'আমার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাজগুলোই উল্লেখযোগ্য'

  • তাশরিক-ই-হাবিব
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সাহিদা বেগমের সঙ্গে তাশরিক-ই-হাবিব

সাহিদা বেগমের সঙ্গে তাশরিক-ই-হাবিব

[সাহিদা বেগম, লেখক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ সরকার। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণার জন্য "বাংলা একাডেমি পুরস্কার-২০২০" অর্জনকারী। সাহিত্য সাময়িকী 'পরানকথা' সম্পাদক ড. তাশরিক-ই-হাবিব তার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, যার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বার্তা২৪.কম পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।]

প্রশ্ন: আপনি বীর  মুক্তিযোদ্ধা। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক - এই পরিচয় এবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জন করল আপনার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণার জন্য "বাংলা একাডেমি পুরস্কার-২০২০" প্রাপ্তির মাধ্যমে। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি ও গবেষণার পরিণতিতে এই স্বীকৃতি অর্জনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

বিজ্ঞাপন

উত্তর: আসলে যে কোনো স্বীকৃতি, যে কোনো স্রষ্টা বা যে কিছু সৃষ্টি করেন, তা স্বীকৃতি অর্জন করলে মানুষকে আন্দোলিত করে, আনন্দিত করে। ভালো লাগে। আমারও ভালো লেগেছে। তবে এই স্বীকৃতি শুধু আমি না, আমাকে যারা চেনেন, জানেন, তারাও বলেছেন যে আরো অনেক আগেই আমার পাওয়া উচিত ছিল। কারণ যখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তেমন লেখালেখি হচ্ছিল না, তখন আমার প্রথম লেখা, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই ‘যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস’ আমি ১৯৮৩ সালে লিখেছি। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য পত্রিকা ‘সচিত্র সন্ধানী’তে এটি এক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরে শিশু একডেমির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রথম বই আমার লেখা "মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো" ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। বইটি তিনটি সংস্করণে ত্রিশ হাজার কপি বিক্রি শেষ হয়েছে। এটির অংশবিশেষ ১৯৯৬ সালে  জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক ষষ্ঠ শ্রেণির  পাঠভুক্ত হয়। এরপর থেকে আমার প্রকাশিত লেখাগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাজগুলোই বেশি উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের কাজটিকে আমি ভালোবেসেছি, এই কাজটিই করেছি। বাংলা একাডেমির গবেষণা উপবিভাগ থেকে বিশাল আয়তনের গ্রন্থটি “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রাসঙ্গিক দরিলপত্র” নামে বেরিয়েছিল ২০০০ সালে। আমার প্রত্যাশা ছিল, তার পরের বছর বা তারও পরের বছর আমি “বাংলা একাডেমি পুরস্কার” পাবো। আমার বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজন বলেছেন, আমার এই পুরস্কার অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল। আমিও তা-ই মনে করি। তবে দেরিতে হলেও আমি তা পেয়েছি। আমি খুশি, আমি সন্তুষ্ট।

প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, প্রসঙ্গ, অনুপ্রেরণা - এই বিষয়গুলোকে  আপনি নিজের লেখালেখি, কর্মকাণ্ড, ভাবনা ও মননে নানাভাবে ধারণ করতে আগ্রহী হয়েছেন। কেন?

বিজ্ঞাপন

উত্তর: আমি  মুক্তিযোদ্ধা, দুই নম্বর সেক্টরের ফ্রন্টফাইটার। নিজে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলাম, আমি যুদ্ধটাকে দেখেছি।

প্রশ্ন :  কোন জেলায়, আপা?

