মৃত্যুনীল নদের আখ্যান, পর্ব- ১



তাশরিক-ই-হাবিব (অনূদিত)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রেনিসেব নীল নদের ওপারে তাকিয়ে ছিল।

খানিকটা দূরে অস্পষ্ট থেকে ক্রমে জোরালো হয়ে ওঠা তার  দুই ভাই ইয়ামোস ও সোবেকের কথা সে শুনতে পাচ্ছিল। খেতের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় বাঁধ আরো শক্ত করা দরকার কি না সে ব্যাপারে তারা কথা বলছিল। বরাবরের মতো এখনও সোবেকের কণ্ঠস্বর ছিল গনগনে ও আত্মবিশ্বাসী।  সে সবসময় সহজে অথচ জোরালোভাবে নিজের মতামত প্রকাশে অভ্যস্ত ছিল। ইয়ামোসের কণ্ঠস্বর নিচু ধরনের ও দোদুল্যমান শোনাচ্ছিল, যাতে সন্দেহ ও উদ্বেগ প্রবল হয়ে উঠেছিল। তার চরিত্রে সবসময়ই এক ধরনের উৎকণ্ঠা বা অস্থিরতার আভাস পাওয়া যেত। সে ছিল পরিবারের বড় ছেলে এবং বাবার অনুপস্থিতিতে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোর মালিকানাধীনগুলোতে কৃষি জমিগুলো তদারকির ক্ষমতা তার আয়ত্তে থাকত। ইয়ামোস ছিল ধীরস্থির, বিচক্ষণ এবং কোনো কাজের ব্যাপারে বাধা না থাকলেও তা খুঁজে দেখা তার স্বভাবে ছিল। সে ছিল ভারিক্কি গড়নের ধীরগতির মানুষ, যার কিছুই সোবেকের সুদর্শন চেহারা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিলত না।

রেনিসেব বেশ মনে করতে পারে যে ছোটবেলা থেকেই সে তার বড় ভাইদের এ ধরনের তর্ক করতে শুনত। এ স্মৃতি হুট করেই তার মনে একধরনের নিরাপত্তা জাগিয়ে তুলত- সে নিজের বাড়িতে আবার এসেছে। হ্যা, সে বাড়িতে এসেছে...

যদিও সে আরেকবার শীর্ণ ঝলমলে নীল নদের দিকে তাকিয়েছিল, তার বিদ্রোহ ও বেদনা আবারও বেড়েছিল। কেয়, তার তরুণ সুদর্শন স্বামী মারা গিয়েছিল ...  হাসিভরা মুখ ও বলিষ্ঠ কাঁধজোড়ার অধিকারী কেয়ের ছবি রেনিসেবের মনে ভাসছিল। সে মৃতের রাজ্যে দেবতা অসিরিসের কাছে চলে গিয়েছিল। আর সে, কেয়ের প্রিয় ও ভালোবাসার স্ত্রী রেনিসেব একাই রয়ে গিয়েছিল। তারা আট বছর সংসার করেছে- যখন রেনিসেব কেয়ের কাছে যায় বিয়ের পর, সে প্রায় বাচ্চা মেয়ে- আর এখন সে বিধবা হয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছে কেয়ের বাচ্চা টেটিকে নিয়ে।

এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন এ জায়গা ছেড়ে কখনো কোথাও যায়নি...

সে সেই ভাবনায় মগ্ন হয়েছিল...

সে ঐ আট বছরের কথা ভুলে যাবে- যা অচিন্তনীয় সুখ আর প্রবল বেদনা ও ক্ষতিতে মোড়ানো।

হ্যা, ভুলে যাবে, তার মনে এসব ভাবনা আর জায়গা পাবে না।  সে আবার হয়ে সমাধিসৌধের পুরোহিত ইমহোটেপের চিন্তামুক্ত, নির্মল মেয়ে। স্বামী ও ভাইয়ের ভালোবাসা আসলে নির্দয়তার ব্যাপার, মধুরতার আড়ালে যা তাকে শুধু প্রতারিতই করেছে। তার মনে পড়ে তামাটে রঙের বলিষ্ঠ কাঁধজোড়ার অধিকারী হাসিমাখা মুখের সেই মানুষটিকে- মাদুলি বেঁধে সুরক্ষিত করে, ব্যান্ডেজে মুড়ে যাকে কবর দেয়া হয়েছে অন্য এক ভুবনে যাত্রার জন্য। কেয় আর এ জগতে নেই- নীলনদে নৌকা চালাতে এবং মাছ ধরতে এবং  রোদের মধ্যে হাসতে, যখন রেনিসেব  নৌকার ভেতর ছোট টেটিকে নিজের কোলের ভাঁজে জড়িয়ে সামনের দিকে বসাত আর তার দিকে পেছনে ফিরে হাসত ...

