মাসুদ খানের প্রিয় কবিতা
পারাপার
কথা ছিল, দেব যৌথসাঁতার। অথচ কথা ভেঙে
একক ডুবসাঁতারে একা চলে এলাম এ-লোকান্তরে
তোমাকে ছাড়াই, ওগো সহসাঁতারিনী।
অনেক তো হলো পরলোকে!
এইবার সাঙ্গ করি পরপারলীলা
দিই আরো একটি অন্তিম ডুব।
ভেঙে দিয়ে এপার-ওপার ভুয়া ভেদরেখা
এক ডুবে ছুটে আসব পরলোক থেকে
সোজা ইহলোকেই আবার।
তোমাকে দেখার কী যে দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আমার!
গিয়ে দেখে আসি-- ওহে মুক্তকেশী,
আজ কোন লকলকে লাউডগা সাপে
বেঁধেছ তোমার
শিথিল চুলের রাশি।
উচ্চতর বাস্তবতা
মায়েরা মৃত্যুর পর দেহ ছেড়ে চলে যান দূরের বিদেহপুরে।
তারপর প্রতিদিন ওই ব্যস্ত বিদেহনগর থেকে এসে
ঘুরে ঘুরে দেখে যান যার-যার ছেড়ে-যাওয়া সোনার সংসার।
অন্তত প্রথম ত্রিশ দিন।
কী করছে আহা সোনামণিরা তাদের,
কেমনই-বা কাটছে তাদের দিন, মাতৃহীন
বিষাদবাতাস, বাষ্পঘন দীর্ঘশ্বাস
ফাঁকা-ফাঁকা ঘরদোর, আশপাশ
মায়ের অভাবে উঠানের কোণে বিষণ্ন দাঁড়ানো জবাগাছ।
নবমৃত মায়েদের কি-জানি কেবলই মনে হতে থাকে
বেঁচেই আছেন তারা সংসারে, হয়তো
সংসারেরই ভিন্ন কোনো সম্প্রসারে, ঘুমঘোরে,
অন্যতর মায়ায়, আবেশে।
যেমন জন্মের অব্যবহিত পরের দিনগুলি...
নবজাতকের কাছে
বোধ হতে থাকে যেন সে রয়েছে তখনো মায়েরই গর্ভকোষে।
উপমান
তোমার মুখের ওপর ঝেঁপে নেমে আসছে বেসামাল কেশদাম, খেয়ালি হাওয়ায়।
তারই ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে এক লালচে নির্জন দুষ্টব্রণ, গণ্ডদেশে তোমার-
যেন পুঞ্জাক্ষ আনারসের ঝোপে ছোট্ট এক রূপদক্ষ গিরগিটি...
অতিদূর অতীত থেকে ভেসে আসে দূরগামী তূর্ণ ট্রেনের সিটি।
অলুক, অনশ্বর
তোমরা কারা? কতদূর থেকে এলে?
মনোহরপুর? মধুপ্রস্থ? লীলাস্থলী? অবাকনগর?
কোন যুগেরই-বা তোমরা?
উপলীয়? তাম্র? প্রত্ন? নাকি নুহের আমল?
যে যেখান থেকে যে-যুগ থেকেই আসো-না-কেন
একই জাহাজের যাত্রী আমরা এ অকূল মহাকাশে।
সহযাত্রী, এবং সমবয়সী।
তোমাদের বয়স প্রায় চৌদ্দ শ কোটি বছর, আমাদেরও তা-ই।
যে-যে কণিকায় গড়া দেহ তোমাদের, আমাদেরও তা-ই।
অমরতা চাও? চাও অন্তহীন পরমায়ু?
বিলাপ থামাও, শোনো, আমরা যে যখনই আসি
অমরতা নিয়েই আসি হে অমৃতের সন্তান—
অলুক, অব্যয়, অনশ্বর, চির-আয়ুষ্মান।
জরা ব্যাধি মন্বন্তর মহামারী অনাহার অত্যাচার গুম খুন দুর্বিপাক দুর্ঘটনা
কোনো কিছুতেই হবে না কিছুই, ধস নেই, মৃত্যু নেই,
ক্ষয়ে যাওয়া ঝরে যাওয়া নেই
শুধু বয়ে চলা আছে, রূপ থেকে রূপান্তরে,
রূপক থেকে ক্রমশ রূপকথায়...