উত্তর: তখন ঢাকা জেলা, কিন্তু পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা, আড়াইহাজার থানা। দুই নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত। সত্তরের নির্বাচনের সময় আমি গাইবান্ধায় ছিলাম। আমি সেই বছর এসএসসি পাস করেছি গাইবান্ধা গার্লস স্কুল থেকে। আমাদের বাসার পেছনে ইসলামিয়া হাইস্কুল। সেই স্কুলে নির্বাচনী কেন্দ্র ছিল। সেখানে যে মহিলারা ভোট দিতে আসতেন, আমি সেই কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছি। এরপর যখন একাত্তর সালের  মার্চের এক তারিখে ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন. তখন থেকে সাতই মার্চ পর্যন্ত যে উত্তাল দিনগুলি, তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে। এরপর আমি আবার গাইবান্ধা চলে যাই। তার আগে আমি একাত্তরের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। সেই বৃত্তান্ত লিখেছিলাম আমার "যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস" গ্রন্থে। এটি স্মৃতিচারণমূলক বই। আপনি জানতে চেয়েছেন, কেন আমি যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হলাম। আমি এই ঘটনা, প্রসঙ্গগুলো দেখেছি, জেনেছি, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ট্রেনিং নিয়েছি, মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ করেছি, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। দেশ স্বাধীন হবার পর আবার যখন শিক্ষাজীবনে ফিরে আসলাম, তখন আমার ভেতরে বরাবরই একটা তাগিদ ছিল। এই যে একটা অন্যরকম সময় এসেছিল বাঙালির জীবনে, তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের আর বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের জীবনে, মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনে, এই যে আমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, অর্জন বিসর্জন, এগুলি ইতিহাসের বিষয়। কিন্তু আমরা যখন থাকব না, ধীরে ধীরে এগুলি তখন হয়ত মুছে যাবে। কিন্তু আমরা যারা এগুলি দেখেছি, জেনেছি, তাদেরই এগুলি লিখে যাওয়া উচিৎ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। সেই অনুপ্রেরণা থেকে আমি মুক্তিযুদ্ধেও লেখালেখি শুরু করলাম। আমার লেখালেখি শুরুই হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখা দিয়ে।

প্রশ্ন: এ ব্যাপারে আরেকটু যদি বলেন! কী লিখলেন আপনি? গদ্য, নাকি কবিতা?

উত্তর: আমি ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি করতাম। আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখন থেকেই জানি, রংপুর-গাইবান্ধা এলাকা সংস্কৃতিচর্চায় অগ্রগামী। আমাদের স্কুলে যে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হত, সাহিত্য প্রতিযোগিতা হত। সেই সাহিত্য প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতায় আমি অংশ নিতাম। সেখানে আমি প্রথম হতাম। আমি কবিতা লিখে, আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়তাম। আমার হাতে লেখা সেই কবিতাটা এখনো আমার সংগ্রহে আছে। তা সেই কবিতাটি লিখে আমি প্রথম হয়েছিলাম। ওখানে বি ডি হল নামে একটা হল ছিল। টাউন হল নামে একটা পাঠাগার ছিল। সেখানে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের জন্য সাহিত্য প্রতিযোগিতা হত। তখন তো পাকিস্তান। পাকিস্তান দিবসে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা যেমন রচনা প্রতিযোগিতা হত।  বেগম রোকেয়া, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও অন্যদের জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকীতে রচনা প্রতিযোগিতা হত। এ প্রতিযোগিতায় আমি রচনা লিখে সবসময় যোগ্যতাবলে ও সৌভাগ্যবলে পুরস্কৃত হতাম। এই যে অনুপ্রেরণা, এটাই আমাকে পরবর্তীকালে লেখালেখির দিকে এগিয়ে নিয়ে আসে। এবং যে বিশেষ ব্যাপারটি আমার এখন মনে হয়, একাত্তর সালে দেশ স্বাধীন হবার পর বাহাত্তর সালে যখন আবার ফিরে আসলাম লেখাপড়ার জগতে। বাহাত্তরে বা তিয়াত্তরে ইত্তেফাক পত্রিকার মহিলা পাতায় আমার একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। এটি আমি অনেকদিন থেকেই খুঁজছি। এটির একটি সংখ্যা আমার কাছে ছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালের বর্সা মৌসুমে আমি তখন বাসাবোতে আমাদের বাসায়। একতলায় বাসায় বন্যার পানি ঢুকেছিল। বন্যার পানিতে আমার সকল কাগজপত্র ভেসে গিয়েছিল। এ কাগজগুলোও আমার কাছে নেই। এজন্য আমি গিয়েছিলাম বাংলা একাডেমির পত্রিকা বিভাগে, ১৯৭২-১৯৭৩ মালের পত্রিকাগুলো খুঁজে আমার এ লেখা বের করার জন্য।

