আসক্তি



মৌরী তানিয়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ দুপুরের পর পরই অফিস থেকে ফিরেছে তিন্নি। মেয়েদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বিকেলবেলা বেডরুমে জানালার পাশে রাখা ইজি চেয়ারটাতে বসল সে। তিন্নি বার বার ঘড়ি দেখছে। যদিও আটটা বাজতে অনেক দেরী আছে তবুও দেখছে। আটটার সময় ইভান ইংল্যান্ড থেকে ফোন করে রোজ। অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই সে ঘড়ি দেখতে শুরু করে। এটা তিন্নির অভ্যাস। হঠাৎ পাশের ছাদে বিষণ্ন একটি শালিকের দিকে চোখ পড়তেই তিন্নির মন খুশিতে নেচে উঠল। তিন্নির মনেহলো শালিকটির সঙ্গীটি হয় মরে গিয়েছে, নয়তো ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। সে সঙ্গীর কথা ভেবে বিষণ্ন মনে একা একা বসে আছে। এমন বিষণ্ন শালিককে দেখলে যে কারও মন বিষণ্ন হওয়ার কথা। কিন্তু তিন্নির তা হলো না। কারণ তিন্নি ভাবে, সে মারা গেলে ইভানও ওর কথা মনেকরে এমন বিষণ্নভাবেই একা একা বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে। ভাবতেই তিন্নির বুকে অন্যরকম একটা ভালোলাগা দোলা দিল। তিন্নি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সে মারা গেলে ইভান কোনদিন বিয়ে করবে না। তিন্নিই ইভানের জীবনের প্রথম ও শেষ ভালবাসা।

তিন্নি নিজেকে প্রশ্ন করে, ইভান মারা গেলে সে কি অন্য কাউকে বিয়ে করবে?

না কখনও না। ইভান ছাড়া সে কখনও অন্য কাউকে ভালবাসতে পারবে না।

বিষণ্ন শালিকটির দিকে আবার তাকিয়ে তিন্নির বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। এমন বিষণ্ন আর একা! পরক্ষণেই ভাবল, হয়তোবা কাউকে বিয়ে করতেও পারে সে। তবে তার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু ইভানের ক্ষেত্রে এমন ক্ষীণ সম্ভাবনাও তিন্নি দেখতে পায়না। বেঁচে থাকতেও তিন্নি যেমন ইভানের মন দখল করে আছে, মারা গেলেও তিন্নি এমনিভাবেই ইভানের সারা মন জুড়ে থাকবে। ইভানের মনে অন্য কোন নারীর জায়গা নেই। ওর পুরো মন জুড়ে শুধু তিন্নি আর তিন্নি!

ইভান আর তিন্নির প্রেমের শুরুটা হয়েছিল কলেজ জীবনে। কলেজ শেষে দুজন ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা শেষ করে চাকুরিতে ঢোকে। দুজনই খুব তুখোড় স্টুডেন্ট। চাকরি শুরুর পর তারা বিয়ে করে। বিয়ের বছর দেড়েক পর তাদের প্রথম মেয়ে জন্মায়। এর বছর দুয়ের পর দ্বিতীয় মেয়ের জন্ম। দুই সন্তান আর চাকরি নিয়ে তিন্নির গলদঘর্ম অবস্থা। ইভানের এক সিনিয়র বন্ধুর এনজিওতে চাকরি করে তিন্নি। পরিচিত বলেই ছোট বাচ্চা দুটিকে নিয়ে চাকরিটা করতে পারছে সে। কারণ মেয়েরা ছোট হওয়ায় প্রায়ই তিন্নিকে অফিস কামাই করতে হয়। আজ বড় মেয়ের জ¦র তো কাল ছোটটার পেটের সমস্যা। আজ কাজের মেয়ে আছে তো কাল নেই। চাকরিটা টিকিয়ে রাখতেই তার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। হায়ার এডুকেশনের জন্য তিন্নি আর কোন চেষ্টা করেনি। ছোট মেয়ের বয়স যখন তিন বছর তখন ইভান ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নামকরা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে যায়। চারবছর হলো ইভান ইংল্যান্ডে। ইভান যাওয়ার দুবছর পর তিন্নি মেয়েদেরকে নিয়ে একবার গিয়েছিল। কমাস পরেই ইভানের পিএইচডি শেষ হবে।

আজ আটটার সময় ফোন করে ইভান তিন্নিকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য ভিসার প্রসেস শুরু করতে বলল। অনেকদিন ধরেই ইভান তিন্নিকে বলছে কথাটা কিন্তু অফিসের বিভিন্ন ঝামেলার কারণে তিন্নি শুরু করতে পারছে না। তিন্নি ইভানকে জানাল, আর দেরি করবে না, দ্রুত কাগজপত্র রেডি করে ভিসার জন্য এপ্লাই করবে।

তিন্নি আজ সেই বিকাল থেকে জানালার পাশের ইজি চেয়ারটিতেই বসে আছে। পাশের ছাদে বসে থাকা বিষণ্ন চড়–ই পাখিটা কখন উড়ে গেছে তিন্নি টের পায়নি। মাঝে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। শরীরটা আজ একটু খারাপ লাগছিল বলেই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে সে। চেয়ারে বসে বসেই ইভানের সঙ্গে কথা শেষ করল তিন্নি। শরীর খারাপের কথাটা বেমালুম চেপে গেল ইভানের কাছে। বললেই অস্থির হয়ে পড়বে সে। ডাক্তার বন্ধুদেরকে ফোন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। আজ মঙ্গলবার হওয়ায় মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারল না ইভান। কারণ বরি,মঙ্গল, বৃহস্পতি সপ্তাহে তিনদিন এই সময় মেয়েরা বাসায় রাখা টিচারের কাছে পড়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিন্নি দেখল নটা পার হয়েছে। আজ ইভান ফোন ছাড়তেই চাইছিল না। ইশ! এত দেরী হয়েছে! কাজের মেয়েটিকে টেবিলে খাবার দিতে বলে তিন্নি আগামীকালের জন্য মেয়েদের স্কুলের টিফিন, সকালের নাস্তা আর নিজের অফিসের লাঞ্চ রেডি করতে শুরু করল।

পিএইচডিতে খুব ভালো করার কারণে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা শুরু করে ইভান। এরমধ্যে তিন্নিরা যেয়ে মাসখানেক থেকে ফিরে এসেছে। তিন্নি চায় ইভান ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতাটা আরও কয়েক বছর করুক। এত নামকরা ইউনিভার্সিটি! এখানে পিএইচডি করার সুযোগ পাওয়াই কঠিন। সেখানে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়েছে ইভান! বিশাল ব্যাপার! এতবড় সম্মান! যদিও ইভানকে ছেড়ে থাকতে তিন্নির খুব কষ্ট হয় তবুও ইভানকে এমন উঁচু জায়গায় দেখতে খুব ভাল লাগে তিন্নির। ইভানের জন্য ওর খুব গর্ব হয় । কিন্তু ইভানের দেশ ছেড়ে, তিন্নি আর মেয়েদেরকে ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না। তাই সেখানে বছরখানেক শিক্ষকতা করার পর ফিরে এলো দেশে। ইভান সবমিলিয়ে প্রায় বছর পাঁচেক ছিল ইংল্যান্ডে। ফিরে এসে ইভান প্রথম সারির উন্নয়ন সংস্থায় ভালো বেতনে চাকরি শুরু করেছে।

তিন্নি আর ইভান দুজনই দেখতে খুব সুন্দর। তিন্নির সৌন্দর্যের সঙ্গে যে জিনিসটি সবার নজর কাড়ে তা হলো ওর ভীষন মিষ্টি চেহারা আর হাসি। ওর হাসি দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়ে যায়। আর তাই কিশোরী বয়স থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য ছেলে ওর প্রেমে দেওয়ানা। কিন্তু তিন্নি শুধু ইভানের প্রেমেই দেওয়ানা। ইভান ছাড়া আর অন্য কোন ছেলেকে ভালোবাসতে হয়নি তিন্নির। কারণ ইভানের সঙ্গেই তিন্নির প্রথম প্রেম হয়, যার পরিণতি বিয়ে।

যদি দাঁড়িপাল্লায় মাপা যেত তবে হলফ করে বলা যেত অন্য মেয়েদের তুলনায় স্বামীর প্রতি তিন্নির ভালবাসার ওজনের পরিমান কয়েকগুণ বেশি। যেহেতু তিন্নি ইভানকে খুব বেশি ভালবাসে তাই ইভানের প্রতি তার বিশ্বাসটাও বহুগুণ বেশি। আর বিশ্বাস না হওয়ারও কোন কারণ নেই।  ইভানের প্রতিটি আচরনে তিন্নির প্রতি গভীর ভালবাসাই প্রকাশ পায়। তিন্নির প্রতি ইভান খুব যত্নশীল। তিন্নিকে ছেড়ে ইভান ইংল্যান্ডে পিএইচডি করতে যেতে চায়নি। তিন্নিই জোর করে পাঠিয়েছে তাকে। তিন্নির প্রতি ইভানের ভালবাসা আর যত্নশীলতা দেখে তিন্নির বান্ধবীরা রীতিমতো জেলাস!

