কল্যাণী কাজীর 'অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ'
"আমরা লিখব, পড়ব, শিখব
অজানাকে জানব,
অজ্ঞানতা দূর করে দিয়ে
জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালবো।।"
খুব ছোটবেলায় শেখা এই গান। বয়স বাড়ার সাথে-সাথে গানের কথাগুলো এক-এক রকম ভাবে ভাবায়। সত্যিই, অজ্ঞানতা দূর করার জন্য বই পড়ার কোন বিকল্প নেই। বিশেষ প্রয়োজনে যেমন কিছু বই পড়া হয়, ঠিক তেমনই শুধুমাত্র ভালোলাগা থেকেই কিছু বই -এর পাতা বার-বার ওল্টাতে ইচ্ছে করে।
'অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ’ তেমনই একটি বই। একজন নজরুল প্রেমী হিসেবে এই বই সংগ্রহ করার ইচ্ছে আমার বহুদিনের। হঠাৎই সেই সুযোগ এলো। কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ শ্রীমতী কল্যাণী কাজী, যিনি স্বয়ং এই বইটির লেখক, উপহার দিলেন আমাকে। বই-এর শুরুতেই লিখে দিলেন - 'আদরের সোমঋতাকে...'।
এ এক পরম পাওয়া। বইটি হাতে পেয়েই পড়া শুরু করি।
প্রথমে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি বইটির প্রচ্ছদের দিকে। অসাধারণ ছবি কাজী অনিরুদ্ধর। সাদা-কালো প্রচ্ছদ যেন সত্যিই আমাকে সেই সময়ে নিয়ে যায়। এবার আসি উৎসর্গপত্রে–
"যিনি আমার মনে ‘অনির্বাণ’ প্রেম দীপশিখা জ্বেলে সত্য পথে চলার শিক্ষা দিয়েছেন, যাঁর ভালবাসার জোরে আমি সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে পেরেছি–সেই ‘অরিন্দম’ কাজী অনিরুদ্ধ – কে
‘অনিন্দিতা’ কল্যাণীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।"
চমৎকার লেখা – একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, প্রকৃতঅর্থে এই বই কাজী অনিরুদ্ধর প্রতি তাঁর পরিবারের এক বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। বইটির প্রারম্ভে, ‘আমার কৈফিয়ৎ'-এ কল্যাণী কাজী লিখেছেন–"আমার বড় ছেলে অনির্বাণ দাদু আর বাবার যা-কিছু যেখানে পায় সযত্নে সঞ্চয় করে। তাতে তার দারুণ উত্তেজনা। ও যদি ওর বাবার চিঠিগুলো যত্ন করে না রাখত, তবে আজ আমি হয়তো এই পরিকল্পনা নিতেই পারতাম না। তার এবং আমার কন্যা অনিন্দিতার উৎসাহ এ লেখার পেছনে কম নয়। এছাড়া শ্রী সুজিত নাথের রচনাটি দিতে না পারলে 'অনিরুদ্ধ স্মৃতিকথা' অসম্পূর্ণ থাকত। দাদা ভি. বালসারা, বটুক নন্দী, রজত নন্দী, দীপঙ্কর সেনগুপ্ত, কিশোর সেন, প্রনব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সমীর খাসনবীশ-তাঁদের স্মৃতিচারণার ভিতর দিয়ে মানুষ, শিল্পী অনিরুদ্ধর যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা সত্যিই আন্তরিক। কাজী অরিন্দম বাবার যোগ্য উত্তরসূরী। তার লেখার মধ্যেও পিতা অনিরুদ্ধর পরিচয় পাওয়া যাবে। সব্যসাচীর ডায়রিটা পেতে শ্রদ্ধেয় অমিতাভ চৌধুরী এবং কমল চৌধুরীর সাহায্যের জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। এই পর্যায়ে মানুষ অনিরুদ্ধ, প্রেমিক অনিরুদ্ধ, পুত্র অনিরুদ্ধ, শিল্পী অনিরুদ্ধর কিছু পরিচয় তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি তারই লেখা চিঠির ভেতর দিয়ে।”