রেনিসেব ভাবছিল:

আমি এসব নিয়ে আর চিন্তা করব না। আমি বাড়িতে এসেছি। সবকিছু আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। এখন আমাকেও আগের মতোই হতে হবে। সব আবার আগের মতো হবে। টেটি ইতোমধ্যে সেসব ভুলেও গেছে। সে এখানকার অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে হাসছে, খেলছে।

রেনিসেব  হঠাৎ করে ঘুরে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল,  তখন বোঝা বহনকারী কয়েকটি গাধাকে নদীতীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সে শস্যক্ষেত ও সংলগ্ন বাড়িঘর পেরিয়ে প্রবেশপথ দিয়ে উঠোনে চলে এল। উঠোনটি ছিল বেশ আরামদায়ক। সেখানে কৃত্রিম লেক ছিল, যার চারপাশ করবী ও জুঁই ফুলের গাছে শোভিত আর এর পাড় সারি সারি ডুমুরগাছের ছায়ায় ঢাকা ছিল। টেটি ও অন্য বাচ্চারা সেখানে খেলছিল, তাদের গলার আওয়াজ বেশ জোরে স্পষ্টভাবে তার কানে এল। লেকের একদিকে আলাদা সীমানাচিহ্নিত  ছোট একটি জায়গা ছিল। বাচ্চারা এর ভেতরে-বাইরে বারবার আসা-যাওয়া করছিল। রেনিসেব খেয়াল করেছিল যে টেটি কাঠের একটি সিংহ নিয়ে খেলছিল, যেটির মুখ দড়ি দিয়ে টানলে খোলে ও বন্ধ হয়। এটি এমন একটি খেলনা, যেটি সে ছোটবেলায় ভালোবাসত।  সে আবারো নিশ্চিন্তমনে ভাবল “আমি বাড়িতে এসেছি ...” এখানকার কিছুই বদলায়নি; আগে যেমন ছিল সব এখনো তেমনই আছে। এখানে জীবন নিরাপদ, আগের মতোই প্রাণবস্ত। টেটি এখন বাচ্চা এবং সে  এ বাড়ির অন্য মায়েদের একজন যারা ঘরের দেয়ালের ঘেরাটোপে বন্দী, কিন্তু  সবটা মিলে এ জায়গাটি আগের মতোই রয়ে গেছে।

একটি বাচ্চা যে বলটি নিয়ে খেলছিল, সেটি তার পায়ের কাছে গড়িয়ে এল। রেনিসেব সেটি তুলে নিয়ে হাসিমুখে তার দিকে ছুঁড়ে দিল।

রেনিসেব উজ্জ্বল রঙা থামঘেরা বারান্দা দিয়ে ঢুকে বাড়ির ভেতরে যায় ঠিক মাঝের বিশাল ঘরটি পেরিয়ে, যেটির দেয়ালজোড়া পর্দাগুলো পদ্মফুল ও পপি ফুলের সাজে শোভিত ছিল। এটি পেরিয়ে তবেই বাড়ির অন্দরমহল।

ক্রমে জোরালো হতে থাকা কণ্ঠস্বরগুলো তার কানে ধাক্কা খাচ্ছিল আর তাই সে আবার থেমে গিয়েছিল, আনন্দের আভাস সেসব গলার স্বরে যেন মিশে গিয়েছিল। সাতিপি ও কাইট বরাবরের মতোই তর্ক করছিল। সাতিপির চড়া ও কর্কশ ধরনের হুমকিদায়ক গলা কি কখনো ভোলা যায়! সাতিপি রেনিসেবের বড়ভাই ইয়ামোসের স্ত্রী, লম্বা ও বলশালী, উচ্চকণ্ঠের মহিলা, যার চেহারায় কমনীয়তা প্রায় ছিলই না আর যে আদেশ দিতেই বরাবর অভ্যস্ত! সে প্রচলিত নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাগুলি দেখাতে ওস্তাদ ছিল, চাকরবাকরদের নাস্তানাবুদ করত, সবকিছুতেই দোষ খুঁজত, কড়া মেজাজ আর হুমকি ধামকির পাশাপাশি জাঁকালো ব্যক্তিত্ব ফলিয়ে অসম্ভবকেও সে সম্ভব করে তুলত। সবাই তার খরজিভকে ভয় পেত বিধায় তার আদেশ দৌড়ে পালন করত। ইয়ামোসের যদিও তার দৃঢ়চেতা ও জেদি স্বভাবের স্ত্রীর প্রতি ভালোলাগা ছিলই, তবু সে স্ত্রীর গালাগাল শুনতে এতটাই প্রস্তুত ছিল, যা রেনিসেবকেও  প্রায়ই ক্ষিপ্ত করত।

