জবাফুলের দুনিয়া



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

এরকম হয়। খুব কম সময়। তবে হয়। সে তো জানা ছিল রফিকুলের। কিন্তু এবার যেরকম হলো সেটা অতীতের চেয়ে ব্যতিক্রম। সে যাচ্ছিল  নীলক্ষেত টু মিরপুর রোডের শুক্রাবাদের সিনজিয়ান রেস্তেরাঁর সামনে দিয়ে। সন্ধ্যা ৭টার একটু বেশি হবে। রাত বেশি নয়। কিন্তু শবে বরাতের রাত বলেই হয়তোবা ঠিক সেসময় মানুষজন রাস্তায় কম ছিল। যদি বেশি থাকত তবে হয়তো রফিকুল অতীতে এমন ঘটনার সময় যেরকম মানুষের হেল্প নিয়েছিল সেরকম নিত। কিন্তু  সেদিন সে নিরুপায়। সিনজিয়ান রেস্তেরাঁ বা’পাশে ফেলে দু’কদম এগুতেই সে পড়ে গেল।

এরপর ধানমন্ডি ইবনে সিনা ক্লিনিকে ১৪ ঘণ্টা পর যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন দেখল তার বাবা, মা ও ছোট ভাই আরিফ তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। চিকিৎসক জানালেন, রফিকুলের যে রোগটি হয়েছে এটিকে চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় বলে, ডিমেনশিয়া। এ রোগ সাধারণত বৃদ্ধকালে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা এলকোহলিক তারা এই রোগের ঝুঁকিতে থাকে।

কিন্তু রফিকুলের বয়স মাত্র আটাশ বছর কয়েক মাস। এবং সে নন-এলকোহলিক।

রফিকুল ক্লিনিক থেকে সুস্থভাবে বাসায় ফেরে ঠিকই কিন্তু বাইরে বেরুনোর ব্যাপারে ভয় গেড়ে বসে তার মনে। যদি সে আর তার বাসা না চিনতে পারে। আবার যদি এমন হয়!

কিন্তু তাকে ক্লাস নাইনে পড়ুয়া যে মেয়েটি ভালোবাসে, মানে মিল্কি, তার তো আর এসব বোঝার কথা নয়। সে মোবাইলে ফোন দিতেই থাকে প্রতিদিন। বলে, ‘স্যার আমাকে বাসায় এসে পড়ানো ছেড়ে দিলেন, ঠিকাছে। কিন্তু আসবেন না বেড়াতে?’ কোনোদিন বা বলে, ‘স্যার খুব মিস করছি। জবাফুলের গল্প না একদিন বলেছিলেন শোনাবেন, শোনালেন না তো!’ কখনো বলে, ‘স্যার পোস্টমাস্টারের রতনের কথা মনে পড়লে এখনো আমার চোখ ভিজে যায়। বলেছিলেন না, মফস্বলে এখনো অনেক রতন থাকে। তাদের কথা বলবেন। কই এলেন না তো! কবে আসবেন।’

রফিকুলের এসব কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। আবার সারাদিন-রাত বাসায় কাটায় বলেই হয়তোবা রতনের ফোনকলের অপেক্ষাও করে। কিন্তু তাকে সারাক্ষণ তো তটস্থ রাখে সেই ভয়—যদি কোনোদিন সে তার বাবা, মা আর ছোটভাই আরিফকেও না চিনতে পারে। বাসার এ ঘর থেকে ওঘরে যাওয়া ভুলে যায়।

জীবন কিভাবে যে ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসছে সে টের পায়।

একদিন দুপুরবেলা তার মাথায় প্রথম চিন্তা আসে যে, আত্মহত্যা করলে তো সে এই ক্রমাগত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্ত সমস্যা হলো আরিফ। আরিফের মুখ ভাসে। যেন সেই শৈশবে জামালপুরের রেললাইন ধরে রফিকুল ঘুড়ি নিয়ে দৌড়াচ্ছে। পেছনে আরিফ। আহা, এমন মায়াময় দৃশ্যের বাইরে চলে গেল রফিকুল। রাতে ঘুম হয় না বললেই চলে। তার পাশে ঘুমায় আরিফ। মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। সেও জেগে থাকতে চেষ্টা করে। রফিকুল যখন আরিফ ঘুমিয়েছে ভেবে একটু উঠে বসে থাকতে চায়, অন্ধকার ঘরে দেখা গেল ঠিক তখনই আরিফ লাফিয়ে উঠে রফিকুলকে জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘ভাইজান খারাপ লাগছে?’

