ভ্রমণসাহিত্যে দৃশ্যমান অনিন্দ্য জগৎ
বহুবছর আগে সৈয়দ মুজতবা আলী আফগানিস্তানের মানুষ ও প্রকৃতির যে প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়েছেন, হালআমলের শত শত মিডিয়ায় উদ্ভাসিত তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের বিবরণে সেটা পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ বিবরণগুলো এখনও চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে সর্বশ্রেণির পাঠকদের। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'ছবির দেশে কবিতার দেশে' ফরাসি শিল্প-সাহিত্যের সৌরভে সবাইকে আবিষ্ট করে।
প্রকৃষ্ট ভ্রমণসাহিত্যে উদ্ভাসিত হয় বহুমাত্রিক বিন্যাসের দোলা। দৃশ্যমান হয় অনিন্দ্য জগৎ, মানুষ, সংস্কৃতি, রুচি, আহার্য। ভ্রমণসাহিত্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি, স্মৃতিকথা, ইতিহাসবোধ এবং একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে ভ্রমণ গাইড বা প্রাসঙ্গিক তথ্যাভিজ্ঞতা। মানবসভ্যতার বহমান পথ পরিক্রমায় ভ্রমণসাহিত্য প্রাচীনত্বের দাবি করলেও তা চির নতুন ও সমকালীন।
ভ্রমণ থেকেই হয় ভ্রমণকাহিনী। কিন্তু ভ্রমণকারীদের সকলের হাত দিয়ে তা নির্মিত হয় না। সাহিত্যের যেমন নানা অর্থ ও প্রকার, তেমনি ভ্রমণ রচনাও নানা ধাঁচের। যে-ভ্রমণরচনা আকর্ষণীয় পাঠযোগ্যতায়, জীবন পর্যবেক্ষণে, প্রকৃতি অবলোকনে, এবং বারংবার পড়ার কৌতূহল জাগিয়ে তোলে, সেটিকেই বলা চলে প্রকৃত ভ্রমণসাহিত্য।
কারণ, শুধু বেড়ানোর প্রসঙ্গকথা হলেই চলবে না, সাহিত্যের স্বাদ লাগবে, ইতিহাসের ছোঁয়া থাকবে, তাহলেই বেড়ানোর মতো, সাহিত্যপাঠে হাওয়াবদলের স্বাদ পাওয়া সম্ভব। ভ্রমণ কেবল তথ্য-সর্বস্ব হলে রচনা ঝোঁকে গাইডবুকের দিকে, চরিত্র ও কাহিনী-বর্ণনা যদি বড়ো হয়ে ওঠে তাহলে তা হয়ে ওঠে ভ্রমণ-উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে এমনই বহু স্বাদের ভ্রমণসাহিত্য পাওয়া যায়।
প্রবোধ সান্যালের 'মহাপ্রস্থানের পথে', অবধূতের 'মরুতীর্থ হিংলাজ' ভ্রমণ-উপন্যাস। জোনাথন সুইফট এর 'Gulliver's Travels', স্টিভেনসন এর 'Travels with a Donkey' বানিয়ান এর 'Pilgrim's Progress', গ্রাহাম গ্রীন-এর 'Travels with my Aunt' প্রভৃতিও এই ঘরানার।
অনেকেই জানেন, শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত 'শ্রীকান্ত' ধারাবাহিক প্রকাশের সময় নাম ছিল- 'শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী'। অনেকে সাহিত্যিক হতে ভ্রমণকথা লিখেছেন। আবার সাহিত্যিক না হয়েও রচনা করেছেন ভ্রমণ বিবরণী।
সাহিত্যিক জলধর সেন, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর, সৈয়দ মুজতবা আলী জনপ্রিয় ভ্রমণসাহিত্য উপহার দিয়েছেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রামনাথ বিশ্বাস প্রমুখ সাহিত্যিক না হয়েও ভ্রমণসাহিত্য রচনা করেছেন। যেসব কালজয়ী গ্রন্থ সাহিত্য পাঠের অনুভবে, জীবন ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে, মন্তব্যে, বিবরণে বারংবার পাঠে আগ্রহী করে তোলে সবাইকে। ভ্রমণসাহিত্য, সাহিত্যিক লিখুন কিংবা অন্য কেউ লিখুন, সে লেখাকে হতে হবে ভ্রমণ-কাহিনী, কিন্তু সাহিত্য গুণান্বিত, তবেই সেটা সফল ও কালজয়ী হতে পারে।
