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু রোগা ছেলেটি অস্থির হয়ে বারবার এদিক-ওদিক তাকাতাকি করে তার মনোযোগ ভেঙে দিচ্ছে। ছেলেটার ওপর ভীষণ রাগ হয়। কন্ডাক্টরকে এদিকে আসতে দেখে রোগা ছেলে আর ভারী নিতম্বের অধিকারিণীকে কিছু সময়ের জন্য সে ভুলে যায়। ঠিক তখনই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়, সে চাইলেই অনায়াসে সাতটি পয়সা বাঁচাতে পারে। কন্ডাক্টরের তো আর চার চোখ নেই যে, সে কোত্থেকে উঠেছে তাও দেখতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে আবার নিজেই নিজেকে তিরষ্কার করে; মাত্র সাত পয়সার জন্য সে বেইমানি করবে? খুব নিকৃষ্ট কাজ। অল্প সময় পর আবারও চিন্তাটা তার ভেতর তাকত নিয়ে ফিরে আসে; আরে সাত পয়সাই বা কম কিসে। দোটানায় পড়ে গেল। লোভ আর সততা তার ভেতর এক সঙ্কটের সৃষ্টি করে। সাতটা পয়সা বেঁচে যাবে। তার বেকারত্বের কথা মনে পড়ে। পকেটে হাত দিয়ে ভাবে সাত পয়সা তো অনেক কাজে লাগতে পারে। আবার ভাবে—নাহ, বেইমানি করতে পারব না। বেইমানি আত্মাকে খোকলা করে দেয়। মনে মনে সে যখন একটি নৈতিক যুদ্ধ চালাচ্ছে তখন কন্ডাক্টর তার মাথার উপর এসে দাঁড়িয়েছে। পকেটে হাত দিয়ে প্রথমে সাড়ে চার আনা হাতে নিল, পকেটেই সে চার আনা রেখে দিয়ে পুরো এক টাকা বের করে কন্ডক্টরের হাতে ধরিয়ে দিল।
মডেল টাউন?
হ্যাঁ।
কন্ডাক্টর তিন আনার টিকিট কেটে বাকি পয়সা তাকে ফেরত দেয়। সে টিকিট এবং বাকি পয়সা কিছুটা ইতস্ততার সঙ্গে হাতে নেয়। এ তো দেখি একবারো পুঁছলো না কোথা থেকে উঠেছি। সে আড়চোখে একবার আশেপাশের যাত্রীদের দেখে নেয়। সহযাত্রীকে ঘুমন্ত দেখে কিছুটা স্বস্তি পায়। পয়সা আর টিকিট পকেটে রেখে দেয়।

ঘুমন্ত লোকটার মাথা ফের কাঁধে এসে ঠেকেছে। আবারও লোকটার উপর বেজায় বিরক্ত হয়। তার বেশি রাগ হচ্ছিল সেই একহারা ছেলেটির ওপর, এখনো নতুন স্টপেজ এলেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছে এ স্টপেজ মডেল টাউনের নয় ততক্ষণ শান্ত হচ্ছে না।

