ইনতেজার হুসেইনের গল্প : সহযাত্রী



অনুবাদ: সালেহ ফুয়াদ
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

সে যে ভুল বাসে চড়ে বসেছে তা কিছুটা দেরিতে টের পেল। ছোট্ট একটি সুটকেস নিয়ে এ স্টপেজ থেকেই ওঠা সামনের সিটের একহারা গড়নের ছেলেটি কিছুটা বিচলিত। চারপাশের যাত্রীদের বোকা বোকা চোখে দেখে নিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করে—এ বাস মডেল টাউনে যাবে?
হ্যাঁ, তুমি যাবে কোথায়?
মডেল টাউন, জি ব্লক... যাবে তো?
যাবে—মুখোমুখি বসা টাকমাথার রাশভারি চেহারার বৃদ্ধ ভ্রুক্ষেপ না করেই উত্তর দিয়ে চশমাটা ঠিক করে আবারো খবরের কাগজে ডুবে যায়।

এ বাস তাহলে মডেল টাউনগামী, এটায় কেন চড়ে বসলাম? কিছুটা তাড়াহুড়ো আর কিছুটা অন্ধকারের জন্য সে বাসের নম্বরটা ঠিক খেয়াল করেনি। দূর থেকে দেখল বাস দাঁড়িয়ে আছে। দিল দৌড়। কাছাকাছি পৌঁছতেই কন্ডাক্টর দরজা বন্ধ করে বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছিল। আগপাছ না ভেবে লাফ মেরে চলন্ত বাসের ফুটবোর্ডে ঝুলে যায়। তারপর দরজা খুলে বহু কসরতে পথ তৈরি করে ভেতরে পৌঁছে। পরের স্টপেজে যাত্রী নামলে একটা সিট খালি পেয়ে দ্রুত দখলে নেয়। এখন জানা গেল সে ভুল বাসে চড়েছে।

যাক, মাত্র তো সাত পয়সার মামলা। সামনের স্টপেজে নেমে গেলেই হলো। পরের স্টপেজে নামা এবং ওখানে দাঁড়িয়ে আবারও বাসের অপেক্ষা করার কথা ভাবতে কিছুটা কষ্ট তো অবশ্যই হয়েছে। বাসের জন্য অপেক্ষা করার তার রয়েছে বাজে অভিজ্ঞতা। যতবার স্টপেজে দাঁড়িয়েছে ততবারই দেখেছে নানা রুটের রাজ্যের বাস আসে আর যায়, শুধু তার বাসটাই আসে না। আজব হলো, বাড়ি থেকে শহরে যাওয়ার জন্য স্টপেজে দাঁড়ালে কিছুক্ষণ পর পর শহরফেরতা বাস আসত আর যেত। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও শহরমুখী কোনো বাস আসত না। আবার শহর থেকে বাড়ি ফেরার জন্য স্টপেজে এলে একটার পর একটা শহরগামী বাস আসত আর যেত। শহরগামী বাসের লাইন পড়ে যেত। অন্যদিকে বাড়ির দিককার স্টপেজ শূন্য পড়ে থাকত। বহু দূর পর্যন্ত বাসের কোনো নামনিশানা চোখে পড়ত না। হ্যাঁ, এমনটা আকসার হয়েছে—স্টপেজ থেকে খানিকটা দূরে থাকতেই কাঙ্ক্ষিত বাস তার সামনে দিয়ে শাঁ শাঁ করে চলে গেছে। তারপর আবারও সেই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে পড়া এবং টলতে শুরু করা। আজ সঙ্গে সঙ্গে বাস পেয়ে যাওয়ায় মনে মনে বেশ খুশি হয়েছিল। কিন্তু এখন জানা গেল এ যে ভুল বাস!

পরের স্টপেজে এসে আচ্ছা মুসিবতে পড়া গেল, সে নামবে কি নামবে না ঠিক বুঝতে পারে না। একবার ভাবে এ তো সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ। এখানে তার রুটের বাস কোথায় পাবে। পায়ে হেঁটে পেছনের স্টপেজে পৌঁছতে হবে এবং সেখানে গিয়ে আবারও সেই বাসের অপেক্ষা করতে হবে। নামার জন্য দাঁড়িয়েও আবার বসে পড়ে। কিন্তু আমি এ পথ ধরে সামনেই বা কেন যাচ্ছি। এভাবে তো আমি আমার পথ থেকে আরো দূরে সরে যাব। আবারও নেমে পড়তে চায়। কিন্তু দাঁড়ানোর আগেই বাস ছেড়ে দেয়। সেও উঠতে উঠতে বসে পড়ে। বাসের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হতে থাকে যে, নিজের পথ ছেড়ে সে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। এ ভুল বাস আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে। খালিদের কথা মনে পড়ে। খালিদ মডেল টাউনে বাস করত। ও থাকলে কোনো ভয় ছিল না। তার বাসায় আনন্দে রাতটা কেটে যেত। খালিদ, নাইম পাথার, শরিফ কালিয়া; তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুগ্রুপের কথা মনে পড়ে। সবাই এক নতুন বিশ্বের খোঁজে পাকিস্তান ত্যাগ করেছে। সবার শেষে গিয়েছে খালিদ। নাইম আর শরিফ দুই মহামূর্খ স্কলারশিপ যোগাড় করে এখন আমেরিকায় আছে। খালিদ বলেছিল, দোস্ত, স্কলারশিপ না হোক কিছু টাকা পেলেই লন্ডন চলে যাব। এখানে কিছু হবে না। হোটেলে থালাবাসন পরিষ্কার করতে হলে তাও করব। তবু এখান থেকে তো বেরুতে পারব। তার বুঝে আসত না খালিদ এখান থেকে বেরুনোর জন্য এত উতলা কেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে খালিদ ঠিক কাজটাই করেছে। এখানে তো বাসে যাতায়াত করাটাও মহাফ্যাসাদের।

বাসে ভয়ঙ্কর রকমের ভিড়। দরজার কাছে এত যাত্রী দাঁড়ানো যে, সামান্য জায়গার জন্য একজন আরেকজনকে ধাক্কাচ্ছে। একেকজনের গা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। জামা থেকে পচা গন্ধ ভদভদিয়ে বেরুচ্ছে। কিছুটা ভর পাওয়ার জন্য গায়েবি কিছু খুঁজে পেতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে হাতগুলো। রাগে মুখগুলো সঙ্কুচিত, কারো মুখেই হাসি নেই।

টাকমাথার রাশভারি চেহারার বৃদ্ধ মনোযোগের সাথে খবরের কাগজে ডুবে ছিল। কিন্তু সে বেচারাও কাগজ গুটিয়ে তা দিয়ে হাতপাখা চালানো শুরু করল। একহারা গড়নের ছেলেটি আগের মতোই বিচলিত রয়েছে। প্রতিটা স্টপেজেই জেনে নিত—এটা মডেল টাউন কিনা। না-বাচক উত্তর পেয়ে কিছু সময়ের জন্য নিশ্চিন্ত হতো। কিন্তু পরের স্টপেজ আসতে না আসতেই অস্থিরতা বেড়ে যেত। পাশের সিটে বসা ময়লা জামাপরা যে লোকটা অনেকক্ষণ ধরে ঝিমুচ্ছিল এবার বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে সে অবাক হলো। এত শোরগোল আর চেঁচামেচির ভেতরেও লোকটা কী আরামসে ঘুমোচ্ছে, আশ্চর্য!
বাসের গতি বেড়ে গেছে। ইতোমধ্যে কয়েকটা স্টপেজ ফেলে এসেছে। এখান থেকে কি কোনো যাত্রী ওঠানোর ছিল না? উদ্বিগ্ন হয়ে দেখল পরের স্টপেজে খুঁটির নিচের আলোয় একদল মানুষ দাঁড়িয়ে; যেন ঘরদোরহারা উদ্বাস্তুক্যাম্প। সবার চোখ বাসের দিকে। বাসের গতি কিছুটা কমেছিল, কিন্তু কন্ডাক্টরের ‘আ-গে চলিয়ে উস্তাদ’ বলামাত্র আবার বেড়ে গেল। সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে থাকে এতগুলো মুখের সমাবেশে কতটা দ্রুত আশা প্রাণ পেয়েছিল আর কতটা দ্রুতই সে আশায় গুড়েবালি পড়েছে। কতটা দ্রুত মুখগুলো নৈরাশ্যে ঢেকে গেছে, কতটা দ্রুততায় ক্রোধ ছড়িয়ে পড়েছে মুখগুলোয়। কেউ কেউ মনখারাপ করে পায়ে হাঁটা শুরু করেছে। এদেরই একজন লাফ মেরে ফুটবোর্ডে ঝুলে যায়। তারপর জোর করেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যেতে থাকে। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে-থাকা যাত্রীদের বেজায় রাগ হয়। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। কন্ডাক্টর বাঁশি ফুঁকলে বাস থেমে গেল। ‘বাবু উতর যা, মেঁ কাহতা হুঁ উতর যা’। ভেতরে প্রবেশকারী লোকটা বিষঢালা চোখে একবার কন্ডাক্টরের দিকে আরেকবার মজমার দিকে তাকায়। তারপর রাগে ঠোঁট কামড়ে নিচে নেমে পড়ে।

