হাসনাত ভাই

  • ড. মহীবুল আজিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল হাসনাত

আবুল হাসনাত

অল্প কিছুদিনের মধ্যে একে-একে দেশের বহু গুণিজন চলে গেলেন। সেই যাত্রায় এবারে সামিল হলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পাদক আবুল হাসনাত। সত্যি কথা বলতে কি, তাঁর চলে যাওয়ার সংবাদটি শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। নিরব সাধকের মত কর্মের চাঞ্চল্য দিয়ে সময়ের বিরাট গহ্বর পূরণ করবার এক অসাধারণ কারিগর ছিলেন তিনি।

আবুল হাসনাত নামটির সঙ্গে কখন প্রথম পরিচয় সেটা খানিক গবেষণা করেই বলতে হয়। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। এক গ্রীষ্মের ছুটিতে ঢাকা আজিমপুর নানাবাড়ি বেড়াতে গেলে মেজো মামা’র (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. মাহমুদুর রহমান) সংগ্রহে বেশকিছু পত্রিকা দেখতে পেলাম। এখনও মনে আছে কয়েকটির নাম- সমকাল, বিপ্রতীক, ছোটগল্প, সাম্প্রতিক, টিপসহি এবং আবুল হাসনাত সম্পাদিত গণসাহিত্য পত্রিকাটি। মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবয়ব, যেমন বিষয়ের ঋদ্ধতায়, তেমনি মুদ্রণের পারিপাট্যে।

বিজ্ঞাপন

প্রথমটায় ভেবেছিলাম বিখ্যাত ‘যৌনবিজ্ঞান’ রচয়িতা আবুল হাসনাত না তো। মামা বললেন, না ইনি, দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক। আর ভুলি নি। প্রায় সমিল নামের আরেকজনকে পাই, কথাশিল্পী আবুল হাসানাত। মামা’র কথায় উৎসাহিত বোধ করেই দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী পড়তে শুরু করি এবং সেই মুগ্ধতার রেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়।

যে-কোনো বিচারে আবুল হাসনাত সম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকী ছিল দেশের সেরা সাহিত্যের পাতা। আর, সম্পাদনার কথা বললে, সেখানেও তিনি অগ্রগণ্য। সন্ধানী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং কবিতার গ্রন্থসংগ্রহ তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের অনেক সংগ্রহ বেরিয়েছে পরে কিন্তু আবুল হাসনাত ছিলেন এক্ষেত্রে নকিব।

বিজ্ঞাপন

সংবাদ-এ আমার লেখা প্রথম বেরোয় যখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী। হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। কিছুকাল পরে বাংলা একাডেমি বইমেলায় পরিচয়। কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। তখনই জানলাম তিনি কবি মাহমুদ আল জামান-ও। সৃজনশীল লেখালেখি করেন এই নামেই। আর সম্পাদনা ও অন্যান্য কাজের জন্যে আবুল হাসনাত। জেনে বেশ পুলকিত বোধ করি।

প্রথম দেখায় তাঁর রাশভারি ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটা ঝাপসা ভাব আমার মনের মধ্যে গড়ে ওঠে। মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক অতিরিক্ত গম্ভীর। পরের বার দেখা হলে হয়তো চিনবেনই না।

আমার ধারণা ভুল ছিল। যাঁকে মনে রাখা দরকার তাঁকে তিনি ঠিকই মনে রাখতেন। ২০০৩ সালে কালি ও কলম পত্রিকার যাত্রা শুরু, এটির সম্পাদক আবুল হাসনাত এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আমাদের আনিস স্যার, ড. আনিসুজ্জামান। প্রথম সংখ্যাতেই লেখা দিয়েছিলাম, বিষয় ছিল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ। আনিস স্যার এবং হাসনাত ভাই দু’জনেই ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন এবং আমাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন (না, দিলেও চলতো, আনিস স্যারের আমি ছাত্র, আর হাসনাত ভাই লেখা চাওয়া মানে নির্দেশই।) এটা বললাম এজন্যে, তিনি যখন লেখা চেয়ে ফোন করতেন তখন কোনো অযুহাতই চলতো না।

লেখা চাইতেনই এমনভাবে যেন আমি তাঁর সূচিপত্রে অ-বিকল্প। লেখককে কীভাবে সম্মান করতে হয় সেটা তাঁকে দেখে শেখা যায়। ২০০৪-এ কালি ও কলম পত্রিকার প্রকাশনা উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আনিস স্যার এবং হাসনাত ভাই দু’জনেই দায়িত্ব দেন আমাকে এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে আমরা অনুষ্ঠানটি করি। অনুষ্ঠান সম্পর্কিত পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনগুলো ছিল অনুপ্রেরণামূলক। ঢাকায় ফিরে ফোনে ধন্যবাদ জানালেন আমার শ্রদ্ধাভাজন দু’জনই।

