নৌকাবিহার

  • তানিয়া চক্রবর্তী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

পৃথিবীতে স্থলের চেয়ে জল বেশি একথা একটি শিশুও জানে। সুতরাং সভ্যতার এই পর্বে এসে যদি ভাবি যে এই গোটা পৃথিবীকে আয়ত্ত করতে মনুষ্যজাতি শুধু স্থলে আধিপত্য বিস্তার করেছে সেটা বড় ভুল হবে। কারণ সেটা সম্ভব হতো না যদি জলের ওপর মানুষের ক্ষমতা কায়েম হতো। আদিম যুগে সাঁতার আর জলে ভাসা জিনিস দেখে ধারণা করে মানুষ ভেলায় করে ভেসে গেছে একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম নৌকা দেখা যায় নেদারল্যান্ডে; মনে করা হয় পাইন গাছের ফাঁপা দেহকাণ্ড থেকেই এর উৎপত্তি; সময়টা সম্ভবত ৮২০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ৭৬০০ খ্রিঃপূর্বের মধ্যে। যদিও এই নিয়ে বিতর্ক আছে, কেউ কেউ বলেন উত্তর ইউরোপে নাকি ৯২০০ খ্রিঃপূর্বেই নৌকার আগমন হয়েছিল। প্রত্নবিদরা এও বলেন সিন্ধু সভ্যতায় এবং অবশ্যই মেসোপটেমিয়াতে নৌকার ভীষণ ভূমিকা ছিল এবং সেখানে বিভিন্ন ধরনের নৌকার অংশ পাওয়া গেছে। ইজিপ্টে নৌকা বিশেষত পালতোলা নৌকার প্রচলন শুরু হয় ৩০০০ খ্রিঃপূর্বে। তারা কাঠের তৈরি নৌকা পরে বানালেও আগে নৌকা বানানোয় প্যাপিরাস ব্যবহার করত।

বিজ্ঞাপন

১৮৮৬ সালে ইঞ্জিন ব্যবহার করে পেট্রোলের মাধ্যমে যন্ত্রচালিত নৌকার আগমন হয়। এর পূর্বে পালতোলা নৌকাই ছিল উন্নত নৌকাদের অন্যতম। যখন মানুষ কম জানত, কম বুঝত সেই সময়ে জলে কী ভাসে সেটা মনে রেখেই নৌকা বানানোকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। পরে যখন মোটর আবিষ্কার হলো, মানুষ “প্লবতার” সূত্রকে আয়ত্তে আনল তখন তারা বুঝে গেল কাঠ বা জলে ভাসা উপাদান দিয়ে নৌকা বানানোই কেবলমাত্র ভেসে থাকার কারণ নয়।

তথ্যের যুক্তি বাদ দিয়ে কিছু কথা আছে যেমন নৌকা ব্যাপারটা কী, তার আদত রূপ কারা বুঝেছিল সেটা জানতে গেলে আরো এক তথ্য মেলে। মানুষের পূর্বতন এক প্রজাতি (হোমো ইরেকটাস) নাকি প্রায় ৮ লক্ষ বছর আগেই নৌকার ব্যবহার করেছে।

বিজ্ঞাপন

সাহিত্যে, ইতিহাসে বারবার যুদ্ধে, ব্যবসায় নৌকার কথা আমরা পেয়েছি। মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক বিভিন্ন রচনাবলিতে নৌকা এক ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বজরা, ভাউলিয়া, পিনিশ এধরনের নৌকার নাম পাওয়া যায় প্রাচীন ভ্রমণসাহিত্যেও। আসলে নৌকা তার গঠনে, সম্বোধনে এত সহজ, সরল যে তাকে আমরা জাহাজের থেকে বেশিই ভালোবাসি বোধহয়। খোল, পাটা, ছাউনি, পাল , মাস্তুল, লগি, গলুই, বৈঠা কত বাহারি সুখী নামে তার ওই নির্মেদ দেহের অঙ্গ গঠিত তা ভাবতেও ভালো লাগে।