সাতিপির উচ্চকণ্ঠে বলে চলা বাক্যবাণের বিরতি ঘটলে শুধু তবেই কাইটের বাধাপ্রাপ্ত শান্ত গলা শোনা যেত। সুদর্শন সোবেকের স্ত্রী কাইট দেখতে চওড়া গড়নের সাদাসিধা ধরনের মহিলা ছিল। নিজের ছেলেমেয়েকে নিয়েই যেন তার দিনদুনিয়া গুজরান হতো, অন্য কোনো বিষয়ে বা আলাপে তার আগ্রহ কখনো প্রকাশিত হত না। কাইট জা সাতিপির সঙ্গে নিত্যদিনের তর্কে বেশ সহজেই  বুঝিয়ে দিত সে কোন দিকটির প্রতি গুরুত্ব দিতে চাইছে। সে তার আচরণে ভালোবাসা বা ঘৃণা কোনোটাই প্রকাশ করত না, নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাতো না।  সোবেকের সঙ্গে তার স্ত্রীর বোঝাপড়া নিবিড় ছিল এবং সে তার যাবতীয় বিষয়াদি নিয়েই কাইটের সঙ্গে অনায়াসে আলাপ করত। সে বুঝতে পারত যে তার স্ত্রী আলাপের জন্য প্রস্তুত, তাদের বোঝাপড়ায় সম্মতি ও মতবিরোধ দুটোই ছিল এবং তাতে তাদের কোনো অসুবিধা হত না। কেননা কাইটের  মনে ছেলেমেয়েদের ভালোমন্দ ও তাদের দেখাশোনার ব্যাপারে একধরনের উৎকণ্ঠা সবসময়ই বিরাজ করত।

“এটা একধরনের জুলুম, আমাকে তা বলতেই হবে,” সাতিপি খেঁকিয়ে ওঠে। “যদি ইয়ামোসের একটি ইঁদুরের সাহসও থাকে, সে তা এক মুহূর্তের জন্য বরদাস্ত করবে না! কে এখন এ বাড়ির কর্তা, ইমহোটেপের অনুপস্থিতিতে? ইয়ামোস! কাজেই ইয়ামোসের স্ত্রী হিসেবে ভালো মাদুর ও বালিশগুলো বেছে নেয়ার প্রথম সুযোগ আমারই প্রাপ্য! ঐ জলহস্তীমুখো কালো চাকরটাকে অবশ্যই আমি দেখে নেবো ...”

কাইটের ভারী, উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায়:

“না, না, আমার সোনামাণিক, তোমার পুতুলের চুলগুলো খেয়ো না। দেখো, এখানে এর চেয়েও ভালো কিছু আছে - একটি মিষ্টি- বাহ, কত মজা ...”

“দেখ কাইট, তোমার দেখছি ভদ্রতা বলে কিছুই জানা নেই; এমনকি আমি কি বলছি তাও তুমি কানে তুলছো না - জবাবে কিছু বলছো না - তোমার ব্যবহার আসলেই অসভ্যদের মতো।”

“ঐ নীল বালিশটা সবসময় আমারই ছিল ... আহা, ছোট আঙ্কের দিকে দেখো, সে হাঁটতে চেষ্টা করছে ...”

“তুমি তোমার বাচ্চাদের মতোই নির্বোধ, কাইট। এবং সেটা একটা ভালো ব্যাপার! কিন্তু তুমি সেটি চাইলেই পাবে না। এটা আমারই হবে, তোমাকে স্পষ্ট বলছি।”

 রেনিসেব কারো পায়ের মৃদু আওয়াজ তার পেছনে শুনতে পায়। সে চটজলদি ঘুরেই পেছনে বাড়ির পুরনো পরিচারিকা হেনেটকে দেখে বিরক্ত হয়। হেনেটের পাতলা গড়নের মুখে বরাবরের মতো অর্ধহাসির ভঙ্গিটি লেপ্টে ছিল।

”কিছুই তেমন বদলায়নি, তুমি নিশ্চয়ই এমন কিছু ভাবছ, রেনিসেব, সে বলল। “আমরা কীভাবে যে সাতিপির ঐ হেঁড়ে গলা সহ্য করি,  জানি না! কাইট অবশ্যই পরে এর জবাব দিতে পারে। আমরা কেউই তেমন ভাগ্যবান নই। আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে জানি, তোমার বাবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই, এ বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের পাশাপাশি খাওয়া পড়ার বন্দোবস্ত করার জন্য। আহ! তোমার বাবা সত্যিই একজন ভালো মানুষ। এবং আমিও সেজন্য যা করা উচিত, সাধ্যমতো তা করতে চেষ্টা করি। আমি সবসময় কাজেই ব্যস্ত থাকি - কখনো এখানে, কখনো ওখানে - এর বিনিময়ে আমি কখনো ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রত্যাশা করি না। তোমার স্নেহময়ী মা আজ বেঁচে থাকলে ব্যাপারটা অন্যরকম হত। তিনি আমার প্রশংসা করতেন। যেন বোনের মতোই আপন ছিলাম আমরা! তিনি খুব সুন্দরী ছিলেন। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তাকে দেয়া প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেছি ‘বাচ্চাদের দেখে রেখো, হেনেট ’, মৃত্যুকালে তিনি বলেছিলেন। আর আমিও তাকে যে কথা দিয়েছিলাম, তা এখনও পালন করে চলেছি, তোমাদের সবার দেখাশোনার জন্যই, এবং বিনিময়ে ধন্যবাদটুকুও চাইনি। সেজন্য প্রশ্নও তুলিনি এমনকি তা পাইওনি! আমি শুধু সবাইকে সাহায্য করতেই চেয়েছি আর তা-ই যথেষ্ট ছিল। সে রেনিসেবের বগলের নিচ দিয়ে প্রায় পিছলেই যেন ভেতরের কামরায় ঢুকে পড়ে।