সে ভাবে, তারও নেমে পড়া উচিত। নিশ্চিত সে ভুল বাসে সওয়ার হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে বাস ছুটতে শুরু করেছে। তাছাড়া দরজাটাও প্রচুর লোক ঘিরে রেখেছে। আর সিটের সামনে তো এক মানবপ্রাচীর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদের সবার বিরুদ্ধে তার ভেতরে ঘৃণা সৃষ্টি হতে থাকে। চিল্লাচিল্লি-ধাক্কাধাক্কি করে ঘামে ডুবন্ত এ নোংরা লোকগুলোকে তার মনে হয়, মনুষ্যত্বহারা প্রাণী। সে এদের প্রতি এতটাই ঘৃণা পোষণ করছিল যে, তার বাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সে এখুনি দরজা খুলে লাফ দিত। ঘুমন্ত লোকটির মাথা তার কাঁধে ঢলে পড়েছিল। একরাশ ঘৃণা নিয়ে ওই ময়লা মাথা আর ঘামে ডুবন্ত কালো ঘাড়টাকে দেখে সে। আধো জেগে লোকটা নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক হয়ে বসে। কিন্তু অল্প সময় পরেই আবারও বেচারার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। লোকটার বুজে-আসা চোখ আর টক্কর-খাওয়া মাথা দেখে তার ঘেন্না লাগে। মনে হয় লোকটা আবারও তার কাঁধে মাথা রাখতে চাইছে। সে মুচকি হেসে একেবারে জানালা ঘেঁষে সরে বসে। ঘুমন্ত লোকটা মাথা রাখার ভর না পেয়ে অল্প সময়ের জন্য জেগে ওঠে। মুহূর্তেই আবারও লোকটার চোখ বুজে আসে। ফের সেই ময়লা মাথা এবং ঘামে ডুবন্ত সেই কালো ঘাড় তার দিকে তেড়ে আসে। মনে হয়, গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা এ যাত্রীদল, প্রচণ্ড এ ভিড় এখনই তার ওপর ভেঙে পড়বে। দম বন্ধ হয়ে আসে। সুখে থাকুক সেই বন্ধুরা যারা এই দেশ থেকে বেরিয়ে গেছে। খালিদ, নাইম পাথার এবং শরিফ কালিয়ার প্রতি তার ঈর্ষা হয়। এরা সবাই দেশভাগের সময় ভারত ছেড়ে তার সঙ্গে ‘স্পেশাল ট্রেনের’ যাত্রী হয়েছিল। একই রকমের ভয় অতিক্রম করে সবাই একই অবস্থায় পাকিস্তানে পৌঁছেছিল। আর এখন তাদের পথ কতটা আলাদা। তার দশা যেন এ লক্করঝক্কর বাসের মতোই, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঝপথে কোথাও গরগর করে অচল হয়ে পড়ে। সমস্ত যাত্রী নেমে গিয়ে নানারকম যানবাহনে চড়ে নানা জায়গায় পৌঁছে যায়।
এটা মডেল টাউন?
না—রাশভারী চেহারার লোকটা আবারও ভ্রুক্ষেপ না করেই উত্তর দিল। বাস আবার চলতে শুরু করেছে। অদ্ভুত কন্ডাক্টর, একবারও এ-মুখো হয়নি। একবার ভাবে নিজেই ডাক দিয়ে কন্ডাক্টরের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। কিন্তু আবার এও ভাবল এটা তো কন্ডাক্টরের কাজ, তারই তো এসে টিকিট কেটে যাওয়ার কথা। কন্ডাক্টর যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে বারবার ঘুরছিল। শেষমেশ সামনের মহিলা আসনের দিকে এগিয়ে যায়। বেশ সময় নিয়ে তাদের টিকিট কাটে। দীর্ঘ ব্লাউজ পরা ভারী নিতম্বের লম্বা মেয়েটি এখন আর দৃষ্টিসীমার ভেতর নেই। রোগা ছেলেটির সামনের আসনটি সে পেয়ে গেছে। যখন মেয়েটির দাঁড়িয়ে থাকাটা তার কাছে উপভোগ্য ছিল তখন বসার জন্য আসন পাওয়াটা তার কাছে আনন্দের হতে পারে না। এখন শুধু মেয়েটির উজ্জ্বল গ্রীবা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু রোগা ছেলেটি অস্থির হয়ে বারবার এদিক-ওদিক তাকাতাকি করে তার মনোযোগ ভেঙে দিচ্ছে। ছেলেটার ওপর ভীষণ রাগ হয়। কন্ডাক্টরকে এদিকে আসতে দেখে রোগা ছেলে আর ভারী নিতম্বের অধিকারিণীকে কিছু সময়ের জন্য সে ভুলে যায়। ঠিক তখনই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়, সে চাইলেই অনায়াসে সাতটি পয়সা বাঁচাতে পারে। কন্ডাক্টরের তো আর চার চোখ নেই যে, সে কোত্থেকে উঠেছে তাও দেখতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে আবার নিজেই নিজেকে তিরষ্কার করে; মাত্র সাত পয়সার জন্য সে বেইমানি করবে? খুব নিকৃষ্ট কাজ। অল্প সময় পর আবারও চিন্তাটা তার ভেতর তাকত নিয়ে ফিরে আসে; আরে সাত পয়সাই বা কম কিসে। দোটানায় পড়ে গেল। লোভ আর সততা তার ভেতর এক সঙ্কটের সৃষ্টি করে। সাতটা পয়সা বেঁচে যাবে। তার বেকারত্বের কথা মনে পড়ে। পকেটে হাত দিয়ে ভাবে সাত পয়সা তো অনেক কাজে লাগতে পারে। আবার ভাবে—নাহ, বেইমানি করতে পারব না। বেইমানি আত্মাকে খোকলা করে দেয়। মনে মনে সে যখন একটি নৈতিক যুদ্ধ চালাচ্ছে তখন কন্ডাক্টর তার মাথার উপর এসে দাঁড়িয়েছে। পকেটে হাত দিয়ে প্রথমে সাড়ে চার আনা হাতে নিল, পকেটেই সে চার আনা রেখে দিয়ে পুরো এক টাকা বের করে কন্ডক্টরের হাতে ধরিয়ে দিল।
মডেল টাউন?
হ্যাঁ।
কন্ডাক্টর তিন আনার টিকিট কেটে বাকি পয়সা তাকে ফেরত দেয়। সে টিকিট এবং বাকি পয়সা কিছুটা ইতস্ততার সঙ্গে হাতে নেয়। এ তো দেখি একবারো পুঁছলো না কোথা থেকে উঠেছি। সে আড়চোখে একবার আশেপাশের যাত্রীদের দেখে নেয়। সহযাত্রীকে ঘুমন্ত দেখে কিছুটা স্বস্তি পায়। পয়সা আর টিকিট পকেটে রেখে দেয়।

ঘুমন্ত লোকটার মাথা ফের কাঁধে এসে ঠেকেছে। আবারও লোকটার উপর বেজায় বিরক্ত হয়। তার বেশি রাগ হচ্ছিল সেই একহারা ছেলেটির ওপর, এখনো নতুন স্টপেজ এলেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছে এ স্টপেজ মডেল টাউনের নয় ততক্ষণ শান্ত হচ্ছে না।

সাহেব, আজ দাতা-দরবারে [দাতা গঞ্জেবখস লাহোরি র. এর দরগা] বহু লোক সমাগম ছিল—পাশেই দাঁড়ানো ময়লা কোট পরা লিকলিকে গড়নের একটি লোক সেই গম্ভীর প্রকৃতির বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ করছিল। আলাপ শুনে তার মনে পড়ল আজ বৃহস্পতিবার। এই লাস্ট বাসে এত ভিড় হওয়ার কারণটাও এতক্ষণে বুঝে এলো। এরা তাহলে ‘দাতা-দরবার’ থেকে আসছে।
আমি যেতে পারিনি—রাশভারী গম্ভীর লোকটি লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল। এতটাই ব্যস্ত থাকি যে, নিয়মিত যেতে পারি না। মাঝে মাঝে মাসের প্রথম বৃহস্পতিবারে যাই।
প্রথম বৃহস্পতিবারের কথা বলছেন, শুনুন—ময়লা আচকানপরা লোকটি বলে, ঝড়-বৃষ্টি যাই হোক, মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার দরবারে যেতে ভুলি না। কিছুটা থেমে আবারও বলে, খান সাহেব, গত মাসে এক আজব ঘটনা ঘটেছে। শুধু ভাবুন একবার, সারা রাত ধরে... লোকটার গলার স্বর ফ্যাসফেসে শুনায়, একটি বিড়াল, বড়, কালো ও লালচোখু বিড়াল... আমি ভয় পেয়ে যাই। বিড়ালটা মাজারের পেছনে চলে যায়। কিছুটা স্বস্তি মেলে। ...কিন্তু অল্প সময় পরেই আবারও ফিরে আসে। আমার ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়। মানুষের পায়ের নিচ দিয়ে এটি আবারও মাজারের পেছনে চলে যায়। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। কিন্তু কী মুশকিল, ফের কিছু সময়ের ভেতরেই ওটা ফিরে আসে। মনে মনে বলি, ব্যাপারটা কী। সাহেব, গভীরভাবে অনুসন্ধান করে যা দেখলাম তাতে তো আমি হতবাক... আদতে বিড়ালটি মাজারের তাওয়াফ করছিল! ভোর পর্যন্ত তাওয়াফ করেই যাচ্ছিল। আজান হলে কিছুটা কেঁপে উঠলাম। তারপর কী হলো জানেন? চেয়ে দেখি বিড়ালটা গায়েব!
তাই নাকি!—গম্ভীর ভদ্রলোক বিস্মিত হয়।
জি, বিড়াল উধাও!

আশেপাশের যাত্রীরা ময়লা আচকানপরা লোকটার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রাশভারী ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে ফেলে।
আসল কথা হলো—ময়লা আচকানপরা লোকটি বলে, বৃহস্পতিবারে জিনরা দাতাকে সম্মান জানাতে আসে।

নিশ্চুপ যাত্রীদের চোখে বিস্ময় আরো বেড়ে যায়। দীর্ঘ গোঁফ বিশিষ্ট পেশিবহুল এক ব্যক্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এটা দাতা সাহেবের কেরামত। শ্রদ্ধায় লোকটার মাথা নত হয়ে আসে।

আমি বিশ্বাস করি না—কোণার সিট থেকে একটি আওয়াজ এলে মুহূর্তের মধ্যে সবার চোখ স্যুটপরা এক ব্যক্তির ওপর নিবদ্ধ হয়।

আপনি দাতা সাহেবকে বিশ্বাস করেন না?—সেই পেশিবহুল ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হয়ে তার বাঁজখাই গলায় জিজ্ঞেস করে।
দাতা সাহেবকে বিশ্বাস করি, কিন্তু...
কিন্তু?
কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে...
কোনো কিন্তুটিন্তু বুঝি না, সোজাসাপ্টা জানতে চাই, দাতা সাহেবে বিশ্বাস করেন নাকি করেন না?
ভাই, ইনি আধুনিক মানুষ, যুক্তিহীন কথায় বিশ্বাস করেন না—গম্ভীর লোকটি নরম সুরে বলে। এরপর স্যুটপরা লোকটাকে সম্বোধন করে বলে—কিন্তু মিস্টার, আপনি যে মাত্রই বললেন দাতা সাহেবকে মানেন?
হ্যাঁ, তাকে আমি মানি। বুজুর্গ মানুষ ছিলেন।
তাকে যদি শ্রদ্ধেয় বলে মানেন তবে এ কথাও নিশ্চয় বিশ্বাস করবেন যে, তিনি মিথ্যা বলতে পারেন না। তো মিস্টার, আপনি তার বই পড়ে ফেলুন। এতে তিনি নিজেই এ ধরনের ঘটনার কথা লিখে গেছেন—বলতে বলতে গম্ভীর প্রকৃতির লোকটি চারপাশের যাত্রীদের একবার দেখে নেয়। তার প্রমাণ দেওয়ার ভঙ্গি অনেকটা বর্ণনাত্মক হয়ে ওঠে। দাতা সাহেব একবার সফরে বের হলেন। তিনি একটার পর একটা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। একটা জায়গা অতিক্রম করতে গিয়ে দেখলেন পাহাড়ে আগুন লেগেছে। পাহাড়টায় অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ছিল। আর সে পাহাড়েই ছিল একটা ইঁদুর। ইঁদুরটা সেই আগুনের পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করছিল। জীবিত ছিল। এরপর সেই ইঁদুরটা ব্যাকুল হয়ে আগুন থেকে বেরিয়ে এলো। আর বেরুনো মাত্রই মরে গেল। গম্ভীর লোকটা খানিক দম নিয়ে আবার বলে, এবার কী বলবেন? যুক্তি তো এটাকে মানে না।

দাতা সাহেব সঠিক বলেছেন—একজন দাঁড়িওয়ালা ব্যক্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে। এরপর লোকটার গলা ভেঙে আসে—দাতা সাহেব সঠিক বলেছেন, মানুষ বড় ক্ষুদ্র প্রাণী, আর এ পৃথিবী...। আগুনের পেটে জ্বলা পাহাড়... নিঃসন্দেহে সত্য, নিঃসন্দেহে সত্য। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।

স্টপেজ কি আর আসবেই না নাকি? কেচ্ছা শুনে বিরক্ত হয়ে ভাবে সে। আচমকা তার মনে হয় স্টপেজ যদি ইতোমধ্যে ফেলে আসে তাহলে? তাহলে আর কী, সে তো ভুল বাসের যাত্রী। এ সময় তার মনে পড়ে সে মডেল টাউনের টিকিট কেটেছে। তার মানে আমি মডেল টাউনে যাচ্ছি, কিন্তু কেন? বাস যেন প্রবল রাগে দৌড়ে চলেছে। তার হাড়হাড্ডি এমন খটমট করতে লাগল যে সে ভয় পেতে লাগল। যাত্রীদের প্রতি লক্ষ করল। দেখল যারা তখন পর্যন্ত সামান্য জায়গার জন্য লড়ে যাচ্ছিল সে সমস্ত যাত্রীরা এখন চুপচাপ। তাদের মুখের ওপর বাতাস উড়ছে। তার আগের মনখারাপ ভাবটা এবার মায়ায় বদলে গেল। মন চাইছে দাঁড়িয়ে ওদেরকে বলে, বন্ধুরা আমরা ভুল বাসে চড়ে বসেছি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো, এমনটা বললে সবাই তাকে বেওকুফ মনে করবে। ভুল বাসে তো শুধু সে চড়েছে, বাকি সবাই সঠিক যাত্রী। তার মানে একই বাস একই সময়ে সঠিক হতে পারে, ভুলও হতে পারে? একই বাস ভুল পথে চলে আবার সঠিক পথেও চলে? ব্যাপারটা তার কাছে বড় অদ্ভুত ঠেকে। বিষয়টা তার ভেতর একটি বিশেষ ও অস্বাভাবিক জিজ্ঞাসা হয়ে দেখা দেয়। এরপর এই গিট্টুকে এই বলে খুলে যে, বাসের কোনো ভুল নেই। বাসের রুট, স্টপেজ এবং টার্মিনাল তো নির্ধারিত। সব বাস স্ব স্ব পথে ছুটে চলে। ভুল বা সঠিক হয় যাত্রী।

ঘুমন্ত লোকটার মাথার ভারে তার কাঁধ ভেঙে পড়ছিল। তবু এবার সে লোকটার দিকে মায়াভরা চোখে তাকায়। সন্দিগ্ধ হয়ে ভাবে, আমার ঘুমন্ত সহযাত্রী আরামে আছে তো। সহযাত্রী? তার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, সে নিজে তো ভুল বাসে আছে, আর সঙ্গী আছে সঠিক বাসে। তারপরও দুজন সহযাত্রী হয় কিভাবে? সে বাসের সকল যাত্রীর ওপর চোখ বুলায়। আমার তাহলে কোনো সহযাত্রী নেই?