জলে স্থলে মহাশূন্যে অগ্নিকুণ্ডে...কোত্থাও মরণ নাই তোর কোনোকালে...
সাড়ে চার শ কোটি বছরের পুরনো এক সজল সবুজ
কমলা আকারের মহাকাশযানে চড়ে
চলেছি সবাই এক অনন্ত সফরে।
অপ্রাকৃত
ছোট্ট একটি ট্রেন— কিশোরী-বয়সী। অসুস্থ, অর্ধবিকল।
পরিত্যক্ত লোকোশেড ছেড়ে
নিশীথে বেরিয়ে পড়ে একা, নিশ্চালক।
সারারাত কোথায়-কোথায় কোন পথে ও বিপথে ঘুরে বেড়ায়...
কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, গ্রাম-গঞ্জ-শহর পেরিয়ে...
রেললাইন ছেড়ে নেমে যায় মাঠে। চলতে থাকে মাঠের ভেতর
পৌষের শূন্য শীতার্ত মাঠ...
সুখী মানুষেরা ঘুমে। অসুখীরা নির্ঘুম, ঊনপ্রাকৃতিক—
দীর্ঘনিশ্বাসের আতসবাতাসে একাকার তাদের ঐহিক-পারত্রিক।
ঘুমে-ঢুলুঢুলু স্টেশনের বিধ্বস্ত কোণে
কয়েকজন নির্দন্ত নুলা ভিখারি সোল্লাসে মেতেছে সম্মিলিত স্বমেহনে।
পথ থেকে এক পথকিশোরকে গাড়িতে উঠিয়ে নিচ্ছে দুই সমকামী
সদ্যমৃত শিশুর লাশ তুলে নিয়ে পালাচ্ছে এক শবাহারী।
কাঁপতে কাঁপতে এগুচ্ছে চোখবাঁধা এক হতভাগা,
ক্রমে ক্রসফায়ারের দিকে।
তা দেখতে পিছু নিয়েছে দুই রোঁয়া-ওঠা ঘেয়ো ক্ষুধার্ত কুকুর
আর রাজ-রহমতে সদ্য-ছাড়া-পাওয়া এক মৃত্যুসাজাপ্রাপ্ত খুনি।
বাসায় বাসায় বন্দি, নির্যাতিতা শিশু পরিচারিকাদের স্ফুট-অস্ফুট কান্না...
এসব কোন অ্যাবসার্ড নাটকের নিষ্ঠুর নাট্যায়ন, ঘূর্ণ্যমান নাটমঞ্চে!
শেষ অঙ্ক থেকে পিচকারির বেগে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে সমাপ্তিসংগীত—
পরাজিত মানুষের শোচনা ও খুনির নৈশ নিভৃত অনুশোচনা
এ-দুয়ের মিশ্ররাগে জেগে-ওঠা এক নিষ্করুণ গান।
প্রাকৃত-অপ্রাকৃতের ভেদ ভুলিয়ে-দেওয়া সব দৃশ্যনাট্য
ঠেলে উজিয়ে চলেছে সেই পালিয়ে-বেড়ানো ট্রেনটি।
কেউ কি দেখেছে ট্রেনটিকে?
—কেউ না।
শুধু পরান মল্লিকের চির-রোগা রাতজাগা ছেলেটি বারবার বলে যাচ্ছে—
“অনেক রাতে জানালা খুলে দেখি-কি,
আগাগোড়া ফিনফিনে কুয়াশা-কালারের হিজাবে মোড়া
নূপুর-পরা এক ঘরপালানো গৃহবধূ
ত্রস্তপায়ে ঝুমঝুম শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে দূরে
আরো অধিক কুয়াশার ভেতর।"
কিন্তু কেউ বিশ্বাস করছে না তার কথা।
সাবানগাছ
নদী দিয়ে কত কী যে ভেসে আসে! আমাদের নদী দিয়ে।
নানান দেশের ওপর দিয়ে বয়ে আসা আমাদের নদী।
একবার উজান দেশের এক ভূমিকম্পে ভেসে এসেছিল শয়ে শয়ে শালগাছ...
সেগুলি ধরে ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা দমাদম বানিয়ে নিয়েছে
বাস্তুঘরের খুঁটি। এখনো টিকে আছে।
একবার ভেসে যাওয়া এক শালপ্রাংশু মরদেহ ধরে এনে
পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। কিছুই গজায়নি।
আরও আসে ভেসে জলজ্যান্ত মানুষ-মানুষী-
সাপে-কাটা, অজ্ঞান, মাকড়ে-কাটা, গুম-হওয়া, ঘুম-পাওয়া, আর
মাঝে মাঝে ঘুমন্ত মানুষ।
ওই যে আমাদের ছোটকাকি, হলদে পাখি হয়ে উড়ছেন এঘর ওঘর,
একদিন তিনিও এসেছিলেন ভেসে, ভেলায় ঘুমন্ত শিশু, আমাদের নদী দিয়ে।
ওই যে রাজপুরুষের মতো উপচানো ঢেউ-জাগানো মেজফুফা,
তিনিও তো নদী-ভাসা, তাকেও তো পাই এই নদীটি থেকেই...
নদীতে মানুষ পাই আর ধরে এনে জুড়ে দিয়ে সংসারে লাগাই।
আর ভেসে আসে বিচিত্র সব ফল ও বীজ।
একবার এক অচেনা বীজ এনে পুঁতে দিলেন আমার বাবা।
ভেবেছিলেন, হবে হয়তো কোনো সুমিষ্ট ফল, বিরল জাতের।
বীজ ফুটে গজায় গাছ। গাছ বাড়ে দিনে দিনে।
ফল হয়। পাকে। পাকা ফল থেকে,
এ কী! সাবানের ফেনার মতো শুধু ফেনা!
কোথায় সুমিষ্ট ফল, কোথায় কী!
বৃক্ষ, তোমার নাম?
-ফল-এ পরিচয়।
ফলে, গাছটির নাম হলো সাবানগাছ।
কাক যখন দ্যাখে যে, কী! তারই বাসার ডিম থেকে ফোটা বাচ্চারা
দিনে দিনে হয়ে উঠছে কেমন ভিন্ন আদলের, কণ্ঠে ফলছে ভিন্নরকম স্বর,
তখন যে বিরক্তি, বিস্ময়, ও অসহায়ত্ব নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে বাচ্চাদের দিকে--
বাবাও সেরকম তাকিয়ে থাকতেন ওই সাবানতরু আর সাবানফলের দিকে
বহুদিন, বহুবছর। আবার গুনগুন করে গাইতেনও-
‘বাঞ্ছা করি সুমিষ্ট ফল পুঁতলাম সাধের গাছ
ফাঁকি দিয়া সে গাছ আমায় ঝরায় দীর্ঘশ্বাস
মনে দুঃখ বারোমাস...’
তারপর একদিন তো তিনি নিজেই গত হলেন;
নদী থেকে পাওয়া সেই অদ্ভুত ফলের গাছ
একদিন নদীই ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
তবে ওই সাবানফলেরা বহুবছর ধরে আমার বাবার ময়লা সন্তানদের
ততোধিক ময়লা পোশাকগুলিকে ঋতুতে ঋতুতে কিছুটা হলেও
ফর্সা ও উজ্জ্বল করে দিয়ে আসছিল...
ব্লিজার্ড
আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দাপিয়ে ফিরে
সমগ্র নীলিমা তছনছ করে দিয়ে
কোটি-কোটি দুষ্ট দাপুটে শিশু খেলছে হুলুস্থুল বালিশ ছোড়ার খেলা।
অজস্র কার্পাস ঝরছে
লক্ষকোটি বালিশফাটানো তোলপাড়-করা অফুরন্ত তুলা।
যেন তুলারাশির জবুথবু জাতক হয়ে পড়ে আছে ধীরা ধরিত্রী, বিব্রত বেসামাল।
সাথে উল্টাপাল্টা ঝাড়ি একটানা বেপরোয়া বাবুরাম পাগলা পবনের।
আবার কোত্থেকে এক নির্দন্ত পাগলীর আকাশ-চিরে-ফেলা ওলটপালট অট্টহাসি
মুহুর্মুহু অট্টালিকায় প্রতিহত হয়ে ছুটছে দিশাহারা দিগবিদিক
ঘরবাড়ি মিনার-ময়দান বাহন-বিপণী আড়ত-ইমারত গাছপালা বন বন্দর বিমান
সবকিছুর ওপর এলোপাথাড়ি থার্ড ডিগ্রি চালিয়ে বের করে আনছে
তুলকালাম গোপন তথ্য, তুলাজটিল শীৎকার।
প্রহ্লাদপুরের জঙ্গল
(রামকৃষ্ণ পরমহংস...)
