বরেণ্য সম্পাদক মুজীবুর রহমান খাঁ স্মরণে
প্রবীণ সাংবাদিক, কথাশিল্পী ইউসুফ শরীফের সঙ্গে ৫ অক্টোবর (মঙ্গলবার) দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয় টেলিফোনে। 'গল্প ব্রহ্মপুত্র' নামে একটি বই তিনি সম্পাদনার কাজ করছেন। বিগত একশত বছরে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার জনজীবন, সংস্কৃতি, সভ্যতা, প্রেম, সংঘাত, সংগ্রাম ছুঁয়ে রচিত গল্পগুলোকে একত্রিত করতে প্রয়াসী তিনি। সাহিত্যে নদীর সাধারণ উপস্থিতিকে ব্রহ্মপুত্রের সংশ্লেষে আরও বিশেষায়িত অভিব্যক্তিতে প্রকাশের লক্ষ্যে গৃহীত তাঁর প্রয়াসে বাংলা সাহিত্যের প্রায়-সকল নমস্য লেখকের গল্পই থাকছে। যার মধ্যে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে শীর্ষেন্দু, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শহীদ আখন্দ, রাহাত খান, হারুন হাবীব থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের গল্পকারের লেখাও রয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা বলতে চীন, তিব্বত, ভারত, বাংলাদেশ ব্যাপী এশিয়ার দীর্ঘতম জনপদ ও জনগোষ্ঠীকে শনাক্ত করা সম্ভব এবং বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ, বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং সন্নিহিত জনপদ অন্তর্ভূক্ত। বিশাল ভূগোল ও জনমানুষের মতোই ব্রহ্মপুর বিধৌত মৃত্তিকা থেকে উত্থিত লেখক-সাহিত্যিকের সংখ্যাও যেমন বিশাল, তাঁদের কৃতিত্বও তেমনিভাবে বহুমাত্রিক ঔজ্জ্বল্যযুক্ত। এসব লেখকদের প্রসঙ্গেও আলাপ বিস্তৃত হয় ইউসুফ শরীফের সঙ্গে কথোপকথনে। অবধারিতভাবে আসেন বরেণ্য সম্পাদক মুজীবুর রহমান খাঁ। যদিও আমরা কেউই জানতাম না যে, কাকতালীয় ভাবে দিনটি তাঁর ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।
অবিভক্ত বঙ্গদেশের অন্যতম বিশিষ্ট সাংবাদিক-সম্পাদক মুজীবুর রহমান খাঁ ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা-প্রথম সভাপতি। ১৯১০ সালের ২৩ অক্টোবর নেত্রকোনার উলুয়াটি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি এবং ১৯৮৪ সালের ৫ অক্টোবর ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।
তিনি নেত্রকোনার আঞ্জুমান হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৯২৮) এবং আনন্দ মোহন কলেজ থেকে বি.এ (১৯৩৪) পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম.এ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে চব্বিশ পরগনার হারুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। এর পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতাও শুরু করেন। তিনি প্রথমে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক (১৯৩৬-৩৯) এবং পরে যুগ্মসম্পাদক (১৯৩৯-৬৫) হন।
পরবর্তীতে তিনি সাপ্তাহিক কমরেড (কলকাতা), মাসিক মোহাম্মদী (ঢাকা) ও দৈনিক পয়গাম-এর সম্পাদক (১৯৬৫-৭১) এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে আজাদ পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি হন।
মুজীবুর রহমান খাঁ বিভিন্ন সামাজিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি অল বেঙ্গল অ্যান্টিফ্যাসিস্ট রাইটার্স গিল্ডের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির (১৯৪৪) সম্পাদক, ভারতের প্রথম গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য (১৯৪৬), পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক (১৯৫৪), পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক এবং বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর সহসভাপতিরূপে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আলাপন সাহিত্য গোষ্ঠী(১৯৭৬) ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা(১৯৮২)-এর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।
মুজীবুর রহমান খাঁ সাহিত্য, ইতিহাস, জীবনী ইত্যাদি বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। বিলাতে প্রথম ভারতবাসী (১৯৩৯) গ্রন্থে তিনি বিলাত সম্পর্কে ভারতীয়দের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তাঁর অন্যান্য রচনা হচ্ছে: পাকিস্তান (১৯৪২), সাহিত্যের সীমানা (১৯৬৭), সাহিত্য ও সাহিত্যিক (১৯৭১), মহানবী (১৯৮০), আমাদের ইতিহাস, সাহিত্যের বুনিয়াদ ইত্যাদি।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ‘সেতারা-ই-কায়েদে আজম’ এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (১৯৮০) লাভ করেন। দীর্ঘজীবন লাভকারী এই বরেণ্য সাংবাদিক-সম্পাদক একটি প্রতিষ্ঠানের মতো বিভিন্ন পত্রিকা ও তরুণ সাংবাদিক তৈরি করেছিলেন। অবিভক্ত বঙ্গদেশ তথা পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন মুজীবুর রহমান খাঁ।