রাজ্জাককে উদ্ভাসিত করার এক জীবনালেখ্য
‘ফাঁসির দড়িতে ঝুললেও সাক্ষ্য দেবো না’- স্পষ্ট করেই পাকিস্তানি সেনাদের জানিয়ে দিলেন সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক। প্রায়-আবদ্ধ একটি ঘরের মেঝেতে শোয়ানো হলো তাঁকে। এরপর বরফে ঢেকে দেওয়া হলো তাঁর উদোম শরীর। দীর্ঘদেহী একজন ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছেন বরফে ঢাকা রাজ্জাকের পাশে। বরফের ঠান্ডায় শরীর ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে আসছে। এই বুঝি দেহ থেকে প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে- মনে হচ্ছিল রাজ্জাকের। আর তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার সেনাদের বললেন- ‘দ্রুত বের করুন, মারা যাবে।’ ডাক্তারের অনুমতি পেয়ে সেনারা বরফ থেকে রাজ্জাককে বের করে আনল। এবার অত্যাচারের মাত্রায় খানিকটা ভিন্নতা, তবে তীব্রতর। ফুটন্ত গরম জলভর্তি ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো রাজ্জাকের শরীর। কিছুক্ষণ পর আবার গরম জলের ব্যাগের নিচ থেকে তাকে তুলে ফেলে রাখা হলো মেঝেতে।
সন্ধ্যা হলেই নেমে আসত নরকযন্ত্রণা। দুই হাত টান করে রশি দিয়ে বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো তাকে। হাতের প্রতিটি আঙুলের ডগায় ইলেক্ট্রোনিক সুচ লাগানো থাকত। ঘুম এলে নড়াচড়ায় সুচগুলো বিঁধে যেত নখের ভেতরে। এ সময় মা গো, বাবা গো বলে চিৎকার করতে থাকতেন রাজ্জাক। আর তখনই বুটজুতো পায়ে দৌড়ে এসে পাকিস্তানি সেনারা বলত- ‘বল, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবি কি না?’ রাজ্জাকের একই জবাব ‘না’। এভাবেই দিনের পর দিন পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতন চালিয়েছে রাজ্জাকের ওপর। শুধু সুবেদার রাজ্জাক নন, এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন গ্রেপ্তার হওয়া প্রায় সকলেই। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেননি সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন জাতির পিতাকে। বলেছেন ‘ফাঁসির দড়িতে ঝুললেও মিথ্যা সাক্ষ্য দেবো না।’ ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার ১৪ নাম্বার আসামি ও বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক বহুবার নিজেই তাঁর জীবনের এসব ঘটনা বলেছেন স্ত্রী ও সন্তানের কাছে। ’ এভাবেই এগিয়ে গেছে গল্প। জীবনের গল্প,বাস্তবতা গল্প।
নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন দেশবাসীর কাছে উদ্ভাসিত করেছেন বীরযোদ্ধা সুবেদার আবদুর রাজ্জাকের জীবন। লিখেছেন ‘ বীরযোদ্ধা সুবেদার রাজ্জাক: আগরতলা মামলার - চৌদ্দ নম্বর আসামি’ শিরোনামে দীর্ঘ এক বই।
সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, যিনি ব্রিটিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছেন। আবার সেই তিনিই ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে লড়েছেন পাকিস্তানের হয়ে। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধেও রেখেছেন বীরোচিত ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষক হিসেবে তাঁর রয়েছে অসামান্য অবদান। শত শত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এই গুণীজনের কাছ থেকে। কখনো আবার নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন যুদ্ধের ময়দানে। যুদ্ধের মাঠে মাঠেই জীবনের বড় একটা অংশ চলে গেছে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের । স্বাধীনতার পথ রচনাকারী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মামলার পয়ত্রিশ জন আসামির মধ্যে চৌদ্দ নম্বর আসামি ছিলেন সুবেদার আবদুর রাজ্জাক। দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা,তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সুবেদার রাজ্জাকের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা অজনা অধ্যায় লিপিবদ্ধ করেছেন ইজাজ আহ্মেদ মিলন। মৃত্যুর সতেরো বছর পর ‘বীরযোদ্ধা সুবেদার রাজ্জাক: আগরতলা মামলার চৌদ্দ নম্বর আসামি’ শিরোনামের এ গ্রন্থে সুবেদার রাজ্জাকের জীবনালেখ্য রচনার ক্ষেত্রে লেখক মুনশীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