রামশরণ ব্যাধ গিয়েছিল শিকার করতে, প্রহ্লাদপুরের জঙ্গলে। শিকার মিলেছে প্রচুর। শিয়াল, শজারু, শকুন, গোধিকা, গন্ধগোকুল, ফেজান্ট, কাছিম...। মেলেনি কেবল কাক আর বক; ওদেরকে তো আগেই ভস্ম করে দিয়েছে তপস্বী। দুপুরের দিকে পশুপাখিগুলিকে কেটেকুটে মাংসের ভাগা দিয়ে বসেছে ব্যাধ, পাকুড় গাছের নিচে। সাতমিশালি মাংস, বিক্রি হচ্ছে খুব। শব হয়ে শুয়ে আছে শিব। কালী লীলা করছে তার বুকের ওপর, যেভাবে প্রকৃতি লীলা করে পুরুষের ওপর; জীব, পরমের। বালিতে মেশানো চিনি, নিত্য-র সাথে অনিত্য যেমন। এসো পিঁপড়া দলে-দলে, সিরিজে-সিরিজে, বালি রেখে চিনি বেছে খাও...
ফেরার পথে একটি ঘাসখেকো বাঘের শাবকও সাথে করে এনেছে রামশরণ। জন্মের পরপরই মেষেদের সঙ্গে চলে গিয়েছিল আলাভোলা ব্যাঘ্রশিশু। সে এখন ঘাস খায় বটে, কিন্তু রাগ আছে ঠিকই, ক্ষাত্রতেজ অব্যাহত...ঠাস-ঠাস করে থাপড়ায়, দাবড়ায় বড়-বড় নিরীহ ভেড়াদের।
হর্ষতরঙ্গ
সরো সরো, ঈশান থেকে তিরের বেগে ওই নেমে পড়ছে হংসবাহিনী— উঠানে, অঙ্গনে, ধানখেতে, নয়ানজুলিতে। আর নৈর্ঋত থেকে ছুটে আসছে দস্যি বাচ্চারা। এসেই দুই ডানা পাকড়ে ধরে উঠে পড়ছে রাজহাঁসের পিঠে। তা-ই দেখে ঘাস থেকে মুখ তুলে মুচকি হাসছে খরগোশ, প্রশাখাজালের আড়াল থেকে কাঠবিড়ালি।
এক হোঁদলকুতকুতে, দুষ্টের চূড়ামণি, এমনিতেই লেট লতিফ, তদুপরি পিছিয়ে পড়ছে বারবার, কুকুরছানার কান মলে দিয়ে, পোষা শজারুর শলাকা ধরে টান মেরে, খুচরা নটাংকি সেরে, দুই কাঁধে দুই অস্থির গুঞ্জরণরত বাচ্চা বসন্তবাউরিকে বসিয়ে নিয়ে এগিয়ে আসছে শেষ হংসবাহনের দিকে। হাঁসটি তখনো নয়ানজুলির জলীয় রানওয়েতে। উড়ালে উন্মুখ। বাচ্চাটি জলকাদা মাড়িয়ে এসে আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে কোনোমতে হাঁকুচ-পাঁকুচ করে উঠে পড়ছে সর্বশেষ হংস-ফ্লাইটে। পেছন পেছন আলপথে হেলেদুলে আসছে কান-মলা-খাওয়া নাদুসনুদুস কুকুরছানাটিও।
তুলাপ্রসূ সব শিমুলের গাছ, ফলপ্রসূ সব আম ও আমড়া বাগান। তাদের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে হংসবাহিনী। এক-একটি হাঁসের পিঠে এক-একটি শিশু। উড়ে যেতে যেতে উৎফুল্ল বাচ্চারা ভূমণ্ডলের দিকে উড়ন্ত চুমু ছুড়ে দেবার মুদ্রায় ফুঁ দিচ্ছে হাতের তালুতে। একবার ডান হাত, আরেকবার বাম। দুই দিকে জেগে উঠছে ছোট-ছোট হাওয়াহিল্লোল। আর সেই হিল্লোলের হালকা ধাক্কাতেই সঙ্গে-সঙ্গে নিচে আগুন ধরে যাচ্ছে হুলুস্থুল কৃষ্ণ- ও রাধাচূড়ায়, আর আমের পাতারা খিলখিল আহ্লাদে ঢলে পড়ছে প্রতিবেশী আমড়ার পাতাপল্লবের ওপর।
আজ আগুনে-বাতাসে গুলতানি, পলাশে-শিমুলে শয়তানি,
আমে-আমড়ায় দুষ্টামি একটানা
আর সাগর দুলছে পাহাড় ঢুলছে আকাশ ঝুলছে মাথার ওপর উড়াল শহর
ভোলাভালারা ভুলছে, লহরি তুলছে, ধীরে ঊর্ণা খুলছে মেঘের বহর...
