ট্র্যাজিক হিরো দারাশিকোহকে দেখালেন মাহফুজ পারভেজ
সুকুমার বৃত্তির চর্চাতে তিনি ছিলেন আত্মনিবেদিত। তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, দার্শনিক চিন্তাধারা, বিচক্ষণতা, ন্যায়পরায়ণতার নজির সমীহ জাগিয়েছিল সবার মনে। রাজদরবার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছেও তিনি অর্জন করেছিলে তুমুল জনপ্রিয়তা। এমনকি মুঘল সম্রাট শাহজাহানও তাকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকার করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু ময়ূর সিংহাসনে বসা হয়নি দারাশিকোহর। মাথায় তোলা হয়নি কোহিনুর হিরা খচিত রাজ মুকুট। উত্তরাধিকারের যুদ্ধে বারবার পরাজিত হয়ে পলাতক জীবন কাটিয়েছেন বেশ কিছুটা সময়। অনেক চেষ্টা করেও প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তারপর একসময় বিশ্বস্ত অনুচরের বিশ্বাসঘাতকতায় বন্দি হয়ে মুখোমুখি হয়েছেন প্রসহনের বিচারে। সবশেষে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে হত্যা করা হয়েছে তাঁকে।
দারাশিকোহর মতো এমন একজন সম্ভাবনাময় শাসক কিভাবে ইতিহাসের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন? কেন অকাল মৃত্যু বরণ করতে হলো তাঁকে? তার সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল? কোন স্রোতে বইছিল তখনকার মুঘল রাজমহল? কেমন ছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র? রাজনীতির ময়দানে কেমন খেলা হতো তখন?
এমনই অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ। পেশায় তিনি শিক্ষক। অধ্যাপনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার লেখা “দারাশিকোহ: মুঘল ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো” গ্রন্থটি তাই একাডেমিক দৃষ্টিকোন থেকে পরীক্ষিত। তবে ড. মাহফুজ পারভেজ কেবল একাডেমিকই নন। তার অন্যতম পারদর্শিতা হলো একাডেমিক ও প্রচলিত জনপ্রিয় ধারার লেখালেখিতে সুচারু সমন্বয়ে।
একাডেমিক অঙ্গনের সঙ্গে সাংবাদিকতার একটা অন্যতম বৈপরিত্য এই যে, প্রচলিত সাংবাদিকতা একাডেমিক গুরুত্ব পেতে ব্যর্থ। আবার একাডেমিশিয়ানদের খুব কম জনই জনপ্রিয় সাংবাদিকতার ধারায় সহজ সরল রচনা উপহার দিতে পারেন। এদিক থেকে ড. মাহফুজ পারভেজকে সব্যসাচী বলাই যায়। কেননা, তিনি একাডেমিক বিষয় তো বটেই, সংবাদপত্রের লেখালেখিতেও দারুণভাবে সিদ্ধহস্ত। যে কোনো সময়ে যে কোনো পরিস্থিতিতে লিখে যাওয়ার একটা অদ্ভূত অভ্যাস আছে তার। তিনি হাঁটতে হাঁটতে লিখেন। দৌড়াতে দৌড়াতেও লিখেন।
তবে দারাশিকোহ গ্রন্থটিতে তিনি সময় দিয়েছেন ঢের। প্রথমত, ঘটে যাওয়া ঘটনার নিখাদ বর্ণনা দিয়েছেন। তারপর বিভিন্ন ইতিহাসবিদের দৃষ্টিকোন থেকে বর্ণিত ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন। সবশেষে নিজের পর্যবেক্ষণজাত অভিমতও তুলে ধরেছেন প্রয়োজন মতো।
দারাশিকোহ: মুঘল ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো গ্রন্থটিতে আলোচ্য মুখ্য চরিত্রের শৈশব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্বের পর্যায়ক্রমিক বিবরণ দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের প্রেক্ষাপটে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের খুঁটিনাটিও তুলে ধরা হয়েছে সাবলীলভাবে। মুঘল সম্রাট হওয়ার ক্ষেত্রে দারাশিকোহর সম্ভাবনা ও অন্তরায়সহ নানামুখী ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে বিবৃত হয়েছে তাতে পাঠকের পাতার পর পাতা এগিয়ে যেতে সমস্যা হয় না।
মুঘল সিংহাসনের উত্তরাধিকারের যুদ্ধ ও যুবরাজদের ভাতৃঘাতী রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ তো আছেই, দিল্লি ও আগ্রার পাশাপাশি বাংলার আলোচনাও বাদ যায়নি লেখকের অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ থেকে। এমনকি পরিষিষ্ট অংশে মুঘল সংস্কৃতির পরম্পরাও তুলে ধরেছেন লেখক। যেখানে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরকেও আমরা কবি হিসেবে পাই। সিংহাসন নিয়ে হুমায়ুনের সংগ্রামের খবর জানতে পারি। আকবর বা জাহাঙ্গীরেরও অনেক অজানা বিষয়ের দেখা পাই।
সব মিলিয়ে দারাশিকোহকে সামনে রেখে মুঘল সাম্রাজ্যের অনেক অপ্রচলিত বিষয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন লেখক। গ্রন্থের শেষে তিনি যে সহায়ক গ্রন্থপঞ্জির তালিকা দিয়েছেন তা আরও গবেষণায় আগ্রহী যে কাউকে সূত্র ধরিয়ে দিতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে।
হাওর বিধৌত কিশোরগঞ্জের সন্তান ড. মাহফুজ পারভেজ রচিত গ্রন্থের সংখ্যা কুড়ি। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- বিদ্রোহী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শান্তিচুক্তি, রক্তাক্ত নৈসর্গিক নেপালে। উপন্যাস-পার্টিশনস, নীল উড়াল। গল্প-ইতিহাসবিদ, ন্যানো ভালোবাসা ও অন্যান্য গল্প। কবিতা-মানব বংশের অলংকার, আমার সামনে নেই মহুয়ার বন, গন্ধর্বের অভিশাপ ইত্যাদি। ২০২১ সালের গ্রন্থমেলায় তার দারাশিকোহ: মুঘল ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে স্টুডেন্ট ওয়েজ। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন সানজিদা স্বর্ণা। সাড়ে এগারো ফর্মার বইটির দাম রাখা হয়েছে তিনশত টাকা। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন রাশেদ রউফ, সুলতানা জাহান, আবসার মাহফুজ ও মানসুরা চামেলী সুহৃদ চতুষ্টয়কে। বইটি ইতিহাস অনুসন্ধানী পাঠকের নজর কেড়েছে।
লেখক: ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক