ফরিদপুরে ছাত্র সম্মেলন: কবি নজরুল ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ

  • বাবু মল্লিক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কবি নজরুলের জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর ফুলেল শুভেচ্ছা

কবি নজরুলের জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর ফুলেল শুভেচ্ছা

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলমের সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পরিচয় ঘটেছিল নিজের জেলা সদর ফরিদপুরের এক সম্মেলনে, ১৯৪১ সালে। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম সাহিত্য সাধনার উন্মেষকাল ১৯২৫ সাল থেকে সুস্থ্য-স্বাভাবিক জীবনে ১৯৪১ শেষ পর্যন্ত অন্তত বৃহত্তর ফরিদপুরের কয়েকটি স্থানে অন্তত আটবার ভ্রমণ করেছেন তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কবির ফরিদপুর ভ্রমণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্রিটিশ রাজশক্তি প্রতিফলিত হয়েছিল। কবি নজরুল বৃটিশ রাজশক্তির তোয়াক্কা না করে বারবার এসেছেন ফরিদপুরের মাটিতে। নজরুল মানস চরিত্রে তাই ফরিদপুরের সফরগুলো আরেক অধ্যায় হয়ে রয়েছে। মুসলিম স্টুডেন্ট কনফারেন্স ছাড়াও কবি একাধিকবার ফরিদপুর জেলা সদরে এসেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সুস্থ জীবনের শেষ পর্যায়ে কবি নজরুল আরো একবার ফরিদপুর গিয়েছিলেন। গবেষক আবুল হোসেন মল্লিকের মতে, সেবার কবির সাথে ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা ও শিল্লী আব্বাস উদ্দীন আহমদ। 

বঙ্গবন্ধুর স্কুল ছাত্রাবস্থায়, ১৯৪১ সাল মধ্যে নজরুলের ফরিদপুরের শেষ সফরের আগেরবার এসেছিলেন ১৯৩৬ সালে, ছাত্রদের একটি অনুষ্ঠানে- জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের চতুর্থ অধিবশনে সভাপতিত্ব করতে। সে সম্মেলনে প্রদত্ত কবির অভিভাষণটি ‘বাংলার মুসলিমকে বাঁচাও’ নামে পরিচিত। ভাষণে পদত্ত প্রবন্ধটি পাওয়া গেলেও নজরুলের সে সফরের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। নজরুলের ফরিদপুর প্রথম ভ্রমণটিও ছিল ছাত্র সমাজ এবং রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, ১৯২৫ সালে তিন দিনের টেপাকোলা মাঠে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কবি নজরুল ছাড়াও সেবার ফরিদপুরে এসেছিলেন মহাত্মাগান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের (৫.১১.১৮৭০-১৬.৬.১৯২৫), নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু (২৩.১.১৮৯৭-১৯.৮১৯৪৫), সরোজিনী নাইডু (১৮৭৯-১৯৪৯), মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-২২.২.১৯৫৮) যোগ দিয়ে বক্তৃতা করেন। কবি নজরুল সাথে একজন বামপন্থী নেতাসহ চারজনের একটি দলে ওই সম্মেলনে যোগ দিতে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বাড়িতে ওঠেন।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু’র অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে, ১৯৩৬ সালে তাঁর পিতা গোপালগঞ্জ থেকে বদলি হয়ে গেলে মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন কিশোর মুজিব। সেখানে চোখে গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান। ফিরে এসে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জে গিয়ে মিশন হাইস্কুলে ভর্তি হন, পিতা শেখ লুৎফর রহমানও তখন গোপালগঞ্জেই ফিরে এসেছিলেন আবার বদলি নিয়ে। সেখানে মিশন স্কুলের ছাত্রাবস্থায়ই মুজিবের রাজননৈতিক সংশ্রব ঘটে ১৯৪০ সালে, নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। এরপর বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন শেখ মুজিব। ফরিদপুরে সে সময়ে মুসলিম লীগের সাংগঠনিক রাজনীতি শুরু হয়নি। কংগ্রেসের নেতৃতে সেখানে ছিলেন নীলকান্ত ঘোষ, রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র বল, রমেশ চন্দ্র সেন, গোপালচন্দ্র মুখার্জি, যতীন্দ্রনাথ বাগচী, সতীশচন্দ্র হীরা প্রমুখ।

১৯৩৬ সালে কবি নজরুলের  অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ছাত্র সম্মেলনে শেখ মুজিব অংশ নিয়েছিলেন কী না তা পরিষ্কার করে বলা যায় না। কবি নজরুলের সঙ্গে যখন ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যোগাযোগ ঘটল তখন তিনি ২১ বছরের পরিপূর্ণ যুবক, ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে তখন তিনি স্কুল ফাইনাল দিয়েছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের পর সম্প্রতি জানা যাচ্ছে যে, কবি নজরুলের আতিথ্য সম্মৃদ্ধ সেই সম্মেলনের অন্যতম অংশগ্রহণকারী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তখন সবে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেছেন। মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে ইতোমধ্যেই তিনি নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র মধ্যে তখন মনোমালিন্য চলছিল।