কৌতুকবিলাস
ঈশ্বর ছুড়েছে ঢিল ঈশ্বরীর দিকে, কৌতুকবিলাসে।
গ্রহটিকে মাটির ঢেলা বানিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের এক প্রান্ত থেকে
ক্ষেপণ করেছে ভগবান, অন্য প্রান্তে থাকা ভগবতীর প্রতি।
মহাকাশ জুড়ে প্রসারিত মহাহিম শূন্যতা, লক্ষ-ডিগ্রি নিস্তব্ধতা—
তারই মধ্য দিয়ে একপিণ্ড ছোট্ট শ্যামল কোলাহল হয়ে
ধেয়ে যাচ্ছে এই ঢিল।
ঢিল নয়, মহামিসাইল—
মহাকাশের জোনাক-জ্বলা ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে
একের পর এক যমজাঙাল পেরিয়ে মিথ্যা-ইথারে অস্থির
ঢেউ তুলে ছুটছে ঢিল অহেতু আহ্লাদে
গোঁয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের মতো একদিকে টাল হয়ে চক্কর খেতে খেতে
ঘোর-লাগা লাটিমঘূর্ণনে
আহ্নিকে বার্ষিকে ধোঁয়াজট বেগব্যঞ্জনায়—
যে বেগ উদ্ভ্রান্ত, যেই গতি একইসঙ্গে ঋজুরেখ বক্র চক্রাকার
ঘূর্ণ্যমান নাটকীয় একরোখা দুর্ধর্ষ ও ওলটপালট...
ছুটতে ছুটতে হয়রান ঢিলখানি।
ওদিকে ঈশ্বরী, ওই রাঘবরহস্যে-ঘেরা উত্তুঙ্গ রহস্যরাজ্ঞী,
সর্বনাশা এক ভাব-আলেয়ার ভাব ধ’রে অজ্ঞাত স্থানকালাঙ্কে ব’সে
থেকে-থেকে ছিনালি-হাতছানি একটু দিয়েই সরে যাচ্ছে দূরে।
মুহূর্তে মুহূর্তে ফুলে-ফেঁপে ওঠে মহাকাশ।
বেঁকে-যাওয়া, বাঁকতে-থাকা, ক্রমপ্রসারিত
এক দেশকালের ভেতর দিয়ে ঘটতে থাকে
ঢেলাটির উদ্ভ্রান্ত উন্মাদ ছুটে-চলা। আর
ছিটকে পড়ার ভয়ে ভয়ার্ত শিশুর মতো ছুটন্ত ঢেলার গা আঁকড়ে ধ’রে
চাম-উকুনের মতো চিমসা দিয়ে পড়ে থাকে প্রাণপণ
তটস্থ ও অসহায় প্রাণিকুল।
খেলা করে ভগবান ভগবতী— বিপজ্জনক ঢিল-ক্ষেপণের খেলা।
আর রোমাঞ্চে ও ত্রাসে শিউরে-শিউরে কেঁপে ওঠে তাদের শিশুরা।
ফাতনা
সরল ছিপের এক প্রান্তে মাছশিকারি, চুপচাপ,
অন্য প্রান্তে মাছ।
মাঝখানে নিরীহ ফাতনা— ভাসে নিরুপায়, মধ্যপক্ষরূপে।
তাকায় চঞ্চল শিকারের দিকে একবার, পরক্ষণে ধূর্ত শিকারির প্রতি।
জগতের প্রত্যেকটি ঘটনার তীব্র, তুঙ্গ মুহূর্তে হাজির থাকে
তৃতীয় একটি পক্ষ। থাকে এক সুদর্শন মাছরাঙা—
বড়শির বিবেকের মতো বাঁকা, রঙিন, আকর্ষণীয়।
আর এই সমস্তকিছুর মৌনী মধ্যস্থতা আকারে ভাসতে থাকে
একা এক শোলার ফাতনা।
নিঃসঙ্গ
লক্ষ-লক্ষ মাইল উঁচুতে, মহাকাশে,
জনমানববিহীন ভাসমান একটি স্পেস-স্টেশনে পোস্টিং পেয়ে
এসে জয়েন করেছে এক স্টেশনমাস্টার।
একদিন একটি রকেট এসে প্রচুর বোঁচকা-বুঁচকিসহ তাকে নামিয়ে দিয়ে,
ফুয়েল-টুয়েল নিয়ে কোথায় যে চলে গেল কোন আসমানের ওপারে...