এভাবেই একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিপত্র এবং গুণী মানুষদের স্মৃতিচারণায় বইটির পাতায় পাতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন কাজী অনিরুদ্ধ। খুবই জনপ্রিয় নজরুল সংগীত ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’–এর প্রথম লাইন কে আশ্রয় করে লেখার নামকরণ করা হয়েছে।
শুরুতে উঠে এসেছে কল্যাণী কাজীর বাল্য জীবনের কথা। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে রাঁচিতে বেড়াতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবেই কাজী অনিরুদ্ধর সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ। কল্যাণী কাজীর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে সেই দিনগুলি- “স্টেশন-এ সপ্রতিভভাবে আমাদের কাছে এসে তিনি আবার আমায় একটা মোটা খাম দিয়ে বললেন – ‘আপনার বাকি গানগুলো এতে আছে’ বোকার মত হেসে বললাম ‘ধন্যবাদ’। খামটা তাড়াতাড়ি হাত ব্যাগে রেখে দিলাম। কেননা ট্রেনে ওঠার আগে গান লেখা যে খাম তিনি আমায় দিয়েছিলেন, তা পড়ে আমার প্রাণ যাবার উপক্রম হয়েছিল। হ্যাঁ, তাতে লেখা ছিল তিনি গভীরভাবে আমায় ভালোবেসে ফেলেছেন। আমার মত একজন সাধারণ মেয়ের কাছে এ খবর ছিল খুবই অপ্রত্যাশিত। তাই প্রথমে বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। একে শিল্পীর নিছক একটা খেয়াল বলেই মনে হয়েছিল। তাছাড়া রক্ষণশীল পরিবারের কঠোর অনুশাসন উপেক্ষা করে, আমি এ ধরনের সম্পর্ককে কতটা পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারবো, সে বিষয়ে মনে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তাই প্রথম দর্শনে ভালবাসলেও তাঁকে সযত্নে এড়িয়ে চলতে চেয়েছিলাম। বুঝেছিলাম তিনি রূপে, গুনে, বুদ্ধি-বিবেচনায় আমার চেয়ে অনেক বড়। কাছাকাছি হলেই তাঁর কথায় সংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। তাঁর সাথে পরিচয়ের মধুর স্মৃতিটা মনের কোণে লুকিয়ে রেখে বন্ধুত্ব পাতাতে চেয়েছিলাম।
তিনি তাতেও রাজী হননি।তিনি এটাকে আমার অহংকার মনে করে একবার লিখলেন –‘Pearl S.Buck'- এর This Proud heart পড়ছিলাম। ওর মধ্যে একজায়গায় আছে- ‘At first I want to break your pride and then fall in love with you' খুব সুন্দর লাগল। সত্যি কথা। হঠাৎ আচমকাই তাঁর বন্ধ মনের দরজা অকপটে আমার সামনে খুলে দিয়ে আমার দ্বিধাগ্রস্ত, অর্ধচেতন মনকে চমক দিয়ে জাগিয়ে দিলেন। তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেললাম। মনের দিক দিয়ে অসহায় মানুষটার কাছে থেকে তাঁর সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবার জন্যে মন-প্রাণ উন্মুখ হয়ে থাকতো।
কিন্তু সে সুযোগ পেলাম অনেক পরে। অনিরুদ্ধ জোর করে আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে চাইলে কোন শক্তিই আমাকে আটকাতে পারত না। কিন্তু তিনি আমায় যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে কাছে পেতে চেয়েছিলেন, এখানেই তিনি অন্যের থেকে আলাদা, অনেক বড় মাপের মানুষ।”
