দারাশিকোহ: যিনি হতে পারতেন মুঘল সম্রাট
ইতিহাস নিয়ে গভীর অধ্যয়ন ও ব্যাপক চর্চার ইচ্ছা ও আগ্রহ সকলের হবে, এমন আশা করা যায় না। মোটা মোটা বই, সন, তারিখ, কালপঞ্জি ধরে ধরে ইতিহাসের অলিন্দে প্রবেশ করার সুযোগ ও সময় সবার না হওয়ারই কথা। কিন্তু ইতিহাসের মূল-কাহিনীটির প্রতি প্রায়-সকল মানুষের আকর্ষণই দুর্নিবার। যে কারণে ঐতিহাসিক উপন্যাস, ইতিহাসভিত্তিক চলচ্চিত্র, উপাখ্যান, গল্প, নাটক মানুষকে চুম্বকের মতো টানে এবং এর আবেদন শেষ হয় না।
একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো ভারতবর্ষে কয়েক শত বছর শাসনকারী মুঘল সাম্রাজ্য। যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে বহু-বিচিত্র কাহিনী। ১৯৬০ সালে নির্মিত স্মরণকালে সফল ছবি ‘মুঘল-ই-আজম’ থেকে অতি-সম্প্রতি ‘যোধা-আকবর’-এর মতো চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে মুঘলদের নিয়ে ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। মুঘলদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক জীবনের সমান্তরালে প্রেম, প্রণয়, হিংসা, হত্যাকা-, শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, স্থাপত্য, রন্ধনকলা, উদ্যানচর্চার অসংখ্য কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে। প্রত্যেক মুঘল সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, যুবরাজ ও যুবরাজ্ঞীকে নিয়ে ঐতিহাসিক তথ্য ও গল্পের শেষ নেই।
দারাশিকোহ তেমনই এক উল্লেখযোগ্য মুঘল, যার সম্রাট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি তা হতে পারেন নি। বরং তিনি হয়েছেন মুঘল ইতিহাসে একজন ট্র্যাজিক হিরো। আবার রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়েও তিনিই দর্শনচর্চা ও মননশীলতায় বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন ইতিহাসর পাতায়। ভাগ্য ও রাজনীতির রণাঙ্গনে বিপর্যস্ত জীবনপ্রবাহের নিরিখে দারাশিকোহর উত্থান ও পতনের সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরাই এ রচনার উদ্দেশ্য। মূল কাহিনী ও ঘটনাক্রমের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ইতিহাসের জটিল ও বিক্ষুব্ধ অধ্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে। তথ্যসূত্র ও অন্যান্য রেফারেন্সের যান্ত্রিক উল্লেখের মাধ্যমে রচনাকে রাশভারি করা হয় নি। তবে শেষে সহায়ক গ্রন্থগুলোর তালিকা দেওয়া আছে।
১৫২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ১৮৫৭ সালে অস্তমিত তিন শতাব্দীরও অধিককাল ভারতবর্ষে শাসনকারী মুঘল সাম্রারাজ্যের ইতিহাসে মুহাম্মদ দারাশিকোহ (২০ মার্চ ১৬১৫-৩০ আগস্ট ১৬৫৯) এমনই এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি হতে পারতেন দিল্লির সম্রাট। কিন্তু ভাগ্য বিপর্যয়, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও সামরিক পরাজয় তাকে বিয়োগান্ত পরিণতিতে ঠেলে দেয়। তথাপি সম্রাট না হয়েও তিনি অন্যান্য সম্রাটদের মতোই আলোচিত। পঞ্চম মুঘল সম্রাট নাসিরউদ্দিন শাহজাহানের (৫ জানুয়ারি ১৫৯২-২২ জানুয়ারি ১৬৬৬) জ্যেষ্ঠপুত্র, চার পুত্রের মধ্যে নয়নে মণি এবং সিংহাসনের ঘোষিত সম্ভাব্য উত্তারাধিকারী ছিলেন তিনি। সম্রাট পিতা প্রিয় পুত্রকে রাজদরবারে পাশে পাশে রাখতেন সব সময়। অন্য পুত্রদের বিভিন্ন প্রদেশে ও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠালেও দারা ছিলেন রাজধানীতে পিতার নিত্যসঙ্গী। শিক্ষা-দীক্ষা, রুচি ও সংস্কৃতির দিক থেকেও তিনি ছিলেন উজ্জ্বলতম। সব কিছু অনুকূলে থাকার পরেও দারা মুঘল সিংহাসনে বসতে পারেন নি। ক্ষমতার জন্য প্রচ- ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে প্রাণ হারান তিনি। এবং পরিশেষে চিত্রিত হন মুঘল ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো রূপে।