নতুন অফিসে জয়েন করার পর ইভানের ফিরতে রাত আটটা-নটা, কোনদিন দশটাও বাজে। তিন্নি অফিস থেকে ফেরে সন্ধ্যার মধ্যেই। বাসায় এসে সে প্রায়দিন ইভান আর মেয়েদের পছন্দের কিছু খাবার-দাবার বানায়। ইভান ফিরলে চারজন একসঙ্গে রাতের খাবার খায়।

ছুটির এক সকাল। ইভান বাজরে গিয়েছে। ল্যাপটপটা ওর টেবিলের উপর খোলা রয়েছে। হঠাৎ তিন্নির বস ফোন করে জানায়, কি একটা জরুরি ফাইল এখনই মেইল করতে হবে তাকে। তিন্নি নিজের ল্যাপটপ খুলে বসল, ধ্যাৎ ল্যাপটপটা অন হচ্ছে না! প্রয়োজনের সময় এমন যন্ত্রণা যে হবে সে আর বলতে! সে ল্যাপটপটা গুতাগুতি করছে খোলার জন্য। খোলা দূরে থাক, বদমায়েসটা অনই হচ্ছে না। মুখটা অমাবশ্যার রাতের মতো ঘুটঘুটে আন্ধকার করে আছে। এরমধ্যে আবার অফিস থেকে বসের ফোন, তিন্নি এখনই ফাইলটা মেইল না করলে, আমরা খুব বিপদে পড়ব। কি আর করা, অগত্যা তিন্নি ইভানের ল্যাপটপে যেয়ে বসল। মেইলটা লিখছে। ইভান ফেসবুক মেসেঞ্জার ওন করে রেখে গিয়েছে। একটু পর পর ইভানকে করা সুস্মির মেসেজের নোটিফিকেশন আসছে। সুস্মিকে তিন্নি চেনে। ইভানের অফিসেই সে চাকরি করে। তবে সুস্মি অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। মেয়েটা দেখতে সুন্দর, স্মার্ট। অফিসে সুস্মির সঙ্গে ইভানের তেমন কোন কাজ থাকার কথা না। কিন্তু একই অফিসে চাকরি করলে অনেক সময় কাজ পড়তেও পারে। আর কাজ ছাড়াও কলিগ হিসেবে সুস্মি মেসেজ পাঠাতেই পারে ইভানকে। তিন্নি মেইল লেখায় মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেইলটি পাঠিয়ে দিল। সুস্মি এইটুকু সময়ের মধ্যে অসংখ্যবার মেসেজ পাঠিয়েছে। বার বার কম্পিউটারে ভেসে উঠছে, সুস্মি মেসেজড ইউ। তিন্নি ভাবল, হয়ত অফিসের খুব জরুরি  কোন বিষয়ে সুস্মি ইভানকে বার বার নক করছে।

একটু আগেই বাজরে গেল ইভান। সারা সপ্তাহের মাছ, মাংস, তরকারি, মুদির দোকানের কেনাকাটা রাজ্যের বাজার! সবকিছু ছুটির দিনেই করে রাখে ইভান। কারণ সারা সপ্তাহে সময় হয় না তার। অফিস আর সংসারের ব্যস্ততার কারণে তিন্নিও বাজারে যেতে পারে না। বাজারের পুরো দায়িত্ব ইভানের উপর। ফিরতে ফিরতে আরও মিনিমাম দু থেকে আড়াই ঘন্টা লাগবে। বাজার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নিশ্চয় ইভানকে ফোনে রিচ করতে পারছে না সুস্মি। খুব জরুরি না হলে এতটুকু সময়ের মধ্যে তার এত অসংখ্যবার মেসেজ দেয়ার কথা নয়।

যত ব্যস্তই থাকুক ইভান অন্যকারও ফোন না ধরলেও সাধারণত তিন্নির ফোন ধরে। এমনকি মিটিং-এ থাকলেও ফোনটা ধরে ফিসফিসিয়ে বলে আমি মিটিং এ।  তিন্নি ভাবল, ড্রাইভার তো ইভানের সঙ্গেই আছে, যদি ইভান একান্তই তিন্নির ফোন শুনতে না পায় তাহলে ড্রাইভারকে জানালে ইভান ফোন ব্যাক করবে। আগে সুস্মির সঙ্গে কথা বলে বিষয়টা জেনে নিই। যদি খুব জরুরি হয়, সুস্মি যদি বলে এখনই ইভানের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাহলে তিন্নি ইভানের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুস্মিকে কল দিতে বলবে। খুব জরুরি না হলে তিন্নি শুধু শুধু বাজারের হচপচ অবস্থার মধ্যে ফোন করবে না ইভানকে। ও খুব বিরক্ত হবে।

সুস্মির সঙ্গে কথা বলার জন্য তিন্নি ইভানের মেসেঞ্জারটি ওপেন করল, প্রথমে যা দেখল তাতে তিন্নির পায়ের মাটি নড়ে উঠল। একটু ধাতস্থ হয়ে ভাবল, সে ভুল দেখছে। চোখ রগড়াল, এরপর বেসিনে যেয়ে মুখ- চোখ ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে এসে আবার মেসেঞ্জারের সামনে বসল। না, ভুল সে দেখেনি। এতটুকু সময়ের মধ্যে ইভানকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশবার লাভ ইমোজিসহ ‘আই লাভ ইউ’ ‘আই মিস ইউ’ লিখেছে সুস্মি। তিন্নি ভাবল, সুস্মি ইভানকে ‘আই লাভ ইউ’, ‘আই মিস ইউ’ আরও অনেক কিছু লিখতেই পারে, তাকেও তো মেসেঞ্জারে ছেলেরা কত কিছু লিখে। ইভানের মতো এমন মেধাবী, সুন্দর, স্মার্ট পুরুষকে সুস্মি কেন, সুস্মির মতো হাজারও মেয়ে এসব কথা বলবে এটা খুবই স্বাভাবিক।

তিন্নি নিজেকে ধিক্কার দিল, ছি! সুস্মির পাঠানো মেসেজগুলোর উপর চোখ পড়তেই কেন সে এমন ঘাবড়ে গিয়েছিল! এত নীচ আমি! সে ভাবল, এত বছরের সম্পর্ক আমাদের! একটা মেয়ের লেখা দুটি বাক্যেই তা নড়ে উঠল! আমার আসলে মাথায় সমস্যা আছে!