রফিকুলের তখন ভীষণ কান্না পায় ছোট ভাইয়ের তার প্রতি মায়া দেখে। কিন্তু বুঝতে দেয় না। সচরাচর এমনই বলে, ‘তুই ঘুমাস না কেন? আমি ঠিক আছি।’

রফিকুল যদিও বলে ভালো আছে কিন্তু আজকাল তার মাঝেমাঝেই আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে। সে আত্মহত্যা বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা করে। বেশ রোমান্টিকতাও আছে এসব পরিকল্পনায়।

উদাহরণ দেওয়া যাক

এক. ছোট্ট তিনটা নীল ক্যাপসুল রফিকুলের হাতে। লাউয়াছড়ার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যে নিঃসঙ্গতম রেলপথটি চলে গেছে সে পথে আশ্বিনের জোছনা, রেললাইনের পাশ দিয়েই নেমে গেছে ঢালুপথ। ওই পথ দিয়ে নেমে যাচ্ছে রফিকুল। জিহ্বার নিচে রাখে  তিনটা নীল ক্যাপসুল। এই-ই শেষ। যে শেষটার জন্য সবাই অপেক্ষা করে। কেউ পায় দেরিতে, কেউ পেতে চায় না। কিন্তু রফিকুলের জীবনে আচমকা এসেছে, বুঝে ওঠার আগেই সে ছিনিয়ে নিয়ে যায় বোধ। হ্যাপিলি এভার আফটার। কেমিক্যাল নাম পটাশিয়াম সায়নাইড।

দুই. একটা বাথটাব, কানায় কানায় পরিপূর্ণ উষ্ণ পানি। গোসল করবা মিল্কি? তুমি আর আমি নেকেড হই চলো আপাতত। শরীর, শরীরই তো। নতুন কিছু নয়। চলে এসো। ঘ্রাণ নাও। নেবু নেবু গন্ধ পাইতেছো না? ওই যে দুইটা গেলাস। আগে আমি খাইনি। কসম আল্লার। আজই একদিন দুইজনে মিল্যা খেলতে খেলতে খাইতে খাইতে তোমারে রতনের গল্প করুম। জবাফুলের। ওই গেলাসে গোপীবাগ থিকা আনা স্পিরিট মিশানো বাংলা মদ।
না রফিকুল বলে না, একটা মদের গ্লাসে দুশোটা ঘুমের বড়ি মেশানো আছে।
মিল্কি পানির ভিত্রে আধডোবা হৈয়্যা আছি ফেস টু ফেস দু’জনে। নাও গেলাস। একশোবার গেলাস বদল করব। আর এক, দুই, তিন করে একশো গুনব। ঠিকাছে? রফিকুল বলে, মিল্কি রতনের মতন কাউরে ভালোবাসবা না। কানবা না। বুঝলা, জবাফুল আমি খুব ভালোবাসতাম। লাল দেইখ্যা। কিন্তু গন্ধ নাই বুঝলা। এরপর এতটুকু বলে রফিকুল গেলাসের হাত বদল করতে করতে গোপন সংকেত দেওয়া গেলাসটা নিজ হাতে নেয়। একশো গোনা শেষ। সে গেলাসের সবটুকু খায়। মিল্কি হয়তো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ওপরে শুয়ে পড়ে রফিকুল, অস্ফুস্ট স্বরে কী বলেছিল, তুমি জবাফুল হলা না আমার!
বাথটাব পানির নিচে এলোমেলো দুটি নগ্ন তরণ-তরুণীর শরীর জড়ানো। অয়েল পেইন্টিং।

তিন. কোনো পাহাড়ী হিমশহর। রফিকুল হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে অনেক কষ্টে এমন একটা জায়গায় উঠে সেখানে দেখে যীশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মতো লোহার ফ্রেমের একটা ক্রুশ। সেই ক্রুশে একটা সাপ ঝুলে আছে। রফিকুল তার মোবাইল থেকে সিম খোলে। তারপর সিমটিকে মুখে মুড়ে চিবিয়ে যতটা সম্ভব গুঁড়ো করে গেলে। মোবাইল ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে। এরপর এগিয়ে যায় ক্রুশে ঝুলে থাকা সাপের দিকে। তখন শীতের বিষণ্ণ বিকাল। সে জিহ্বা এগিয়ে দেয়, ব্যাস সাপটি সাহায্য করে। তার জিহ্বায় একটা সত্যি একটা মাত্র ছোবল দেয়। The road less travelled। রফিকুলকে দেখা যায় গড়িয়ে গড়িয়ে অনেক নিচে খাদ থেকে থাদে ঝরে পড়তে।

কিন্তু মুশকিল হলো রফিকুল এসব ভাবলে ভয় পায়। সে জানে আত্মহত্যা করবে না। সে ভীরু প্রকৃতির। তার সামনে জাকিরের মুখ ভাসে। ভাইজান ভাইজান ডাক শোনে। তার বাবার মুখ অতোটা ভাসে না। তবে মায়ের মুখ ভাসে। মাঝে মাঝে। ভাসবে আর কতদিন? সে তো স্মৃতিভ্রষ্টই হতে যাচ্ছে। অতএব বেঁচে থাকলেই বা কী মরে গেলেই বা কী? এমন চিন্তা রফিকুলকে তাজা করে।