বইটির ভূমিকায় বরেণ্য কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন লিখেছেন ‘বীরযোদ্ধা সুবেদার রাজ্জাক আগরতলা মামলার চৌদ্দ নম্বর আসামি' শিরোনামে ইজাজ আহমেদ মিলন এই অসাধারণ মানুষটির জীবনী রচনা করে তাঁকে দেশবাসীর সামনে নিয়ে এসেছেন। জাতির ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দিক সম্পন্ন হয়েছে এই মাত্রায়।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করার পর থেকে কথায় কথায় তাঁকে জেলে ভরা পাকিানি প্রশাসনের রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি প্রশাসন রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য অবতারণ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে মোট পঁয়ত্রিশ জনের বিরুদ্ধে করা এই মামলায় আসামি করা হয়, শেখ মুজিব এবং সেনাবাহিনীর কিছু বাঙালি সদস্য ভারত সরকারের সহায়তায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। ইজাজ মিলন তার মেধা ও শ্রমের নিপুণ ব্যবহারে ফুটিয়ে তুলেছেন ইতিহাসের অন্যতম এই অংশ। একই সাথে সুবেদার রাজ্জাকের জীবনের নানান দিক ওঠে এসেছে অসামান্য ব্যঞ্জনায়।
ইজাজ আহমেদ মিলন মূলত সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক । সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার, দুইবার বজলুর রহমান স্মৃতিপদক, কালি ও কলম তরুণ কবি ও সাহিত্য পুরস্কারসহ বেশ কিছু দাবি পুরস্কার জমা হয়েছে তার ঝুঁড়িতে। মোহনীয় ভাষায় রচনা করেছেন একাধিক জীবনী গ্রন্থ। যা শেষ পর্যন্ত একই সাথে হয়ে ওঠেছে ব্যক্তি, সমাজ ও একটি দেশের ইতিহাস। সুবেদার আবদুর রাজ্জাকের জীবনালেখ্যও তার ব্যতিক্রম নয়।
সুবেদার আবদুর রাজ্জাকের জীবনী গ্রন্থি রচনায় ইজাজ আহমেদ মিলন যেমন তার জানার পরিধি বিশ্লেষণ করেছেন, একইভাবে প্রয়োগ করেছেন তার সৃজনক্ষমতা। যার কারণে ‘বীরযোদ্ধা সুবেদার রাজ্জাক: আগরতলা মামলার চৌদ্দ নম্বর আসামি’ গ্রন্থ কেবল তথ্যে ঠাসা না হয়ে; তা হয়ে ওঠেছে প্রাঞ্জল গদ্য। পরম দরদ, ভালোবাসা আর তৃপ্তির জায়গা থেকেই ১৯১৭ সালের ১০ মে জন্ম নেওয়া সুবেদার রাজ্জাকের জীবনালেখ্য রচনার প্রয়াস ইজাজ আহমেদ মিলনের।
রচনায় ওঠে এসেছে একজন দেশপ্রেমিকের গল্প; একজন লড়াকু মানুষের গল্প। দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সুবেদার রাজ্জাকের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা অজানা অধ্যায় লিপিবদ্ধ করেছেন ইজাজ মিলন। যেমন “ ইতিহাসের ধ্রুপদি সাহচরযে পর্যায়ক্রমে মতলবের মাটি ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক্ষেত্রের এক তীর্থে পরিণত হয়। ... তাঁর (রাজ্জাক) উপস্থিতি মাঠকে উজ্জ্বল রাখত। খেলার সাথিরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই বালক একদিন তাঁর সীমাবদ্ধ গণ্ডির বৃত্ত ভেঙে অমিত স্বপ্ন ও সম্ভাবনার শৈল্পিক সিদ্ধিকে পূর্ণতা দিয়ে আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলতে সক্ষম হবে।” সুবেদার রাজ্জাক তা পেরেছিলেন। অল ইণ্ডিয়া টিমের হয়ে ইতালি ফুটবল খেলতেও যান। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বক্সার হিসেবেও ছিলেন জনপ্রিয়। হর্স পোলোতে তাঁর বিকল্প ছিলো না মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষক হিসেবে রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। যুদ্ধের মাঠেই জীবনের বড় অংশ কাটে তাঁর। তাঁ জীবনী রচনার মধ্যে লেখক ইজাজ আহমেদ মিলন শুধু একজন ব্যক্তির জীবনালেখ্যই রচনা করেননি; বরং তা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ঐতিহাসিক দলিল।