এবার সে মেসেঞ্জার স্ক্রল করে ধীরে ধীরে নীচে নামতে শুরু করল। প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি লাভ ইমোজিসহ সুস্মির মেসেজগুলো শেষ হওয়ার পর, যা দেখল তাতে তিন্নির বুকটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। তার পুরো শরীর দুলতে শুরু করল, যেন ভুমিকম্প সারা পৃথিবীটার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরটাকেও দোলাচ্ছে। চোখ জোড়া ঘোলা হয়ে এলো। 

বাজারে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ইভান সুস্মিকে অজ¯্রবার লাভ ইমোজিসহ ‘আই লাভ ইউ’ লিখেছে। আরও লিখেছে, ছুটে যেতে মন চাইছে। একদিন নয়, এ যেন এক যুগ মনেহচ্ছে। ইশ! কেন যে এই শুক্রবারটা আসে! তোমাকে একমুহূর্ত না দেখে থাকতে পারি না! এমন অজশ্র আবেগঘন কথা। ইভানের এমন মেসেজের মাঝে মাঝে সুস্মিরও আবেগঘন অনেক মেসেজ তিন্নি দেখল।

মেসেজগুলো দেখার পর তিন্নি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না, মেঝেতে ঢলে পড়ে। ছুটির দিন হওয়ায় মেয়েরা তখনও ঘুমাচ্ছে। কাজের মেয়েটি রান্না ঘরে কাজে ব্যস্ত। ইভান বাজার থেকে ফিরে তিন্নিকে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে কিছুই বুঝতে পারে না। সে তিন্নিকে মেঝে থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। মুখ চোখে পানি ছিটালো। একটু পর তিন্নির জ্ঞান ফিরল।  তিন্নি ইভানের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে! যেন ইভানকে সে চিনে না! যেন ইভানকে সে কোনদিন দেখেনি! ইভান তিন্নির এমন অদ্ভুত আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তিন্নিকে ধরে ঝাকুনি দিতে দিতে বলে, এই তিন্নি কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? এই তিন্নি?

ইভানের মনে একবারের জন্যও এই ভাবনা আসেনি, সে সুস্মির সঙ্গে কথা বলতে বলতে মেসেঞ্জার খোলা রেখে চলে গিয়েছে। তিন্নি হয়ত দেখেছে বলে এমন অদ্ভুত আচরন করছে। এমন ভাবনা তার হওয়ার কথা নয় কারণ ইভানের প্রতি তিন্নির বিশ্বাসটা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি সেটা ইভান জানে। স্বামীর প্রতি সাধারণ বিশ্বাস সম্পন্ন মেয়েরাই কোন সন্দেহের উদ্রেক না হলে স্বামীর অনুপস্থিতিতে লুকিয়ে তাদের মেসেঞ্জার চেক করে না। এতে তার নীচুতা প্রকাশ পায়। নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যায়। আর তিন্নির তো এমন কাজ করার প্রশ্নই আসে না। ওর নিজের আলাদা ল্যাপটপ আছে, যদি ওর আলাদা ল্যাপটপ না থাকত তাহলে ইভান নিজেই সতর্ক হতো। আর ছুটির দিন সে এতটাই ব্যস্ত থাকে সেটা বলে বুঝানো যাবে না। সারা সপ্তাহের কাজ সে গুছিয়ে রাখে এই একদিনে। নিঃশ্বাস নেয়ার সময় হয়না তার। এরমধ্যে কোন কারণ ছাড়া ইভানের মেসেঞ্জার চেক করার প্রশ্নই আসে না।

তিন্নির দু কাঁধ ধরে ইভান আবার ঝঁকুনি দিয়ে বলল, কি হয়েছে বলো প্লিজ!  এবার তিন্নি দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠল, ‘ইভান আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ইভান! খুব যন্ত্রণা হচ্ছে! আমি এখন কি করব! আমি এখন কি নিয়ে বাঁচব ইভান!’

ইভান তিন্নির মুখ থেকে হাত সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, পাগলের মতো এসব কি বলছ! কেন বলছ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!

‘তুমি সুস্মিকে এসব ---’ তিন্নি শেষ করতে পারল না কথাটা। আবারও সে ঢলে পড়ল বিছানার উপর।

ইভান ল্যাপটপের কাছে যেয়ে সবকিছু বুঝল।

জ্ঞান ফেরার পর ইভান তিন্নির কাছে এসে হাত জোর করে মাফ চাইল। অনেক অনুনয়-বিনয় করে বলল, এবারকার মতো মাফ করে দাও প্লিজ। আসলে সুস্মি সারাক্ষণ আমার পেছনে এমন আঠার মতো লেগে থাকত, আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি।

ইভান অনেক মাফ চাওয়ার পর, অনেক বুঝানোর পর তিন্নি ভাবে, বাইরের একটা মেয়ের জন্য আমি নিজে কেন এত কষ্ট পাব! সংসারের সবাইকে কেন এত কষ্ট দিব! আসলে ইভান কখনই এমন করত না। ইভান এমন ছেলেই নয়। ইভানকে আমি সেই কলেজ জীবন থেকে চিনি। ইভান আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসে না। বাসতেই পারে না। আসলে সব দোষ ঐ সুস্মির। সুস্মি সারাক্ষণ ইনিয়ে বিনিয়ে ভালবাসার কথা বলেছে, সবসময় পিছে লেগে থেকেছে বলেই ওর প্রতি ইভানের সাময়িক একটা আবেগ তৈরী হয়েছে। আমার প্রতি, নিজের মেয়েদের প্রতি ইভানের ভালবাসা কত গভীর! ইভানের মতো স্নেহশীল বাবা, দায়িত্বশীল স্বামী কখনও এমন হতে পারে না! সুস্মির মতো ছলনাময়ী, চরিত্রহীন মেয়েদের পাল্লায় পড়ে ইভানের মতো সৎ ছেলেরা এমন একটু আধটু ভুল করতেই পারে! 

তিন্নি নিজেকে প্রতিদিন এভাবে বুঝাতে বুঝাতে একসময় স্বাভাবিক হয়ে আসে। বিষয়টি না ভুললেও সেটা আর তাকে কষ্ট দেয় না। আবার ইভানকে সে আগের মতো বিশ্বাস করে।

ভালই চলছিল সবকিছু। হঠাৎ একদিন সে মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ পায়। রিয়া নামের খুব সুন্দরী অল্প বয়সী এক মেয়ে তাকে মেসেজ দেয়, আপু আপনার স্বামীকে বলেন, আমাকে যেন আর ডিস্টার্ব না করে। আমি আর তার সঙ্গে থাকতে চাই না। সে একটা নোংরা ও অসৎ চরিত্রের মানুষ, আমি প্রথমে বুঝিনি। বুঝতে পেরে সরে এসেছি । আমি এখন তাকে ঘৃনা করি। আমি এখন অন্য একজনকে ভালবাসি। আমি তাকে সব বলেছি। আমরা কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করব। আপনার স্বামী সারাক্ষণ আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলছে। ওকে সব জায়গা থেকে ব্লক করেছি। কিন্তু সে নতুন নতুন আইডি খুলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। মেইল পাঠিয়ে যন্ত্রণা করছে। প্লিজ আপু আপনার স্বামীকে থামান। 

তিন্নি প্রথমে একদম বিশ্বাস করেনি রিয়ার কথা। মেসেঞ্জারে উল্টা রিয়াকেই গালিগালাজ করে সে। তিন্নির ঘরে, তিন্নির বাসরের খাটে ইভানের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ছবি তাকে পাঠায় রিয়া। যেগুলো দেখে তিন্নি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়!

রিয়া জানায়, তিন্নি গত রোজার ঈদে যখন ময়মনসিংহে বাবার বাড়ি গিয়েছিল তখন ইভান রিয়াকে রোজ বাসায় আনত। বিয়ের পর ঢাকায় তিন্নির শ্বশুরের কিনে দেয়া এই ফ্ল্যাটেই তিন্নিরা ওঠে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তিন্নি এখানেই আছে। বাসর রাতের সেই খাটটিতেই তিন্নি এখনও ঘুমায়। তিন্নি যখন ঈদ করতে বাবার বাড়িতে গিয়েছিল তখন ইভান অফিসের কাজের অজুহাতে ঢাকায় ছিল। তিন্নির বাবার বাড়ি আর শ্বশুড় বাড়ি একই শহরে হওয়ায় ঈদে গেলে দুজায়গা মিলিয়ে তাকে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়।