নৌকার প্রকারভেদ জানলে বিস্ময়ে কপালে হাত দিতে হয় যে জলে মানুষ এত বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ছিল। ডিঙি নৌকা, গো-নাও, ঘুনী, খেয়া,  পানসি, শালতি, কিস্তি, ভড়, কোষা, বাচারি, সাম্পান, রপ্তানি, গয়না গোলন্দাজ নৌকা, মকরমুখী নৌকা, সপ্তডিঙ্গা, মান্দাস, বাইচ। নৌকার ছাউনি ও শরীর নির্মাণের ওপর নির্ভর করে নৌকার বিশেষ ভাগ আছে। বাংলাদেশে ডিঙ্গি ও “সাম্পান” নৌকা খুবই পরিচিত। সেইসময়ে অবিভক্ত বাংলায় ধনী মানুষের নৌকাবিহারে বজরার তুলনা ছিল না! নৌকাবাইচের মতো খেলা ছিল খুব জনপ্রিয়। একসময়ে “পদি” নামে বাংলাদেশে এক নৌকা ছিল  যা চালাতে প্রায় ১৭ থেকে ১৮ জন মাঝির প্রয়োজন হতো। বর্তমানে কেরালায় অনুরূপ নৌকার ব্যবহার অবশ্য দেখা যায়।

বহন ক্ষমতা ও কাঠামোর ভিত্তিতে অজস্র ভাগ আছে নৌকার, তবু যেগুলো প্রচলিত তার মধ্যে কিছু বিশেষ পরিচিত যেমন, ডিঙ্গি  আকারে ছোট, কম মানুষ মূলত জিনিস বহন করার নৌকা। সাম্পান যেন একটু দুষ্টু নৌকা, বহু সংস্কৃতিগত ভাষ্যে এর উল্লেখ থাকে, পাল থাকা বা না থাকা হলেও ঢেউয়ে ভেসে থাকতে ইনি ওস্তাদ। পানসি নৌকাবিহারে পাল তুলে চলে এই নৌকা, হালকা হয়ে ভেসে থেকে বহুদূর যায় এছাড়াও যে কত শত নৌকা আছে তার আভাস বন্ধুরা আগে পেয়েছেন। এখন অবশ্য শ্যালো নৌকার বাড়াবাড়ি। কিন্তু গ্রামবাংলায় এখনো নৌকা মাঝির কাছে নিজের জীবন তুলে দিয়ে জোয়ারে, ঝড়ে ক্রমশ জীবন খেলে বেঁচে থাকে, ভেসে বেড়ায়।

সাহিত্যে, বাণিজ্যে, যুদ্ধে, প্রেমে, কবিতায়, বন্যায়, রূপকথায় কোথায় নৌকা নেই। সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত ঐতিহাসিক সমগ্রের পটভূমি জুড়ে নৌ-ইতিহাস। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পদ্মানদীর মাঝি”র সেই মাঝিজীবন কি আমরা কোথাও আড়াল করতে পারব। জলদস্যুদের সেই আস্ফালন, সেইসব কি নৌকা ছাড়া সম্ভব? যখন যাতায়াতের মানেই লোকে বোঝেনি সেই সময় থেকে যেভাবে তারা বিদেশে সংযোগ করে সভ্যতাকে ফুলিয়ে তুলেছে সেটা কি নৌকা ছাড়া সম্ভব ছিল? ভারতে প্রথম বরফও এলো সেই জলপথে। এ তো গেল কথার কথা কিন্তু এখন যে এই জাহাজ জাহাজ, নেভি নেভি করে আমরা কেতাদুরস্থ হয়ে আছি তার ভিত্তি তো সেই নির্মল সরল নৌকা, যে মুক্ত আদরে ভেসে বেড়ায় পৃথিবীর জল তত্ত্বকে তুড়ি মেরে।