তারপর সে জানালার বাইরে চেয়ে থাকে। একটা খুঁটির কাছে কিছুটা আলো-অন্ধকারে একটি যাত্রীহীন বাস কিছুটা সড়কে আর কিছুটা সড়কের বাইরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চাকাহীন একটি খালি টাঙ্গা আকাশমুখী হয়ে পড়ে আছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে হয়তো। এরপর এভাবেই ঘাড় বের করে বাসের পেছনের দিকটা দেখল। পেছন দিক থেকে প্রচুর কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছিল। বাসে যদি আগুন লেগে থাকে? কিন্তু আগুন তো লেগেই ছিল। এটা ভেবেই তার চোখ ওই জানালায় পড়ল যার গায়ে লেখা ‘স্রেফ খতরনাক অবস্থায় খুলুন’। সে বাসের ভেতরটার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে চমকে গেল। বিশ্রী রঙের বাল্বের আলোয় সমস্ত মুখগুলো হলদে-ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। পুরোটা বাস মানুষে ঠাসাঠাসি; তবু বনের অন্ধকারে আটকে পড়া গবাদি পশুর দলের একে অন্যের মুখ দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার মতো নিঃশব্দ-নীরব। দাঁড়িওয়ালা লোকটার চোখ বন্ধ। গম্ভীর ব্যক্তি আসন আঁকড়ে নীরব বসে আছে। পেশিবহুল গোঁফওয়ালা লোকটা হাতলকে শক্ত করে মুঠোয় ধরে কোনো অজানা চিন্তায় হারিয়ে গেছে। ময়লা আচকানপরা লোকটা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এবার সে অন্য কারো মুখোমুখি হয়ে আছে। আর ঘুমন্ত ব্যক্তি? ঘুমন্ত লোকটির দোলায়িত কাঁধের পুরোটা ভার এবার তার ঘাড়ে। সে এতটা আলগা হয়ে ওই মাথার নিচে ঢাকা পড়া বাহুর দিকে তাকাল যেন এটি তার দেহ থেকে আলাদা কোন চিজ। এখানে কেবল ঘুমন্ত মানুষটিই সুখে আছে।

যাত্রীদের হুড়মুড় করে নামতে দেখে বুঝতে চেষ্টা করল এটা কোন স্টপেজ। সবাই এমনভাবে পড়িমরি করে বেহুঁশ হয়ে নামছে যেন কোনো বড় আগুনের হাত থেকে পালাচ্ছে। এ তো দেখছি পুরো বাসটাই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। নেমে যাওয়ার পর নতুন কিছু লোক সওয়ারও হয়েছে। কিন্তু বাস ছাড়ার পর কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। সে অবাক হলো, এক স্টপেজেই কত কত লোক নেমে পড়েছে। সামনের স্টপেজে বাকি যাত্রীরাও যদি নেমে পড়ে? এটা ভেবে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। আশ্বস্ত হতে সে সমস্ত পরিচিত মুখগুলো খুঁজে ফেরে যাদেরকে যাত্রার শুরু থেকে দেখে আসছিল; যেন ওদেরকে সে হাজার বছর ধরে চেনে। স্যুটওয়ালাকে তো সে নিজেই নেমে যেতে দেখেছে। ময়লা আচকানপরা লোকটা এখনো আছে। লোকটা এবার সিট ভাগাভাগি না করে গা ঢেলে বসেছে। রাশভারী গম্ভীর লোক আবারও খবরের কাগজ খুলে মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করেছে। আর একহারা গড়নের সেই বালক! কোথায়? নেমে পড়েছে নাকি? এই সেরেছে! আজব ছেলে, মডেল টাউন আসার আগেই নেমে গেছে। তার অনুতাপ হচ্ছে, বিচলিত ছেলেটাকে অকারণে সে সহ্য করতে পারছিল না। যদি ছেলেটাকে বুঝিয়ে দিত, মডেল টাউন কতটা দূরে এবং কোন সড়ক অতিক্রমের পর মডেল টাউন আসবে তাহলে হয়তো বেচারা আর ভুলটা করত না। কিন্তু তার এই অনুতাপ-উপলব্ধি খুব দ্রুতই কেটে যায়। তার চোখ সামনের সিটে বসা ভারী নিতম্বের মেয়েটির ওপর আটকে যায়। মেয়েটির উজ্জ্বল ঘাড় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মাঝখানের দেয়াল দূর হয়ে গিয়েছে। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

থামো, থামো—এক ব্যক্তি হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।

বাবু মশাই এতক্ষণ কি ঘুমিয়ে ছিলেন নাকি? এখন আর পরের স্টপেজে থামবে। কন্ডাক্টর সবার থেকে দূরের সিটে গিয়ে বসে।

হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ানো ব্যক্তি অগত্যা চুপচাপ বসে পড়ে। যেভাবে হঠাৎ উত্তেজনা ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেভাবেই হতাশা তাকে ভেজা আটার মতো জমিয়ে দিয়েছে। লোকটার আচমকা জেগে ওঠা এবং সঙ্গে সঙ্গে দপ করে নিভে যাওয়া দুটোই তার কাছে অদ্ভুত ঠেকে। কেন জানি আবারও তার মডেল টাউন আসার আগেই নেমে পড়া সেই রোগা ছেলেটার কথা মনে পড়ে। যে তার নির্ধারিত স্টপেজের আগেই নেমে পড়েছে, যে তার নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়িয়ে সামনে চলেছে এবং সে নিজে; যে একটা ভুল বাসে চড়ে বসেছে, যে ব্যক্তি বাসে পা রাখার জায়গা পাচ্ছিল না এবং যাকে বাসে উঠেও নেমে পড়তে হয়েছিল—সবার কথা মনে পড়ে। বাসে ভ্রমণকারীরা কোনো না কোনোভাবে ফ্যাসাদে অবশ্যই পড়বে। কিন্তু আমি যাচ্ছি কোথায়? তার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, বাস তো এখন মডেল টাউনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সামান্য অসতর্কতার কারণে সে কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছে। এত রাতে মডেল টাউনে গিয়ে আবার ফিরে আসা কতটা আচ্ছা মসিবতের কাজ। আবারও খালিদের কথা মনে পড়ে। ও এখানে থাকলে আজ কতটা সহজে সে উতরে যেত। খালিদ, নাইম পাথার এবং শরিফ কালিয়ার সঙ্গে কত রাত জেগে পার করেছে। সে রাতগুলো তো রাত নয়, ছিল দিন। ঘরে না ফেরার ছুঁতোয় কত অজানা গলি কত নাম না জানা বাজার চষে বেড়িয়েছে। কত জলদি তাদের দলটা ভেঙে গেল। একেকজন কোথায় কোথায় হারিয়ে গেছে। তার কাছে রাত এখন পাহাড়সমান, এ রাতে পথ ছেড়ে সামান্য বেপথু হলেই কেয়ামত সামনে এসে দাঁড়ায়।

চৌধুরী সাহেব, ওটা কিসের বিল্ডিং হচ্ছে?—ময়লা আচকানপরা লোকটা জানালার বাইরে তাকিয়ে পেশিবহুল লোকটাকে জিজ্ঞেস করে।
কারখানা।
সাহেব, এ সড়কের পাশে অনেক বড় বড় বিল্ডিং উঠেছে এখন—গম্ভীর লোকটি বলে, এ-সমস্ত জায়গা আগে পতিত ছিল।
খান সাহেব, পাকিস্তানের আগে তো আপনি দেখেননি—পেশিবহুল লোক বলে, এসব জঙ্গল ছিল। পথচারীরা শুধু দিনের বেলা চলাচল করত। কিন্তু একবার এখানে দুজন ইংরেজ এলো শিকার করতে। অনেকক্ষণ ধরে গুলাগুলি করতে থাকে। শিকার বারবার ফসকে যায়। দুই ছোকরা মজা দেখছিল। ছোকরা দুইটা ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওদের হাত থেকে বন্দুক নিয়ে ঠাস ঠাস করে ফায়ার করে ফটাফট দুইটা হরিণ ফেলে দেয়। এরপর ছোকরার দল কী বুঝল কে জানে, যৌবনের ঢেউয়ে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে ইংরেজদের দিকে তাক করে বসে। ইংরেজ দুটো মাথার উপর পা তুলে পালাল।
উত্তম কাজ করেছে ভাই—ময়লা আচকানওয়ালা দাদাগিরির ভঙ্গিতে বলে।
উত্তম কাজ হয়নি মশাই—পেশিবহুল লোকটা দুঃখভরা গলায় বলে।
ইংরেজ দুটো বড় সাহেব ছিল। পরের দিন বহু ফিরিঙ্গি সৈন্য এলো। পুরো জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজেও ছোকরা দুটোকে আর পেল না। রাগে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিল। তিন দিন ধরে বন পুড়ল। যে ভেতরে রইল পুড়ে ছাই হলো, যে বাইরে বেরুল গুলির মুখে পড়ল। অনেক ঘন জঙ্গল ছিল। বহু পুরনো পুরনো গাছ ছিল। সব জ্বলেপুড়ে উজাড় হয়ে গেল। ময়লা আচকানপরা লোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গাছ পুড়ে গেলে ভালো হয় না। আর হলোও না, দীর্ঘ দিন ধরে এ জায়গা বিরাণ পড়ে রইল। দিনেও আসতে ভয় করত।
তুমি দেখেছিলে?—ময়লা আচকানওয়ালা জিজ্ঞেস করে।
না।
আমি দেখেছি। দুশমন ইংরেজরা এই শহরটাকেও খুব জ্বালিয়েছে। হজরত আউলিয়ার দরগার আশপাশটা খুবই নীরব জায়গা। রাতের বেলা ওই পথ দিয়ে কেউ যেতেই পারে না। কিন্তু ভাই সাহেব আমরা, হ্যাঁ, ওই জেন্টলম্যান সাহেব গিয়েছেন; স্যুটপরা লোকটার খালি সিটটার দিকে তাকিয়ে বলে। মশাই, দুপাতা ইংরেজি পড়লে সব কিছুতেই একটা ‘কিন্তু’ জুড়ে দেওয়ার রোগটা বেড়ে যায়। ওরা এখানেও ‘কিন্তু’ লাগায়। তো আমি কী যেন বলছিলাম; হ্যাঁ, বৃহস্পতিবার, রাত প্রায় অর্ধেক, রাস্তাঘাট সুনশান, নীরব। দেখি আমার আগে আগে একটি ছাগল হাঁটছে। ডোরাকাটা স্তনভারী ছাগল। ভাবলাম, ধরে বাড়ি নিয়ে যাই। যেই ধরতে গেলাম অমনি হরিণের মতো লম্ফঝম্ফ শুরু করল। এরপর চেয়ে দেখি কী—ওমা এ তো বিরাট বড় কুকুর! ভয়ে আমার জান বেরিয়ে যায়। কিন্তু মশাই আমি হাল ছাড়িনি। পিছু পিছু চলতে থাকি। এবার দেখি কুকুর গায়েব! দেখি একটা চিত্রা খরগোশ আমার আগে আগে দৌড়ছে। এরপর পলকের মধ্যে তাও দুম করে উধাও। এরপর মনে হলো, কে যেন আমার পেছনে পেছনে আসছে। মনে মনে বললাম, উস্তাদ এইবার মরেছ। কিন্তু আগের মতোই হাঁটতে থাকলাম। ভাবলাম, যা হবার হবে, একবার তো দেখি আসলে পেছনে কে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখি কি, ওটাই পেছনে পেছনে আসছে!
কোনটা?
ছাগল।
ছাগল?
খোদার কসম, হুবহু সেই ডোরাকাটা ছাগল। আরে মিয়া, স্টপেজে গাড়িটা একটু থামাও না!