সাহেব, আজ দাতা-দরবারে [দাতা গঞ্জেবখস লাহোরি র. এর দরগা] বহু লোক সমাগম ছিল—পাশেই দাঁড়ানো ময়লা কোট পরা লিকলিকে গড়নের একটি লোক সেই গম্ভীর প্রকৃতির বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ করছিল। আলাপ শুনে তার মনে পড়ল আজ বৃহস্পতিবার। এই লাস্ট বাসে এত ভিড় হওয়ার কারণটাও এতক্ষণে বুঝে এলো। এরা তাহলে ‘দাতা-দরবার’ থেকে আসছে।
আমি যেতে পারিনি—রাশভারী গম্ভীর লোকটি লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল। এতটাই ব্যস্ত থাকি যে, নিয়মিত যেতে পারি না। মাঝে মাঝে মাসের প্রথম বৃহস্পতিবারে যাই।
প্রথম বৃহস্পতিবারের কথা বলছেন, শুনুন—ময়লা আচকানপরা লোকটি বলে, ঝড়-বৃষ্টি যাই হোক, মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার দরবারে যেতে ভুলি না। কিছুটা থেমে আবারও বলে, খান সাহেব, গত মাসে এক আজব ঘটনা ঘটেছে। শুধু ভাবুন একবার, সারা রাত ধরে... লোকটার গলার স্বর ফ্যাসফেসে শুনায়, একটি বিড়াল, বড়, কালো ও লালচোখু বিড়াল... আমি ভয় পেয়ে যাই। বিড়ালটা মাজারের পেছনে চলে যায়। কিছুটা স্বস্তি মেলে। ...কিন্তু অল্প সময় পরেই আবারও ফিরে আসে। আমার ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়। মানুষের পায়ের নিচ দিয়ে এটি আবারও মাজারের পেছনে চলে যায়। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। কিন্তু কী মুশকিল, ফের কিছু সময়ের ভেতরেই ওটা ফিরে আসে। মনে মনে বলি, ব্যাপারটা কী। সাহেব, গভীরভাবে অনুসন্ধান করে যা দেখলাম তাতে তো আমি হতবাক... আদতে বিড়ালটি মাজারের তাওয়াফ করছিল! ভোর পর্যন্ত তাওয়াফ করেই যাচ্ছিল। আজান হলে কিছুটা কেঁপে উঠলাম। তারপর কী হলো জানেন? চেয়ে দেখি বিড়ালটা গায়েব!
তাই নাকি!—গম্ভীর ভদ্রলোক বিস্মিত হয়।
জি, বিড়াল উধাও!

আশেপাশের যাত্রীরা ময়লা আচকানপরা লোকটার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রাশভারী ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে ফেলে।
আসল কথা হলো—ময়লা আচকানপরা লোকটি বলে, বৃহস্পতিবারে জিনরা দাতাকে সম্মান জানাতে আসে।

নিশ্চুপ যাত্রীদের চোখে বিস্ময় আরো বেড়ে যায়। দীর্ঘ গোঁফ বিশিষ্ট পেশিবহুল এক ব্যক্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এটা দাতা সাহেবের কেরামত। শ্রদ্ধায় লোকটার মাথা নত হয়ে আসে।

আমি বিশ্বাস করি না—কোণার সিট থেকে একটি আওয়াজ এলে মুহূর্তের মধ্যে সবার চোখ স্যুটপরা এক ব্যক্তির ওপর নিবদ্ধ হয়।

আপনি দাতা সাহেবকে বিশ্বাস করেন না?—সেই পেশিবহুল ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হয়ে তার বাঁজখাই গলায় জিজ্ঞেস করে।
দাতা সাহেবকে বিশ্বাস করি, কিন্তু...
কিন্তু?
কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে...
কোনো কিন্তুটিন্তু বুঝি না, সোজাসাপ্টা জানতে চাই, দাতা সাহেবে বিশ্বাস করেন নাকি করেন না?
ভাই, ইনি আধুনিক মানুষ, যুক্তিহীন কথায় বিশ্বাস করেন না—গম্ভীর লোকটি নরম সুরে বলে। এরপর স্যুটপরা লোকটাকে সম্বোধন করে বলে—কিন্তু মিস্টার, আপনি যে মাত্রই বললেন দাতা সাহেবকে মানেন?
হ্যাঁ, তাকে আমি মানি। বুজুর্গ মানুষ ছিলেন।
তাকে যদি শ্রদ্ধেয় বলে মানেন তবে এ কথাও নিশ্চয় বিশ্বাস করবেন যে, তিনি মিথ্যা বলতে পারেন না। তো মিস্টার, আপনি তার বই পড়ে ফেলুন। এতে তিনি নিজেই এ ধরনের ঘটনার কথা লিখে গেছেন—বলতে বলতে গম্ভীর প্রকৃতির লোকটি চারপাশের যাত্রীদের একবার দেখে নেয়। তার প্রমাণ দেওয়ার ভঙ্গি অনেকটা বর্ণনাত্মক হয়ে ওঠে। দাতা সাহেব একবার সফরে বের হলেন। তিনি একটার পর একটা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। একটা জায়গা অতিক্রম করতে গিয়ে দেখলেন পাহাড়ে আগুন লেগেছে। পাহাড়টায় অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ছিল। আর সে পাহাড়েই ছিল একটা ইঁদুর। ইঁদুরটা সেই আগুনের পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করছিল। জীবিত ছিল। এরপর সেই ইঁদুরটা ব্যাকুল হয়ে আগুন থেকে বেরিয়ে এলো। আর বেরুনো মাত্রই মরে গেল। গম্ভীর লোকটা খানিক দম নিয়ে আবার বলে, এবার কী বলবেন? যুক্তি তো এটাকে মানে না।