একদিন দুপুরে ঘুম থেকে উঠে গোসল, নাস্তা সেরে তার কেন জানি বহুদিন পর খুব ফ্রেশ লাগে নিজেকে। আব্বা অফিসে। আম্মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। জাকির স্কুলে। সে গ্যাবার্ডিনের একটা প্যান্ট আর এ্যাশ কালারের টিশার্ট পরতে পরতে ফোনকল দেয় মিল্কিকে, ‘মিল্কি কোথায় তুমি?’
মিল্কি কল রিসিভ করে। কিন্তু এত কোলাহলপূর্ণ তার চারপাশ যে কথা স্পষ্ট শোনা যায় না। শুধু শোনা যায়, ‘স্কুলের গেইটে।’ আরো কীসব বলে শোনা যায় না।
রফিকুল বলে, ‘থাকো। আমি আসছি।’

বাসা থেকে বেরুনোর আগে রফিকুলের একটু ভয় জাগে, যদি না বাসা চিনে ফিরতে পারে, যদি চারপাশ অন্ধকার দেখে! তবু সে বেরিয়ে পড়ে। শ্যামলী সিনেমা হলের উল্টোপাড়ে গিয়ে একটু দাঁড়ানোর পরই বাস পায়। ঘিঞ্জি। উঠতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করায় পায়ের একজোড়া স্যান্ডেলের একটা খসে পড়ে।

রফিকুল ততোক্ষণে উঠে গেছে। বাসও ছেড়েছে। রফিকুলের একটা হাত উপরের হাতল ধরা অন্যটি একটি সিটের পেছনে ভর দেওয়া। সে ধীরে ধীরে বাম পায়ে থাকা অন্য স্যান্ডেল পা থেকে খুলে অগোচরে যেনবা, কেউ যেন না দেখে এমনভাবে ধাক্কা দিতে দিতে অনেকটা দূরে সরিয়ে দেয়। যেন ওই একখানা স্যান্ডেল তার না।

জ্যাম।  বাস ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। আসাদগেটের স্টপেজ পেরিয়ে ফের জ্যাম। রফিকুল মিল্কির বাসার কথা মনে পড়ে। আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে। তার স্কুলও পাশেই। 

মিল্কিদের বাসার গেটভর্তি মাধবীলতা। উলোঝুলো হয়ে ঝুপ্পুস করে জড়িয়ে আছে গেটটা। সেই গেট ঠেলে এগুলে একটা উঠোনমতো। তারপর একটা টানা বারান্দা। প্রথম দরজাটা খুললে উপরে ওঠার সিঁড়ি। ওই উপরে থাকে বাকি বাড়িটা। আর দ্বিতীয় দরজা ঠেললে? হ্যাঁ, ওইটা মিল্কির ঘর। অনেকগুলো জানলা। সেই জানালা দিয়ে তাকালে জবাফুলের দুটো গাছ। মিল্কিকে যেদিন প্রথম টিউশনি পড়াতে যায় রফিকুল সেদিনের কথা মনে পড়ে। মিল্কিদের বাসার কাজের বুয়া প্রথমে এসে চা বিসকিট দেন। এর কিছুক্ষণ পর আসেন মিল্কির আম্মা। বোরকা পরিহিতা। বাসায়ও কি বোরকা পরেন? রফিকুল ভাবে। কে জানে? রফিকুলের পেছনে পেছনে ঢোকে মিল্কি। পরিচয়পর্ব শেষে রফিকুল মিল্কিকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই চলে যায় জবাফুলের দুটো গাছের দিকে। সে ওদিকে তাকিয়েই বলে, ‘বাহ, জবাফুল দেখতে দেখতে পড়ানো।’
মিল্কিও তাকায় জানালা গলিয়ে জবাফুলের দিকে।
রফিকুল আপনমনে বিড়বিড় করে বলে, ‘ফুলটা লাল। সুন্দর। কিন্তু কোনো স্মেল নাইকা। এই যে গন্ধ—এই ফুলটা পেল না এই নিয়া মজার গল্প আছে।’
মিল্কি মিশুক মেয়ে বোঝা গেল তার প্রশ্নে, ‘কী গল্প স্যার বলেন না?’
রফিকুল বলে, ‘ওইটা আরেকদিন বলুম। নাও ম্যাথ বইটা নাও।’

জ্যাম ছেড়েছে। প্রায় একঘণ্টা লেগে যায় মিল্কির স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে। রফিকুল মোবাইলে কল করে, ‘মিল্কি আছো?’
কল রিসিভ করে মিল্কি বলে, ‘জ্বী। এই যে পাশেই আমিন কনফেকশনারির ভেতর।  জবাফুলের, রতনের গল্প শুনব বলে সেই থেকে বসে আছি। আপনি কই?’