সে-ও কতদিন আগে!
মৃত্যুরও অধিক হিম আর নির্জনতা...
মানুষটি একা-একা থাকে, খায়, ঘুমায়— ওজনহীন, নিঃসাড়, নির্ভার...
মাঝে মাঝে নভোপোশাক পরে বাইরে সাঁতার কেটে আসে শূন্যে,
তখন সে বাঁধা থাকে ধাতুরাংতারচিত এক লম্বা লাঙুলে, স্টেশনের মাস্তুলের সঙ্গে।
কাছে-দূরে কোত্থাও কেউ নেই,
কোনো প্রেত-প্রেতিনী, অথবা কোনো যম-যমী, জিন-পরি, ভগবান-ভগবতী,
ফেরেশতা-ইবলিশ কাঁহা কিচ্ছু নাই, কেউই ঘেঁষে না কাছে, যে,
তার সঙ্গে একটু কথা বলবে, কফি খাবে...
এমনকি মানুষটা যে একটু ভয় পাবে, তারও উপায় নেই...
নিজের সঙ্গেই তাই নিজেরই মিথুন ও মৈথুন, খুনসুটি, হাসাহাসি, সাপলুডো খেলা...
কেবল রজনীস্পর্শা, ভীষণবর্ণা এক গন্ধরাজ্ঞী ফুটে থাকে অবাধ, অনন্তরায়...
বহুকাল দূরে...
অ-বশ্য
পাশ দিয়ে দ্রুত ছুটে যাবার সময়
কেশর খামচে ধরে কোনোক্রমে উঠে পড়েছে
দুর্ধর্ষ সিংহের পিঠে
আরোহণশাস্ত্রে অজ্ঞ, অধিকারহীন এক অশিষ্ট বালক।
এখন সে না-পারছে নামতে, না-পারছে থাকতে সওয়ার।
উঠে পড়া যতটা সহজ, নেমে যাওয়া ততটা নয় আর।
অর্বাচীনে চেনে না সুইচ, ব্রেক, ব্যাটারি, গিয়ার সিলেকটর...
জানে না সিংহ-চালানোর কায়দাকানুন।
অনুমানে, স্রেফ অনুমানে, একটার বদলে অন্যটা
অপারেট করে যাচ্ছে বেদিশার মতো একে-একে।
একে তো ভুল বশীকরণের ছুরা, তা আবার উল্টা করে পড়ে ফুঁ দিচ্ছে
সিংহের কেশরে, একনাগাড়ে।
যেখানেই গিয়ে লাগছে সেই ফুঁ,
সেখানেই অঙ্কুরিত হচ্ছে আহ্লাদিনী অনূঢ়া আগুন।
বিন্দু-বিন্দু বহ্নিচিহ্ন, গোঁফ আর কেশরের আগায় ডগায়।
জ্বালানি জ্বলছে খুব অন্তর্দাহ সিংহের ইঞ্জিনে
পিস্টনের আজগবি ওঠানামা সিলিন্ডারে গহ্বরে সুড়ঙ্গপথে
সরাসরি অস্বীকার কারনট চক্রের অনুজ্ঞা...