অনেক বাধা পেরিয়ে অবশেষে এই প্রেম পরিণতি পায়। এই সময় কল্যাণী কাজীকে লেখা কাজী অনিরুদ্ধর বেশ কয়েকটি চিঠি বইটিতে স্থান পেয়েছে, সেগুলি পড়লে সহজেই অনুমান করা যায় যে তখনকার দিনে দুই পৃথক ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে ভালোবাসার কি সুদৃঢ়বন্ধন থাকলে তবেই এই প্রতিকূল পরিবেশকে অতিক্রম করা যায়।
অবশেষে এলো সেই শুভ দিন- কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ হয়ে কাজী পরিবারে পদার্পণ করলেন- কাজী অনিরুদ্ধর। কলকাতার ১৬ নম্বর, রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিটের বাড়িতে শুরু হলো তাঁদের বিবাহিত জীবন।
“ নিনি আমার মায়ের সাথে দেখা করে বলেছিলেন –যে, আমার পড়াশোনা শেষ হলে (এম.এ. পাশ করার পর) তবেই কোনও সিদ্ধান্তে আসবে। কিন্তু বাবা উঠে পড়ে লাগলেন আমায় অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়ার জন্য। ওদিকে দুশ্চিন্তায় মামণি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন বাধ্য হয়েই ১৮ বছর পূর্ণ হতেই বাড়ির অমতে আমরা রেজিস্ট্রি করে বিয়েটা সেরে রাখতে চাইলাম।
১৯৫৫ সনের ২৪শে ডিসেম্বর শনিবার দুপুর ২-১৫ মিনিট।
দক্ষিণেশ্বরে বিরজাসুন্দরী দেবীর মেয়ে অঞ্জলি সেনগুপ্ত (জটুমাসিমা ) এবং জামাই অনন্ত সেনগুপ্তর বাড়িতে রেজিস্টার B. K. Roy আমাদের দুজনের পূর্ণ সম্মতিতে বিয়ে দেন। সাক্ষী ছিলেন বীরেন সেনগুপ্ত, অনন্ত সেনগুপ্ত এবং শিবনাথ চট্টোপাধ্যায়। বিয়ের পর আমরা দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে পূজো দিতে গিয়েছিলাম। নিনি এগুলো খুব মানতেন। হাওয়াতে পূজোর ডালা থেকে মালা পড়ে যায়। নিনির খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী জীবনে যখনই কোনো অঘটন আমাদের সংসারে ঘটেছে তখনই তিনি ঐ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। নিনি আর আমার মধ্যে বোঝাপড়া এমনই ছিল যে, আমরা অনেকের অশুভ প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলাম। রেজিস্ট্রির পর নিজের বাড়িতেই ফিরে এসেছিলাম। সামনেই I.A. পরীক্ষা। পড়াশোনায় মন দিলাম। যথাসময়ে সাফল্যের সঙ্গে I.A. পাশ করে B.A. Class – এ ভর্তি হলাম। এমন সময় আমাদের জন্য চিন্তা করে মামণির শরীরের অবস্থা এত খারাপ হলো যে নিনি একদিন আমায় বলতে বাধ্য হলেন – ‘মা’র যদি কিছু হয়, তোমার আর এ বাড়িতে এসে কাজ নেই’ – তাছাড়া আমার বাড়িতে এত চরম ব্যবস্থা নেওয়া হল যে একদিন বাড়ি ছেড়ে ১৬নং রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের বাড়িতে মামনির কাছে চলে যেতে বাধ্য হলাম। বাবা-মার আশীর্বাদ ছাড়াই শুরু হল আমাদের বিবাহিত জীবন। সে আরেক কাহিনী। যেমন সুখের, তেমনি রোমাঞ্চকর।”
রাঁচি থেকে কাজী অনিরুদ্ধকে লেখা প্রমীলা দেবীর দুটি চিঠি বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। ‘নিনি’ সম্বোধন করে লেখা এ চিঠি দুটি পড়লেই বোঝা যায় যে–সেই সময় প্রমীলা দেবী তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের উপর কতখানি নির্ভর করতেন। “এই চোখের জলের সঙ্গে নিয়ত প্রার্থনা করছি, তোমার সকল অশান্তি, সব বিঘ্ন দূর হোক। বাবা, হতাশ হয়ো না। কায় মনে ওঁকে স্মরণ কর, যার কৃপায় অলৌকিক ঘটনা