দেখা হয় তাদের। একটা কমদামী হোটেলে ঢোকে। চা সিঙাড়া খায়। মুখোমুখি বসা। রফিকুলের মনে হয় সে তো আর কিছুদিন পরই মিল্কিকে চিনবে না। সে কিছু বলে না।   তার মুখ দেখে। ভাগ করে করে। ভ্রু। কপাল। চিবুক। ওষ্ঠ। কান। মিল্কি জানতে চায়, ‘কথা বলছেন না যে। কী দেখছেন?’
মানুষের এমন হয়। দেখছে এক জিনিস। ভাবছে অন্য জিনিস। আর ওই অন্য জিনিস নিয়ে ভাবনাই সে অসতর্কভাবে প্রকাশ করে ফেলে হঠাৎ। মন। তোর এত অলিগলি।   রফিকুল দৌড়াচ্ছে। এ গলি থেকে ও গলিতে। আর সামনে বসা মিল্কিকে বলে, ‘কী দেখছি? দেখছি জবাফুল।’

রফিকুলের মিল্কির হাত স্পর্শ করতে ইচ্ছা করে। বলতে ইচ্ছা করে সে আর বেশিদিন বাঁচবে না হয়তো। কিছুদিন পরই হয়তো আর কাউকে চিনতে পারবে না। স্মৃতিভ্রষ্ট হবে। বলতে ইচ্ছা, এই অল্প জীবনে সে কেন পড়াতে গিয়েছিল মিল্কিকে। মিল্কিকে কেন মনে পড়বে তার?

কিছুই বলে না।

বাসায় ফেরার পথে রফিকুল আটকা পড়ে নীলক্ষেত মোড়ে জ্যামে। একটা বাম ছাত্র সংগঠনের ছেলে মেয়েরা মিছিল বের করেছে। শ্লোগান দিচ্ছে ‘প্রহসনের নির্বাচন  চাই না। লুটপাটের ক্ষমতা চাই না। মুক্তি মুক্তি মুক্তি, মানুষের মুক্তি চাই।’

রফিকুলের শিরদাঁড়া বেয়ে ঘামের বিন্দু নামতে থাকে একের পর এক। তার মনে হলো ফের ঘটতে যাচ্ছে বিপর্যয়। একটা নেপথ্য। ব্যাকগ্রাউন্ড। আলো নেই। পিচ ডার্ক। শুধু সাউন্ড আসছে। কথা। আর অসংখ্য জবাফুল। ঝরে পড়ছে তার ওপর।

আপনারা কী ভাবছেন? চারপাশে যাদের দাঁত হাসছে তারা সেভেন্থ হেভেনে আছে আর রফিকুল দোজখের  টিকেট কেটেছে? জ্বী না... এটা দোজখই, টিকিট দরকারই নেই। এই যারা চাদ্দিকে রংচং মেখে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ টিপছে, মুচকি হাসছে, বলছে, ‘দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে...’ তারাও, ওই... দোজখেই। কিন্তু কাউকে সেটা বলছে না। অথবা, কেউ কেউ আবার জানেও না এখনো। কেউ কাউকে বলে না তো... তাই সবাই জানে যে তারা জানে না তারা দোজখে আছে, অথবা তারা সত্যিই জানে না অথবা ওই বামের মিছিলের মুখগুলোও জানে না বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। নো মোর বিপ্লব।

ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়া দুপুর যাচ্ছে বিকেলের কাছে। রফিকুলকে আমরা পড়ে থাকতে দেখি। দেখি অনেক লালজবা ঝরে পড়ছে তার ওপর। সত্যি কথা কী, এসব গপসপ তো আর রফিকুলকে বানিয়ে লাভ নেই। ইলিউশ্যুন। সব। সব।

সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষই বা কেমন দায়িত্বজ্ঞানহীন। ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা। সেদিকে নজর নেই।

থাক ওসব কথা। আমরা এরপর দেখি রফিকুল একটু পাশ ফেরে। এরপর জবাফুলের ভিড় থেকে ম্যানহোলে পড়ে যায়। তেমন কিছু না, ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন। এন্ড অব দ্যা হিস্ট্রি।

এগিয়ে আসুন, প্লিজ, না রফিকুলদের জন্য নয়। একটু ভাবতে থাকেন, রফিকুল গন্ধহীন জবাফুল কেন ভালোবাসত? আর তার পরিণতি কেনইবা হলো দুর্গন্ধযুক্ত ম্যানহোলে। সে ভেসে ভেসে এই রাজধানী ঢাকার নিচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মিশবে। বাদ দেন। আমরা বরং উপরিকাঠামোতেই ব্যস্ত থাকি। লগ আউট।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;