দাতা সাহেব সঠিক বলেছেন—একজন দাঁড়িওয়ালা ব্যক্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে। এরপর লোকটার গলা ভেঙে আসে—দাতা সাহেব সঠিক বলেছেন, মানুষ বড় ক্ষুদ্র প্রাণী, আর এ পৃথিবী...। আগুনের পেটে জ্বলা পাহাড়... নিঃসন্দেহে সত্য, নিঃসন্দেহে সত্য। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।

স্টপেজ কি আর আসবেই না নাকি? কেচ্ছা শুনে বিরক্ত হয়ে ভাবে সে। আচমকা তার মনে হয় স্টপেজ যদি ইতোমধ্যে ফেলে আসে তাহলে? তাহলে আর কী, সে তো ভুল বাসের যাত্রী। এ সময় তার মনে পড়ে সে মডেল টাউনের টিকিট কেটেছে। তার মানে আমি মডেল টাউনে যাচ্ছি, কিন্তু কেন? বাস যেন প্রবল রাগে দৌড়ে চলেছে। তার হাড়হাড্ডি এমন খটমট করতে লাগল যে সে ভয় পেতে লাগল। যাত্রীদের প্রতি লক্ষ করল। দেখল যারা তখন পর্যন্ত সামান্য জায়গার জন্য লড়ে যাচ্ছিল সে সমস্ত যাত্রীরা এখন চুপচাপ। তাদের মুখের ওপর বাতাস উড়ছে। তার আগের মনখারাপ ভাবটা এবার মায়ায় বদলে গেল। মন চাইছে দাঁড়িয়ে ওদেরকে বলে, বন্ধুরা আমরা ভুল বাসে চড়ে বসেছি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো, এমনটা বললে সবাই তাকে বেওকুফ মনে করবে। ভুল বাসে তো শুধু সে চড়েছে, বাকি সবাই সঠিক যাত্রী। তার মানে একই বাস একই সময়ে সঠিক হতে পারে, ভুলও হতে পারে? একই বাস ভুল পথে চলে আবার সঠিক পথেও চলে? ব্যাপারটা তার কাছে বড় অদ্ভুত ঠেকে। বিষয়টা তার ভেতর একটি বিশেষ ও অস্বাভাবিক জিজ্ঞাসা হয়ে দেখা দেয়। এরপর এই গিট্টুকে এই বলে খুলে যে, বাসের কোনো ভুল নেই। বাসের রুট, স্টপেজ এবং টার্মিনাল তো নির্ধারিত। সব বাস স্ব স্ব পথে ছুটে চলে। ভুল বা সঠিক হয় যাত্রী।

ঘুমন্ত লোকটার মাথার ভারে তার কাঁধ ভেঙে পড়ছিল। তবু এবার সে লোকটার দিকে মায়াভরা চোখে তাকায়। সন্দিগ্ধ হয়ে ভাবে, আমার ঘুমন্ত সহযাত্রী আরামে আছে তো। সহযাত্রী? তার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, সে নিজে তো ভুল বাসে আছে, আর সঙ্গী আছে সঠিক বাসে। তারপরও দুজন সহযাত্রী হয় কিভাবে? সে বাসের সকল যাত্রীর ওপর চোখ বুলায়। আমার তাহলে কোনো সহযাত্রী নেই?