“ঐ বালিশগুলো সম্পর্কে, আমাকে কিছু বলতেই হবে সাতিপি কিছু মনে করো না। আমি শুনেছিলাম সোবেক বলছিল-” রেনিসেব সরে যায় সেখান থেকে। হেনেটের প্রতি তার পুরনো বিরক্তি আবার মাথা চাড়া দিচ্ছিল। এটা খুবই পরিতাপের ব্যাপার যে বাড়ির সবাই হেনেটকে অপছন্দ করে। ঘ্যানঘ্যানে গলায় নিজের অনর্গল প্রশংসা এবং একের কথা অন্যকে লাগিয়ে তাদের মধ্যে বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে সে কদর্য পরিতৃপ্তি পেত।

“যা হোক, ভালোই,” রেনিসেব ভাবছিল, “কেন নয়?” এটাই সে ভেবেছিল, এভাবেই হেনেট মজা পেতে চায়! তার জন্য জীবন তবে উপভোগ্য - এটা ঠিক যে সে যেন সব কাজ থেকে ছিটকে পড়েছিল আর এবং কেউই তার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল না। তুমি কখনোই হেনেটের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারো না- রেনিসেব নিজের বিবেচনার প্রতি নিবিড় মনোযোগ সহকারে এটাই ভাবছিল যে এর ফলে তার মনে উদারতা অনুভূত হচ্ছিল। সে ভাবছিল, হেনেট হচ্ছে সেসব মানুষের একজন যাদের নিয়তিই নির্দিষ্ট থাকে অন্যদের প্রতি সমর্পণে এবং তাদের প্রতি কেউ নিবেদিত নয়। সে দেখতে কুশ্রী ও স্বভাবে নির্বোধ ধরনের হলেও বেশ ভালোই জানত যে বাড়িতে কখন কী ঘটে চলেছে। নিঃশব্দে তার পা ফেলে হাঁটা, তার অতি খাড়া কানজোড়া এবং দ্রুত ঘুরিয়ে ফেলা চোখজোড়া মিলেমিশে এমন অবস্থা সৃষ্টি করত যে  কেউই তার কাছ থেকে বেশিক্ষণ কোনো কিছু আড়াল করতে পারত না।

কখনো বা সে নিজের এই পটুতায় নিজেই অভিভূত হত -অন্য সময়ে সে একজন থেকে দ্রুত আরেকজনের কাছে গিয়ে ফিসফিস করত এবং আনন্দের সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তার লাগানো কথার ফল খুঁটিয়ে পরখ করত।

বাড়ির লোকজন বারবার ইমহোটেপের কাছে গিয়ে হেনেটকে বাড়িছাড়া করার অনুনয় জানালেও সে এসব ব্যাপারে কখনো কর্ণপাত করত না। বাড়িতে সেই ছিল একমাত্র ব্যক্তি, যে হেনেটকে পছন্দ করত। ইমহোটেপের পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিদান হেনেট এতটা বিশ্বস্তভাবে পরিশোধ করত যে পরিবারটির অন্য সকলের কাছে তা সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছিল।

রেনিসেব সেখানে অনিশ্চিতভাবে অল্পক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, তার ভাবীদের তীব্র কোলাহল তার কানে বাজছিল, যা হেনেটের দৌরাত্ম্যে আগুনের মতো গনগনে আঁচ ছড়াচ্ছিল। কাজেই রেনিসেব সেই জায়গা ছেড়ে তার দাদীমা এশার ছোট কামরায় ধীর পায়ে হাজির হয়েছিল। সেখানে এশার পাশে অল্পবয়সী কালো দুটি দাসীও ছিল। তারা তাকে লিনেনের জামাকাপড় দেখাচ্ছিল আর সে সেগুলো দেখে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাদেরকে মৃদু বকাঝকা করছিল।

হ্যা, এসবই আগের মতো আছে। রেনিসেব সবই দেখছিল, শুনছিল। বৃদ্ধা এশা খানিকটা বুড়িয়ে গিয়েছিল, এটুকুই তার কাছে নতুন মনে হয়েছিল। কিন্তু এশার কণ্ঠস্বর এবং কথা বলার ভঙ্গি আগের মতোই রয়েছে, একের পর এক ঠিক সেভাবেই, যেভাবে আট বছর আগে এ বাড়ি ছেড়ে রেনিসেব চলে যাবার আগেও এশা বলত...