এবারও ইভান তিন্নির কাছে মাফ চায়, অনেক বুঝায়। তিন্নি এখন বুঝতে পারে, ইভান আগাগোড়ায় একজন অসৎ চরিত্রের ছেলে ছিল। কিন্তু সে প্রথম থেকে তাকে এত বিশ্বাস করত, এত ভালবাসত, কখনই কোন সন্দেহ মাথায় আসেনি। তিন্নির মনেপড়ে, বিয়ের পর পর তার ছোট বোন মিমিকে ইয়ার্কির ছলে ইভান এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল, মিমির বিষয়টি একদম ভাল লাগেনি। তিন্নির কাছে এ বিষয়ে অভিযোগও করেছিল মিমি। কিন্তু  তিন্নি উল্টো মিমিকে ধমক দিয়ে বলেছিল, দুলাভাই হয় বলে একটু ইয়ার্কি করে, তুই এমন মাইন্ড করিস কেন! এরপর থেকে তিন্নি খেয়াল করেছে ইভান ওদের বাড়িতে গেলে, মিমি তাকে এড়িয়ে চলে সবসময়। তিন্নি মনে মনে ভাবে, মিমিটা একদম কাঠখোট্টা গোছের হয়েছে। দুলাভাইয়ের একটু ইয়ার্কিও সহ্য করতে পারে না। একই অভিযোগ তিন্নির এক বান্ধবীও করেছিল। তাকেও তিন্নি একইভাবে ধমক দিয়েছিল।

রিয়ার ঘটনাটি জানার পর তিন্নি ইভানকে ডিভোর্স দেয়ার কথা ভাবে। কিন্তু সে তার ভালবাসার কাছে পরাজিত হয়। ইভানকে সে কিছুতেই ছাড়তে পারে না। ইভান তার জীবনে থাকবে না, ইভানকে সে চাইলেই ছুঁতে পারবে না, চাইলেই সে ইভানের গায়ের গন্ধ নিতে পারবে না, এসব ভাবলেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার ইভানের সঙ্গে থাকতেও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, যন্ত্রণা হচ্ছে। দিনে-রাতে যতবার সে খাটে শুতে আসে ততবার সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। এই খাটে ইভান অন্য মেয়েকে নিয়ে কিভাবে শুয়েছিল। ওর কি একবারও মনেহয়নি আমার কথা!

তিন্নি অসুস্থ হয়ে পড়ে। সারারাত সে ঘুমাতে পারে না। খেতে পারে না। প্রায় সারারাত সে কেঁদেই কাটিয়ে দেয়। দিনের বেলা অফিস আর মেয়েদেরকে নিয়ে থাকে বলে কাঁদতে পারে না। তবে বুকের ভেতরে যেন একটা আগুনের কু- জ্বলতে থাকে সবসময়। একসময় সে মানসিক ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়। মা-বাবা, ভাইবোন সবাই ইভানকে ছাড়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু ইভানকে ছাড়ার কথা ভাবলেই তিন্নির হাত পা অবশ হয়ে আসে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ইভানকে ছাড়া সে তার জীবন চিন্তা করতে পারে না। ইভানকে সে আগের মতোই ভালবাসে। কিন্তু পার্থক্য হলো  ইভানের প্রতি এখনকার ভালবাসাটা ভয়ংকর যন্ত্রণা আর কষ্ট মিশ্রিত। ইভানের স্পর্শের জন্য সে উন্মুখ হয়ে থাকে। রাতে ইভান যখন তাকে কাছে টানে তখন সে যেন মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ভুলে যায়। দুটি শরীর যতক্ষণ এক হয়ে মিশে থাকে ততক্ষণ তিন্নির মনেহয় ইভান তারই আছে। আগের মতোই সে ইভানকে সন্তুষ্ট করতে পারে। কিন্তু দুটি শরীর আলাদা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাসরের খাটে ইভান আর রিয়ার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের সেই ছবিগুলো। এতক্ষণ তিন্নি যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল! ঘোর কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন্নি ডুকরে কেঁদে ওঠে। প্রায় রাত এভাবেই কাটে তিন্নির। ইভান তাকে যথারীতি বুঝায়, সে ভাল হয়ে গিয়েছে, আর সে এমন করবে না। তিন্নি ইভানের কথাগুলো বিশ্বাস করে না।

তিন্নির বন্ধুরা ওকে অনেক তিরস্কার করে ইভানের মতো এত নীচ আর ভন্ড একজন মানুষের সঙ্গে থাকার জন্য। তিন্নি বলে, আমি নিজের কাছে অসহায়। আমি ওকে ছাড়তে পারছি না। ওর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে থাকতেও পারছি না। তিন্নিকে হাই ডেজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার কিন্তু ওষুধেও ঘুম হয় না ওর।

ইভানকে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারে ফলো করে তিন্নি বুঝতে পারে সে একসঙ্গে অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। বসুন্ধরার একদম শেষ মাথায় তাদের আর একটি ফ্ল্যাট আছে, ওখানেই সে বিভিন্ন মেয়েদেরকে নিয়ে যেয়ে সময় কাটায়। ফ্ল্যাটটি ফাঁকা রেখেছে সে। ইভান বাবা-মার একমাত্র ছেলে হওয়ায় ওর সিদ্ধান্তই বাবা-মা মেনে নেয়।

ইভান এখন আর কিছু লুকাতে পারে না। লুকাতে না পারার আর একটি কারণ হলো, একসঙ্গে বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে ওর সঙ্গে একেক সময় একেক মেয়ের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তখন তারা তিন্নিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। তারা তিন্নিকে ইভানের নামে অভিযোগ করে। গত দশ-পনের বছরে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ,ভাইবারের যথেচ্ছা ব্যবহারের কারণে ইভানের আরও বেশি পতন হয়েছে বলে তিন্নি মনেকরে।

এরমধ্যে একটা মেয়ে ওকে জানায়, ইভানের সঙ্গে থাকার কারণে সে দুবার বাচ্চা নষ্ট করেছে। সেই মেয়ে তিন্নিকে আরও বলে, আপনি তাড়াতাড়ি  ইভানকে ডিভোর্স দেন। এভাবে আমি আর থাকতে পারছি না। আমি বিয়ে করে ইভানের সঙ্গে থাকতে চাই। ইভানকে বহুবার বলেছি, আপনাকে ডিভোর্স দিতে কিন্তু তার এক কথা সে আপনাকে ডিভোর্স দিবে না কখনও। তিন্নি অবাক হয়ে ভাবে, যা শুনছে তা কি বাস্তব! নাকি সে স্বপ্ন দেখছে!

ইভান প্রথম থেকেই নিশ্চিত ছিল তিন্নি কখনও ইভানকে ছেড়ে থাকতে পারবে না, যাবে না কখনও ইভানকে ছেড়ে। রিয়ার সঙ্গে তার বাসরের খাটে অন্তরঙ্গ ছবিগুলো দেখার পরও তিন্নি তাকে ছেড়ে না যাওয়ায় ইভানের এই ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। এ কারণে ইভান যেন আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এখন সে প্রায় দিনই গভীর রাত করে বাসায় ফেরে।

তিন্নি নিয়মিত মানসিক ডাক্তারের কাছে যায়। গাদা গাদা ওষুধ খায়। এরপরও প্রায় দিন তিন্নির প্যানিক অ্যাটাক হয়। তিন্নি সারারাত কাঁদে। নামাজে বসে কাঁদে। তিন্নির মা-বাবাসহ সবাই অনুরোধ করে ইভানকে ডিভোর্স দিতে।  কিন্তু তিন্নি পারে না। তিন্ন অসহায়! নিজের কাছে ভীষণ অসহায় সে!

তিন্নি একদিন ইভানকে বলে, আমি যেহেতু তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারছি না, তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও প্লিজ। তাহলে আমার আর করার কিছু থাকবে না। তোমার কাছ থেকে আমি চলে যেতে বাধ্য হব। কিন্তু ইভান বলে, আমি তোমাকে কখনও ডিভোর্স দিব না।

 কেন?