একমুখী ভালভের ভৌতিক কেরামতি
ঘনঘন বাতকর্মে বায়ুদোষে মিথেনে মনোক্সাইডে মুহুর্মুহু মিসফায়ারে
এলোমেলো লুব্রিকেশনে, থেকে-থেকে ফুয়েলের নিবাত দহনে
দুঃশব্দ ও দুর্গন্ধদূষণে প্রাণ-জেরবার আরোহী ও আরোহবাহন।
বেদম নাকাল চারপাশ, নাজেহাল লোকালয়
আরোহণ যতটা সহজ, অবরোহণ ততটা নয়।
দমকল
উন্মাদ উঠেছে গাছে, তরতর করে, ছাড়া পেয়ে পাগলাগারদ।
নামে না সে কিছুতেই, যতক্ষণ-না ওই বেঁটেখাটো নার্সটি এসে
মিনতি করে না-নামায় তাকে।
নার্স আসে দ্রুত, দমকলের মতন
কী-কী যেন বলে হাত নেড়ে নেড়ে,
তাতে খুশি হয়ে নেমে আসে উঁচু ডাল থেকে বিমুগ্ধ পাগল-
ঝোলের উল্লাসসহ নেমে আসে যেইভাবে কইমাছ পাতে
কানকো টেনে টেনে
ক্রমিক সংখ্যার মতো সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে।
ঝিলমিল করে বয়ে যায়, সেবিকার বোধে, পাগলের বিকল বিবেক।
উন্মাদ আবার ফিরে যাবে আজ উন্মাদ-আশ্রমে
ধর্মগণ্ডিকায় মাথা রেখে নির্বিকার নিয়ে নেবে
তেরোটি ইলেকট্রিক শক
তেরোবার স্বীকারোক্তি, স্বাস্থ্যযাজকের শান্ত সুধীর নির্দেশে।
চিত্রকল্প
কেরোসিন খেয়ে মাতাল হয়েছে মাঝি
গলা ছেড়ে গান ধরেছে মাঝনদীতে
দাহ্য তরলে গোসল সেরেছে বউও
মেতেছে দুজনে নেশায়, নৈশ গীতে।
দুটি প্রাণী এই ঘোর অমাবস্যায়
জড়িয়ে ধরেছে যেই-না আশ্লেষায়,
উগ্র দাহ্য তরলের মৌতাতে
ঘর্ষ-আতশ জ্বলে ওঠে সাথে সাথে।
জ্বলে ওঠা ওই মাঝি-মাঝিনীর
মিথুনমূর্তি দেখে
ভীতবিহ্বল নৌকাখানিও
নিজেকে পোড়াতে শেখে।
জ্বলছে মাঝিটি, সেই সাথে মাঝিনীও
মধ্যনদীতে জ্বলছে নৌকাটিও।
নৌকা জ্বলছে, নদীও জ্বলছে,
জ্বলছে প্রতিমাযুগ
পালক পুড়ছে, খোলস পুড়ছে
আর যা পোড়ে পুড়ুক।
মাঝি ও মাঝিনী আর ডিঙাখানি
এই তিন বাহু, আর
নদী ঢেউ স্রোত এই তিনে মিলে
চিতা ছয় মাত্রার।
জ্বলন্ত ওই যুগল মূর্তি
দাঁড়ানো লম্বাকার
ষড়ভুজ চিতা জ্বলছে নদীতে
হু-হু হাওয়া, হাহাকার।
বহুদূর থেকে কূটাগারে বসে
দৃশ্য দেখছি এই
অন্ধ ক্ষুব্ধ নদীকে হয়তোঃ
মানায় এই রূপেই।
জ্বলন্ত ফুলে ফুটে-থাকা দুই
জ্বলন্ত মৌমাছি
বিস্ফোরিত এ চিত্রকল্পে
স্তম্ভিত হয়ে আছি।
লেখক: কবি, লেখক, অনুবাদক। জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯, পিতার কর্মস্থল জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে। পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জ। প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। তড়িৎ ও ইলেকট্রন প্রকৌশলী। প্রকাশিত বই : কবিতা— পাখিতীর্থদিনে (নদী, ১৯৯৩) নদীকূলে করি বাস (একুশে, ২০০১) সরাইখানা ও হারানো মানুষ (একুশে, ২০০৬) আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি (ভাষাচিত্র, ২০১১) এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায় (আড়িয়াল, ২০১৪) গদ্য— দেহ-অতিরিক্ত জ্বর (চৈতন্য, ২০১৫) প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান (চৈতন্য, ২০১৬) ই-মেইল : [email protected]
মাসুদ খানের পোট্রেট: শিল্পী সুনীল কুমার পথিক