রেনিসেব সেখান থেকেও সরে এল। বৃদ্ধা দাদী বা দাসী দুটি তাকে খেয়াল করেনি। অল্প সময় নিয়ে সে রান্নাঘরের খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। সেখানে হাঁস ঝলসানোর ঘ্রাণ, হরদম আলাপ, হাসাহাসি, বকাঝকা-টিপ্পনির আমেজ যথারীতি ছিল, সবজি রান্না করার প্রস্তুতিও যথারীতি চলছিল।

রেনিসেব চোখজোড়া অর্ধেক বন্ধ রেখে সেখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এখান থেকে সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল বাড়ির কোথায় কী হচ্ছে! রান্নাঘরের হট্টগোল, বৃদ্ধা এশার তীক্ষ্ম গলা, সাতিপির বাঁজখাই কণ্ঠ এবং কাইটের অস্পষ্ট ও মৃদুস্বরের পাল্টা জবাব। সবকিছু মিলে যেন নারীকণ্ঠের অদ্ভুত জগাখিচুড়ি - আলাপ, হাসিঠাট্টা, অভিযোগ, বকাঝকা, উল্লাসে ফেটে পড়া...

এবং হঠাৎ করেই রেনিসেবের এ পরিবেশটা যেন গুমোট লাগছিল, চারপাশটা যেন নারীদের খবরদারিতে বড্ড আঁটোসাঁটো। নারীরা স্বভাবে বরাবর কোলাহলমুখরা! তারা অন্তঃপুরের বাসিন্দা - কখনোই শান্ত ও স্থির নয়, সর্বদাই বকবক করছে, উচ্চকণ্ঠে চেঁচাচ্ছে, - অন্য কিছুই যেন তাদের করার নেই!

এবং কেয় নৌকায় বসা অবস্থায় মাছের দিকে নীরবে লক্ষ্য রাখছিল হাতে বর্শা ধরে...

এই অবিচ্ছিন্ন হট্টগোলের লেশমাত্র সেই স্মৃতিতে ছিল না।

রেনিসেব দ্রুত বাড়ির বাইরে আবার চলে গেল, যদিও সেখানে ছিল স্পষ্ট নীরবতা। সে ফসলের মাঠ থেকে সোবেককে ফিরতে দেখে। ইয়ামোসকে দূর থেকে সমাধিসৌধের দিকে যেতে দেখা গেল।

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে চুনাপাথরের টিলাসংলগ্ন পথটি ধরে এগিয়ে যায় সমাধিসৌধের দিকে। এটি ছিল মহান মেরিপাথার সমাধি, যেটি দেখাশোনার ভার ছিল তার বাবা ইমহোটেপের। সমাধিসৌধটি দেখাশোনার জন্য যা অনুগ্রহপূর্বক দান করা হয়েছে, সবই এ জমিদারি ও কৃষি জমির অংশ। ইমহোটেপ কোথাও গেলে সমাধিসৌধ দেখাশোনার ভার ইয়ামোসের ওপর বর্তায়।

যখন রেনিসেব ধীরে ধীরে খাড়া পথ বেয়ে ওপরের দিকে উঠছিল, ইয়ামোসের সঙ্গে হোরিকে পরামর্শ করতে দেখা গেল। হোরি হলো তার বাবার ব্যবসায়িক বন্দোবস্তের হিসাবরক্ষক। সমাধিসৌধ সংলগ্ন যে গুহায় উপহার নিবেদন করা হয়, তার পাশের ছোট একটি পাথুরে গুহায় তারা বসেছিল।

হোরির হাঁটুর ওপর একটি প্যাপিরাস বিছানো ছিল এবং দুজনেই এটির ওপর ঝুঁকে ছিল।

দুজনই রেনিসেবকে সেখানে দেখে মৃদু হাসল।  সে তাদের পাশেই ছায়ায় বসল। রেনিসেব বরাবর ইয়ামোসের ভক্ত। ইয়ামোস স্বভাবে শান্ত, রেনিসেবের প্রতি মমতা তার মনে প্রবল। হোরিও ছোট রেনিসেবকে আপনজনের মতো দয়ালুভাবে দেখত, কখনো বা তাকে খেলনা বানিয়ে দিত।  কিশোরী বয়সে যখন সংবেদনশীল ও লম্বা আঙুলের অধিকারী  রেনিসেব বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল বিয়ের পর, হোরি তখন ধীরস্থির এক যুবক। রেনিসেব এতদিন পর তাকে এখানে দেখে ভাবছিল, যদিও হোরির বয়স বেড়েছে, তবু সে দেখতে প্রায় আগের মতোই আছে। যে স্মিত হাসিটি সে রেনিসেবকে উপহার দিল, তাও তার স্মৃতিতে আগের মতোই মনে হয়েছিল।

ইয়ামোসে ও হোরি নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিল:

“ছোট ভাই আইপির সঙ্গে তিয়াত্তর বস্তা বার্লি ...”