তারপর সে জানালার বাইরে চেয়ে থাকে। একটা খুঁটির কাছে কিছুটা আলো-অন্ধকারে একটি যাত্রীহীন বাস কিছুটা সড়কে আর কিছুটা সড়কের বাইরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চাকাহীন একটি খালি টাঙ্গা আকাশমুখী হয়ে পড়ে আছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে হয়তো। এরপর এভাবেই ঘাড় বের করে বাসের পেছনের দিকটা দেখল। পেছন দিক থেকে প্রচুর কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছিল। বাসে যদি আগুন লেগে থাকে? কিন্তু আগুন তো লেগেই ছিল। এটা ভেবেই তার চোখ ওই জানালায় পড়ল যার গায়ে লেখা ‘স্রেফ খতরনাক অবস্থায় খুলুন’। সে বাসের ভেতরটার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে চমকে গেল। বিশ্রী রঙের বাল্বের আলোয় সমস্ত মুখগুলো হলদে-ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। পুরোটা বাস মানুষে ঠাসাঠাসি; তবু বনের অন্ধকারে আটকে পড়া গবাদি পশুর দলের একে অন্যের মুখ দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার মতো নিঃশব্দ-নীরব। দাঁড়িওয়ালা লোকটার চোখ বন্ধ। গম্ভীর ব্যক্তি আসন আঁকড়ে নীরব বসে আছে। পেশিবহুল গোঁফওয়ালা লোকটা হাতলকে শক্ত করে মুঠোয় ধরে কোনো অজানা চিন্তায় হারিয়ে গেছে। ময়লা আচকানপরা লোকটা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এবার সে অন্য কারো মুখোমুখি হয়ে আছে। আর ঘুমন্ত ব্যক্তি? ঘুমন্ত লোকটির দোলায়িত কাঁধের পুরোটা ভার এবার তার ঘাড়ে। সে এতটা আলগা হয়ে ওই মাথার নিচে ঢাকা পড়া বাহুর দিকে তাকাল যেন এটি তার দেহ থেকে আলাদা কোন চিজ। এখানে কেবল ঘুমন্ত মানুষটিই সুখে আছে।

যাত্রীদের হুড়মুড় করে নামতে দেখে বুঝতে চেষ্টা করল এটা কোন স্টপেজ। সবাই এমনভাবে পড়িমরি করে বেহুঁশ হয়ে নামছে যেন কোনো বড় আগুনের হাত থেকে পালাচ্ছে। এ তো দেখছি পুরো বাসটাই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। নেমে যাওয়ার পর নতুন কিছু লোক সওয়ারও হয়েছে। কিন্তু বাস ছাড়ার পর কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। সে অবাক হলো, এক স্টপেজেই কত কত লোক নেমে পড়েছে। সামনের স্টপেজে বাকি যাত্রীরাও যদি নেমে পড়ে? এটা ভেবে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। আশ্বস্ত হতে সে সমস্ত পরিচিত মুখগুলো খুঁজে ফেরে যাদেরকে যাত্রার শুরু থেকে দেখে আসছিল; যেন ওদেরকে সে হাজার বছর ধরে চেনে। স্যুটওয়ালাকে তো সে নিজেই নেমে যেতে দেখেছে। ময়লা আচকানপরা লোকটা এখনো আছে। লোকটা এবার সিট ভাগাভাগি না করে গা ঢেলে বসেছে। রাশভারী গম্ভীর লোক আবারও খবরের কাগজ খুলে মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করেছে। আর একহারা গড়নের সেই বালক! কোথায়? নেমে পড়েছে নাকি? এই সেরেছে! আজব ছেলে, মডেল টাউন আসার আগেই নেমে গেছে। তার অনুতাপ হচ্ছে, বিচলিত ছেলেটাকে অকারণে সে সহ্য করতে পারছিল না। যদি ছেলেটাকে বুঝিয়ে দিত, মডেল টাউন কতটা দূরে এবং কোন সড়ক অতিক্রমের পর মডেল টাউন আসবে তাহলে হয়তো বেচারা আর ভুলটা করত না। কিন্তু তার এই অনুতাপ-উপলব্ধি খুব দ্রুতই কেটে যায়। তার চোখ সামনের সিটে বসা ভারী নিতম্বের মেয়েটির ওপর আটকে যায়। মেয়েটির উজ্জ্বল ঘাড় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মাঝখানের দেয়াল দূর হয়ে গিয়েছে। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