ঘটে। আমাদের ব্যাধির জন্যে কষ্ট কোরো না। অনেকদিন গত হয়েছে। এতে প্রাণ ভয় নেই। তুমি ছাড়া শান্তি পাওয়ার আর কিছু নাই জীবনে। তোমাকে ভালো দেখতে না পেলে এই মৃত্যুহীন প্রাণ অসহায় হয়ে ওঠে। আমারই জন্য এবং যাঁর ছেলে তুমি তাঁর প্রতি কর্তব্যবোধে মন কে সবল রাখো। ওঁর অসুখের প্রথম অবস্থায় তোমারই জন্য কেবল ব্যাকুল হতেন এবং তোমার নাম করতেন। ওঁর প্রতি সকলেরই কর্তব্য আছে, কিন্তু যে তার অর্থ না বোঝে তাকে বলা বৃথা।”
বিলেত থেকে প্রমিলা দেবী চিঠি লিখেছেন পুত্রবধূকেও। চিঠির প্রতিটি লাইনে ঝরে পড়েছে মাতৃস্নেহ।
কল্যাণী কাজীর এই একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার পাশাপাশি এই বইটিতে স্থান পেয়েছে বিশিষ্ট যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীদের স্মৃতিচারণা – তাঁরা কেউ কাজী অনিরুদ্ধকে পেয়েছেন অত্যন্ত মেধাবী, প্রতিভাবান ও মনোযোগী ছাত্র হিসেবে, আবার কেউ পেয়েছেন সহশিল্পী হিসেবে, অন্যতম গুরু হিসেবে। কাজী অরিন্দমের ‘আমার বাবা’ শীর্ষক লেখাটি নিঃসন্দেহে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে।লেখাটি শুরু হয় এভাবে – "কাজী অনিরুদ্ধ নামটা উচ্চারণের সাথে সাথে সদা হাস্যময় এক সুপুরুষের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অজাতশত্রু এই শিল্পী নিপুণ দক্ষতায় বিদেশী যন্ত্র গীটার কে স্বদেশের ঘরে-ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ভাবতে গর্ব হয় এমন একজন মহান শিল্পীর ছেলে আমি...।"
বইটির একেবারে শেষ পর্যায়ে যুক্ত হয়েছে ‘কাজী সব্যসাচীর বাল্য – স্মৃতি’। নজরুল প্রেমীদের কাছে এ এক পরম পাওয়া। কাজী সব্যসাচীর সাবলীল লেখনীতে ফুটে উঠেছে অনেক অজানা পারিবারিক কথা। কাজী অনিরুদ্ধর সংক্ষিপ্ত জীবনীও প্রকাশ পেয়েছে। লেখার পাশাপাশি অনেক দুর্লভ ছবি বইটিতে স্থান পেয়েছে – সাদা-কালো আলোকচিত্রের হাত ধরে আরও একবার ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করে।
শুধুমাত্র পারিবারিক জীবন নয়, কাজী অনিরুদ্ধর শিল্পী জীবনের কথাও অত্যন্ত সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে এই বইটিতে। পরিশেষে তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলা হয়েছে – "গীটারযন্ত্রের শিল্প সাধনায় যে ক'জন শিল্পী আজ বাংলার সুরের আকাশে আপন প্রতিভার কিরণে নিজেদের আলোকিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম কাজী অনিরুদ্ধ। সাহিত্য ও সংগীত জগতের অবিস্মরণীয় প্রাণপুরুষ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠপুত্র কাজী অনিরুদ্ধ নিজের প্রতিভা বলে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিদেশী যন্ত্র গীটারকে স্বদেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন। জন্ম – ১৯৩১ সনের ২৪শে ডিসেম্বর, মৃত্যু – ১৯৭৪ সনের ২২শে ফেব্রুয়ারি। মাত্র ৪৩ বছরের জীবনে তিনি সঙ্গীতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে দক্ষতা দেখিয়েছেন, তা বিস্ময়কর। তাঁরই স্মৃতিতর্পণ ‘অন্তরঙ্গ-অনিরুদ্ধ’।"
লেখক: সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)