হর্ন বাজতেই বাস থামল। ময়লা আচকানপরা লোকটা লাফ মেরে নেমে গেল।

ভাই, সামনের স্টপেজেও থামতে হবে—গম্ভীর লোকটি বলল।
সবাই নেমে পড়বে। সে পুরো বাসটায় একবার চোখ ঘুরিয়ে নিল। শক্তপেশিবহুল লোক, গম্ভীর বৃদ্ধ, ঘুমানো ব্যক্তি, বাস তো সত্যি সত্যি খালি হয়ে গেছে। যারা সামান্য স্থানের জন্য পরস্পর ধাক্কাধাক্কি-লড়াই করছিল কী হলো সে সমস্ত মানুষগুলোর। আর সে ভারী ভারী নিতম্বের মেয়েটি? তার সিটটা শূন্য পড়ে আছে। পুরো বাসটাকে তখন তার বিরাণ ও পরিত্যক্ত মনে হলো। বাসযাত্রা কত সংক্ষিপ্ত হয়। তার হৃদয় চাইছে সব লোক আবার ফিরে আসুক। সেই একজন আরেকজনকে মারমুখো হয়ে ধাক্কা মারা লোক, তার ওই লোকটার বিষেভরা চোখ মনে পড়ে যাকে বাসে উঠেও নেমে পড়তে হয়েছিল। লোকটা এ মুহূর্তে কোথায় আছে? সে মানুষটি যে নেমে গেছে, সে ব্যক্তি যে বাসে উঠতেই পারেনি, অথবা যে উঠেও পা রাখার জায়গা না পেয়ে নেমে পড়েছিল—অসংখ্য মুখ তার সামনে ভাসতে থাকে। তার এই অদ্ভুত অবস্থা দেখে নিজেরই হাসি পায়, বাস ভরা থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে আবার খালি হলে ভয় ঘিরে ধরে। কিন্তু আমি এখন যাচ্ছি কোথায়?

এই যে ভাই, ফিরতি বাস পাওয়া যাবে?
পাওয়া গেলেই কী আর না গেলেই কী। সময় তো শেষ হয়ে গেছে।

সময় তাহলে শেষ হয়ে গেছে? সে হিম্মত হারাচ্ছে। আস্তে আস্তে একটা ভয় তাকে ঘিরে ধরছে। পরের স্টপেজে বাস থামলে সে মনে মনে দৃঢ় সঙ্কল্প হয়, গম্ভীর লোকটার পেছনে পেছনে সেও নেমে পড়বে। নেমে ফিরতি বাসের অপেক্ষা করবে। বাইরে ঘোর অন্ধকার। বিল্ডিংগুলো গাছের মতো নিশ্চুপ-নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে সে মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়।

পরের স্টপেজে পেশিবহুল শক্তপোক্ত লোকটা নেমে যায়, তাকে অল্প দূর পর্যন্ত খুঁটির নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারপর অন্ধকার। পরের স্টপেজে দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোকও নেমে গেল এবং একইভাবে সামান্য দূর পর্যন্ত আলোতে দেখা যাবার পর আলো কমে আসে। সুনশান ফাঁকা স্টপেজে এক এক করে মুসাফির নেমে যায় আর তার মন পড়ে থাকে সে সমস্ত ফেলে আসা স্টপেজে যেখানে যাত্রীরা মুসাফির কাফেলার মতো দলবেঁধে নেমে মৌমাছির মতো ছড়িয়ে পড়ে।

এতক্ষণে বাস প্রায় খালি হয়ে গিয়েছিল। স্টপেজে যেখানে-সেখানে একলা মুসাফির নামছিল। অল্প দূর পর্যন্ত আলোয় দেখা যাওয়ার পর পথহারা ভেড়ার মতো অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল। স্টপেজ যখন শূন্য হয়ে পড়ে, মুসাফিরকে যখন একা নামতে হয় এবং তার ছেড়ে যাওয়া সিট কোনো নতুন মুসাফির এসে বুঝে নেয় না তখন বাসের যাত্রা শেষ হয়ে যায়। সে প্রথমে ফাঁকা বাসটাকে দেখে, তারপর আপন ক্লান্ত কাঁধের দিকে থাকায় যেখানে ঘুমানো মানুষটার মাথা ঠেকানো। লোকটার ব্যাপারে প্রথমে তার মনে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়—এই মানুষটা যাচ্ছে কোথায়? তারপর সন্দেহ হয়, এ লোকটাও ভুল বাসে চড়ে বসেনি তো! এই ময়লা-ময়লা মাথাটাকে, ঘামে ভেজা ঘাড়টাকে সে আরেকবার দেখে এবং জানতে পারে, ঘুমন্ত ব্যক্তি তার ক্লান্ত কাঁধেরই অংশ। সে মনে মনে বলে, আমি বাসের শেষ গন্তব্য পর্যন্ত যাব।


ইনতেজার হুসেইন
কথাসাহিত্যিক ইনতেজার হুসেইনকে তুলনা করা হয় প্রখ্যাত উর্দু ছোটগল্পকার সাদত হাসান মান্টোর সঙ্গে। কেউ কেউ তাকে মান্টোর চেয়েও শক্তিশালী গল্পকার বলে দাবি করেন। মান্টোপরবর্তী উর্দু ছোটগল্পের সবচেয়ে শক্তিমান স্রষ্টা ইনতেজার হুসেইন প্রথম কোনো পাকিস্তানি লেখক হিসেবে ম্যানবুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাস্তি’-র জন্য ২০১৩ সালে ম্যানবুকার শর্টলিস্টের চতুর্থ নামটি ছিল তার। পৌরাণিক আখ্যান, এরাবিয়ান নাইটস্ ও কাফকাকে ছেনে সৃষ্টি করেছেন ছোটগল্পের নিজস্ব ভূবন। তার গল্পের প্লট, চরিত্র কিংবা ভাষা সবই প্রতীকী। এ ছাড়াও দেশভাগের সময় ভারত ছেড়ে আসা এই লেখকের লেখায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে নস্টালজিয়া।

ইনতেজার হুসেইন উর্দু ছাড়াও ইংরেজিতে লেখালেখি করেছেন। পেশাজীবনে পাকিস্তানের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন-এ কাজ করেছেন। অনুবাদ করেছেন চেখভসহ বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ নানা লেখাজোখা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের এই কথাসাহিত্যিক আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও লিখেছেন একাধিক অসাধারণ ছোটগল্প। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বিখ্যাত দুটি ছোটগল্প হচ্ছে, ‘স্লিপ’ এবং ‘সিটি অব সরো’। এ ছাড়াও তার বিখ্যাত উপন্যাস বাস্তি-র একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে সাতচল্লিশ, উনসত্তর এবং একাত্তরের দিল্লি, ঢাকা এবং লাহোর। ২০১৬ সালের দুসরা ফেব্রুয়ারি উর্দু সাহিত্যের এই শক্তিমান লেখক মারা যান।

‘সহযাত্রী’ গল্পটি ইনতেজার হুসেইনের ‘হামসফর’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি সরাসরি উর্দু থেকে অনূদিত।


সালেহ ফুয়াদ
প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক সালেহ ফুয়াদের জন্ম সুনামগঞ্জে। বেড়ে উঠেছেন সিলেটে। তিনি আরবি, উর্দু ও ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে থাকেন। পদ্মভূষণপ্রাপ্ত বিখ্যাত ভারতীয় পণ্ডিত মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের ‘সালমান রুশদি ও মিছিলের রাজনীতি’ (চৈতন্য, বইমেলা-২০১৭) উর্দু থেকে অনূদিত তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। ২০১৮ সালের একুশে বইমেলায় ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার অনূদিত দ্বিতীয়গ্রন্থ ‘ইনতেজার হুসেইনের শ্রেষ্ঠগল্প’। অনুবাদ করেছেন ইনতেজার হুসেইনের ম্যানবুকার শর্টলিস্টেড উপন্যাস ‘বাস্তি’ ও বিখ্যাত উর্দু ছোটগল্পকার সাদত হাসান মান্টোর ‘স্যাম চাচাকে লেখা মান্টোর চিঠি’।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র কাছে কী সেবা চান আপনি!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

জুলাই ১৩, ২০২৪ সালের ভোর পাঁচটায় শুরু হয়েছিল এক তুমুল বৃষ্টি। রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ তখনও গভীর ঘুমে।

এ সময়টা ঘোর বর্ষাকাল। সে কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হতেই পারে। তাই, অ্যালার্ম শুনেও আরেকটু ঘুমিয়ে নিই বলে যারা কিছুটা দেরিতে উঠে অফিসে যাবেন বলে আটটার দিকে পথে নেমেছেন, তাদের চক্ষু সেদিন চড়কগাছ‍!

সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি থামেনি। একটানা চার ঘণ্টার মুষলধারার পতনে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার ২৬ থেকে ৩০টি বড় রাস্তা একসঙ্গে ডুবে গেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ‘ডোবা’ সেই ডোবা নয়! রাস্তায় ১-২ ঘণ্টা জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার পর অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় অচল হয়ে যানজট অসহনীয় করে তুলেছিল সেদিন। সংবাদে টেলিভিশনের ভিডিওচিত্র দেখেও তাই-ই মনে হচ্ছিল।

সে এক অতি ভয়ঙ্কর অবস্থা সারাদিন জুড়ে। যেখানে চোখ যায়, সেখানেই মনে হয়, প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। নটরডেম কলেজের পাশের রাস্তায় পার্কিং করা কারের শুধু ছাদটা দেখা যাচ্ছে। মালিক গাড়িতে উঠতে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন।

নিউমার্কেটের প্রধান গলিতে বুকসমান পানি। দোকানকার মালিকেরা যারা বাসা থেকে ডুবন্ত নিউমার্কেটের ছবি দেখে দৌড়ে এস মাল সরানোর চেষ্টা করেছিলেন, তারা অনেকে এসে দেখেন দোকানের তালা ঘোলা-ময়লা পানিতে ডুবে অচেনা হয়ে গেছে। মালপত্র ভিজে গছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেই মালামাল সরাতে পারেননি।

কোথায় নেবেন! বেরুনোর সব রাস্তায় থৈ থৈ পানি! ভ্যান, যানবাহন কিছুই ঢোকানো যাবে না! এখানে জলের যানবাহন নেই। কলের গাড়ি জমানো বৃষ্টির বুকসমান জলে চলার পথ খুঁজে পায়নি কোথাও।

গ্রীন রোডে অনেকগুলো প্রাইভেট হাসপাতাল। সেখানে আগত রোগীদের অবস্থা খুবই করুণভাবে চিত্রিত হয়ে সংবাদে ঠাঁই নিয়েছে সেদিন। ডুবন্ত রিকশাভ্যানে নারী রোগীকে শুইয়ে নিয়ে ঠেলে চলছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরা। পাশের ভবনের কৌতূহলী মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে ‘আহারে’ বলে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যিস! শুক্রবার হওয়ায় সেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না।

এদিন পথে যারই নেমেছেন, তারাই দুর্ভোগে পড়ে গিয়েছেন। বাইকারদের অনেকের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পেটের ধান্ধায় যারা ব্যাটারিরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের বাহন অচল হয়ে যাওয়ায় সেগুলো ঠেলে অন্যখানে সরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

চিৎকার করে কেউ কেউ বলছিলেন- ‘আমাদের ট্যাক্স, ভ্যাট আদায়ের সময় যারা নিয়ম দেখায়, যারা জরিমানা আদায় করে তারা এখন ঘরে বসে টিভিতে আমাদের কষ্ট দেখে তামাশা করছে! এই তিলোত্তমা নগরে নাগরিক সুবিধা কি সামান্য বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকবে’!