থামো, থামো—এক ব্যক্তি হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।

বাবু মশাই এতক্ষণ কি ঘুমিয়ে ছিলেন নাকি? এখন আর পরের স্টপেজে থামবে। কন্ডাক্টর সবার থেকে দূরের সিটে গিয়ে বসে।

হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ানো ব্যক্তি অগত্যা চুপচাপ বসে পড়ে। যেভাবে হঠাৎ উত্তেজনা ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেভাবেই হতাশা তাকে ভেজা আটার মতো জমিয়ে দিয়েছে। লোকটার আচমকা জেগে ওঠা এবং সঙ্গে সঙ্গে দপ করে নিভে যাওয়া দুটোই তার কাছে অদ্ভুত ঠেকে। কেন জানি আবারও তার মডেল টাউন আসার আগেই নেমে পড়া সেই রোগা ছেলেটার কথা মনে পড়ে। যে তার নির্ধারিত স্টপেজের আগেই নেমে পড়েছে, যে তার নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়িয়ে সামনে চলেছে এবং সে নিজে; যে একটা ভুল বাসে চড়ে বসেছে, যে ব্যক্তি বাসে পা রাখার জায়গা পাচ্ছিল না এবং যাকে বাসে উঠেও নেমে পড়তে হয়েছিল—সবার কথা মনে পড়ে। বাসে ভ্রমণকারীরা কোনো না কোনোভাবে ফ্যাসাদে অবশ্যই পড়বে। কিন্তু আমি যাচ্ছি কোথায়? তার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, বাস তো এখন মডেল টাউনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সামান্য অসতর্কতার কারণে সে কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছে। এত রাতে মডেল টাউনে গিয়ে আবার ফিরে আসা কতটা আচ্ছা মসিবতের কাজ। আবারও খালিদের কথা মনে পড়ে। ও এখানে থাকলে আজ কতটা সহজে সে উতরে যেত। খালিদ, নাইম পাথার এবং শরিফ কালিয়ার সঙ্গে কত রাত জেগে পার করেছে। সে রাতগুলো তো রাত নয়, ছিল দিন। ঘরে না ফেরার ছুঁতোয় কত অজানা গলি কত নাম না জানা বাজার চষে বেড়িয়েছে। কত জলদি তাদের দলটা ভেঙে গেল। একেকজন কোথায় কোথায় হারিয়ে গেছে। তার কাছে রাত এখন পাহাড়সমান, এ রাতে পথ ছেড়ে সামান্য বেপথু হলেই কেয়ামত সামনে এসে দাঁড়ায়।