আমার তৃতীয় উপন্যাস ‘বর্ণসন্তান’ সংক্রান্ত একটি স্মৃতিকথন এ-প্রসঙ্গে আবশ্যিক হয়ে পড়ে। একটি সংখ্যার জন্যে লেখা চেয়ে ফোন করেছিলেন তিনি। কথাপ্রসঙ্গে বললাম, আমার তৃতীয় উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি। শুনেই বললেন, পাঠিয়ে দিন, আমরা ‘বেঙ্গল’ থেকে ছাপবো। দিলাম পাঠিয়ে। পাঠাবার পর খানিকটা দ্বিধা-সংকোচ আমাকে পেয়ে বসে। উপন্যাসটি ১৯৯৬/৯৭ সালের ইংল্যান্ডের প্রেক্ষাপটে লেখা। এতে বেশ খানিকটা জায়গার বর্ণনা বিচিছন্নভাবে পড়লে মনে হবে পর্নোগ্রাফি লেখা হয়েছে। কিন্তু সেই জায়গাটাকে আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে অতি প্রয়োজনীয় অংশ- বাদ দেওয়া চলবে না কোনোভাবেই। মনে মনে ভাবি, দেখা যাক হাসনাত ভাই কি বলেন।

তারপর একদিন ফোন করলাম, বললেন, উপন্যাসটা তো প্রেসে, ছাপার কাজও প্রায় শেষ, বেরিয়ে যাবে দিনকয়েকের মধ্যেই। শুনেই আমি থ। বলেন কী হাসনাত ভাই। তাহলে নিশ্চয়ই কেটেছেটে বাদ দিয়ে ছাপছেন বই! উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছিলাম তাঁকেই। অতি নান্দনিক প্রচ্ছদটি করেছিলেন শিবু কুমার শীল। কপি হাতে এলে দেখলাম, হ্যাঁ, বাদ সেটুকুই দিয়েছেন যেটুকু তাঁর সম্মানে উৎসর্গপত্রে লেখা হয়েছিল। নিজের সম্পর্কে সুভাষণেও তাঁর আপত্তি ছিল। আমার পাণ্ডুলিপি থেকে একটি শব্দও তিনি বাদ দেন নি।

বেঙ্গল প্রকাশনী বাংলাদেশের পুস্তক-প্রকাশনার জগতে অল্পদিনের মধ্যেই দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি লাভ করেছে। শুনেছি, গ্রন্থ প্রকাশনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অসম্ভব ধরনের মনোযোগী পরীক্ষক এবং নিরীক্ষক। একটি গ্রন্থকে সামগ্রিকভাবে উপস্থাপন করবার জন্যে যা-যা দরকার সবই তার প্রযত্নে হতো সুচারুরূপে।

উপন্যাস প্রকাশের কিছুকাল পরে আবার তাঁর সঙ্গে কথা হয় ফোনে। বললাম, ইতালো ক্যালভিনো’র গল্প অনুবাদ করেছি। বললেন, ক’টা গল্প? বললাম, ষোলোটা। এবারেও বললেন, পাঠিয়ে দিন আমার ই-মেইলে। দিলাম পাঠিয়ে। কিছুকাল পরে ফোন করি খবর নেওয়ার জন্যে। জানতে পেলাম, তিনি দেশে নেই, আমেরিকা গেছেন তাঁর একমাত্র কন্যাকে দেখতে। ফিরে আসবার পর আবার যোগাযোগ হলো। হাসনাত ভাই বললেন, আপনার ক্যালভিনো প্রেসে। এটির প্রচ্ছদ এবং অভ্যন্তরীণ অলংকরণের দায়িত্বে রয়েছে নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। নি্র্ঝরের সঙ্গেও কথা হয় ফোনে।

বই বেরোলে দেখলাম, এ এক অসাধারণ আয়োজন হাসনাত ভাইয়ের বদৌলতে এবং শিল্পীর অপূর্ব্ নান্দনিক অবদানে। একটি গ্রন্থ কতটা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা যায় আমার কাছে ইতালো ক্যালভিনোর বইটি তারই এক অনন্য নজীর। বলতে দ্বিধা নেই, আমার অনুবাদে যদি কোনো অপূর্ণতা থেকেও থাকে তা উধাও হয়ে গেছে এমন ঐশ্বর্য্ময় আবেদনের কারণে।