মুঘল রাজধানীতে বসবাসকারী দারাশিকোহ সাধারণত রাজদরবারেই সময় কাটান বেশি। তিনি কবি, দার্শনিক ও ধর্মবেত্তাদের অধিক ঘনিষ্ট ছিলেন। দারাশিকোহ যখন কলম ও অধ্যয়নে ব্যস্ত, অন্য ভাইরা তখন সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে তরবারি চালনায় নিজেদের সুদক্ষ করছেন। অথচ দারাই ছিলেন সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্ধারিত মুঘল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। তার উপাধিযুক্ত নাম ছিল পাদশাজাদা বুজুর্গ মারতাবা, জালাল উল কবির, সুলতান মুহাম্মদ দারাশিকোহ, শাহ-ই-বুলন্দ ইকবাল। এতো পদ-পদবির পরেও কিন্তু সিংহাসন নয়, ফেরারি জীবন কাটে তার পালিয়ে পালিয়ে। মৃত্যুর পর তার মন্তক ব্যাতিত দেহ সমাহিত হয় দিল্লিতে দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের কবরগাহে আর মু-ু সমাহিত হয় আগ্রায় তাজমহল প্রাঙ্গণে, মাতা মমতাজ মহলের কবরের সন্নিকটে। সম্রাট শাহজাহান যে প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মৃতিতে বিশ্বের বিস্ময় ও ভালোবাসার প্রতীক তাজমহল নির্মাণ করেন, সেখানেই বেদনার চিহ্ন হয়ে তার প্রিয়তম জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহজাদা দারাশিকোহর দেহহীন মস্তকও সমাহিত। শেষ বয়সে অপর পুত্র ও পরবর্তী সম্রাট আওরঙ্গজেব (৩ নভেম্বর ১৬১৮-৩ মার্চ ১৭০৭) কর্তৃক বন্দি সম্রাট শাহজাহান অশ্রুসজল চোখে তাজের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন পুত্র দারার নির্মম পরিণতি।
সম্রাট না হওয়া সত্ত্বেও দারা দর্শনচর্চা, শিল্পপ্রেম ও নানামুখী নান্দনিক গুণের জন্য সমাদৃত। মুঘল সম্রাটদের তালিকায় তিনিই একমাত্র যুবরাজ, যাকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে সর্বাধিক। সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে দুর্বলতার কারণে ক্ষমতা হারানোর জন্য যেমন তিনি সমালোচিত, তেমনি শিল্প-সংস্কৃতি-দর্শন-চিত্রকলার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্বীকৃত। ঐতিহাসিকদের অনেকে দারার মৃত্যুর সাড়ে তিনশ বছর পরেও মনে করেন, তিনি মহামতি মুঘল সম্রাট আকবরের পর ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সমন্বয়ের প্রতীক। যদিও আকবর রাজনৈতিকভাবে সফল আর দারা ব্যর্থ।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রতি বছরই দারার জীবন ও কর্ম নিয়ে নতুন নতুন গবেষণায় উন্মোচিত হচ্ছে অনেক অজানা তথ্য, যার অধিকাংশই বাংলা ভাষায় অনুল্লেখিত। সর্বশেষ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দারার একটি সংক্ষিপ্ত ও সামগ্রিক জীবনেতিহাসের প্রচেষ্টা এই রচনা। যারা এ বিষয়ে অধিকতর গবেষণা করতে আগ্রহী, তারা রচনার শেষে সংযুক্ত সহাযক গ্রন্থ তালিকা থেকে সাহায্য পেতে পারেন।
শুষ্ক ও যান্ত্রিক ঐতিহাসিক বর্ণনার বদলে সরল উপস্থাপনায় মুঘল ইতিহাসের এই উল্লেখযোগ্য চরিত্রের নানা দিক উপস্থাপনের সময় প্রাসঙ্গিত ভাবে এসেছে তৎকালের অপরাপর চরিত্রের কথাও। যার মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং সম্রাট শাহজাহান, আওরঙ্গজেব এবং দারার অন্যান্য ভ্রাতৃ ও ভগ্নিগণ। আলোচিত হয়েছে সে আমলের আর্থ-সামজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিও।
‘যিনি হতে পারতেন সম্রাট কিন্তু হতে পারেন নি’, এমন একটি চরিত্রকে দোষে-গুণে দেখার সময় প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বহু প্রাসঙ্গিক বিষয়কেও পর্যালোচনা করতে হয়েছে। কেন তিনি সম্রাট হওয়ার সকল সম্ভাবনা ও সুযোগ পেয়েও সিংহাসনে বসতে পারেন নি এবং ভাগ্য বিপর্যয়ের শিকার হয়ে করুণ মৃত্যুর মাধ্যমে বিয়োগান্ত পরিণতির সম্মুখীন হন, তা অবশ্যই ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা। তদুপরি, সিংহাসনে না বসেও কেন তিনি আজ পর্যন্ত আলোচিত হচ্ছেন, এটিও বেশ চিত্তাকর্ষক একটি প্রশ্ন। ইতিহাস তাকে নানা ভাবে মূল্যায়ন করেছে। তার জীবন ও কর্মের বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও করা হয়েছে।
সব কিছু মিলিয়েই এক মুঘল ট্র্যাজিক হিরো তিান। শেকসপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ যেমন ‘প্রিন্স অব ডেনমার্ক’-এর ট্র্যাজেডি, তেমনি দারাশিকোহও মুঘল সাম্রাজ্যের একজন বিয়োগান্ত চরিত্র, যাকে বাদ দিয়ে তৎকালীন ইতিহাসের অনেকটুকু অংশ আলোচনা করাই অসম্ভব। ‘প্রিন্স অব ডেনমার্ক’ ছাড়া যেমন ‘হ্যামলেট’ হয় না, তেমনি দারা ছাড়া মুঘল ইতিহাস রচনা করাও সম্ভবপর হয় না। আবার দারার আলোচনা আওরঙ্গজেবের আলোচনা ছাড়া অসম্ভব এবং আওরঙ্গজেবের আলোচনাও দারাকে ছাড়া একেবারেই অসম্ভব। দারাশিকোহ এমনই এক ট্র্যাজিক হিরো হলেও ভারতবর্ষের ঐশ্বর্যশালী মুঘল ইতিহাসের তেমনই এক অপরিহার্য ও বর্ণময় চরিত্র।