আমি তোমাকে ভালবাসি।

ইভানের মুখ থেকে ভালবাসা শব্দটি শোনার পর তিন্নির বমি চলে আসে। সে বাথরুমে যেয়ে হল হল করে বেসিন ভরে বমি করে।

এত ঝড়ঝাপটার মধ্যে আগের মতো না হলেও তিন্নি এখনও যথেষ্ট সুন্দরী আছে। ওর মিষ্টি হাসি দেখলে এখনও যেকোন পুরুষের বুক উত্তাল সাগরের মতো উথাল-পাথাল করে। তিন্নির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সিঁথি বলে, তুই অন্য কোন ছেলের প্রেমে পড়লেই ইভানকে ছাড়তে পারবি, তার আগে নয়। আসলেই কি তাই! তিন্নি জানে না। সিঁথির পরামর্শে তিন্নি ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছে। উদ্দেশ্য বন্ধুত্বের সম্পর্কটি ধীরে ধীরে প্রেমে গড়াবে। ফেসবুকে ও পরিচিতদের মাধ্যমে অনেক ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছে তিন্নির। কিন্তু কোন ছেলে এগুতে চাইলে তিন্নি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তিন্নি পারে না, ইভানকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসতে পারবে না সে।

এখন প্রায়ই বিভিন্ন মেয়েরা মেসেঞ্জারে তিন্নির কাছে ইভানের নামে অভিযোগ করে। অল্প বয়সী বিভিন্ন মেয়েরা ইভানের টার্গেট। প্রথমে ইভান বিভিন্ন অল্প বয়সী মেয়েদেরকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠায়, ওরা এমন হাই প্রোফাইলের একজনকে তার সঙ্গে অ্যাড করতে পেরে গর্বিত হয়। এরপর ইভান যখন সেসব মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে চায়, তারা খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলে। কথা চালাতে চালাতে কিছু কিছু মেয়ে তার টোপে পা দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর তাদের মধ্যে কেউ কেউ বুঝতে পারে সে ভয়ংকর চরিত্রহীন একজনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তারা ইভানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তখন ইভান তাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা চালায়। কখনও কখনও ভয়ও দেখায় তাদেরকে। তখন তারা তিন্নির কাছে অভিযোগ করে ইভানের সম্পর্কে। কেউ কেউ তিন্নির কাছে সাহায্যও চায়। এসব শুনে এখন আর তিন্নি অবাক হয় না, বিস্মিত হয় না, ক্ষুব্ধ হয় না! শুনে শুধু হাসি পায় তার, করুন সে হাসি!

ফেসবুকে দীপন নামে একটা  ছেলের সঙ্গে তিন্নির পরিচয় হয়েছে। দীপন তাকে জানায় কলেজ জীবন থেকে তিন্নিকে পছন্দ করে সে। কিন্তু তিন্নি ইভানকে ভালবাসত বলে কথাটা তাকে বলতে পারেনি দীপন। তিন্নির জন্যই সে রুয়েট, কুয়েটে চান্স পাওয়ার পরও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। শুধু তিন্নিকে দেখতে পাবে সে আশায়। দীপন সবসময় আশায় আশায় থেকেছে যদি ইভানের সঙ্গে তিন্নির কখনও ব্রেকআপ হয় তখন সে তিন্নিকে তার ভালবাসার কথা জানাবে। কিন্তু তাদের এত গভীর প্রেম! সেই সুযোগ আর পায়নি দীপন।

সুন্দরী আর মিষ্টি চেহেরার মেয়ে তিন্নির প্রেমে কিশোরী বয়স থেকে অনেক ছেলে হাবুডুবু খেত। তিন্নি সেটা জানত। কিন্তু তিন্নির প্রতি দীপনের এত গভীর প্রেম! ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বাদ দিয়ে শুধু তিন্নির জন্য ঢাকা ভাসির্টিতে ভর্তি হয়েছে সে! কথাটা শুনে তিন্নির কেন জানি খুব ভাল লাগল। অনেকদিন পর তার ভেতরে অন্য কোন ছেলের জন্য অন্যরকম এক ভাল লাগার অনুভুতি জাগল। ভার্সিটিতে পড়ার সময় দীপনকে তিন্নি চিনত। কিন্তু বিষয়টি জানত না। দীপন খুব চাপা স্বভাবের ছেলে। দীপন আরও জানায়, সে বিয়ে করেছে। প্রায় পনের বছরের সংসার জীবন তাদের। কিন্তু কিছুদিন হলো তাদের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। তারা ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ফেসবুকে তিন্নিকে অনেক খুঁজেছে দীপন। কিন্তু এতদিন পর সে পেল। আসলে তিন্নির প্রোফাইল এতদিন লক করা ছিল। বান্ধবী সিঁথির পরামর্শে কিছুদিন হলো সে প্রোফাইলটা পাবলিক করেছে। এখন তিন্নির মনেহচ্ছে, ইভানের সঙ্গে এভাবে থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু ইভানকে সে এখনও ছাড়তে পারছে না। সে বুঝতে পারছে কারও প্রেমে না পরা পর্যন্ত ইভানকে সে ছাড়তে পারবে না। সিঁথি শুরু থেকেই তাকে এই কথা বলত। কিন্তু এখন তিন্নি নিজেও এটা বিশ্বাস করে। যদিও বলে কয়ে, এভাবে প্রস্তুতি নিয়ে তো আর প্রেম হয় না। কিন্তু প্রেমের বিষয়টা সে এখন সিরিয়াসলি মাথায় নিয়েছে। আর সেকারণে মনের মানুষকে খুঁজে পেতে সে তার প্রোফাইল পাবলিক করেছে।

মেয়েরা যথেষ্ট বড় হয়েছে। বড়টা ভার্সিটির প্রথম বর্ষে, আর ছোট মেয়ে কলেজে পড়ে। বেশিরভাগ সন্তানই চায় না মা-বাবা আলাদা থাকুক। কিন্তু ওর মেয়েরা বাবার এসব কুর্কীতি দেখতে দেখতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। ওরা এখন মাকে নিয়মিত চাপ দিচ্ছে, আলাদা থাকতে। এখনও তিন্নি পারবে তা ভাবছে না। তবে সে সিরিয়াসলি চেষ্টা করছে।

দীপনের সঙ্গে কথা বলতে তিন্নির খুব ভাল লাগে। দীপনের সঙ্গে পরিচয়ের তিন-চার মাসের মধ্যেই তিন্নি তাকে ইভানের বিষয়টি বলে। দীপন মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। বন্ধুর মতোই চলতে থাকে তাদের সম্পর্ক। একসময় দীপন আর তার বউয়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তিন্নি খবরটা শুনে খুশি হয় কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। এখন একদিন দীপনের সঙ্গে কথা না বললে তিন্নির খারাপ লাগে, খুব খারাপ লাগে। দীপনের বউ নেই। ইভানও সারাদিন অফিসে থাকে, অনেক রাত করে ফেরে। তিন্নি অফিসের ফাঁকে ফাঁকে দীপনের সঙ্গে কথা বলে, বাসায় ফিরেও ইভান আসার আগ পর্যন্ত কথা বলে। একসময় তিন্নি খেয়াল করে দীপনকে সে ভালবাসে। ইভানের জন্য তার আর কোন ভালবাসা নেই। ইভানের দেয়া কষ্টগুলো তাকে আর কষ্ট দেয় না। তিন্নির সারা মনপ্রাণ এখন দীপন দখল করে নিয়েছে।  তিন্নি দীপনকে সে কথা জানায়। দীপন বলে, আমি এদিনটির জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তিন্নি ইভানকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

ইভানকে সে সিরিয়াসলি ডিভোর্সের বিষয়টি জানায়। ইভান প্রথমে বিশ্বাস করেনি। ভেবেছে আগের মতোই ইভানকে ভয় দেখানোর জন্য বা রাগ করে বলছে। কারণ ইভান জানে তিন্নি তাকে ছাড়তে পারবে না। কিন্তু সে যখন বুঝতে পারল, তিন্নি সত্যি সত্যি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইভানকে ছাড়ার, তখন অবাক হয়ে সে তিন্নির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। এরপর সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। সে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। আমাকে আর একটাবার সুযোগ দাও। আমি সব ছেড়ে তোমাকে নিয়েই থাকব।

তিন্নি ইভানের কথা আর বিশ্বাস করল না। কারণ আগে বহুবার একথা শুনেছে তিন্নি। তিন্নি ইভানকে এমন কথাও বলেছে, তুমি সব মেয়েদেরকে ছেড়ে ভাল হয়ে যাও ইভান। আমি তোমার আগের দেয়া সব কষ্ট ভুলে সুখী হতে পারব। আমি যদি শুধু বুঝতে পারি, অন্যকোন মেয়ের সঙে তোমার কোন সম্পর্ক নেই, তুমি এখন শুধু আমাকেই ভালবাস, তাহলেই আমি পৃথিবীর সেরা সুখী হতে পারব ইভান! প্লিজ ইভান ভাল হয়ে যাও। আমরা আমাদের মেয়েদেরকে নিয়ে বাকি জীবনটা সুখে কাটিয়ে দেই। কিন্তু ইভান শোনেনি। নতুন নতুন মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা তিন্নির কাছে ফাঁস হওয়ার পর সে বলেছে, আমাকে আর একটাবার সুযোগ দাও। আমি সব ছেড়ে তোমাকে নিয়েই থাকব। কিন্তু কিছুদিন পর আবারও সে জড়িয়ে পরে বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে।  