আমাদের সকলের প্রিয় ব্যক্তিত্ব আনিস স্যারের প্রয়াণে আমরা সবাই শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আনিস স্যার শিক্ষক ছিলেন আবুল হাসনাতেরও। কালি ও কলম আনিসুজ্জামান সংখ্যার জন্যে লেখা চেয়ে ফোন করলেন হাসনাত ভাই। শুধু তা-ই নয়, আনিস স্যারের ওপর তাঁর লেখাটি আমাকে পাঠালেন যদি কোন অসঙ্গতি চোখে পড়ে। বলাবাহুল্য, কোনো অসঙ্গতি ছিল না সে-রচনায়। লেখাটি আমাকে না-দেখালেও তাঁর চলতো কিন্তু এটি তাঁর মনের উদারতারই পরিচয়।

মাত্র কিছুদিন আগে শেষবার তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হলো। বললাম, একটু সাবধানে থাকবেন, যতটা সম্ভব দূরত্ব মেনে চলবেন। উত্তরে তাঁর স্বভাবসুলভ মিতকথনের ভঙ্গিতে বললেন, চেষ্টা করি। বলছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ওপর একটি প্রবন্ধ দিতে হবে কালি ও কলম বিদ্যাসাগর সংখ্যার জন্যে।

বিষয়টা বেশ মজারই। তাঁর যোগাযোগের দিনকয়েক আগেই আমি বিদ্যাসাগরের ওপর একটি প্রবন্ধ লিখে শেষ করেছি। পাঠিয়ে দিলাম তাঁকে সেই লেখা। তারপর আর কথা হয় নি। আজ রোববার (১ নভেম্বর) জানলাম, হাসনাত ভাই পরপারের যাত্রী। চোখের সামনে চকিতে ভেসে উঠতে থাকে চলচ্চিত্রের মতন- সেই আজিমপুরে গণসাহিত্য পত্রিকাটি হাতে তুলে নেওয়া থেকে এই সেদিনের বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত সংযোগের ঘটনা পর্যন্ত, একটার পর একটা- সবই হয় লেখা সংক্রান্ত নয় গ্রন্থ সংক্রান্ত।

আরেকটি ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করি। সম্ভবত ২০১৬ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ আমন্ত্রিত ড. শহীদুল্লাহ্ স্মারক বক্তৃতা দেই আর সি মজুমদার মিলনায়তনে ‘সংকট মোকাবিলায় সাহিত্য' শিরোনামে। পর্বটির সভাপতি ছিলেন আনিস স্যার। অনুষ্ঠান শেষে স্যার বললেন, হাসনাত ফোন করেছিল, আজকের বক্তৃতাটি কালি ও কলম-এ ছাপতে দেওয়ার জন্যে চাইছে। আমি বললাম, নিশ্চয়ই। যেহেতু সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে রচিত, আমি তখনই তৎকালীন সভাপতি শ্রদ্ধেয় বেগম আকতার কামালের সম্মতি আদায় করে নেই আনিস স্যারকে সাক্ষী মেনে। আনিস স্যার বললেন, লেখাটা বেশ বড়। সম্পাদনার প্রয়োজন হলে হাসনাত তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। প্রবন্ধটি কালি ও কলম কলকাতা-সংস্করণে মুদ্রিত হয় এবং কোনো প্রকারের পরিবর্তন-পরিমার্জনা ব্যতিরেকেই। ছাপা হলে ঢাকা থেকে হাসনাত ভাই ফোন করে জানান প্রকাশনার কথা।

আটান্ন বছরের জীবনে যত মানুষের দেখা পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে আবুল হাসনাত নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমার আকাশ থেকে খসে পড়েছে একটি নক্ষত্র। মাহমুদ আল জামান নামে লেখা হাসনাত ভাইয়ের অনেক লেখা পড়েছি- বিশেষ করে কবিতা, শিশু-কিশোর সাহিত্য এবং প্রবন্ধ। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক একটি কবিতার কথা মনে পড়ে। ‘যখন ফিরছি’ শিরোনামের কবিতাটি থেকে ছোট-ছোট কয়েকটি পংক্তির উদ্ধৃতি – যখন ফিরছি/ সরে যায় সমস্ত ঘরবাড়ি, আনন্দের/ পূর্ণতার ছবি/ যখন ফিরছি/ যখন ফিরছি।

হাসনাত ভাই, জানি না, কোথায় ফিরে যাচ্ছেন আপনি, পেছনে পড়ে রইলাম আমরা- ঋণী।