“তাহলে মোট দুইশত ত্রিশ বস্তাা আর এর মধ্যে একশ বিশ হলো বার্লি।”

“হ্যা, কিন্তু এখানের কাঠের দাম রয়েছে, এবং তেলের বিনিময়ে ফসল পরিশোধ করা হয়েছে ...

তাদের আলাপ চলছিল। রেনিসেব তন্দ্র্াচ্ছন্নভাবে সেখানে বসে থাকলেও তাদের অস্পষ্ট আলাপ তার কানে আসছিল। একটু পর ইয়ামোস প্যাপিরাসের টুকরোটি গোলাকারভাবে মুড়িয়ে হোরির হাতে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

রেনিসেব নীরবতাকে সঙ্গী করে সেখানে বসে রইল।

এবার সে গোলাকারভাবে মোড়ানো একটি প্যাপিরাস হাতে নিয়ে জানতে চাইল, “এটা কি আমার বাবা পাঠিয়েছে?”

হোরি মাথা ঝাঁকায়।

“কী লেখা আছে এতে?” সে কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

রেনিসেব প্যাপিরাসটি মেলে ধরে এবং এতে দাগানো চিহ্নগুলো তার নিষ্পন্দ চোখজোড়ায় অর্থহীন মনে হয়।

মৃদু হেসে হোরি তার কাঁধ ঝুঁকিয়ে প্যাপিরাসের লেখায় আঙুল ছুঁয়ে তা পড়তে থাকে। এ চিঠিটি পেশাদার চিঠি লেখক হেরাক্লোপোলিশের চিঠি লেখার অলংকরণ অনুসরণে বিন্যস্ত হয়েছে:

“এই জমিদারির তদারককারী, পুরোহিত ইমহোটেপ বলছি: যারা বহুকাল যাবত স্বস্তিতে বেঁচে থাকে, তোমাদের অবস্থাও তেমনই হোক। প্রভু হেরিসাফ, হেরাক্লোপোলিশের প্রভু এবং ও অন্য সব দেবতা তোমাদের মঙ্গল করুন। দেবতা পিতাহ তোমাদের হৃদয় আনন্দে ভরিয়ে দিন, যারা দীর্ঘদিন বাঁচে তাদের মতো। ছেলে তার মাকে বলছে, পুরোহিত তার মা এশাকে বলছে. তুমি কেমন আছো? নিরাপদ ও সুস্থ আছো তো? গার্হস্থ্য জীবন উপভোগ করছ তো? আমার ছেলে ইয়ামোস, তুমি জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যময় প্রাচুর্যে ভরপুর তো?  আমার জমি যথাসাধ্য কাজে লাগাবে। জমির কাছ থেকে যতটা সম্ভব কশে আদায় করো, প্রয়োজনে জমি খনন কনে কাজের ভেতর আকণ্ঠ ডুবে থাকো। যদি জানতে পারি যে তুমি কঠোর পরিশ্রমী, তবে তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হব প্রভুর কাছে।” রেনিসেব হাসে।

“বেচারা ইয়ামোস! সে কঠোর পরিশ্রম করে, তাতে আমার মোটেই সন্দেহ নেই।”

বাবার উৎসাহব্যঞ্জক প্রাণবন্ত ভাবটি যেন রেনিসেবের চোখের সামনে ভেসে ওঠে- এর পাশাপাশি ইমহোটেপের জমকালো, খানিকটা উচ্ছৃঙ্খল, অবিরাম নির্দেশনাসম্বলিত চেহারাটিও পাশেই ছিল।

হোরি উঠে দাঁড়ায়:

“আমার ছেলে আইপির দিকে খেয়াল রাখবে। আমার কানে এসেছে, সে নাকি অসন্তুষ্ট। আরো খেয়াল রাখবে, সাতিপি যেন হেনেটের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। শণ ও তেল সম্পর্কে চিঠি লিখে জানাতে ভুলবে না। আমার জমির উৎপাদিত ফসল নিষ্ঠার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করবে। আমার বিষয়াদি ভালোভাবে দেখাশোনা করবে কারণ এজন্য তোমাকেই আমি দায়ী করব। আমার জমি বানে ভাসলে তোমার ও সোবেকের কপালে শনি আছে।”

“বাবা আগের মতোই আছে” রেনিসেব সুখী গলায় বলে। “সবসময় ভাবে যে সে না থাকলে কিছুই ঠিকঠাক চলবে না।”

সে প্যাপিরাসটি গোলাকারভাবে গুছিয়ে বলতে থাকে:

“সবকিছুই আগের মতো আছে ...”