ইভানের একথা আর বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। আর বিশ্বাস করেও এখন আর লাভ নেই কারণ তিন্নি এখন দীপনকে ভালবাসে। ইভানের প্রতি ওর আর কোন ভালবাসা নেই।

তিন্নি ডিভোর্সের জন্য উকিলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে। এখন ইভান অফিস থেকে রাত আটটা-নটার মধ্যেই বাসায় ফিরে। বাসায় ফিরতে সে আর গভীর রাত করে না। ফেসবুক চালায় না। হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার কোন কিছুতেই সে আর এ্যাকটিভ থাকে না। আগে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া বাকি পুরোটা সময় সবগুলো যোগাযোগ মাধ্যমে সে এ্যাকটিভ থাকত। একসঙ্গে সবগুলো মাধ্যম সে অন রাখত। তিন্নি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে ইভান অফিস শেষে বাসায় এসে শুয়ে অথবা বসে থাকে চুপচাপ। খাওয়া-দাওয়াও করে না ঠিকমতো। অফিসে যতক্ষণ থাকে তখনও ফোন ছাড়া তার সবগুলো যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকে। তিন্নি ভাবে এটা তার নতুন চাল।

তবে তিন্নি কিছুতেই বুঝতে পারে না, কেন ইভান এতদিন তিন্নিকে ডিভোর্স দেয়নি! অনেক ভেবেছে সে কিন্তু কোন উত্তর পায়নি। তিন্নির সঙ্গে থাকার কারণে তার লাম্পট্য কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তিন্নিকে ডিভোর্স দিলে তার লাম্পট্যের রাস্তা তো ক্লিয়ার হতো। আবার তিন্নি যখন সিরিয়াসলি ডিভোর্স দিতে চাইছে তখন সে কেন বাধা দিচ্ছে! কেন সে ডিভোর্স চায় না! সামাজিক কারণ কি! তিন্নি ভাবে, না, সমাজকে সে বিন্দুমাত্র কেয়ার করে না। সমাজকে যদি সামান্যতম কেয়ার করত তাহলে একজন মানুষ এত নীচু কাজ বছরের পর বছর ধরে চালাতে পারত না! তাহলে কেন! তিন্নি বুঝতে পারে না!

প্রতিদিন রাতে ইভান তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। তিন্নির সামনে হাতজোড় করে অনুরোধ করে, তিন্নি প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না!  তিন্নি ভাবে সবই অভিনয়! ইভানের মুখ থেকে ভালবাসা শব্দটি শুনলেই তিন্নির শরীরটা গুলাতে থাকে, বমি পায়! কোন কোনদিন তিন্নি বেসিন ভাসিয়ে বমি করে!

ইভানকে ডিভোর্স দিয়ে দীপনকে বিয়ে করে তিন্নি। মেয়েরা তিন্নির সঙ্গেই থাকে। এর কিছুদিন পর তিন্নি জানতে পারে ইভান আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা করার আগে ইভান কুরিয়ারে তিন্নির কাছে একটা চিঠি পাঠায়-

‘তিন্নি আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। বাঁচতে চাইও না। তুমি ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন তিন্নি!

তিন্নি এখন বুঝতে পারে, সত্যিই ইভান তাকে ভালবাসত। এতদিন ধরে ইভান যা করেছে সেটা ছিল ইভানের আসক্তি। বিড়ি, সিগারেট, মদ, গাঁজা, ভাংয়ের মতো এটাও একটা আসক্তি! যেটা ইভান ছাড়তে পারত না কোনভাবেই! চিঠিটি হাতে নিয়ে তিন্নি হাসে, করুণ সে হাসি!

   

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

বাংলাদেশের বৈশাখি মেলা

  ‘এসো হে বৈশাখ’



সাইমন জাকারিয়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ হাজারো মেলার দেশ। এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম-শহর জুড়ে প্রতি বছর এখনও প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রতিটি মেলা আয়োজনের পিছনে কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। সেটি হয় ধর্মীয়, নয় ব্রত-পালা-পার্বন অথবা যে কোনো একটি নির্ধারিত বিষয় বা ঐতিহ্যকে স্মরণ করে।

মেলার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে- নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত তারিখ বা তিথি-লগ্নে এক একটি মেলাতে নর-নারী, শিশু-কিশোর এমনকি আবাল বৃদ্ধরাও সমাগম ও সমাবেশ করে থাকে। উল্লেখ্য, একটি জায়গায় অনেক লোকের সমাবেশ ও সমাগম মানেই সাধারণ বাংলা অর্থে মেলা বলা হয়। তবে, মেলার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে- ব্যবহার্য পণ্য ও গৃহ সামগ্রীর বিরাট সমাবেশ এবং চিত্তবিনোদনের জন্যে যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ ইত্যাদির আসর।

আধুনিক এই যুগের খেয়ালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাসমূহ এখন অনেকটাই তার চরিত্র বদলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এরমাঝে তাকে নানা উত্থানপতন ও অবক্ষয়ের ধকল সইতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের মেলাগুলো কিছুতেই তার ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে পুরোপুরি যেতে নারাজ। বাংলাদেশের মেলাগুলো এখন আগের সনাতন চেহারা থেকে রূপান্তরিত হয়ে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও অতিমারি কালে বাংলাদেশের বহু ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির মতো মেলাগুলোও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। তবে, মানুষের জীবিকার চাহিদা ও মননশীল মনের তাগিদে ঐতিহ্যগত মেলাগুলো আয়োজনে সাময়িক বাধাপ্রাপ্ত হলেও কোভিড-১৯ উত্তরকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যগত মেলাগুলো আবার আগের মতো অনুষ্ঠিত হতে শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, এদেশের প্রচলিত মেলাগুলির প্রকৃতি বহুবিধ ধরনের। এক বাক্যে তার প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণী করণ দুঃসাধ্য। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে এদেশে প্রচলিত মেলাগুলির একটি সরল শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশের মেলা প্রায় সর্বাংশই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, যুগের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে এদেশের মেলা বর্তমানে গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই ছড়িয়ে পড়েছে।

চারিত্র্য বিচারে এদেশে প্রচলিত মেলাসমূহকে মোটামুটি সাতটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে, যথা- ১. ধর্মীয় উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ২. কৃষি উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ৩. ঋতুভিত্তিক মেলা, ৪. সাধু-সন্তের ওরশ উপলক্ষে ফকিরী মেলা ৫. জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি যেমন, কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ইত্যাদির স্মরণোৎসব উপলক্ষে স্মারক মেলা, ৬. জাতীয় দিবসসমূহ উদ্যাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃৃতিক মেলা, ৭. বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় মেলা। উল্লেখ্য, যেসকল মেলার ঐতিহ্য বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত আছে এই শ্রেণীবিন্যাসে কেবল সেসকল মেলাগুলিকেই বিবেচনায় আনা হয়েছে। তবে, ভিন্ন বিবেচনায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মেলাসমূহের এমন সরলকৃত শ্রেণীবিভাগকে যে কেউ নতুনভাবেও পুনর্বিন্যস্ত করতে পারেন।

এক

উপলক্ষই বাংলাদেশের মেলা উদ্যাপনের স্বাভাবিক উৎস কথা। কিন্তু উপলক্ষ যা-ই থাকুক বাংলাদেশের মেলার একটা সার্বজনীন রূপ কিন্তু আছেই। এদেশের মেলায় অংশগ্রহণে সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিন্নতা কোনো দিনই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বাংলাদেশের সবগুলো মেলাই আর্থ-সাংস্কৃৃতিক বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে মিলন কথাকেই প্রকাশ করে থাকে। সে কারণে এদেশের মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল ধর্ম ও শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা ঘটে। অতএব, বাংলাদেশের মেলা মানে মৈত্রী সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু -কিশোর সকলেই আসে এই মেলাতে।