বিজ্ঞাপন

ফরিদপুরের ওই ছাত্রসভায় ব্রিটিশের নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় শেষে হুমায়ুন কবিরের বাড়িতে কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হল। শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন-

‘১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দ্বিতীয় বিভাগের মার্কস পেয়েছি। মন ভেঙে গেল।

তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি বক্তৃতা করি খেলার দিকে মন নাই। শুধু মুসলিম  লীগ আর ছাত্রলীগ। ....পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় যাই। সভা-সমাবেশে যোগদান করি। মাদারীপুর যেয়ে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করি। ....এই সময় ফজলুল হক সাহেবের সাথে জিন্নাহ সাহেবের মনোমালিন্য হয়। হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের হুকুম মানতে রাজী না হওয়ায় তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করলেন শ্যামা মুখার্জির সাথে।.....’

১৯৪১ সালের সেই ফরিদপুর সম্মেলন প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন কবির নামটি। সম্মেলন ১৪৪ ধারার কারণে হুমায়ুন কবিরের বাড়িতে গিয়ে ওঠে, কবি নজরুল সেখানে গান গেয়ে শোনান। আর কোন রাজনৈতিক আলোচনা হতে দেন নি তরুণ মুজিব। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য বিষয়ে আলাপ আলোচনা ও বক্তৃতা চলে সেখানে। ফলে দলাদলি হয়ে দু’দলে ভাগ হয়ে যায় ছাত্ররা। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন সেকথা-

‘একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজি নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজি নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতির আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্মন্ধে বক্তৃতা হবে। ছাত্রদের মধ্যেও দুইটা দল হয়ে গেল।’[ অসমাপ্ত আত্মজীবনী: শেখ মুজিবুর রহমান, পৃঃ ১৬ ]

১৯৪১ সালে ফরিদপুর সম্মেলনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়াও উপস্থিত হয়ে ছিলেন প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহিম খাঁ। তিনি তাঁর বক্তৃতায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল গঠনের উপায় নাই এবং ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক চিন্তা ও প্রত্যক্ষ দলীয় আনুগত্যের কোন প্রয়োজন নেই বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। সে প্রসঙ্গে আহম্মদ কাফিল লিখেছেন-

‘১৯৪১ সালে ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনের চতুর্থ অধিবেশনে ইব্রাহিম খাঁ ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গ মন্তব্য করেন-সত্য বটে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, দেশে রাজনৈতিক দল গঠন ছাড়া উপায় নাই।....কিন্তু ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক চিন্তা ও আলোচনায় এরূপ দলের প্রকাশ্য এবং প্রত্যক্ষ আনুগত্যের কোন অনিবার্য প্রয়োজন নেই।’ [ দ্রঃ প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ স্মৃতিগ্রন্থ: আহমাদ কাফিল, ঝিঙেফুল-ঢাকা। প্রথম প্রকাশ-বইমেলা’২০০৬। 

ফরিদপুর সম্মেলনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল সে সময়ের আজাদ পত্রিকায়। ১৯৪১ সালে আজাদের ওই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, ছাত্রদের যে সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে কবি নজরুল ইসলাম ফরিদপুর গিয়েছিলেন, ১৪৪ ধারা জারি হওয়ায় তা পণ্ড হয়ে গেলে কবি নজরুল ইসলাম একটি ধর্মসভায় যোগ দেন। তবে সে ধর্মসভাটি কোথায় বা কার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা জানা যায় না। আজাদ পত্রিকায় (২৮ শ্রাবণ, ১৩৪৮/ ১৩ আগস্ট, ১৯৪১) প্রকাশিত ওই রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘ফরিদপুরে ছাত্র সম্মেলন/১৪৪ ধারা জারি করায় পণ্ড। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক ধর্মসভায় বক্তৃতা।’

সে রিপোর্টে আরও জানা যায়, রিপোর্ট প্রকাশের দিনে জেলা মোসলেম ছাত্র সম্মেলনের অধিবেশন হবার কথা ছিল। নজরুল ছাড়াও সম্মেলন উপলক্ষে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা হলেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, মুহম্মদ হাবীবুল্লাহ, শামসুল হুদা চৌধুরী ও আব্দুর রউফ। এছাড়াও এসেছিলেন অধ্যাপক হুমায়ুন কবির যিনি ততদিনে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য। কিন্তু ১৪৪ ধারা জারি হওয়ায় সে সম্মেলন আর হয়নি।

ফরিদপুর প্রেক্ষাপটে কবি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের সম্ববত ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতির উত্তাল সময়ে ‘ফরিদপুরে ছাত্র সম্মেলন/১৪৪ ধারা জারি করায় পণ্ড’ হওয়ার ভেতর দিয়েই পরিচয় সম্পন্ন হয়। 

লেখক: বাবু মল্লিক, সাংবাদিক ও সম্পাদক-সাপ্তাহিক অনুসন্ধান। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ‘মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ’ রচনা প্রকল্পের রাজবাড়ী জেলা অংশের লেখক, গবেষক ও সম্পাদক