সে এক অচিন পাথর
কলিং বেজ বাজছে। এই অবেলায় কে আসতে পারে সেটা ভাবতে থাকে মধুরিমা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সে। কলিং বেল বেজেই চলছে। দরজা খুলতেই বাসার গেটকিপার মিজান অস্থিরভাবে জানালো একটা পার্সেল আছে তার নামে। ডেলিভারি ম্যান নিয়ে এসেছে। কিন্তু মধুরিমা কোনকিছুর অর্ডার করেনি। তাহলে পার্সেল কিসের? মিজানের অতো কিছু বোঝার সময় নেই। সে পার্সেলটি মধুরিমার হাতে দিয়েই নীচে নেমে গেল। যাবার সময় শুধু জানিয়ে গেল পার্সেলের পেমেন্ট নাকি আগেই করা আছে।
কে পার্সেল পাঠালো? তাহলে কি আকাশ তাকে কোন সারপ্রাইজ দেবার জন্য কোন অর্ডার করেছে? কিন্তু আজ তো কোন বিশেষ দিনও না। আজ বিবাহ বার্ষিকী না, মধুরিমার জন্মদিন না, এমনকি তাদের প্রথম দেখার দিনও না। একটা পাগল ছেলে আকাশ। মাঝে মাঝেই সে এমন কাণ্ড করে। মধুরিমার জন্মদিনে অফিস থেকে ফুল পাঠিয়ে একবার অবাক করে দিয়েছিল আকাশ। এমনিতে গম্ভীর হয়ে থাকে, তবে মধুরিমার প্রতি তার অগাধ ভালবাসা। বছর তিনেক হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। প্রেমের বিয়ে। মান-অভিমানে ভরা ছোট্ট সুন্দর তাদের সংসার। আকাশের পাগলামির কথা ভাবতে ভাবতে পার্সেলটি খুলে ফেলল মধুরিমা। পার্সেলের ভেতর খুব সুন্দর র্যাপিং পেপারে মোড়ানো ছোট্ট একটা বাক্স। এ নিশ্চয় আকাশেরই কাজ। চমৎকার র্যাপিং পেপার আকাশের খুব পছন্দ। আস্তে আস্তে র্যাপিং পেপারটি খুলে ফেলল মধুরিমা। খুলতেই বাক্সের ভেতর থেকে বের হয়ে আসলো অদ্ভুত এক পাথর। খুবই হালকা অথচ মোহময় আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকলো পাথরটি থেকে।
পাথরটি হাতে নিয়েই কেমন যেন মায়া লাগলো মধুরিমার। ছোট্ট তুলতুলে শিশু দেখলে যেমন মায়া লাগে, ঠিক তেমন। পাথরটি থেকে নানা রং এর বিচ্ছুরণ হতে থাকলো। খুবই মোলায়েম আলোর বিচ্ছুরণ। তারপরও চারপাশ কেমন যেন সুন্দর হয়ে গেল। দিনভর পাথরটি নিয়েই ব্যস্ত থাকলো মধুরিমা। সন্ধ্যেবেলায় আকাশ অফিস থেকে ফিরলো ক্লান্ত হয়ে। দরজা খুলেই মধুরিমা মিটিমিটি হাসতে লাগলো। অফিসের পোশাক পাল্টে স্নান শেষে আকাশ বসার ঘরে আসলো। দু’কাপ চা নিয়ে মধুরিমা আকাশের পাশে বসলো। আকাশ মধুরিমার দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলো। মধুকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে। অপরূপ স্নিগ্ধতায় ভরা। আকাশের মুগ্ধচোখের দিকে তাকিয়ে মধুরিমা জিজ্ঞেস করলো, ‘পাথরটি কোথায় পেয়েছ?’ মধুর প্রশ্ন শুনে আকাশ বেশ অবাক হয়েই পাল্টা প্রশ্ন করলো ‘পাথর? কিসের পাথর?’ তখন মধুরিমা ছদ্ম অভিমানের সুরে বললো, ‘থাক আর নাটক করতে হবেনা, পাথরটি যে তুমিই পার্সেল করেছ, সে কি আমি জানিনা?’ এইবার বেশ একটু বিরক্তির স্বরেই আকাশ জানতে চাইলো কি বিষয়, কিসের পাথর। মধুরিমা দুপুরে পার্সেলের ঘটনা খুলে বললো। কনফার্ম না হয়ে কেন পার্সেলটি গ্রহণ করলো সেই কারণে মধুকে হালকা একটু বকাও দিল সে। কোন বিপদও তো হতে পারতো, সেটা কেন মধুর মাথায় আসলো না। যাই হোক, কথা শেষে পাথরটি দেখতে চাইলো আকাশ। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো কোথাও কোন ভুল পার্সেল ডেলিভারি হয়ে গেল কিনা। মধুরিমা খুব উৎসাহ নিয়েই পাথরটি তার বেডরুম থেকে আনতে গেল।
পাথরটি দেখতে আসলেই খুবই অদ্ভুত সুন্দর। মোহময় তার আলো। হাতে করে মধু যখন নিয়ে আসছিল, তখন মধুর মুখেও সেই আলোর ছটা লেগেছিল। অপরূপ দেখাচ্ছিল মধুরিমা কে। নিজের প্রেমময় আর শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য সৃষ্টিকর্তাকে আবারও কৃতজ্ঞতা জানালো। পাথরটি হাতে নিল আকাশ। হাতে নিতেই শিরদাঁড়ায় একটা অস্বস্তি অনুভব করলো। মনে হলো কেউ যেন বরফ-ঠান্ডা হাত দিয়ে স্পর্শ করলো। পাথরটির দিকে তাকাতেই আকাশের মুখ কালো হয়ে গেল। এক ঝটকায় পাথরটিকে দূরে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল আকাশ। খুবই ভীত সন্ত্রস্ত দেখালো তাকে। আকাশের এই আকস্মিক ব্যবহারে মধুরিমা ভীষণ অবাক হলো। কি