এখানে সকলের অভিন্ন আকাক্সক্ষা একটিই, আর তা হলো- মেলা বা আড়ৎ দেখা। যার সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে আরেকটি বিষয় জড়িয়ে থাকে, তা হচ্ছে-বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। মেলাতে গাঁয়ের বধুর ঝোঁক থাকে আলতা-সিঁদুর-স্নো-পাউডার-সাবান আর ঘর-গৃহস্থালির টুকিটাকি সামগ্রীর প্রতি। আরেকটি আকর্ষণ থাকে বিনোদনের প্রতি, আর তা হচ্ছে- যাত্রা, পুতুল নাচ বা সার্কাস প্রদর্শনী দেখা।

তবে, শিশু-কিশোরদের টান থাকে মূলত খেলনার দিকে, যেমন- মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ। শিশু-কিশোরদের আরেক আকর্ষণের বস্তু হচ্ছে- খই, বাতাসা, রসগোল্লা, চমচম, কদমা, খাগড়াই, মুড়ি-মুড়কি, জিলিপি আর দানাদার। তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের খেলনা বাঁশির কথাও বলা যায়। মেলার প্রাঙ্গণে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোরই বাঁশি কিনে থাকে।

বাংলাদেশের মেলার একটি দিকে থাকে অনিবার্যভাবেই বিনোদনের ব্যবস্থা। যেমন- নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, যাত্রা, বাউল-ফকির বা কবি গান, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, কুস্তি, জারিগান ইত্যাদি। কিছু কিছু মেলাকে মাতিয়ে রাখে সঙ-এর কৌতুক ও মশকরা, তারা স্বাধীনভাবে মেলাতে ঘুরে ঘুরে রঙ্গ করে থাকে। এছাড়া, মেলায় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাড়ি-মদ আর জুয়ার আসর বসে থাকে। নেশায় এমন ডুবে এবং জুয়ার খেলায় সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে অনেকেই। এটা বাংলাদেশের মেলার একটি প্রাত্যহিক চিত্র।

তবে, বাংলাদেশে বর্তমানে চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এদেশের মেলায় এখন হর-হামেশাই মাইকে বা সাউন্ড বক্সে উচ্চ আওয়াজে গান বাজে। মেলায় পসরা সাজিয়ে বসা দোকানে দোকানে এখন মোবাইল বা ল্যাপটপের মাধ্যমে ইউটিউব থেকে পছন্দমতো গান বেছে নিয়ে তা সাউন্ডবক্সে বাজানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো করা হয়।

সময় বদলের সঙ্গে এদেশের মেলার চিত্র-চরিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলার রূপ ও মেজাজ অনেকখানিই বদলে গেছে। সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে এইদেশে যে সকল মেলার আয়োজন হতো তার মধ্যে অনেক মেলার আয়োজন এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এবং অনেক মেলা এখন বিলুপ্তির পথে, কিছু মেলা এরই মাঝে রূপান্তরিত হয়ে নতুন রূপ গ্রহণ করে বেঁচে আছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ মেলাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এদেশের গ্রামীণ মেলার স্বাভাবিক ও সাধারণ চিত্র কুটির শিল্পজাত গ্রামীণ পণ্যের বদলে দেশী-বিদেশী চোখ ধাঁধানো বাহারি পণ্যের জৌলূস ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি চ্যানেলে প্রচলিত কাটুনের চরিত্রের মুখ ও নকশা এখন প্লাস্টিক ও বাতাস দিয়ে ফোলানো বেলুনের উপর শহর থেকে গ্রামের মেলায় বাতাসে উড়তে দেখা যায়। বিশেষ করে জনপ্রিয় কাটুন চরিত্র মটু-পাতলু সারা বাংলাদেশের মেলাগুলোতে প্রত্যক্ষ করা যায়। এগুলোই এখন শিশুদের প্রধান আকর্ষণের বস্তু হয়ে গেছে।

এদেশের বহু নাগরিক প্রয়াসের সঙ্গেই বাংলায় প্রচলিত মেলার লৌকিক ধারা এসে মিশেছে। যেমন- বৈশাখীমেলা, ঈদমেলা, বইমেলা, বিজয় মেলা ইত্যাদি মূলত এদেশে প্রচলিত মেলার লোকধারার প্রেরণা নিয়ে নতুন আঙ্গিক ও মাত্রায় আজ নগরজীবনে প্রতিষ্ঠিত এবং তা এর মধ্যেই ঐতিহ্যে পরিণতি লাভ করেছে। এমত ধারায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে বিজয়মালা, যা যথার্থ অর্থেই ‘ঐতিহ্য ও আধুনিক চেতনার.. অপূর্ব সমন্বয়’।

দুই

বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর শুরু উপলক্ষে এখানে এদেশের বৈশাখি মেলার অতীত ও বর্তমান চালচিত্র সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই।
বৈশাখ হচ্ছে বাংলা সনের প্রথম মাস। ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল থেকে যখন বাংলা সনের গণনা শুরু হয় তখন বছর সূচনার মাস হিসেবে বৈশাখকেই প্রথমে রাখা হয়। অনেকের ধারণা, সম্ভবত তখন থেকেই নববর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে বৈশাখী মেলার সূচনা। বৈশাখী মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এ মেলা ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালির মেলা।

বৈশাখি মেলার অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যকে কোনো দিনই কোনো ধর্মের গোঁড়ামী খর্ব করতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই বৈশাখী মেলারও রয়েছে অন্যান্য মেলার মতো দুটো দিক। একটি বাণিজ্যিক আর একটি সাংস্কৃতিক। বাংলার ব্যবসায়ীরা চৈত্রের শেষ দিন বা ‘চৈত্রসংক্রান্তি’তে এবং বৈশাখের প্রথম দিনে ‘হালখাতা’ করে থাকে। আসলে ‘চৈত্রসংক্রান্তি’র দিনটা পালন করে বাংলাদেশের মানুষেরা পুরনো বছরকে বিদায় দেওয়ার উৎসব করে থাকে।

এতে মেলা, গান-বাজনা ও খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশে বাংলার একটা বছর বিদায় নেয় এবং নতুন একটা বছরের সূচনা হয়। এই দেশে তাই বৈশাখি মেলার সূচনা হয় বৈশাখের আগে থেকেই মানে চৈত্রের শেষ দিক থেকে। তবে, বৈশাখের প্রথম দিনটিই আসলে উৎসবের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সবাই পরিষ্কার ও সুন্দর জামা-কাপড় পরে। ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। আর ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ছোটে মেলাতে।

বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে কৃষক, কামার, কুমোর, তাঁতি, ময়রা এবং অন্যান্য শিল্পী-কারিগরেরা যে সব সামগ্রী তৈরি করে, বৈশাখী মেলায় তা প্রদর্শন ও বিক্রি করার সুযোগ এনে দেয়। গ্রামীণ কৃষিজাত পণ্য, মিষ্টান্ন দ্রব্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, মাটি ও বেতের তৈরি শিল্পসামগ্রী প্রভৃতি নিয়ে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা দোকান সাজায় এই মেলায়। বাঁশ ও তালপাতার রঙিন বাঁশি, ভেঁপু, একতারা, দোতারা, ডুগডুগি, বেলুন, লাটিম, মার্বেল, ঘুড়ি-লাটাই, চরকি, পুতুল, মাটির ঘোড়া, কাঠের ঘোড়া, কাঠ, কাগজ ও বাঁশের পাখি, মাটির হাড়ি-বাসন, কলস, কাচের চুরি, পুঁতির মালা ইত্যাদি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে ছোট ছোট দোকানিরা।