কথা হলো- এই ‘তিলোত্তমা’ কী দেবে তোমায় আমায়! তার কি-বা দেবার আছে! রাজধানী ঢাকাকে বিশেষণ দিয়ে রূপসীর টোলপড়া গালের তিলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর সৌন্দর্যের মোহে কবি-সাহিত্যকরা কত শত ছড়া-কবিতা লিখেন দিনরাত।

কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর কত মূল্যবান প্রসাধনী কিনে সাজানোর চেষ্টা করেন এর দেহকে। এর একই অঙ্গে উত্তর-দক্ষিণে কত বাহারি আলো শোভা পায়‍ কিন্তু দিনশেষে এত মেকাপ ‘রিমুভ’ করে ঘুমুতে যাওয়া উপায় নেই তার। এজন্য সে নিজেই নিজের সহ্যগুণ হারিয়ে ‘ভালনেরাবল’ বা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে কারো কোনো নজর নেই।

তবুও প্রতিদিন নতুন নতুন ফেসপাউডার, কাজল, ভারী ভারী গহনা পরানো হচ্ছে। তিলোত্তমার বুক চিরে এত ভারী গহনা পরানোর ফলে এর বুক দুরু দুরু করছে। কানের গহনা কখন কান ছিঁড়ে পড়বে, তার নিরাপত্তা নেই। এর প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় এখন বন্ধ হয়ে গেছে! এসব কথা আক্ষেপ করে বলছিলন এক প্রবীণ ঢাকাবাসী। তাঁর কাছে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হওয়ার কথা হঠাৎ আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম- সেটা কেমন!

মানুষের প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হয়ে গেলে যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না যায়, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য! তবে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হলো কীভাবে! তিনি জানালেন, ধরুন, এর বাতাসের মান বছরের ১০ মাসই অস্বাস্থ্যকর থাকে। পথে হাঁটতে গেলে নাক, চোখ দিয়ে গরম পানি ঝরে। এখন বর্ষাকাল তাই বায়ুতে একটা স্বস্তি। এর মুখ খোলা। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা দিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ, ছাত্র, বেকার, ভাসমান মানুষ ঢুকছে। কেউ একবার ঢুকলে আর বের হতে চায় না।

তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো- এর নিচের ইন্দ্রিয় দুটো বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। যেমন- ধরুন, ভূগর্ভস্থ সুয়্যারেজ লাইন ও নর্দমাগুলোর কথা। এই দুটি ‘তিলোত্তমা’র অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। জুলাই ১৩, ২০২৪ তারিখ চার ঘণ্টার বৃষ্টির পানি যদি বাধাহীনভাবে সব নর্দমা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়তো, তাহলে কি এই ভয়ঙ্কর জলজট হতো!

কিন্তু ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় সদৃশ নর্দমাগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এর নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার উন্নয়ন কাজে এত বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত, তা গুনে শেষ করা যাবে না। তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। কে কখন কাটলো, কে ঢেকে রাখলো, আর কে নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিলো, তা ঠিকমতো হিসাব রাখার মতো সময় সুযোগ নেই কর্পোরেশনগুলোর।

সুতরাং একটু বৃষ্টি হলেই প্লাষ্টিক, মাটি, কাপড়ের টুকরো, কিচেন গার্বেজ ইত্যাদি দিয়ে এর নিচের ইন্দ্রিয় বা ময়লা নিষ্কাশনের নর্দমা বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে; যার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়ে রাজপথে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে, মার্কেটে। নগরের সব জায়গার সব কার্যক্রম হঠাৎ থৈ থৈ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।

এজন্য কর্পোরেশনগুলোর সার্বক্ষণিক ওয়াচটিম ও মটিভেশন কর্মসূচি থাকা দরকার। একেকটি সার্বক্ষণিক ওয়াচটিমের এক-দুইজন সদস্য একেকটি এলাকার ১০টি করে নর্দমার প্রবাহ পরিষ্কার আছে কিনা তা নজরদারিতে রাখলে এই জলাবদ্ধতা সহজেই নিরাময় করা যাবে!

জাপানের ট্রাফিক যেমন অফিসে বসেই রাস্তার চলন্ত গাড়ি ওয়াচ করে মাসিক বেতন বিলের সঙ্গে জরিমানার বিল কেটে ধরিয়ে দেয় তদ্রুপ আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নর্দমা ওয়াচ টিমের দৈনন্দিন কার্যকলাপ সিসি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে জরিমানার বিধান করা যেতে পারে।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকার নির্মাণ কাজ সারাবছর জুড়ে চলে। কখনো শেষ হয় না। নির্মাতারা রাস্তার পার্শ্বে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী, নুড়িপাথর বর্জ্য ফেলে স্তূপ করে রাখে। একটু বৃষ্টি হলে সেগুলো গড়িয়ে কাছাকাছির ড্রেন বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন পার্ক, পথঘাটের খোলা রেস্টুরেন্টে হরদম পলিথিন প্যাকেটে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয়। ফুটপাতের দোকান, দর্জিপাড়া ইত্যাদি থেকে প্লাষ্টিক ব্যাগ ও বেশি শক্ত বর্জ্য নর্দমার মধ্যে ফেলা হয়ে থাকে। ওয়াচটিমের মাধ্যমে সেগুলো নিয়মিত সরিয়ে ড্রেনের ময়লা পানির গতিপ্রবাহ দেখে প্রতিদিন রিপোর্ট নেওয়ার নিয়ম থাকা উচিত।
হয়ত অনেক নিয়ম-কানুন হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘তিলোত্তমা’র রাস্তায় যেখানে-সেখানে কাগজ, পলিথিন, ইটের টুকরা, আবর্জনার ছড়াছড়ি দেখে এসব কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাইতো মনে হয়, মাত্র একবেলা বৃষ্টির পানিতে কেন এই বন্যা! গেল অর্থবছরে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতশ পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে। তবু কেন নগর জুড়ে ভয়াবহ জলাব্ধতার দুর্ভোগ কিছুদিন পর পর ঘাড়ে চাপে! এর দায়ভার কার!

‘তিলোত্তমা’ ঢাকা যানজট, জলজট ইত্যাদিতে নিজেই পঙ্গু হয়ে অসাড় হয়ে পড়েছে। বুয়েটের আবাসিকের মতো জায়গায় নগর পরিকল্পনাবিদদের কোয়ার্টারের নিচতলাবাসী এবার জলজটকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তারা কেউ কেউ পাম্প দিয়ে ঘরের পানি সেচে বাইরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কেউ সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাদের জন্যও উন্নত নাগরিক সেবা সে রাতে শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকায় প্রায় প্রতিবছর এই জায়গায় বার বার কাটাছেঁড়া করায় অতি উন্নয়নের ভারে সে ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছে। যেমনটি ঘটেছিল পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের বেলায়। তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গে এত বেশি প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছিল যে, তিনি একসময় চরম হতাশ হয়ে ওষুধ গ্রহণ ছেড়ে দিয়ে একা একা বাঁচার জন্য নিঃসঙ্গ থাকতে চেয়েছেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি তার। এখন থেকে আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অঙ্গে আর কাটাছেঁড়া না করাটাই উত্তম।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র ওপর একসঙ্গে অনেক ব্যাধি ভর করেছে। এ অবস্থায় তার কাছে আর কী নতুন সেবা চাওয়ার আছে আমাদের! তাই, ‘তিলোত্তমা’র ওপর আর শল্য চিকিৎসা না চাপিয়ে উল্লিখিত টোটকা দাওয়াই দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রাবণ সংখ্যা আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে শিল্প ও সাহিত্যের ছোট পত্রিকা 'কথার কাগজ'-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

শুক্রবার (১২ জুলাই) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে 'কথার কাগজ' শ্রাবণ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহানারা স্বপ্না, কথাসাহিত্যিক ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর, স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনীর প্রকাশক মাশফিক তন্ময়, কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ, নির্বাহী সম্পাদক অয়ন আব্দুল্লাহ প্রমুখ। পত্রিকাটির বার্ষিক শ্রাবণ, কার্তিক ও ফাল্গুন তিনটি সংখ্যায় প্রকাশ হবে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ বলেন, 'করোনাকালীন ২০২০ সালে কথার কাগজের জন্ম। সে সময় কয়েকজন প্রবাসী আর দেশি লেখক অনলাইনে ব্লগের মাধ্যমে কথার কাগজের লেখালেখি শুরু করি। তরুণ সাহি- ত্যিকদের সঙ্গে প্রবীণ সাহিত্যিকদের লেখালেখির একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায় কথার কাগজ।

প্রকাশক মাশফিক তন্ময় বলেন, 'এক সময় সাহিত্য আন্দোলনের প্রধান বাহন ছিল ছোট পত্রিকা বা লিটলম্যাগ। কিন্তু নানা সংকটে লিটলম্যাগের কলেবর ছোট হয়ে গেছে। প্রকাশকরা অনেকেই অর্থসংকটে তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে অনলাইনের এই যুগে ছাপা কাগজে কথার কাগজের যাত্রা তরুণ লেখকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।'

শাহানারা স্বপ্না বলেন, 'আশা করি, পত্রিকাটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। শ্রাবণ সংখ্যার প্রথম দর্শনে মনে হচ্ছে এটি পাঠকদের সাহিত্যের খোরাক জোগাবে।'

ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর বলেন, 'মানুষের ভাষার প্রতি টান থাকলে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কাজ করা যায়, এর উদাহরণ কথার কাগজ। সম্পাদকম- গুলীর তিনজনই দেশের বাইরে থেকে এর যাত্রা শুরু করেন। আজকে দেশে এসেই তারা পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করলেন।'

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, 'আমাদের তরুণরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। তবে কথার কাগজের সঙ্গে জড়িতরা বিদেশ থেকে সাহিত্য আর দেশের টানে ফিরে এসেছেন। অনলাইনের যুগে যখন অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা কথার কাগজের প্রিন্ট ভার্সন নিয়ে এসেছেন। এটি অনেক ভালো লাগার।' নতুন পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

;

লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হওয়ার পথে!



আবদুল হামিদ মাহবুব
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখালেখির হাত খুব ভালো। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হননি তখনই তার একাধিক বই প্রকাশ হয়েছে। সম্ভবত তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘ওরা টোকাই কেন’। ঢাকার আগামী প্রকাশনী থেকে বইখানা বের হয়েছিল। ওই প্রকাশনী থেকে আমারও দু’খানা ছড়ার বই প্রকাশ হয়। ১৯৯১ সালে আমার ‘ডিমের ভিতর হাতি’ যখন প্রকাশ হচ্ছিলো তখন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাই শেখ হাসিনার ‘ওরা টোকাই কেন’ এককপি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।

বইখানা প্রথম না দ্বিতীয় সংস্করণের ছিলো সেটা মনে নেই। ওই বই কয়েকটি নিবন্ধের সংকলন। অধিকাংশ নিবন্ধেই শেখ হাসিনা তাঁর ভিতরের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন দেশ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কিছু কিছু ইঙ্গিত। পড়েছিলাম তো অনেক আগে। তারপরও লেখাগুলোর অনেক বিষয় মনে রয়ে গেছে। প্রতিটি নিবন্ধ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার পারিবারিক ছোট লাইব্রেরিতে বইখানা গোছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ যখন ওই বই খোঁজতে লাগলাম, পেলাম না। অনুমান হচ্ছে আমার বইচোর কোন বন্ধু হয়তো এই বইখানা মেরে দিয়েছেন। অথবা বন্যা অতঙ্কে কয়েকেবার বাসার বইগুলো টানাটানি করার কারণে কোথাও হয়ত খুইয়ে ফেলেছি। তবে আমার ধারণা এই বইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমটি ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রীর অনেক বইয়ের মতো ‘ওরা টোকাই কেন’ নিশ্চয়ই বহুল প্রচারিত হয়েছিল, বেরিয়েছিল অনেক অনেক সংস্করণ। আর বই সমূহের রয়্যারিটিও তিনি হাজার হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রাপ্তি ঘটে থাকলে, আমি একজন লেখক হিসাবে অবশ্যই পুলকিত হই। আমি দেখেছি সেই ১৯৯১ সালের পর থেকে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশনা ব্যবসারও অনেক উন্নতি হয়েছে। ব্যবসার উন্নতি ঘটার অর্থ প্রকাশকের উন্নতি ঘটা। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা অনেক অনেক ভালো হয়েছে।