চৌধুরী সাহেব, ওটা কিসের বিল্ডিং হচ্ছে?—ময়লা আচকানপরা লোকটা জানালার বাইরে তাকিয়ে পেশিবহুল লোকটাকে জিজ্ঞেস করে।
কারখানা।
সাহেব, এ সড়কের পাশে অনেক বড় বড় বিল্ডিং উঠেছে এখন—গম্ভীর লোকটি বলে, এ-সমস্ত জায়গা আগে পতিত ছিল।
খান সাহেব, পাকিস্তানের আগে তো আপনি দেখেননি—পেশিবহুল লোক বলে, এসব জঙ্গল ছিল। পথচারীরা শুধু দিনের বেলা চলাচল করত। কিন্তু একবার এখানে দুজন ইংরেজ এলো শিকার করতে। অনেকক্ষণ ধরে গুলাগুলি করতে থাকে। শিকার বারবার ফসকে যায়। দুই ছোকরা মজা দেখছিল। ছোকরা দুইটা ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওদের হাত থেকে বন্দুক নিয়ে ঠাস ঠাস করে ফায়ার করে ফটাফট দুইটা হরিণ ফেলে দেয়। এরপর ছোকরার দল কী বুঝল কে জানে, যৌবনের ঢেউয়ে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে ইংরেজদের দিকে তাক করে বসে। ইংরেজ দুটো মাথার উপর পা তুলে পালাল।
উত্তম কাজ করেছে ভাই—ময়লা আচকানওয়ালা দাদাগিরির ভঙ্গিতে বলে।
উত্তম কাজ হয়নি মশাই—পেশিবহুল লোকটা দুঃখভরা গলায় বলে।
ইংরেজ দুটো বড় সাহেব ছিল। পরের দিন বহু ফিরিঙ্গি সৈন্য এলো। পুরো জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজেও ছোকরা দুটোকে আর পেল না। রাগে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিল। তিন দিন ধরে বন পুড়ল। যে ভেতরে রইল পুড়ে ছাই হলো, যে বাইরে বেরুল গুলির মুখে পড়ল। অনেক ঘন জঙ্গল ছিল। বহু পুরনো পুরনো গাছ ছিল। সব জ্বলেপুড়ে উজাড় হয়ে গেল। ময়লা আচকানপরা লোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গাছ পুড়ে গেলে ভালো হয় না। আর হলোও না, দীর্ঘ দিন ধরে এ জায়গা বিরাণ পড়ে রইল। দিনেও আসতে ভয় করত।
তুমি দেখেছিলে?—ময়লা আচকানওয়ালা জিজ্ঞেস করে।
না।
আমি দেখেছি। দুশমন ইংরেজরা এই শহরটাকেও খুব জ্বালিয়েছে। হজরত আউলিয়ার দরগার আশপাশটা খুবই নীরব জায়গা। রাতের বেলা ওই পথ দিয়ে কেউ যেতেই পারে না। কিন্তু ভাই সাহেব আমরা, হ্যাঁ, ওই জেন্টলম্যান সাহেব গিয়েছেন; স্যুটপরা লোকটার খালি সিটটার দিকে তাকিয়ে বলে। মশাই, দুপাতা ইংরেজি পড়লে সব কিছুতেই একটা ‘কিন্তু’ জুড়ে দেওয়ার রোগটা বেড়ে যায়। ওরা এখানেও ‘কিন্তু’ লাগায়। তো আমি কী যেন বলছিলাম; হ্যাঁ, বৃহস্পতিবার, রাত প্রায় অর্ধেক, রাস্তাঘাট সুনশান, নীরব। দেখি আমার আগে আগে একটি ছাগল হাঁটছে। ডোরাকাটা স্তনভারী ছাগল। ভাবলাম, ধরে বাড়ি নিয়ে যাই। যেই ধরতে গেলাম অমনি হরিণের মতো লম্ফঝম্ফ শুরু করল। এরপর চেয়ে দেখি কী—ওমা এ তো বিরাট বড় কুকুর! ভয়ে আমার জান বেরিয়ে যায়। কিন্তু মশাই আমি হাল ছাড়িনি। পিছু পিছু চলতে থাকি। এবার দেখি কুকুর গায়েব! দেখি একটা চিত্রা খরগোশ আমার আগে আগে দৌড়ছে। এরপর পলকের মধ্যে তাও দুম করে উধাও। এরপর মনে হলো, কে যেন আমার পেছনে পেছনে আসছে। মনে মনে বললাম, উস্তাদ এইবার মরেছ। কিন্তু আগের মতোই হাঁটতে থাকলাম। ভাবলাম, যা হবার হবে, একবার তো দেখি আসলে পেছনে কে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখি কি, ওটাই পেছনে পেছনে আসছে!
কোনটা?
ছাগল।
ছাগল?
খোদার কসম, হুবহু সেই ডোরাকাটা ছাগল। আরে মিয়া, স্টপেজে গাড়িটা একটু থামাও না!