কয়েকটি বই এখনও সুখপাঠ্য। যেমন, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পালামৌ'। যৌবনে ঘুরতে গিয়ে পাহাড়ের বর্ণনা, কোল পুরুষ ও নারীর বর্ণনা, লাতেহার পাহাড়ের কিছু অভিজ্ঞতা উপস্থাপন থেকে তার দেখার চোখ, তীক্ষ্ণ, কাব্যময়, ভাবনাবাহী মনের পরিচয় মেলে। এ বইয়ে উপন্যাস ও প্রবন্ধের কিছু উপাদান যেমন পাওয়া যায়, তেমনিভাবে চিত্তের গতিশীলতায় ভ্রমণের আনন্দও অনুভূত হয়।
জলধর সেনের ভ্রমণ বিষয়ক বই দশটি, তার মধ্যে 'হিমালয়' বইটি (১৯০০) অতি জনপ্রিয়। কন্যা ও স্ত্রীর অল্পদিন ব্যবধানে মৃত্যুর পর ১৮৯০ নাগাদ তিনি বদরিকাশ্রম অভিমুখে রওনা হন। তিনি ও মহেন্দ্র দত্ত যে হিমালয় দেখেছেন (১৮৯৪) তা আজ বদলে গেছে। কিন্তু দেবপ্রয়াগের শোভা, রুদ্রপ্রয়াগ থেকে পিপল চটির তৎকালীন দুর্গমতা, বদরিগামী পথবৈচিত্র্য, বরফ কেটে রাস্তা তৈরি, যোশীমঠের পথের অলৌকিক সৌন্দর্য, ব্যাসগুহায় তুষারাচ্ছন্ন নদীপরিসর ইত্যাদির বর্ণনা একালের পাঠককে নানা ঔৎসুক্যে প্রাণিত করবে। বইটিতে আছে বানিয়ানের পিলগ্রিমস্ প্রগ্রেস, একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত, আনন্দমঠ, বিবর্তনবাদ, মেসমেরিজম, থিয়োসফি শঙ্করাচার্যের উল্লেখের মতো স্বর্ণলতা উপন্যাসের কথা, বদরির পাণ্ডা প্রসঙ্গ বা ঈশ্বর গুপ্তের পাঁঠা বিষয়ক কবিতা, শেক্সপীয়র, মীরাবাঈ-এর উল্লেখ, যা মননশীল পাঠককে আগ্রহী করে তুলে।
কলকাতার উত্তর প্রান্তের গঙ্গা তীরের বরাহনগর মঠের ঘরে বসে বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাইদের বলেছিলেন, 'এই শেষ আর ফিরছি না।' ১৮৯০ সালের জুলাই কলকাতা ছাড়েন তিনি। ফিরেন সাত বছর পর ২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ সালে। তিনি বলেছিলেন, 'আমাদিগকে ভ্রমণ করিতেই হইবে, আমাদিগকে বিদেশ যাইতেই হইবে ... যদি আমাদিগকে যথার্থই পুনরায় একটি জাতিরূপে গঠিত হইতে হয়, তবে অপর জাতির চিন্তার সহিত আমাদের অবাধ সংস্রব রাখিতেই হইবে।'
তার ভ্রমণের ১ম পর্ব জুলাই ১৮৯০ থেকে জানুয়ারি ১৮৯১: সাতমাস গুরুভাইদের সঙ্গে হিমালয়ে সাধনা ও তীর্থ ভ্রমণ। ইচ্ছে ছিল নেপাল হয়ে তিব্বত যাবার, কিন্তু অসুস্থতায় তা হয় নি। এর পর জানুয়ারী ১৮৯১ থেকে ৩১ মে ১৮৯৩ এই দুবছর চারমাস নিঃসঙ্গ একক ভ্রমণ - উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের রাজ্যগুলো, তারপর পুনা, গোয়া, ব্যাঙ্গালোর, মহীশূর, ত্রিবান্দ্রাম, কন্যাকুমারিকা, রামেশ্বর, রামনাদ, মাদুরাই, পণ্ডিচেরী, মাদ্রাজ, হায়দ্রাবাদ, তারপর বোম্বাই থেকে জাহাজে বিদেশ ৩১ মে ১৮৯৩, শেষ ৩০ জুলাই ১৮৯৩ শিকাগো পৌঁছে। ৩য় পর্ব - বিশ্ব ধর্মসম্মেলনে বক্তৃতা দিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপ ভ্রমণ এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ কলকাতা ফেরা ছবছর সাত মাস পর। এই তিন পর্বের মধ্যে তৃতীয় পর্বের ভ্রমণ কথা পাওয়া যায় পাশ্চাত্ত্য শিষ্য ও অনুরাগীদের লেখা থেকে।
সংস্কৃতে একটি শব্দ আছে, 'চরৈবেতি'। ঋগ্বেদের ঐতরেয় ব্রাহ্মণের রচয়িতা ঋষি ঐতরেয়'র প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সপ্তম পঞ্জিকার তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় খণ্ডে বলা হয়েছে, 'চরৈবেতি, চরৈবেতি': 'তুমি চলিতে থাক, চলিতে থাক'।
নিত্য সচলতার, নিত্য অগ্রসর হওয়ার একটি শাশ্বত মহামন্ত্র রূপে শব্দটি ব্যবহৃত হলেও তা আসলে নিত্য ভ্রমণেরও তাগিদ দেয়। দুর্ভাগ্যের অবসানে সৌভাগ্যের বিনির্মাণে কর্মে পাশাপাশি সচলতার অপরিহার্যতা আসলেই অনস্বীকার্য, যা মানুষকে স্থবিরতা থেকে মুক্তি দেয় এবং ভ্রমণে অনুপ্রাণিত করে। এসবই সবিস্তারে স্থান পায় মানুষের জীবনে এবং চিরায়ত ভ্রমণসাহিত্যে।