পূর্বে দেখতাম একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী ছোট্ট স্টল নিত। এখন প্যাভিলিয়ন নেয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়নের অঙ্গসজ্জা করা হয়। নিশ্চয় বইয়ের ব্যবসা ভালো হয়। সেকারণেই বইমেলার প্যাভিলিয়ন তৈরিতে বিনিয়োগও বেশি করেন। প্রতিবছরই আগামী প্রকাশনীর কোন না কোন বই কেনার জন্য পাঠকের লাইন পড়ে। পাঠক যখন যে কোন লেখকের বই কেনে, সেটা দেখে আমি একজন লেখক হিসাবে আনন্দিত হই। বইয়ের ব্যবসার উন্নতি হোক। প্রকাশকরা ভালো লাভ করুন, আমি মনে প্রাণে সেটা চাই।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, প্রকাশকের লাভ হলে আমার মতো মফস্বলের লেখকরা কি লাভমান হই? অবশ্যই যৌক্তিক প্রশ্ন। এর জবাব খুব সংক্ষিপ্ত। প্রকাশকরা যখন বই প্রকাশ করে লাভের মুখ দেখবেন, তখন তারা নতুন নতুন বই প্রকাশে আগ্রহী হবেন। নতুবা আমাদের মতো লেখকদের প্রকাশককে উল্টো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করিয়ে নিতে হবে। এবং আমরা অনেকেই সেটা করছিও।

অনেকে আবার এও বলেন ডিজিটালের এই যুগে এখন আর কেউ বই কিনে পড়ে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে টুকটাক পড়েই তাদের পড়া শেষ করেন। সেই কারণে লেখকরা গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করলেও সেগুলো বিক্রি হয় না। আমি এই অপবাদটা মানতে নারাজ। কারণ আমি দেখেছি কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলা চলাকালে শত শত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। আর যারা পড়ুয়া, তারা সারা বছরই খোঁজে খোঁজে রকমারি, প্রথমা, আগামী, শ্রাবণ, ইউপিএলসহ বিভিন্ন আনলাইন বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান থেকে বই আনান।

আমি মফস্বলের একটি শহরে থাকি। আমাদেরে শহরে বইয়ের দোকান আছে অনেক। সেগুলোতে স্কুল কলেজের পাঠ্য ও গাইড বই ছাড়া অন্য বই খুব কমই দেখা যায়। সৃজনশীল বলুন আর মননশীল বলুন, সেইরকম বইয়ের দোকান খুব একটা নাই। আমাদের শহরে প্রকাশনা ব্যবসার সাথে ‘কোরাস’ নামে একটি দোকান চালান বই পাগল এক যুবক মুজাহিদ আহমদ। তাঁর কোরাসেই আমাদের মত পাঠকের উপযোগী কিছু কিছু বই আসে। কিন্তু সবসময় কোরাসও আমাদের মতো পাঠকদের চাহিদার যোগান দিতে পারে না। তারপরও মন্দের ভালো হিসাবে দোকানটি টিকে আছে, টিকে থাক্।

আমাকে প্রায়ই অর্ডার করে ‘রকমারি’ থেকে বই আনাতে হয়। আমার আনানো বই ছাড়িয়ে আনার জন্য আমি নিজে প্রায়ই কুরিয়ার অফিসে যাই। আমি যেদিনই কুরিয়ার অফিসে গিয়েছি, দেখেছি কেবল আমার বই নয়, আমার মতো আরও অন্তত বিশ থেকে পঁচিশ জনের বইয়ের প্যাকেট এসেছে। কুরিয়ার অফিসের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, প্রতিদিনই এভাবে কিছু না কিছু বই নানাজনের নামে আসে। আর আমার নিজের চোখে দেখাটাকেওতো বিশ্বাস করতে হবে। মানুষ যদি বই নাই পড়বে তবে কেনো রকমারি কিংবা অনলাইনের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এতো এতো বইয়ের প্যাকেট আসবে? আমি বলবো বইয়ের পাঠক মোটেই কমেনি বরংচ বেড়েছে।

শুরু করেছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বইয়ের প্রসঙ্গ দিয়ে। বই প্রসঙ্গেই বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গও এসে গেল। আমাদের শহরের সেই যে ‘কোরাসে’র কথা বলেছি; ক’দিন আগে এক দুপুরবেলা কোরাসে গিয়ে বই দেখছি। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইজন প্রধান শিক্ষক কোরাসে এসে ঢুকলেন। তাদের দু’জনের হাতেই বেশ বড় সাইজের চারখানা করে বই। ওই দুই প্রধান শিক্ষক আমার পূর্ব পরিচিত। তাদের হাতে বই দেখে আমি উৎফুল্ল হলাম। কি বই? কোথা থেকে আনলেন? এমন প্রশ্ন করে বইগুলো দেখতে চাইলাম। দু’জনই ক্ষোভ প্রকাশ করে আমার সামনে টেবিলের উপর ধাম্ ধাম্ করে বইগুলো রাখলেন। একজন বললেন, ‘‘আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার জন্য এই বইগুলো নগদ চব্বিশ’ টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। বলুন ছাত্ররা এই বই পড়তে পারবে? তারা কি কিছু বুঝবে?’’ অন্য প্রধান শিক্ষকের চেহারায় তখনও বিরক্তি রয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘বইগুলো দেখুন, আপনি লেখক মানুষ, আপনিও কিছু বলুন।’

আমি তাদের আনা বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম। দেখি চার চার আটখানা বই, দুটি বিষয় নিয়ে করা হয়েছে। প্রচ্ছদে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছবি। বইগুলোর লেখক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি বইয়ের নাম ‘সকলের তরে সকলে আমরা’। এই বইয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যে ভাষণগুলো দিয়েছেন সেগুলোর বাংলা ও ইংরেজি সংকলন। অপর বইয়ের নাম ‘আহ্বান’। এই বই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে যেসব ভাষণ দিয়েছেন সেগুলো সংকলিত করে।

দু’খানা বইয়ের-ই কাগজ, ছাপা, বাঁধাই খুবই উন্নত মানের। প্রতি কপি বইয়ের মূল্য ছয়শত টাকা। প্রত্যেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য প্রতিটি বইয়ের দুই কপি করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বিক্রি করেছে। প্রধান শিক্ষকরা এই বইগুলো কিনে নিতে বাধ্য। চারখানা বইয়ের জন্য প্রধান শিক্ষকদের দুই হাজার চারশত টাকা করে অফিসের সংশ্লিষ্ট ক্লার্কের কাছে পরিশোধ করতে হয়েছে। বুঝতে পারি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলেই এই দুই প্রধান শিক্ষক ক্ষুব্ধ। আমি শিক্ষকদের অনুমতি নিয়েই একটি বিদ্যালয়ের জন্য আনা চারখানা বইয়ের ছবি উঠিয়ে নিলাম। এই সময় কোরাসের কর্ণধার মুজাহিদ আহমদ বললো, ‘ভাই, আমি এমন একখান বই প্রকাশের অনুমতি পেলে কোটিপতি হয়ে যেতাম।’

আমি ওই দুই প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললাম; ‘প্রধানমন্ত্রীর বই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, এটাতো আনন্দের বিষয়। কিন্তু আমারও প্রশ্ন হচ্ছে বইগুলো কি প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগি? আর প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রিয় এইসব ভাষণ বই আকারে করাটা তো সরকারি খরচেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে দিতে হলে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকলন টাকার বিনিময়ে কিনতে হবে কেনো?’

তখন একজন বললেন; ‘ভাই, এই বই রাষ্ট্রিয় ভাবে হয়নি। ব্যবসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের এক দু’জন প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা কোটি কোটি টাকা কামাই করে নিচ্ছেন।’ উনার কথায় আমি বইয়ের প্রথম দিকের পাতা উল্টালাম। ঠিকইতো প্রকাশক ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান। দু’খানা বইয়েরই গ্রন্থনা ও সম্পাদনা মো. নজরুল ইসলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার (সচিব)। খেয়াল করে দেখলাম বই দু’খানার কপিরাইট শেখ হাসিনা। বুঝতে পারি যে এই বইগুলোর যে রয়্যালিটি আসবে সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীই পাবেন।

এখন একটা হিসাব করে দেখি। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬শ ২০টি। এই বই যখন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বাধ্যতামূলক কিনতেই হবে, তা হলে ৪ কপি করে বই বিক্রি হবে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোতে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪শ ৮০ কপি। এই বইয়ের মূল্য থেকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের হাতে টাকা আসবে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৮হাজার। বইয়ের কপিরাইট অনুযায়ী শতকরা ১৫ ভাগ রয়্যালিটি নিলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী পাবেন ২ কোটি ৩৬ লাখ ২৩ হাজার ২শ টাকা। হিসাবে কিন্তু আমার মাথা ঘুরে গেছে। বই থেকে এমন অঙ্কের রয়্যারিটি এদেশে আগে কেউ পেয়েছেন কি না আমি জানি না।

আর এটাতো আমি কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিক্রির হিসাব দিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য যখন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে, তবে তো উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও এই বইগুলো এভাবেই বিক্রি হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত করলে আরো কতো কতো হাজার বেড়ে যাবে। আমি হিসাব বাড়ালে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারি।

আমার ঘরেও একজন প্রধান শিক্ষক আছেন। লেখাটার পূর্ণতার জন্য তার কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি খ্যাক্ করে উঠে বললেন, ‘স্কুল আমি চালাই। আমার স্কুলের জন্য কখন কি ভাবে কি কিনবো না কিনবো সেটা তোমাকে বলবো কেনো?’ দেখলাম ঘাটাতে গেলে আবার কি থেকে কি হয়ে যায়। তাই কথা না বাড়িয়ে লেখা শেষ করার দিকেই মনোযোগ রাখলাম।

আমরা যারা লেখক আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, প্রকাশকরা লেখকদের ঠকান। তারা ঠিক মতো লেখকের পাওনা রয়্যালিটি পরিশোধ করেন না। তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রীকে ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান ঠকানোর সাহস করবেন? নিশ্চয় না। এই ভরসাতেই বলতেই পারি বই বিক্রির অর্থে আমাদের লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হবার পথে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার

ইমেইল: [email protected]

;

দশ টাকার শোক



মনি হায়দার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় পনেরো মিনিট ধরে মানিব্যাগটা উল্টেপাল্টে দ্যাখে রজব আলী।

মানিব্যাগটা খুব পছন্দ হয়েছে তার। বিশেষ করে মানিব্যাগটার বাদামি রংটা। ব্যাগটা চামড়ার তৈরি। রজব আলী নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকে। বোঝা যায় না কোন্ পশুর চামড়ায় মানিব্যাগটা তৈরি হয়েছে। মানিব্যাগটার ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট কুঠরি। রজব আলী কল্পনায় দেখতে পায়- মানিব্যাগটার ভিতরে রাখা টাকায় ভেতরের কুঠুরিগুলো ভরে উঠেছে।

ব্যাগটা প্যান্টের পকেটে নিয়ে যখন হাঁটবে পিছটা ফুলে যাবে, মুহূর্তেই শরীরের কোষে কোষে একটা অন্যরকম অহমিকা অনুভব করে সে।

ভাই, মানিব্যাগটার দাম কতো ? রজব আলী মানিব্যাগঅলাকে জিজ্ঞেস করে।

ব্যাগঅলা রজব আলীর উপর মনে মনে চটে উঠেছে। সেই কতোক্ষণ থেকে ব্যাগটা উল্পেপাল্টে দেখছে। কেনার কথা বলছে না। অথচ রজব আলীর দেখার মধ্যে দুটো ব্যাগ সে বিক্রি করেছে। ফুটপাতের জিনিস এতক্ষণ নাড়াচাড়া কেউ করে না। ব্যাগঅলা রাগ করে কিছু বলতেও পারে না। যদি কেনে ?