এছাড়া আছে কাঠের আসবাবপত্র, খাট, পালঙ্ক, চৌকি, চেয়ার-টেবিল, আলনা, আলমারি, ঢেঁকি, পিঁড়ি, গাড়ির চাকা প্রভৃতি। মেলায় আরও পাওয়া যায় পিতলের হাড়ি, কলস, বাসন-কোসন, লাঙল-জোয়াল, লোহার দা, বটি, কুড়–ল, খন্তা, কাচি, নিড়ানি, গরুর গলার ঘুঙুর। ময়রারা তৈরী করে নানা রকমের মিষ্টান্নদ্রব্যÑ কদমা, জিলিপি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচের মিঠাই, খাগড়াই আরো কতো কি। বলে রাখা ভালো এসব মিষ্টান্নদ্রব্য মেলাতে আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে মেলার প্রচলিত রীতিকে ধরে। মুড়ি, মুড়কি, খই, চিড়ে, ছাচ খাজা, মোয়া, নারিকেলের নাড়–, বুট, চানাচুর, বাদাম ভাজা আর দিল্লির লাড্ডু, মটরভাজা, তিলের খাজা আজও মেলা আগত মানুষের প্রিয় খাবার।

বৈশাখি মেলার আরেক আকর্ষণ হচ্ছে তাঁতবস্ত্র। এই মেলাতে তাঁতিরা নিয়ে আসে নক্সীপাড়ের শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, বিছানের চাদর প্রভৃতি। মেলার একপাশে ছেলেমেয়েদের জন্য তৈরি জামা-কাপড়ও পাওয়া যায়। স্যাকরার দোকানে মেয়েরা ভীড় জমায় রূপা, তামা ও পিতলের গহনা কিনতে। বৈশাখী মেলায় গ্রামের কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের উন্নত জীবন গঠনের উপযোগী কিছু শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে।

এরমধ্যে রয়েছেÑ পশু প্রদর্শনী, চরকায় সুতা কাটা, গালার কারিগরি, গাছের চারা বা নার্সারি এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক প্রদর্শনী। গ্রামের মেয়েদের তৈরি নানাপ্রকার পাখা, মাদুর, কাঁথা, শিকে, বেত ও বাঁশের তৈরি হরেক রকম জিনিসপত্র সাজানো হয়। আর থাকে উন্নত ধরনের শাক-সবজি,উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, শস্যের বীজ প্রদর্শনী ও কেনার ব্যবস্থা।

যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মেলার যে রীতি ও ধরন আমাদের দেশে চালু রয়েছে, বৈশাখি মেলা তার সবটাই ধারণ করে আছে। যেমনÑ ১. বহু মানুষের সমাবেশ, ২. গানবাজনাসহ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, ৩. গ্রামীণ ব্যবহারিক শিল্পসামগ্রীর প্রদর্শনী ও বিক্রয়, ৪. বিভিন্ন রকমের খেলার আয়োজন।

মেলায় এসে মানুষ আনন্দের উপকরণ খোঁজে। তাই এখানে থাকে আনন্দলাভের নানা আয়োজন। পালাগান, বাউলগান, যাত্রা, কবিগান, গম্ভীরা, আলকাপ, জারিগান, পুতুলনাচ, সার্কাস প্রভৃতি বৈশাখি মেলার প্রধানতম সাংস্কৃতিক দিক। দেশজ খেলাধূলাও যে মানুষকে আনন্দ দিতে পারে তার প্রমাণ মেলে আমাদের বৈশাখি মেলায়। লাঠিখেলা, কুস্তি, হা-ডু-ডু, ঘুড়ি ওড়ানো, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, মোরগের লড়াই, বানেরর খেলা ইত্যাদি দেশজ মজার খেলা সবাইকে মাতিয়ে রাখে।

গ্রামই ছিল একসময় বৈশাখি মেলার প্রধান ক্ষেত্র। সাধারণত পথের তেমাথায়, তিন নদীর মিলনস্থানে, ফাঁকা মাঠে, কিংবা বিশাল অশ্বত্থ বা বট গাছের নিচে এই মেলা বসত। যেখানে নানান দিক থেকে অনেক লোক এসে জড়ো হতে পারত। কালক্রমে মেলার স্থান গ্রাম থেকে শহরে বি¯তৃত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

এখন তাই পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ সারাদেশের সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তবে, রাজধানী ঢাকা থাকে এই উৎসবের কেন্দ্রস্থলে। ছায়ানট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকায় নববর্ষের উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক) বৈশাখি মেলার আয়োজন করে আসছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত বিসিকের বৈশাখি মেলা দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখে বিসিক বৈশাখী মেলার আয়োজন করে, যেমন- ১. কুটির ও হস্তশিল্পজাত পন্যের বাজার সৃষ্টি,

২. গ্রামীণ কারুপণ্য শহুরে মানুষ ও বিদেশীদের সামনে তুলে ধরা, ৩. ক্রেতার চাহিদা সম্বন্ধে উৎপাদকদের অবহিত করা, ৪. কারুশিল্পীদের বিভিন্ন পণ্য, নক্সা ও নমুনার সঙ্গে মানুষের পরিচিতি ঘটানো। এবছর ঈদের ছুটির পর পরই পহেলা বৈশাখ পড়ে গেছে বিধায় বিসিক বৈশাখী মেলা ঈদের পর সুবিধাজনক সময়ে করবে বলে আশা করা যায়।

মনে রাখা দরকার, বৈশাখি মেলা কেবল একদিনেই শেষ হয় না। একদিন, তিনদিন, সাতদিন, পক্ষকাল, পুরো মাস আবার কোথাও-বা দুই মাসব্যাপীও বৈশাখি মেলা চলে। সারা বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কোনো না কোনো স্থানে বৈশাখি মেলা বসে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, যশোর, বরিশালসহ আরো অনেক জেলায় পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে মাসব্যাপী বৈশাখি মেলা চলতে থাকে।

উত্তরবঙ্গের উল্লেখযোগ্য বৈশাখি মেলার মধ্যে দিনাজপুরের আমবাড়ির মেলা, বগুড়ার গাঙনগরমেলা, যশোরের নিশিনাথ তলার মেলা, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-বিত্তিপাড়ার ঘোড়াপীরের মেলা এবং বরিশালের বাকালের মেলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ।

কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়ার চান্দনা গ্রামের বৈশাখি মেলা ছিল বিখ্যাত। এই মেলার আড়ম্বর, জাঁকজমক অন্যান্য মেলার চেয়ে বেশি হতো। এছাড়া, কুমিল্লা জেলার সিদলাই, কান্দুঘর, ময়নামতিসহ বিভিন্ন স্থানে বৈশাখি মেলার ঐতিহ্যের সুখ্যাতি রয়েছে। এ অঞ্চলে বৈশাখি মেলায় বিক্রির জন্য বাঁশের বাঁশি তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর, গোকর্ণঘাট, নবীনগর, খড়মপুর প্রভৃতি স্থানে বৈশাখি মেলা বসে।

চট্টগ্রামে বৈশাখী মেলার অন্যতম পর্ব ‘জব্বারের বলীখেলা’। একদিনের এই বলীখেলা উপভোগ করতে সমবেত হয় অসংখ্য মানুষ। চৈত্রের শেষে চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা আয়োজন করে ‘মহামুনির মেলা’। এই মেলা বর্ষবরণেরই অংশ। চট্টগ্রামের আদিবাসী মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসব পরিচিত সাংগ্রাই, বিঝু বা বিষু নামে। এই উৎসব উপলক্ষেও মেলা জমে ওঠে।

বর্তমানে প্রচলিত বৈশাখিমেলার তালিকা প্রণয়ন ও তার সম্পূর্ণ বিবরণসহ আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্রে নথিভুক্ত করা জরুরি। ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এই বৈচিত্র্যময় রূপ তুলে ধরতে পারলে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সময় এদেশে যেমন প্রচুর বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটতো, তেমনি নতুন প্রজন্ম বৈশাখি মেলার ঐতিহ্য সুরক্ষায় সচেতন হতো।

বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো এবং বৈশাখি মেলায় অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা উদ্ধুদ্ধ হতেন ঐতিহ্যপ্রেমে। এমনকি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সাধনা বিস্তার ঘটতো এবং বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তো।

লেখক: বিশিষ্ট লোক-ঐতিহ্য গবেষক, নাট্যকার ও উপ-পরিচালক, সংস্কৃতি উপবিভাগ, বাংলা একাডেমি। 

;