হোরি জবাব দেয় না।

সে এক টুকরো প্যাপিরাস নিয়ে লিখতে শুরু করে। রেনিসেব অলস ভঙ্গিতে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। সে পড়তে খুব আগ্রহী ছিল।

স্বপ্নের ঘোরে সে বলে চলেছিল:

“এটা জানা বেশ মজার মনে হয়, কীভাবে প্যাপিরাসে লিখতে হয়। কেন সবাই লিখতে শেখে না?”

“এর প্রয়োজন নেই।”

“প্রয়োজনীয় নয়, সম্ভবত, কিন্তু এটা শেখা আনন্দের হবে।”

“তোমার তাই মনে হয়, রেনিসেব কী এমন ভিন্নতা ঘটবে তোমার ক্ষেত্রে?”

 রেনিসেব অল্প সময় নিল এর জবাব দিতে। তারপর ধীরে বলল:

“তুমি যখন এ প্রশ্ন কর, এর জবাবে কী বলতে হবে আমার সত্যিই জানা নেই, হোরি”

হোরি বলে, “এখন আসলে অল্প সংখ্যক লেখককে দিয়েই একটি বড় প্রদেশের কাজ দিব্যি চলে যাচ্ছে। কিন্তু সামনে এমন দিন আসবে, যখন সারা মিশরে লেখকদের বিরাট বাহিনী থাকবে। আমরা মিশরের স্বর্ণোজ্জ্বল আমলের শুরুর দিকে আছি।”

“এটা নিশ্চয়ই ভালো ব্যাপার” রেনিসেব বলে।

হোরি ধীরে বলে, “আমি নিশ্চিত নই।”

“কেন তুমি নিশ্চিত নও?”

“কারণ রেনিসেব এটা খুব সহজ বা তেমন পরিশ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার নয় - দশ বস্তা বার্লির বা একশ গবাদি পশুর বা দশটি ক্ষেতের ফসলের হিসাব লিখে রাখা - এবং যখন এসব লেখা হবে, তখন হয়ত মনে হতে পারে যে সব তো ঠিকই আছে। কাজেই তখন হিসাব লেখকরা ও কেরানিরা যখন ঐসব জমির চাষাদের কাছে আসে এবং যারা জমিতে বার্লি বোনে এবং গবাদি পশু চড়ায়, তাদের কাছে এলে হিসাব লেখকদের মনে হতে পারে যে কৃষি জমি ও উৎপাদিত বার্লি এবং গবাদি পশু  সবই বাস্তবে আছে - এগুলো প্যাপিরাসের ওপর নিছক কালির চিহ্ন নয়। এবং যখন সব দলিল-দস্তাবেজ এবং হিসাব লেখা প্যাপিরাস নষ্ট হয়ে যাবে, হিসাব লেখকরা শঙ্কিত নাও হতে পারে এজন্য যে চাষারা জমিতে কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলায় ও কাটে, তারা বিতাড়িত হলেও মিশর দিব্যি বাঁচবে। কারণ জমি, ফসল ও গবাদি পশু থেকে যাবে।”

রেনিসেব গভীর মনোযোগ দিয়ে হোরির কথা শুনছিল। সে এবার ধীরগলায় বলে “আমি এবার বুঝতে পারছি, তুমি কি বলতে চাও। তুমি যা চোখে দেখো ও ছুঁতে পারো, সেগুলোই প্রকৃত বস্তু ... লেখার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন যে ‘আমার দুইশত চল্লিশ বস্তা বার্লি আছে’ মানে তোমার এর চেয়ে কম পরিমাণ বার্লি নেই। তার মানে একজন চাইলেই মিথ্যা লিখতে পারে।”

হোরি রেনিসেবের গুরুগম্ভীর মুখের দিকে তাকায়। সে হঠাৎই বলে ওঠে:

“তুমি আমার খেলনা সিংহটা মেরামত করে দিয়েছিলে, অনেক আগে। মনে পড়ে?”

“হ্যা, দিব্যি মনে আছে, রেনিসেব।”

“টেটি এখন ওটা দিয়ে খেলে ... সেই সিংহটাই”।

খানিক থেমে সে আবার বলে,

“কেয় যখন অসিরিসের কাছে চলে যায়, আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি আবার বাড়িতে ফিরে এসেছি এবং আমি আবার সুখী হব এবং কষ্টের সেই স্মৃতি ভুলে যাব - কারণ এখানে সবকিছুই আগের মতো আছে। কিছুই যেন বদলে যায়নি।”

“তুমি সত্যিই তাই মনে কর?”

রেনিসেব সতর্কভাবে তার দিকে তাকায়।

“তুমি কি বলতে চাও, হোরি?”