আপনি নেবেন ? রজব আলীর দাম জিজ্ঞাসায় ব্যাগঅলা পাল্ট প্রশ্ন ছোড়ে। কারণ রজব আলীকে দেখে তার মনে হয় না এই লোক মানিব্যাগ কিনবে।

রজব আলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির অফিসের পিওন। পরনের পোশাকে ঐ বহুজাতিক কোম্পানির পরিচয় আছে। ব্যাগঅলার ধারণা এইসব লোকজন সাধারণত মানিব্যাগ-ট্যাগ কেনে না। তাদের সামান্য টাকা আয়, কোনোভাবে সেই পয়সায় মানিব্যাগ কেনার মানসিকতা বা প্রয়োজনীয়তাও থাকে না।
নেবো।

ইতোমধ্যে ব্যাগঅলার সামনে দামি প্যান্টশার্ট পরা একজন ভদ্রলোক এসেছে। সঙ্গে তন্বী তরুণী। তাদের আসায় চারপাশের আবহাওয়ায় বিদেশী সেন্টের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভদ্রলোকের কাছে রজব আলী অযাচিতভাবে হেরে যায়। বাস্তবতার কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হয় তাকে।

তন্বী তরুণী ও ভদ্রলোক মিলে কয়েকটা মানিব্যাগ দেখে। বাছাই করে। অবশেষে তন্বীয় কথানুযায়ী ভদ্রলোক তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যে তারা মানিব্যাগ দেখলো, দাম করলো, কিনলো এবং চলেও গেলো। অথচ রজব আলী বিশ-পঁচিশ মিনিচের মধ্যে মধ্যে দামটাও জানতে পারলো না ! তারা চলে যাওয়ার পর রজব আলী ব্যাগঅলার কাছে যায়।

বললেন না কতো দাম ?

রজব আলীর দিকে আড়চোখে তাকায়, মানিব্যাগ আপনার পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ না হলে দাম জিজ্ঞেস করবো কেনো ?

একশো আশি টাকা।

একশো আশি টাকা। রজব আলী মুখ থেকে বিপন্ন শব্দগুলো বের হয়।

বিরক্তি প্রকাশ করে ব্যাগঅলা, অবাক হওয়ার কি আছে? আপনার সামনেই তো দেখলেন তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ বিক্রি করেছি। ঠিক আছে আপনি ঐ সোয়াশ টাকাই দেন।
সোয়াশ টাকা একটা মানিব্যাগের দাম ! রজব আলীর বিস্ময় কোনো বাঁধা মানে না।

ব্যাগঅলা বুঝতে পারে রজব আলী এতো টাকায় ব্যাগ কিনবে না। সবাইতো ঐ টাকাঅলা ভদ্রলোক নয়, বেশি দাম-দর না করেই তাদের হাকানো দামেই কিনবে। রজব আলীরা তো মানিব্যাগই কেনে না। সেখানে রজব আলী যে কিনতে এসেছে সেটাই অনেক। ব্যাগঅলা মানিব্যাগ বিক্রি করলেও তার পকেটে মানিব্যাগ থাকে না। নিজের সঙ্গে রজব আলীর সাদৃশ্য দেখতে পায় ব্যাগঅলা। একই কাতারের ঠেলা-গুতা খাওয়া মানুষ তারা। লোকটাকে ঠকিয়ে লাভ নেই। হয়তো অনেক আশা করে সারা জীবনে একবার একটা মানিব্যাগ কিনতে এসেছে।

আপনি সত্যিই কি মানিব্যাগটা কিনবেন ? নরম কণ্ঠে ব্যাগঅলা জানতে চায়।

কিনবো বলেই তো পছন্দ করেছি। দাম জানতে চাইছি।

তাহলে শোনেন ভাই, অনেক্ষণ ধরে আপনি মানিব্যাগটা দেখছেন, ফাইনাল কথা বলে দিচ্ছি, মানিব্যাগটা আপনি আশি টাকায় নিতে পারবেন। আশি টাকার এক টাকা কমেও বিক্রি করবো না।
রজব আলীর এই মুহূর্তে ব্যাগঅলাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়। কোথায় একশো আশি টাকা, সেখান থেকে একশত পঁচিশ এবং সবশেষে পুরো শতকই নেই; কেবল আশি টাকা। সে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে রাখে। মানিব্যাগটা পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে রজব আলী নিজেকে একজন দামি মানুষ ভাবে। তার পকেটেও অনেকের মতো মানিব্যাগ আছে।

দীর্ঘদিনের একটা আকাক্ষা, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো রজব আলীর। মানিব্যাগ কেনার একটা সিগারেট কেনে। সাধারণত সে সিগারেট টানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সিগারেট টানার ইচ্ছে হলো তার। না, কেবল সিগারেটই নয়, একটা ঝাল দেওয়া পানও কিনলো এবং মুখে দিয়ে পরম আয়াসে চিবুতে লাগলো। সিগারেটটা ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে রজব আলী একটা রিকশায় উঠলো। পর পর তিনটি কাজ সে করলো-যা সে খুবই কম করে। সিগারেট টানা, পান খাওয়া এবং রিকশায় করে বাসায় ফেরা। তার জীবনেএকটুকুই শ্রেষ্ঠ বিলাসিতা। রিকশা ছুটে চলেছে।

রজব আলীর মাথার কোষে, যেখানে স্বপ্ন বিলাসী বা ইচ্ছের রক্তকণিকা থাকে- সেখানে মানিব্যাগ কেনার শখ জাগলো প্রায় মাস তিনেক আগে। সে, অফিসের বড় সাহেবের ব্যক্তিগত পিওন। চা, চিনি, সিগারেট থেকে শুরু করে যা কিছু দরকার সবই আনে রজব আলী। দীর্ঘদিনের চাকরির কারণে সে বড় সাহেবের খুব বিশ্বস্ত ও অনুরাগী। অফিসে প্রতিদিন অনেক মেহমান আসে।

নানান কিসিমের মানুষের আনাগোনা বড় সাহেবের কাছে। এইসব মেহমান আসলেই বড় সাহেব বেল টিপে রুমের বাইরে হাতলবিহীন চেয়ারে অপেক্ষায় থাকা রজব আলীকে ডাকেন। রজব আলী ত্রস্ত খরগোশের মতো ভেতরে ঢোকে। কিন্তু ঢুকেই খরগোশের মতো মাথা উঁচু রাখতে পারে না। কোথাকার কোন এক অদৃশ্য অপরিমেয় শক্তি এসে তার মাথাটাকে নিচু করে দেয়।

তার দাঁড়ানো পর বড় সাহেব বড় অবহেলায়, নিপুণ নৈপুণ্যে, গাম্ভীর্যের কৌশলী পারম্পর্যে অবলীলায় প্যান্টের ডান দিক থেকে মোগল সম্রাটদের ক্ষমতায় মানিব্যাগটা বের করে টেবিলে রাখেন। মেহমানবৃন্দ গভীর অভিনিবেশে বড় সাহেবের কর্মকান্ড দেখতে থাকেন। মানিব্যাগটা টেবিলে রেখেই বড় সাহেব টেবিলের অন্যপ্রান্তে রাখা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে পরম আদরে রাখেন এবং তৎক্ষণাৎ লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট টানেন আয়েসের সঙ্গে।

সিগারেটে দু’-দিনটি টান দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝখানে আটকে রেখে মানিব্যাগটা তোলেন ডান হাতে। মানিব্যাগটা টাকার কারণে সবসময় পোয়াতি নারীর মতো ফুলে থাকে। বড় সাহেবের মানিব্যাগে টাকাগুলো অধস্তন, পরাধীনভাবে নিবিড় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। একহাজার, পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ টাকার অসংখ্য নোট সাজানো পাশাপাশি। দেখতে কতো ভালো লাগে ! রজব আলী দেখে। দেখেই তার আনন্দ।

বাম হাতে মানিব্যাগটা ধরে ডান হাতের দুই আঙ্গুলে বড় সাহেব বেশ কয়েকটা নোট বের করেন। একটা নোট রজব আলীর দিকে বাড়িয়ে দেন, শীগগির নাস্তা নিয়ে আয়।

রজব আলী বিনয়ের সঙ্গে টাকাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবং নাস্তার আয়োজনে নিদারুণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই রুটিন চলছিলো। হঠাৎ মাস তিনেক আগে রজব আলীর মাথায় এই প্রশ্নটা উঁকি দেয়- বড় সাহেবের গাড়ি বাড়ি টাকা মান-সম্মান ক্ষমতা আছে। রজব আলীর কিছুই নেই। কিন্তু একটা মানিব্যাগতো থাকতে পারে। আর যাই হোক বড় সাহেবের মতো মানিব্যাগ থেকে সেও টাকা বের করে বাস কন্ডাকটর, চালের দোকানদার, মাছঅলা, ডালঅলাদের দিতে পারবে।

এই ভাবনা, স্বপ্ন এবং কল্পনার পথ ধরে কয়েকমাস যাবৎ রজব আলী চেষ্টা করে আসছে একটা মানিব্যাগ কেনার। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। বৌয়ের শরীর খারাপ- ডাক্তারের টাকা দেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন, বই খাতা কেনা- যাবতীয় সাংসারিক কাজের চাপে মানিব্যাগ কেনা সম্ভব হয়নি। আজকে সে বেতন পেয়েছে। এবং সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে রজব আলী মানিব্যাগটা কিনেই ফেললো। আসলে কখনো কখনো একটু-আধটু রিস্ক নিতেই হয়। নইলে ছোটখাট স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ হবার নয়।

রিকশায় বসেই সে জামার বুক পকেট থেকে বেতনের বাকি টাকাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে মানিব্যাগে। মানিব্যাগটার পেট ফুলে যায়। হাতে নিয়ে তার দারুণ ভালো লাগে। কিছুক্ষণ হাতে রাখার পর রজব আলী মানিব্যাগটাকে পিছনে প্যান্টের পকেটে রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্যান্টের পিছন দিকটা ফিরে ফিরে দ্যাখে- কতোটা ফুলে উঠলো ? তেমন না। যেভাবে বড় সাহেবের পিছন দিকটা ফুলে থাকে, সে রকম নয়। রজব আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

রিকশা বাসার কাছে আসলে সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে যায়। তার মনের মধ্যে ছোট সুখের একটা ছোট পাখি ডানা মেলেছে। গানের সুর ভাজতে ভাজতে রজব আলী দেড় কামরার স্যাঁতস্যাঁতে বাসায় ঢোকে। সে ঢুকলো সংসারে, তাতে সংসারের কিছু যায় আসে না। সংসারটা তার কাছে সীমাহীন অন্ধগলির মোড়। যেখানে অভাব দারিদ্র ক্ষুধার চাহিদা কুমিরের হা মেলে থাকে, সেখানে তার মতো একজন রজব আলীর আসা না আসায় কিছুই যায় আসে না। রজব আলী স্ত্রী মকবুলা বেগম চতুর্থ সন্তান, যার বয়স মাত্র তিনমাস তাকে মাই খাওয়াচ্ছে।

অন্যান্যরা মেঝেতে জটলা পাকাচ্ছে একটা পুরোনো ক্যারামের গুটি নিয়ে। মকুবলা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে রজব আলীকে একবার দেখে আবার মাই দিতে থাকে। রজব আলী কি করবে ভেবে পায় না। সাধারণত বেতন নিয়ে বাসায় ফিরলে তরিতরকারি, চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান, দুই এক প্যাকেট সস্তা বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে আসে রজব আলী। আজকে একবারে অন্যরকম একটা জিনিস এসেছে- যার প্রতি তার নিজের মমতা অনেক। সংসারে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কি হবে বুঝতে পারছে না।

শুনছো ? রজব আলী স্ত্রীকে ডাকছে।

কনিষ্ঠতম সন্তানের মুখ থেকে মাই সরাতে সরাতে সাড়া দেয় মকবুলা বেগম, কি ?

একটা জিনিস এনেছি।

মকবুলা বেগম সরাসরি তাকায় রজব আলীর দিকে, কি এনেছো ?