হর্ন বাজতেই বাস থামল। ময়লা আচকানপরা লোকটা লাফ মেরে নেমে গেল।

ভাই, সামনের স্টপেজেও থামতে হবে—গম্ভীর লোকটি বলল।
সবাই নেমে পড়বে। সে পুরো বাসটায় একবার চোখ ঘুরিয়ে নিল। শক্তপেশিবহুল লোক, গম্ভীর বৃদ্ধ, ঘুমানো ব্যক্তি, বাস তো সত্যি সত্যি খালি হয়ে গেছে। যারা সামান্য স্থানের জন্য পরস্পর ধাক্কাধাক্কি-লড়াই করছিল কী হলো সে সমস্ত মানুষগুলোর। আর সে ভারী ভারী নিতম্বের মেয়েটি? তার সিটটা শূন্য পড়ে আছে। পুরো বাসটাকে তখন তার বিরাণ ও পরিত্যক্ত মনে হলো। বাসযাত্রা কত সংক্ষিপ্ত হয়। তার হৃদয় চাইছে সব লোক আবার ফিরে আসুক। সেই একজন আরেকজনকে মারমুখো হয়ে ধাক্কা মারা লোক, তার ওই লোকটার বিষেভরা চোখ মনে পড়ে যাকে বাসে উঠেও নেমে পড়তে হয়েছিল। লোকটা এ মুহূর্তে কোথায় আছে? সে মানুষটি যে নেমে গেছে, সে ব্যক্তি যে বাসে উঠতেই পারেনি, অথবা যে উঠেও পা রাখার জায়গা না পেয়ে নেমে পড়েছিল—অসংখ্য মুখ তার সামনে ভাসতে থাকে। তার এই অদ্ভুত অবস্থা দেখে নিজেরই হাসি পায়, বাস ভরা থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে আবার খালি হলে ভয় ঘিরে ধরে। কিন্তু আমি এখন যাচ্ছি কোথায়?

এই যে ভাই, ফিরতি বাস পাওয়া যাবে?
পাওয়া গেলেই কী আর না গেলেই কী। সময় তো শেষ হয়ে গেছে।

সময় তাহলে শেষ হয়ে গেছে? সে হিম্মত হারাচ্ছে। আস্তে আস্তে একটা ভয় তাকে ঘিরে ধরছে। পরের স্টপেজে বাস থামলে সে মনে মনে দৃঢ় সঙ্কল্প হয়, গম্ভীর লোকটার পেছনে পেছনে সেও নেমে পড়বে। নেমে ফিরতি বাসের অপেক্ষা করবে। বাইরে ঘোর অন্ধকার। বিল্ডিংগুলো গাছের মতো নিশ্চুপ-নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে সে মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়।

পরের স্টপেজে পেশিবহুল শক্তপোক্ত লোকটা নেমে যায়, তাকে অল্প দূর পর্যন্ত খুঁটির নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারপর অন্ধকার। পরের স্টপেজে দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোকও নেমে গেল এবং একইভাবে সামান্য দূর পর্যন্ত আলোতে দেখা যাবার পর আলো কমে আসে। সুনশান ফাঁকা স্টপেজে এক এক করে মুসাফির নেমে যায় আর তার মন পড়ে থাকে সে সমস্ত ফেলে আসা স্টপেজে যেখানে যাত্রীরা মুসাফির কাফেলার মতো দলবেঁধে নেমে মৌমাছির মতো ছড়িয়ে পড়ে।

এতক্ষণে বাস প্রায় খালি হয়ে গিয়েছিল। স্টপেজে যেখানে-সেখানে একলা মুসাফির নামছিল। অল্প দূর পর্যন্ত আলোয় দেখা যাওয়ার পর পথহারা ভেড়ার মতো অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল। স্টপেজ যখন শূন্য হয়ে পড়ে, মুসাফিরকে যখন একা নামতে হয় এবং তার ছেড়ে যাওয়া সিট কোনো নতুন মুসাফির এসে বুঝে নেয় না তখন বাসের যাত্রা শেষ হয়ে যায়। সে প্রথমে ফাঁকা বাসটাকে দেখে, তারপর আপন ক্লান্ত কাঁধের দিকে থাকায় যেখানে ঘুমানো মানুষটার মাথা ঠেকানো। লোকটার ব্যাপারে প্রথমে তার মনে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়—এই মানুষটা যাচ্ছে কোথায়? তারপর সন্দেহ হয়, এ লোকটাও ভুল বাসে চড়ে বসেনি তো! এই ময়লা-ময়লা মাথাটাকে, ঘামে ভেজা ঘাড়টাকে সে আরেকবার দেখে এবং জানতে পারে, ঘুমন্ত ব্যক্তি তার ক্লান্ত কাঁধেরই অংশ। সে মনে মনে বলে, আমি বাসের শেষ গন্তব্য পর্যন্ত যাব।


