তুলসীদাস: হিন্দি ভাষার মহাকবি
প্রতিটি ভাষারই এক-দুই জন বিশিষ্ট বা প্রধান কবি থাকেন, যাদেরকে মহাকবি বলেও সম্বোধন করা হয়। হিন্দি ভাষায় তেমনি একজন তুলসীদাস, যাকে গোস্বামী তুলসীদাস নামেও ডাকা হয়। ১৫৩২ সালে জন্ম নিয়ে ১৬২৩ সালের ২৩ অক্টোবর পরলোকে গমন করেন তিনি।
তুলসীদাসের নাম জানলেও তার কোনো লেখা পড়ার সুযোগ হয় নি। একবার সাহিত্যিক-সাংবাদিক রমাপদ চৌধুরীর এক বইয়ে তুলসীদাসের একটি উদ্ধৃতি পড়ে চমকিত হয়েছিলাম। হিন্দিতে কথাগুলো ছিল: 'পহেলা প্রহর ম্যা সকলি জাগে/ দোসরা প্রহর ম্যা ভোগী/ তেসরা প্রহর ম্যা তস্কর জাগে/ চৌথা প্রহর ম্যা যোগী।'
আমরা প্রায়-সবাই জানি, প্রতিদিনের ২৪ ঘণ্টা আটটি 'প্রহর'-এ বিভক্ত। তিন ঘণ্টা করে একটি প্রহর। তিন আটে হয় অষ্টপ্রহর বা একদিন। অষ্টপ্রহর শব্দটিই চলতিতে আটপৌরে। আটপৌরে শাড়ি বা পোষাক মানে, সারা দিনের গতানুগতিক শাড়ি-পোষাক, আনুষ্ঠানিক কিছু নয়।
রাতের চারটি প্রহরে কেমন কাণ্ড ঘটে, কবিতার ভাষায় প্রাচীন কবি তুলসীদাস সেটাই বলেছেন এই ভাবে যে, প্রথম প্রহরে সবাই জাগে। দ্বিতীয় প্রহরে জেগে থাকে ভোগপ্রবণ মানুষ। তৃতীয় প্রহরের নিঝুম অন্ধকারে জাগে চোর-ডাকাত-তস্কর আর চতুর্থ বা শেষ প্রহরে ভোরের আগে আগে জেগে ওঠে যোগী বা সাধক।
তুলসীদাসের কথাগুলোর সারবত্তা অসামান্য এবং গুরুত্ব অপরিসীম। যদিও আজকাল তুলসীদাসের মানদণ্ডে যথেষ্ট হেরফের হয়েছে। তস্করকে আর তৃতীয় প্রহরে জাগতে হয় না। দিনে-দুপুরেই বীরদর্পে অপকর্ম সাধন করতে পারে। আর চতুর্থ প্রহরে হাল আমলে শুধু তপস্বীগণ জাগেন না, অনলাইনের উদভ্রান্তরাও নির্ঘুম জেগে থাকেন।
এহেন তুলসীদাস ছিলেন একজন হিন্দু-সন্তকবি, ধর্মসংস্কারক ও দার্শনিক। তিনি রামানন্দের গুরুপরম্পরায় রামায়নী সম্প্রদায়-ভুক্ত ছিলেন। তুলসীদাস তার রাম-ভক্তির জন্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। তিনি একাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তবে তিনি 'রামচরিতমানস' মহাকাব্যের জন্য সর্বাধিক পরিচিত ও ব্যাপক জনপ্রিয়। এই গ্রন্থটি হলো সংস্কৃত রামায়নের হিন্দি অনুবাদ। তার জীবদ্দশায় তুলসীদাসকে মূল রামায়ণ মহাকাব্যের রচয়িতা 'বাল্মীকি'র অবতার মনে করা হত। রামভক্ত হনুমানের জনপ্রিয় স্তোত্র 'হনুমান চালিশা'ও তারই রচনা বলে মনে করা হয়।
তুলসীদাস তার জীবনের অধিকাংশ সময়টাই হিন্দু তীর্থনগরী বারাণসী শহরে অতিবাহিত করেন। বারাণসীতে গঙ্গা নদীর তীরে প্রসিদ্ধ 'তুলসীঘাট' তারই নামাঙ্কিত। বারাণসীতে হনুমান মন্দিরও তারই প্রতিষ্ঠিত।
কথিত আছে, যেখানে এই মন্দিরটি তুলসীদাস প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানেই তিনি হনুমানের দর্শন লাভ করেছিলেন। 'রামলীলা' নামে রামায়ণ-ভিত্তিক লোকনাট্যের প্রচলনও তুলসীদাসই করেছিলেন। তার অনেক শ্লোক, কাহাবাত বা প্রবচন অতীব জনপ্রিয় এবং অদ্যাবধি হিন্দু ভাষী অঞ্চলে বহুলভাবে প্রচলিত।
তুলসীদাসকে হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মনে করা হয়। তুলসীদাস ও তার সাহিত্যকর্মের প্রভাব ভারতের শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও সমাজে সুদূরপ্রসারী। আজও এই প্রভাব দৃষ্ট হয় উত্তর ভারতের স্থানীয় ভাষা, রামলীলা নাটক, জনপ্রিয় সংগীত ও টেলিভিশন ধারাবাহিকগুলিতে।