এমন হলো যে আকাশের মুখ এমন কালো, এত ভয়ক্রান্ত হয়ে গেল। পাথরটিকেই কেন বা সে ওভাবে ছুঁড়ে মারলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আকাশ রীতিমতো মধুকে তিরস্কার করতে শুরু করলো কেন এই পাথরটি সে নিলো তা নিয়ে। কে দিয়েছে, কেন দিয়েছে, কোন বাজে উদ্দেশ্য আছে কিনা এই নিয়ে রাগারাগি করা শুরু করলো। মধুরিমার খুবই অভিমান হলো তাতে। সামান্য এক পাথরই তো। ভুলও যদি হয়ে থাকে, তাহলেই বা কি এমন পাপ করে ফেলেছে সে। রাতে কিছুই খেল না আকাশ। কোন কথাও বললো না তেমন। সামান্য এক পাথরের জন্য এত অশান্তি ভাবতে ভাবতে মন খারাপ করে ঘুমাতে গেল মধুরিমা। সকালে উঠেই পাথরটি সে কোথাও ফেলে দিয়ে আসবে বলে মনস্থির করলো।
আকাশ প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। এত ভয় সে কোনদিনই পায়নি। কিন্তু পাথরটি হাতে নিয়েই ছয় বছর আগের এক স্মৃতি, এক পাপের কথা মনে হলো তার। হ্যাঁ পাপই। ভীষণ বড় পাপ। কারণ পাথরের ভিতরে সে স্পষ্ট এক কিশোরীর মুখ দেখতে পেয়েছে। হাসিখুশি মায়াময় এক কিশোরীর মুখ। মেয়েটির নাম অন্তরা। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় হাত খরচের জন্য আকাশ কয়েকটি টিউশনি করতো। অন্তরা ছিল তার তেমনই এক ছাত্রী। খুবই চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। কথায় কথায় হেসে উঠতো। অনেক বকবক করতো অন্তরা। একদিন পড়ানোর সময় হঠাৎ করে আকাশ মেয়েটির বুকে হাত রাখে। অন্তরা একটু ঘাবড়ে যায়, শক্ত হয়ে যায়। মাথা নিচু করে থাকে। যাবার সময় আকাশ বার বার অন্তরা যেন কাউকে কিছু না বলে সেটা অনুরোধ করে। তারপর বেশ কয়েকদিন সে অন্তরাকে পড়াতে যায়নি। একদিন অন্তরার মায়ের ফোন পেয়ে সে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। বুঝতে পারে, অন্তরা কাউকে কিছু বলেনি। সে আবার অন্তরাকে পড়ানো শুরু করে। কিন্তু অন্তরা ঠিক আগের মতো নেই। তার চেহারায় একটা ভয় দেখতে পায় আকাশ। এই ভয়টাকে সে বেশ এনজয় করা শুরু করে। মাঝে মাঝেই সে অন্তরার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করতে থাকে। এমনকি একদিন বাসা খালি পেয়ে সে অন্তরাকে ......... নাহ আর কিছু মনে করতে চায়না আকাশ। অন্তরা একটু বেশিই ভীতু ছিল, তা না হলে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসার ছাদ থেকে লাফ দেয়। বোকা মেয়ে একটা। কেন যে এসব আবার মনে পড়লো আকাশের। এই পাথরটাই সকল নষ্টের মূল। কোথা থেকে এই পাথর নিয়ে আসলো মধুরিমা কে জানে। এখন মধুর ওপরও রাগ হচ্ছে। পাথরটার দিকে তাকাতেই বা কেন তার ছয় বছর আগের কথা মনে পরে গেল। এক্ষুণি পাথরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেই তবে আকাশের শান্তি। যেই ভাবা সেই কাজ। মধুরিমা সকাল সকাল ঘুমিয়ে গেছে দেখে পাথরটি হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে আকাশ ছাদে গেল। সকালে উঠে মধু পাথরটি খুঁজলে সেও মধুর সাথে পাথরটি খোঁজার ভান করলেই হবে। এখন আপদ বিদায় হোক আগে। ছাদে উঠেই আকাশ রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে পাথরটির দিকে শেষবারের মতো তাকালো।
আবারও সেই মুখ। আবারও সেই হাসি। হাসি মিলিয়ে এখন আবার ভয়ার্ত চেহারা। তীব্র ভয়ে আকাশ পাথরটি ছুঁড়ে দিতে চাইল। ঠিক সেই মুহূর্তে পাথরটি থেকে একটি নরম কোমল হাত বের হয়ে এলো। সেই হাতটি শক্ত করে ধরে থাকলো আকাশের হাত। তীব্র প্রচেষ্টা স্বত্ত্বে আকাশের সেই হাতের ডাক উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ভোরবেলা রাস্তায় হাঁটতে বের হওয়া মানুষজন আকাশের মৃতদেহ পরে থাকতে দেখে বাসার দেয়ালের পাশে। কিন্তু পাথরটিকে কোথাও দেখা গেলনা। যাবেই বা কি করে। ভোরবেলা রিকশা নিয়ে বের হওয়া আমির আলী গলির মোড়ে একটা সুন্দর পাথর দেখে সেটা মুছে নিয়ে সে তার লুঙ্গির ভাঁজে গুঁজে রাখে। বাসায় গিয়ে ময়নার মাকে উপহার হিসেবে দিবে। কয়দিন ধরেই ময়নার মা’কে সে বেশ চিন্তিত দেখছে। পাথরটা পেলে হয়তো তার মন ভালো হবে।