তিরিশ বছর আগে পার্কসার্কাসে, বাসস্টপে
'বাসস্টপে কেউ নেই।' এই বইটা কি তুমি পড়েছো কৃত্তিকা? হয়তো এই নামেরই চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের একটা গান তুমি শুনেছো।
তুমি ফিরে এলে দেখবে তোমার আলমারিতে ওরহান পামুকের 'ইস্তাম্বুল'-এর পাশে মায়ের এই বইটাও রাখা আছে। কলকাতা শহরের বাসস্টপগুলোতে এখন সত্যিই কেউ নেই।
কিন্তু আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে একদিন বাসস্টপে, ভিড় বাসস্টপেই তোমার মাকে আমি এই বইটা পড়তে দিয়েছিলাম। তোমার মা, মফস্বল থেকে কলকাতায় পড়তে আসা এক তরুণী বইটার খোঁজ করছিল। আজ তুমি কিংবা তোমার ভাই, যাঁরা অক্লেশে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে আমেরিকা কিংবা কানাডা চলে যাও, তাঁরা হয়তো বুঝবে না সেই যুগে তোমার মা কিংবা মাসীর প্রেসিডেন্সিতে পড়তে আসা টা কতটা লম্বা জার্নি ছিল।
তোমার মায়ের কথায় ফিরি। পার্কসার্কাসের রয়্যাল রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে বা কোয়েস্ট মলে সিনেমা দেখতে গিয়ে তোমাকে আমি মুসলিম গার্লস হোস্টেল টা দেখিয়েছি। কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এসে দিলখুসা স্ট্রিটের ওই মুসলিম গার্লস হোস্টেলেই থাকতেন তোমার মা। কারণ তখন প্রেসিডেন্সির কোনো গার্লস হোস্টেল ছিল না। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে, বিভাজন আর দেওয়াল তোলা দেখতে দেখতে তুমি যদি ভাবো কলকাতায় একজন মুসলিম মেয়ে পড়তে এলে তো পার্কসার্কাসের মুসলিম গার্লস হোস্টেলেই থাকবে, তাহলে ভুল করবে।
দিলখুসা স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে তোমার মা পার্কসার্কাস বাজারে চলে আসতো বহুরূপীর দফতর দেখবে বলে। তুমি তো জানো, তোমার মা নাটক করতেই চেয়েছিলেন, তাই শম্ভু মিত্রের বহুরূপীর অফিসের সামনে দিয়ে রোজ একবার হেঁটে যাওয়াটা হয়তো তীর্থদর্শনই ছিল।
আইপিটিএ বা গণনাট্য সঙ্ঘ যাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান ছিল, তাঁর জীবনে এইটুকু মুগ্ধতা তো থাকবেই। এখন যখন তুমি বেকবাগান থেকে মিঠাইয়ের পাশ দিয়ে লোয়ার রেঞ্জ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসো, তাহলে হয়তো জানতে পারবে না গত শতকের নব্বই দশকে ওই রাস্তাতে আরেকজন আইকন বড় হয়ে উঠছিলেন। লিয়েন্ডার পেজ। পরের ২৫ বছর ধরে যিনি শুধু ভারতের উজ্জলতম টেনিস নক্ষত্র হয়ে থাকবেন না, বারবার উইম্বলডন থেকে ইউ এস ওপেনে তাঁর নাম উচ্চারিত হবে।
কৃত্তিকা, তোমার জানলে পরে বুঝতে সুবিধে হবে, কলকাতায় আসার পরে যাঁর কবর তোমাকে প্রথম দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই মাইকেল মধূসূদন দত্তর বংশধর ছিলেন আমাদের প্রজন্মের ক্রীড়া নক্ষত্র লিয়েন্ডার পেজ। কলকাতার সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা, যাঁদেরকে তোমাদের প্রজন্ম হয়তো চিনেছো অঞ্জন দত্তের গান দিয়ে, সেই সব মানুষেরাও থাকতেন, থাকেন এই পার্কসার্কাস এলাকায়। মল্লিকবাজার থেকে বেকবাগান পর্যন্ত ছড়ানো এলাকাটা তোমার মায়ের সঙ্গে একটা বড় শহরের কসমোপলিটান চেহারার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল।