ইনতেজার হুসেইন
কথাসাহিত্যিক ইনতেজার হুসেইনকে তুলনা করা হয় প্রখ্যাত উর্দু ছোটগল্পকার সাদত হাসান মান্টোর সঙ্গে। কেউ কেউ তাকে মান্টোর চেয়েও শক্তিশালী গল্পকার বলে দাবি করেন। মান্টোপরবর্তী উর্দু ছোটগল্পের সবচেয়ে শক্তিমান স্রষ্টা ইনতেজার হুসেইন প্রথম কোনো পাকিস্তানি লেখক হিসেবে ম্যানবুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাস্তি’-র জন্য ২০১৩ সালে ম্যানবুকার শর্টলিস্টের চতুর্থ নামটি ছিল তার। পৌরাণিক আখ্যান, এরাবিয়ান নাইটস্ ও কাফকাকে ছেনে সৃষ্টি করেছেন ছোটগল্পের নিজস্ব ভূবন। তার গল্পের প্লট, চরিত্র কিংবা ভাষা সবই প্রতীকী। এ ছাড়াও দেশভাগের সময় ভারত ছেড়ে আসা এই লেখকের লেখায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে নস্টালজিয়া।

ইনতেজার হুসেইন উর্দু ছাড়াও ইংরেজিতে লেখালেখি করেছেন। পেশাজীবনে পাকিস্তানের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন-এ কাজ করেছেন। অনুবাদ করেছেন চেখভসহ বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ নানা লেখাজোখা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের এই কথাসাহিত্যিক আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও লিখেছেন একাধিক অসাধারণ ছোটগল্প। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বিখ্যাত দুটি ছোটগল্প হচ্ছে, ‘স্লিপ’ এবং ‘সিটি অব সরো’। এ ছাড়াও তার বিখ্যাত উপন্যাস বাস্তি-র একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে সাতচল্লিশ, উনসত্তর এবং একাত্তরের দিল্লি, ঢাকা এবং লাহোর। ২০১৬ সালের দুসরা ফেব্রুয়ারি উর্দু সাহিত্যের এই শক্তিমান লেখক মারা যান।

‘সহযাত্রী’ গল্পটি ইনতেজার হুসেইনের ‘হামসফর’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি সরাসরি উর্দু থেকে অনূদিত।


সালেহ ফুয়াদ
প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক সালেহ ফুয়াদের জন্ম সুনামগঞ্জে। বেড়ে উঠেছেন সিলেটে। তিনি আরবি, উর্দু ও ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে থাকেন। পদ্মভূষণপ্রাপ্ত বিখ্যাত ভারতীয় পণ্ডিত মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের ‘সালমান রুশদি ও মিছিলের রাজনীতি’ (চৈতন্য, বইমেলা-২০১৭) উর্দু থেকে অনূদিত তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। ২০১৮ সালের একুশে বইমেলায় ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার অনূদিত দ্বিতীয়গ্রন্থ ‘ইনতেজার হুসেইনের শ্রেষ্ঠগল্প’। অনুবাদ করেছেন ইনতেজার হুসেইনের ম্যানবুকার শর্টলিস্টেড উপন্যাস ‘বাস্তি’ ও বিখ্যাত উর্দু ছোটগল্পকার সাদত হাসান মান্টোর ‘স্যাম চাচাকে লেখা মান্টোর চিঠি’।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;