অদ্ভুত একটা হাসি রজব আলীল ঠোঁটে, একটা মানিব্যাগ।

দ্রুত ব্যাগটা বের করে মকবুলা বেগমের হাতে দেয় রজব আলী। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো বসে থাকে মকবুলা বেগম। একবার কোটরের চোখ দিয়ে তাকায় রজব আলীর দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়েই ব্যাগটা অবহেলায় রেখে দেয় সে, মানিব্যাগ ফুটাতে কে বলেছে তোমাকে! বেতন পেয়েছো আজ না ?

বেতন পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। মকবুলা বেগমের লং প্লে রেকর্ড বাজা আরম্ভ হলো, বাসায় কিছু নাই। অফিসে যাবার সময় বললাম, ফিরে আসার সময় ছোট বাচ্চাটার জন্য এক কৌটা দুধ এনো। বড় ছেলেটার খাতা পেন্সিল নেই- নিয়ে এসো। তার কোনো খবর নেই। উনি নিয়ে এলেন মানিব্যাগ। ছেলেমেয়ে বৌয়ের মুখে তিন বেলা ভাত জোটাতে পারে না, উনি মানিব্যাগ কিনে ভদ্দরলোক হয়েছেন! কানার আবার স্বপ্ন দেখার শখ!

রজব আলীর মন শরীর স্বপ্ন আকাক্ষাগুলো শাঁখের করাতে কাটছে এখন। হায়, সংসারের জন্য ব্যক্তিগত দুই-একটা স্বপ্নও কি পূরণ করা যাবে না ! সকাল থেকে রাত পর্যন্ততো সংসারের সুখের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সামান্য একটা মানিব্যাগের জন্য স্ত্রী এমনভাবে শ্লেষের কথা বলে-একেক সময় মনে হয় রজব আলী আত্মহত্যা করে। পারে না।

স্ত্রীর শান দেওয়া কথার বান থেকে আপাতত রক্ষা পাবার জন্য না খেয়ে বাইরে চলে আসে রজব আলী। এভাবেই সে অক্ষমতার জ্বালা, বেদনা ও ক্ষরণকে তাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। রাস্তায় দোকানে এখানে সেখানে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার মকবুলা বেগমের সংসারেই ফিরে আসে। পরের দিন রজব আলী যথারীতি অফিসে।

অফিসের লোকজনের কাছে মানিব্যাগটা দেখায়। কেউ দেখে, কেউ আগ্রহবোধ করে না।

বল তো বারেক, অফিসের আরেকজন পিওনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে রজব আলী- মানিব্যাগটা কেমন হয়েছে ?

বারেক মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে- ভালো। খুব ভালো হয়েছে। কতো টাকায় কিনেছো ?
প্রচ্ছন্ন গর্ব রজব আলীর, তুই বল।

আমি কেমনে বলবো ?
অনুমানে।
বারেক কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলে, ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।

তোর বাপের মাথা! ধমকে ওঠে রজব আলী। এ রকম একটা মানিব্যাগ জীবনে চোখে দেখেছিস ? কেমন রং এটার ! ভেতরে কতোগুলো ঘর আছে জানিস ! একহাজার, পাঁচশ, একশো, পঞ্চাশ টাকার নোট রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে। তাছাড়া এই ব্যাগটা বিদেশী। দেশী না।

তোমার মানিব্যাগের যতো দামই থাক, তুমি বাপ তুলে কথা বলবে ? বারেকের আত্মসম্মানে সামান্য ঘা লাগে।

বলবো না, হাজার বার বলবো। এতো শখ করে একশ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কিনলাম। আর তুই কিনা বলিস মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় কিনেছি ! জানিস, এই রকম মানিব্যাগ আছে আমাদের বড় সাহেবের।

হতেই পারে। আমার তো মানিব্যাগ নেই। কখনো ছিলোও না। তাই দাম জানি না। কিন্ত তুমি একটা একশো টাকা মানিব্যাগে জন্য বাবা তুলে কথা বলতে পারো না-

বারেক যখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত তর্কে হেরে যাচ্ছিলো, তখনই বড় সাহেব অফিসে ঢোকেন সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু মেহমান নিয়ে। বারেক চট্ করে সরে যায়। রজব আলী দ্রুত দরজা খুলে দাঁড়ায়। বড় সাহেব সঙ্গীদের নিয়ে রুমে ঢোকেন। রজব আলীকে চা আনতে বলেন বড় সাহেব। শুরু হয় রজব আলীর দৌড়।

কয়েকদিন পর বড় সাহেব অফিসে কয়েকজন ক্লায়েন্টের সামনে বসে রজব আলীকে ডাকেন, রজব আলী?

জ্বী স্যার ?
তোমার হয়েছে কি ?

রজব আলী ভেবে পায় না তার কোথায় কখন কি হয়েছে ? ডানে বামে উপরে নিচে তাকায় সে, কই স্যার-কিছু হয় নাইতো।
তোমার হাতে মানিব্যাগ কেনো ?

এই কথার কি জবাব দেবে রজব আলী? হঠাৎ মগজের কোষ কোনো কাজ করে না। সে বুঝে উঠতে পারে না- তার হাতে মানিব্যাগ থাকলে বড় সাহেবের অসুবিধা কি ? কক্ষের সবাই রজব আলীর দিকে চেয়ে আছে। এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। হঠাৎ রজব আলী উপলব্ধি করতে পারে- মানিব্যাগটা থাকার কথা প্যান্টের পকেটে। হাতে নয়। এবং তার আরো মনে পড়লো মানিব্যাগটা কেনার পর থেকে, বিশেষ করে অফিস করার সময় মানিব্যাগটা কারণে-অকারণে তার হাতেই থাকে। কেন থাকে ?

সে কি সবাইকে তার সদ্য কেনা মানিব্যাগটি দেখিয়ে তৃপ্তি পেতে চায় ? যা প্রকারান্তরে অক্ষম অথর্ব মানুষের করুণ মনোবিকৃতি ? নিশ্চয়ই তার অবস্থা দেখে বড় সাহেব, তার পরিষদবর্গ, অফিসের লোকজন হাসছে। রজব আলী নিমিষে নিজেকে বায়ুশূন্য ফাটা একটা পরিত্যাক্ত বেলুন হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করে। লজ্জায় বালুর সঙ্গে সে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে মুশকিল হচ্ছে- সে ইচ্ছে করলেই বালু বা বায়ুর সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। মানুষ হিসাবে তাকে অনড় ও অবিচল থাকতে হয়।

বড় সাহেবের মুখে অদ্ভুত হাসি- রজব ?

জ্বী স্যার ?
মানিব্যাগটা কবে কিনেছো ?

রজব আলী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। ভেতরের কে একজন যেন রজব আলীকে থামিয়ে দিয়েছে। যে রজব আলীর ওষ্ঠ জিহ্বা কণ্ঠ ভেতরের ক্ষুধিত শক্তিকে পাথর বানিয়ে জমাট করে রেখেছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে কথা বলতে। পারছে না। সে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কথা বলছো না কেন ? বড় সাহেবের কণ্ঠে এখন কর্তৃত্ব ও অপমানের সুর।

ঢোক গিলে জবাব দেয় রজব আলী- কয়েক দিন আগে।

কতো টাকায় ?

একশ টাকা।

তাই নাকি ! দেখি, বড় সাহেব হাত বাড়ান।

রজব আলী সারা জীবনের সমস্ত অভিশাপ নিজের মাথায় ঢালে-কেন সে মানিব্যাগ কিনতে গেলো ? কিনলোই যদি তাহলে পকেটে না রেখে হাতে রাখার প্রয়োজন হলো কেন ? দেখাতে চেয়েছিলো বড় সাহেবকে ? বড় সাহেবের মানিব্যাগ থাকলে পারলে তার থাকবে না কেন ? প্রতিযোগিতা ? কি অসম প্রতিযোগিতা ? কি ভয়ংকর গ্লানিকর পরাজয় !

কই দাও, বড় সাহেবের হাতটা তখনো বাড়ানো। নিন।

রজব আলী ব্যাগটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়।

কোথায় যাও? তোমার মানিব্যাগ নিয়ে যাও-

আর যেতে পারে না সে কক্ষের বাইরে। কক্ষের ভিতরে রজব আলীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বড় সাহেব মানিব্যাগটাকে উল্টেপাল্টে দেখেন। কক্ষের অন্যান্য সবাই বড় সাহেবের হাতের ব্যাগটাকে তীর্যক চোখে দেখছে। কেউ কেউ হাসছে। সে হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে তীক্ষ্ন কাঁটা। কাঁটায় বিষ। যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছে রজব আলী। এছাড়া তার উপায়ও নেই।

রজব আলী !

বড় সাহেবের ডাকে চোখ তুলে তাকায় সে, স্যার!

নাও তোমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা ভালোই কিনেছো।

হাত বাড়িয়ে ব্যাগটি নিয়ে রজব আলী দরজা খুলে নিমিষে বাইরে চলে আসে। দরজা দ্বিতীয়বার বন্ধ করতে পারে না, তার আগেই বড় সাহেব এবং অন্যান্যদের হাসির ছুরি তীব্র অপমানে রজব আলীর কান এবং মর্মের মূলে আঘাত হানে। মনে হচ্ছে তাদের হাসির হলকা তাকে শান দেয়া ছুরির মতো কাটছে। আর রজব আলী নিজের রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

রজব আলী মানিব্যাগ আর হাতে রাখে না। প্যান্টের পকেটেই রাখে। মাস শেষে মানিব্যাগের ছোট্ট খোপে খুচরো কয়েকটা মাত্র টাকা দেখতে পায় রজব আলী। মানিব্যাগে টাকা নেই, একটা পরিত্যাক্ত রুমালের মতো মনে হয় মানিব্যাগটাকে। এবং রজব আলী বুঝতে পারে- বড় সাহেবের মতো মানুষদের সঙ্গে রজব আলীরা কোনদিন, কোনোকালে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারবে না।

মাস শেষ, রজব আলীর মানিব্যাগের টাকাও শেষ। অথচ বড় সাহেবের মানিব্যাগে মাসের প্রথম দিকে যতো টাকা ছিলো বা থাকে, এখনো সে রকমই আছে। কমে না। বরং বাড়ে। তাহাদের টাকা বাড়তেই থাকে। বাড়বে আমৃতকাল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রজব আলী।

দীর্ঘনিঃশ্বাস এবং পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নিয়ে নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে রজব আলী। প্রতিদিনের জীবনাচারের সঙ্গে রজব আলী বেশ মানিয়ে নিয়েছে। মানিব্যাগটা তার সঙ্গে থাকছে প্রতিদিনকার মতো- যেমন তার পকেটে থাকছে একটি রুমাল, একটি চিরুনি।

মাসের প্রথম দিকে মানিব্যাগটা ভরা থাকে, মাঝখানের দিকে কমতে কমতে টাকা অর্ধেকেরও কমে এসে পৌঁছে এবং এই কমার গতিটা বলবৎ থাকে গাণিতিক হারে।

মাসের শেষের দিকে রজব আলী মানিব্যাগ বহন করার আর কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। কারণ ব্যাগের তলায় পাঁচ-দশটা টাকা পড়ে থাকে বড় অযত্নে, বড় অবহেলায়। কখনো কখনো রজব আলীর মনে হয়- মানিব্যাগটা বোধহয় তাকেই উপহাস করছে। মাস খানেক পরে একদিন।

রজব আলী অফিস থেকে ফিরছে। মাস শেষের দিকে। বাসে প্রচুর ভিড়। বাসে ওঠা মানে জন্তুর খাঁচায় ওঠা। জীবন যে কতো অবাঞ্ছিত, বাসে উঠেই সেটা বুঝতে পারে রজব আলী।

বাস থেকে নেমেই হাত দেয় প্যান্টের পকেটে। পকেটটা খালি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, মানিব্যাগটা নেই ! এতো সাবধানে থাকার পরও মানিব্যাগটা নিয়ে গেলো?

রজব আলী কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মানিব্যাগটা পকেটমার নিয়ে গ্যাছে। রজব আলী মানিব্যাগটার জন্য ভাবছে না। ভাবছে মানিব্যাগের সর্বশেষ পুরোনো ময়লা দশটি টাকা...। ওই দশ টাকা থাকলে আরো দুই দিন বাস ভাড়া দিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে পারতাম।

;