প্রশ্ন: আপনি একটু আগে বললেন যে আপনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা এবং গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন,  মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে আপনার পরিবার বিষয়টিকে কীভাবে দেখেছে এবং কী ভূমিকা রেখেছে? আপনি যে বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন, সেক্ষেত্রে পরিবারের সমর্থন বা নিষেধাজ্ঞা - বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাই।

উত্তর: আমার আব্বা আনোয়ার আলি ভুঞা সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি সবসময়ই খুব উদারপন্থী মানুষ ছিলেন। আরেকটা কথা না বললেই নয়। তখন আমাদের বাসায় সবসময় দুটো পত্রিকা রাখা হত। ‘দৈনিক পাকিন্তান’ ও ‘দৈনিক আজাদ’। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি যে আব্বা পত্রিকাগুলো পড়েন। ১৯৮৫ সালে আমি যখন লইয়ার হয়ে কোর্টে জয়েন করলাম, তখন আমার মনে হলো, সেই যে ছোটবেলায় আব্বা পত্রিকা পড়ে পড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কার্যবিবরণী, ধারাবিবরণী পড়ে শোনাতেন, সেই মামলাটা আসলে কী ছিল? কেন এই মামলাটা হয়েছিল? আসলে মামলাটার বিষয়বস্তু কী? এসব জানার খুব আগ্রহ হল। তাই ১৯৮৬ সাল থেকে আমি এ মামলার নথিপত্র খোঁজা শুরু করি। মামলার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা চলল। আপনারা জানেন যে এগুলো ইতিহাস। এ মামলার রায় হয়নি, কিন্তু কয়েকটা সাক্ষী হওয়ার পরই আমাদের দেশপ্রেমিক সাংবাদিকরা এ মামলার খবরাখবর প্রতিদিন সংবাদপত্রে উপস্থাপন করেছেন অনুপুঙ্খভাবে।

আপনার কথার সূত্র ধরেই বলি,  বাঙালি ঘরের একটা মেয়ের এ ধরনের কাজে অংশগ্রহণ সহজ ছিল না। তাছাড়া সময়টা বিবেচনায় রাখতে হবে। এখন তো মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হওয়া ও বিভিন্ন সুযোগ প্রাপ্তি এসব অনেক বেড়েছে। কিন্তু তখনকার সময়ে একজন মেয়ে মুক্তিযুদ্ধে আসবে বা ঘরের বাইরে এসে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে, এটা খুব সহজ ছিল না। কিন্তু আমার আব্বা সবসময়ই খুব সহানুভূতিশীল ও  উদারমনের মানুষ ছিলেন। আমরা ছয় বোন। আব্বা বলতেন যে, আমার যদি ছয়টা ছেলে হত, আমি সবগুলিকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতাম। আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশিক্ষণ নেবার ব্যাপারে আব্বা সবসময় উৎসাহ, সাহস, সমর্থন যুগিয়েছেন। আব্বার অনুপ্রেরণায় আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছি। আমার পরিবার থেকে বাধা আসেনি। তবে আমার মা নিমরাজি ছিলেন, কিছুটা ভয় পেতেন। আর একারণে আমি ১২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের এই সময়ে  আমাদের শহরবাসী মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গেদের ডাক’ নামে একটি দেয়াল পত্রিকা করেছিলাম। এবং পরবর্তীকালে যে যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়া, স্বেচ্ছাসেবকের ট্রেনিং নেয়া এসব কারণে আমাদের বাসা মে মাসে মিলিটারি দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল। মিলিটারি ঘেরাও করে ফেলেছিল আমাদের বাসা। দেশের ভেতরেই আমরা শরণার্থীর জীবন যাপন করেছি এক মাস।

প্রশ্ন: এই সময়ের স্মৃতিকথা কি আপনার ‘যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস নামের স্মৃতিকথামূলক বইটাতে বিধৃত হয়েছে?

উত্তর: হ্যা। আমি এই স্মৃতিকথাগুলোকে উপন্যাসের মতো করে লিখেছি। ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় আমার এ বইটার একটা রিভিউ বেরিয়েছিল। সেই রিভিউয়ার লিখেছিলেন - এটা কি স্মৃতিকথা? এটা কি ঐতিহাসিক দলিল? এটা কি ইতিহাস? এটা কি উপন্যাস? যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এটার আবেদন অতুলনীয়। কিন্তু ঐ কাগজটাও হারিয়ে ফেলেছি ১৯৯৮ এর বর্ষা মৌসুমে।