টুইটার, ইনস্টাগ্রাম আর উবের এর সঙ্গে বড় হওয়া তুমি বুঝতেই পারবে না পার্কসার্কাস থেকে ২৪০ নামক একটি বাস ধরে কলেজ স্ট্রিটে আসাটা তোমার মায়ের জন্য কত বড় সোশ্যাল মিলিউ-এর সঙ্গে আলাপচারিতা ছিল। ফেসবুকের চাইতেও বেশি চ্যাট হতো! কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার জন্য আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ওটাই সেরা বাস ছিল। প্রাক-সেমিস্টার পৃথিবীতে ফাস্ট ক্লাস পেতে গেলে চারটে পেপার মিলিয়ে ২৪০ পাওয়াটা বাধ্যতামূলক ছিল, কিন্তু তোমার মায়ের মতো সেই যুগের কলেজছাত্রীরা ২৪০ নম্বরের বাস পাওয়া গেলেই খুশি থাকতেন। সেই বাসে দিকপাল শিক্ষকরাও থাকতেন, যেমন ইতিহাসের রজতকান্ত রায়।
বিকেলে লাইব্রেরি ইত্যাদি সেরে তোমার মা যখন বেকবাগান এসে নামতেন, তখন হয়তো জিশান নামক একটি সদ্য খোলা রেস্তোরা থেকে রোল কিনে গুটি গুটি পায়ে হোস্টেলের দিকে হাঁটতেন। তখনও জিশান একটা সদ্য খোলা রেস্তোরাই, আরসালান পার্কসার্কাসের মোড়ে এসে জাঁকিয়ে বসেনি। সিরাজ ছিল খানিক দূরপ। আর কোয়েস্ট মলে মিশেলিন স্টার রেস্তোরায় ডিনার সারাটা জুলে ভার্নের লেখার মতোই কল্পবিজ্ঞান ছিল।
মনখারাপ হলে তুমি এখন কত কিছু করতে পারো, নেটফ্লিক্স/ আমাজন আছে, জোম্যাটো তে খাবারের সুযোগ আছে। তিরিশ বছর আগে মন খারাপ হলে তোমার মা ওই পার্কসার্কাস থেকে ২০ নম্বর ট্রাম ধরে হাওড়া চলে যেতেন, সেখান থেকে ট্রেন ধরে বর্ধমান। ২০ নম্বর ট্রামটা পার্কসার্কাস থেকে শিয়ালদহ হয়ে হাওড়া যাওয়ার ফাঁকে হয়তো তোমার মায়ের জন্য কলকাতার একটা জলছবি এঁকে দিত।
মল্লিকবাজারের মোড়ে মাইকেল-এর কবর দেখিয়ে আইস স্কেটিং পর্যন্ত যেতে যেতে তোমাকে আমি পার্কসার্কাসের অনেক কিছু একদিন আমি দেখিয়েছিলাম। শুধু তোমাকে বলা হয়নি, ওই মোড় থেকে একটা মিনিবাসও ছাড়তো। বেকবাগান থেকে সুদূর উত্তরের বি. টি. রোডের সিঁথির মোড় হয়ে চলতো মিনি। কদাচিৎ যেদিন তোমার মা ২৪০ নম্বর বাস ছেড়ে ওই মিনি ধরে বড়বাজার পেরিয়ে গিরিশ পার্কের আগে আগে মোহাম্মদ আলি পার্কে এসে নামতেন, সেদিন বাসস্টপে আমাদের দেখা হয়ে যেত। আসলে উল্টো দিকে সিঁথির মোড় থেকে ওই মিনি বাসে চেপেই আমিও কলেজে আসতাম। বাসস্টপে তোমার মা বই চাইলে জোগাড় করে দিতাম।
কৃত্তিকা, বাসস্টপে হোক কিংবা এয়ারপোর্টে, কেউ তোমাকে বই দিতে চাইলে, নেবে। সেই বই পড়বে। কে জানে কোন বই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জীবনও তো আসলে একটি বই-ই বৈকি!
সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক। কবি ও কথাশিল্পী।