“আমার মনে হয় সবসময়ই বদল ঘটছে। আট বছর আদতে আট বছরই।

“কিছই বদলায়নি এখানে।” রেনিসেব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে।

“তাহলে পরিবর্তন তো হতেই হবে।”

রেনিসেব সতর্কভাবে বলে ওঠে

“না, না, আমি চাই সবকিছু আগের মতোই থাকুক।”

“কিন্তু তুমি নিজেই তো আগের সেই রেনিসেব আর নও, যে তার স্বামী কেয়ের কাছে চলে গিয়েছিলে।”

“হ্যা, আমি আগের মতোই আছি। আর যদি তা না-ও হয়, তবে আবার আগের মতোই হব।”

হোরি মাথা নাড়ে।

“তুমি পেছনে ফিরে যেতে পারো না, রেনিসেব। এটা অনেকটা আমার দেয়া হিসাবের মতো। যেমন - আমি একটা কিছুর অর্ধেক নিচ্ছি, এর সঙ্গে সিকিভাগ যোগ করছি, তারপর দশ ভাগের এক ভাগ এবং তারপর বিশ ভাগের চার ভাগ - এবং সবশেষে, তুমি দেখতোই পাচ্ছো, এটা পরিমাপে অন্য কিছু হবে, সবমিলিয়ে।”

“কিন্তু আমি আগের সেই রেনিসেবই।”

“কিন্তু রেনিসেব ইতোমধ্যে সময়ের ¯্রােতে ভেসে আরো নতুন কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাই সে সবসময়ই আরো ভিন্ন মানুষ।”

“না, না। তুমি আগের সেই হোরিই আছো।”

“তুমি তা ভাবতে পারো। কিন্তু ব্যাপারটা আদতে তা নয়।”

“হ্যা, তাই। ইয়ামোস আগের মতোই যেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তেমনি উদ্বিগ্ন। সাতিপি তাকে আগের মতোই একইভাবে গালমন্দ করছে এবং সাতিপির সঙ্গে কাইটের মাদুর বা বিছানা নিয়ে কথা কাটাকাটি আগের মতোই যথারীতি চলছে। আমি যখন ফিরে যাব, দেখব যে তারা যথারীতি হাসাহাসি করছে, যেন সবচেয়ে ভালো বন্ধু! হেনেট এখনো চুপিসারে কান পেতে অন্যের কথা শোনে এবং তার হাহাকার ও ভক্তি আগের মতোই আছে এবং আমার দাদীও তার ছোট দাসীটিকে বকাঝকা করে, লিনেনের জামাকাপড় তদারকির ব্যাপারে। এসবই আগে থেকে দেখা আর বাবা বাড়ি ফিরে এলে যথারীতি হৈচৈ হবে এবং তিনিও অভিযোগ করবেন, “তুমি এটা এখনো করোনি কেন?” এবং “তোমার এটা করা উচিত ছিল”। তখন ইয়ামোসে উদ্বিগ্ন হবে এবং সোবেক হাসবে আর গর্ব করবে এবং বাবার উস্কানিতে সে ইচড়ে পাকা হবে। তার বয়স মাত্র ষোল আর আট বছর থেকেই সে আস্কারা পেয়ে বিগড়াতে শুরু করেছে। এসব কিছুই আগের মতো যথারীতি চলছে, কিছুই বদলাবে না!” একনাগাড়ে গড়গড় করে বলা কথা সে থামায়।

হোরি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুভাবে বলে:

“তুমি বুঝতে পারছ না, রেনিসেব। একটি শয়তান বাইরে থেকে এসে আক্রমণ করলে সারা পৃথিবী তা দেখে। কিন্তু অন্য ধরনের পচনও আছে, যা ভেতর থেকে সংক্রমণ ঘটায়, যার কোনো লক্ষণ বাইরে থেকে বোঝা যায় না। এটা দিনের পর দিন অল্প অল্প করে বাড়ে, শেষ পর্যন্ত ফলটি পচে যায় -  খেলে রোগ হয়।”

রেনিসেব তার দিকে তাকায়। সে প্রায় আনমনেই বলে যায়, যেন সে রেনিসেবকে নয়, বরং বিড়বিড় করে নিজেকেই বলছিল।

রেনিসেব আর্তনাদ করে ওঠে:

“ তুমি এসব কী  বলছ, হোরি? তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ।”

“আমি নিজেই ভীত।”

“কিন্তু তুমি কী বোঝাতে চাও? কোন শয়তানের ব্যাপারে তুমি বললে?”

হোরি রেনিসেবের দিকে তাকায় এবং হঠাৎকরেই হাসে।

“বাদ দাও রেনিসেব, আমি কী বলেছি সেসব! যেসব রোগ শস্যখেতে হানা দেয়, সেগুলো নিয়েই ভাবছিলাম।”

রেনিসেব এতক্ষণে মুক্তি পায়।

“আমি আনন্দিত। আমি ভাবছিলাম - আমি জানি না আসলে কী ভাছিলাম”

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;