'করোনাকালের কবিতা'র প্রথম সংকলনের নেপথ্যে
যেভাবে “করোনাকালের কবিতা” প্রকাশের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা খানিকটা খাপছাড়া মনে হতে পারে। কারণ গত এক বছর যাবত করোনার জুজু আসলেই বুঝিয়ে দিয়েছে, শুধু আতঙ্ক সৃষ্টিই এ অদৃশ্য দানবের মতলব নয়।
কয়েক লক্ষ মানুষকে এই রাহু ইতোমধ্যে পৃথিবীছাড়া করেছে। সারা বিশ্বে এর সংক্রমণে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র অবধি। ভেঙে গেছে পারিবারিক সম্পর্কের বিন্যাস, গ্রামে চলে যেতে হয়েছে বহু মানুষকে, রাজধানী ও শহর ছেড়ে। চাকরিচ্যুত হয়েছে বহুজন, তিলে তিলে ধুঁকতে শুরু করেছে অনেকে সঞ্চিত অর্থ তলানিতে ঠেকায়।
মধ্যবিত্তের, বিশেষত গড়পরতা মধ্যবিত্তের ভয়াবহ সংকটের চালচিত্র নানাভাবে বেরিয়ে আসছে। না যায় কারো কাছ হাত পাতা, না যায় কাউকে বলা, না যায় পেটে কিল মেরে পড়ে থাকা! এমনই দূরবস্থা তাদের। স্বজন-পরিজন সবারই আছে। কিন্তু দুর্বিপাকে সকলেই নিজেকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত থাকে।
এর মধ্যেও অনেকে নিজেকে আড়ালে রেখে, মহৎ ভাবনা ও অবস্থানে থেকে সাধ্যাতীত অনেক কিছুই করেছেন, করছেন মানবিক দায়বদ্ধতার টানে। তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। নিম্নবিত্তের মানুষ বিত্তবানের কাছে চেয়েচিন্তে কোনোমতে কিছু যোগাতে নির্দ্বিধায় হাত পাতে ছলছল চোখে, কাতর কণ্ঠে। ভবঘুরে, ছিন্নমূল মানুষ রাস্তার ফুটপাতে, ডাস্টবিনে কাক ও কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে খাবারের জন্য - শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ভয়াবহ রুদ্ধশ্বাস বাস্তবতা করোনাকালে চোখের সামনে দেখে ভিডিও করে রেখেছি।
এসব নিয়ে গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখা - সে তো পরের ব্যাপার! আগে তো বিভীষিকাময় কালের আগাপাশতলা বুঝতে হবে! নইলে সবটাই হবে বানোয়াট, কল্পনার রঙিন চোখে দেখা ফাঁপা বুলির সম্ভার। এমনতর বীক্ষণের পটভূমিতে বাংলাদেশ ও ভারতের একান্ন জন বাঙালি কবির কবিতা নিয়ে সাজানো হয়েছে “করোনাকালের কবিতা” শিরোনামভুক্ত করোনাবিষয়ক কবিতার সংকলনগ্রন্থ। এখনো খবর পাইনি যে অন্য ভাষায় এ ধরনের বই এখনো প্রকাশিত হয়েছে। ফলে একদিক থেকে এটিই করোনাবিষয়ক কবিতার প্রথম সংকলনগ্রন্থ।
এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্যই ছিল, করোনাকালীন চলমান জীবনবাস্তবতার নানা দিককে সংবেদনশীল কবিরা যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা মলাটবদ্ধ করা। কবিতার মেজাজ, ভঙ্গি ও প্রকরণে যে স্বকীয়তা ও প্রকৌশলগত বিন্যাস অতি জরুরি, এসব কবিতা সেই বিবেচনায় কতটা সাড়া ফেলবে, তা বলবেন পাঠক। ঝানু কবির পাশাপাশি নড়বড়ে হাতে কলম তুলে লিখেছেন, এমন নবাগত কবিকেও যে সাহস করে একই মলাটে আনা গেল, তা শুধু পাঠকের বিবেচনার ওপর ভরসার কারণেই।
অমর একুশে বইমেলা ২০২১ এর আজ পঞ্চম দিন। বইমেলার পাঠকের হাতে বইটি পৌঁছাক, সেই প্রত্যাশা আর সবার মতো আমারও রয়েছে। পাঠকের আগ্রহ ও মনোযোগ তাই কামনা করি। বইটি প্রকাশের ব্যাপারে সবার আগে কথা বলি এ সংকলনের সহ-সম্পাদক ও ভারতের ‘কথাকাব্য’ ছোট কাগজ সম্পাদক, কবি-কথাশিল্পী-গবেষক শ্রদ্ধেয় সপ্তদ্বীপা অধিকারীর সঙ্গে। এর আগে আমাদের যৌথ কাজের ফসল “পরানকথা সাময়িকী”-র চৌদ্দতম আয়োজন ‘দুই বাংলার তরুণ গল্পকার সংখ্যা ২০২০’ ও বাংলা সাহিত্যে করোনাবিষয়ক গল্পের প্রথম সংকলনগ্রন্থ “করোনাকালের গল্প” (২০২১) প্রকাশিত হয়ে যথেষ্ট সাড়া পায়। তিনি জানতেন, এ ধরনের বইয়ের সংকলন করোনাকালে প্রকাশ করা দুরুহ ব্যাপার। তবু তিনি আমাকে নিরুৎসাহিত করেননি। বরং নানাভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। ভারতের কবিদের কবিতাগুলোর বেশিরভাগই সপ্তদ্বীপা অধিকারী দিদির সৌজন্যে প্রাপ্ত। সেই কবিতাগুলো বাছাইয়ে তিনি পুরো সাহায্য ও সমর্থন যুগিয়েছেন। তাঁর প্রতি আমার ঋণ অপরিসীম। যাঁরা কবিতা দিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদেরও ধন্যবাদ। এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য: অনিরুদ্ধ আলি আক্তার, অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়, আনোয়ার কামাল, আনোয়ারা আজাদ, আসলাম হোসেন, আহমেদ নকীব, ইমন সালাউদ্দিন, কেদারনাথ দাস, চিত্ত মণ্ডল, জুনান নাশিত, তাশরিক-ই-হাবিব, দিলারা মেসবাহ, দীলতাজ রহমান, নাসরীন জাহান, নাহিদা আশরাফী, মহীবুল আজিজ, মাহফুজ পারভেজ, মুজিব ইরম, মুনিরা সুলতানা, মোশাররফ খোকন প্রমুখ।