মন জিনিসটা কী



টোকন ঠাকুর, কবি
অলংকরণ ও সম্পাদনা: রুদ্র হক

অলংকরণ ও সম্পাদনা: রুদ্র হক

  • Font increase
  • Font Decrease

‘পিজারোর মন যত না বাইবেলের দিকে, তার চেয়ে বেশি সোনার খনির দিকে।’-এটি প্রায় প্রবাদ আজ। এক রাজনৈতিক ভাষণে সেইন্ট কাস্ত্রো পিজারো সম্পর্কে এ কথা বললেন। বাঙালি পাঠক মাত্রই কি পিজারোকে চিনতে পারছেন? তা মনে হয় না।

পিজারো হচ্ছেন একজন স্প্যানিশ যাজক। তার হাতে বাইবেল। একদিন তিনি পৌঁছলেন ল্যাতিনো দেশের মাচ্চুপিচ্চুতে। মাচ্চুপিচ্চুর স্থানীয় আদিবাসীরা গভীর কৌতূহল নিয়ে পিজারোকে দেখতে থাকে। পিজারো মহান যিশুর ঐশী বাণী ছড়াতে ব্যস্ত হলেন। মাচ্চুপিচ্চুবাসীরা সে বাণী মুগ্ধ হয়ে শোনায় মনোযোগ দিল। পিজারো বাইবেল থেকে অনুবাদপূর্বক উচ্চারণ করে চললেন, ... হে মেষপালক, দ্যাখো, আকাশ কত নীল। অথচ নীল হচ্ছে নিছক দৃষ্টি সীমানার মরমি শূন্যতা, আর সমস্ত শূন্যতা জুড়ে থাকি আমি। আমাকে তুমি কোথায় খুঁজবে, বলো? শূন্য থেকে ক্রমাগত শূন্যতার অভিযাত্রায় দ্যাখো আমি তোমাকেই দেখা দেব বলে দীর্ঘকাল নীল হয়ে আছি, আকাশ হয়ে আছি। কত মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে কথা হয়ে, কত পাখি উড়ে যাচ্ছে সুরধ্বনি তুলে, কত রোদ ঝরে ঝরে পড়ছে গান হয়ে, কত প্রেম ঘনীভূত হচ্ছে কবিতা হয়ে...

যাজকের জলদ-গম্ভীর গলা শুনতে শুনতে মাচ্চুপিচ্চুবাসীদের চোখে ঘুম এসে যায়। তারা ঘুমিয়ে পড়ে নবনির্মিত চার্চের বারান্দায়, তারা ঘুমিয়ে পড়ে নক্ষত্রের পাশে। তাদের ঘুমন্ত শিয়রে ধবধবে ছায়া ফেলে রেখে হেঁটে বেড়ান যাজক পিজারো। ঘুম ভাঙলে তারা দ্যাখে, তাদের সোনার খনি লুট হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের মাথার কাছে বাইবেল, তাদের হাতে হাতে বাইবেল। এরপর ইতিহাসের কালো পৃষ্ঠায় বহু রক্ত, গ্রন্থাগারের তাকে তাকে মাচ্চুপিচ্চুবাসীদের সারি সারি লাশ। তাদের সোনার খনি লুট হয়ে গেছে। পিজারোর মুখে ঐশী আভা, দিগবিজয়ীর চার্চীয় হাসি। একদিন কুব্যার রাজনৈতিক সেইন্ট ফিদেল কাস্ত্রো তার এক ভাষণে বললেন, ‘পিজারোর মন যত না বাইবেলের দিকে, তার চেয়ে বেশি সোনার খনির দিকে।’

দৃশ্যত, হাতে বাইবেল, কিন্তু লুট হয়ে গেল সোনার খনি- তাহলে মন কী জিনিস? মনের মধ্যে কত রাজনীতি! মনের মধ্যে কত যুদ্ধ, রক্তপাত? মনের মধ্যে কত ইতিহাস, গাথা, গান, কবিতা কিংবা ছটফটানি! মনের মধ্যে কত প্রেম, বিরহ, জ্বালা, অসুখ এবং উপশম! মন নিয়ে কত ছিনিমিনি। মন নিয়ে কত বাড়াবাড়ি, কত ভাব-অভাব! মনের কী প্রভাব! মনের কথা লিখে প্রকাশ, কীরূপে সম্ভব, হরি? মন কি কথা শোনে? মন কি বারণ শোনে? মন কি শোনে আদৌ? তবে কি মন বোবা-কালা-বধির? মনের কথা ভাষায় লেখা আর পানের দোকানদারের পক্ষে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সভাপতি হওয়া একই রকম দুরহ ব্যাপার।


ঠিক এ কারণেই হয়তো লিখে রেখেছি, ‘ভাষার সমস্যা আছে। সব কথা সে প্রকাশে সমর্থ নয়। যতই পণ্ডিতি করি, সান্ধ্য সুর ধরি, ঠিক যেন হলো না- মনের কী বলার ছিল? কী বলার মধ্যে আমি কী ভাব বোঝাতে চেয়েও, শেষ পর্যন্ত বাক্য যেন বাগে এলো না, বরং মহা বিট্রে করে বসল। কুয়োর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া চৈত্র মাসের মহাজোছনা যেন আমি আর তুলে আনতে পারলাম না। ভাষায় আমি জোছনা দেখাতে পারছি না, সূর্যাস্ত দেখাতে পারছি না, যুদ্ধ দেখাতে পারছি না, রক্ত কতটা লাল দেখাতে পারছি না, বাতাসের বেয়াদপ আচরণ দেখাতে পারছি না। এমনকি আমার মন কতখানি অবাধ্য যে, সে আমার ঘরেই থাকে না, প্রত্যেকদিন একই রাস্তায় একই দিকে যায়- মনোগমনের এ বর্ণনা লিখে বোঝানো অসম্ভব! অ্যাবসার্ড! কারণ, ভাষা শিল্পকে যতটা সমর্থন করে বা শিল্পীকেও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে পারে কিন্তু শিল্প ও শিল্পীর মধ্যে যেটুকু প্রচ্ছন্ন দূরত্ব, যতটা লৌহবেদনা- ভাষা তা কখনোই স্পর্শ করতে পারে না। কতটা নির্মম, দুর্ভাগ্যপীড়িত, যদি বলো, এই ভাষাতেই আমাকে লিখে জানাতে হবে সেই প্রচ্ছন্ন দূরত্বের গল্প, লৌহবেদনার ইতিকথা! মন-আনমনা, বাক্য যেন ভাব বুঝল না, বাক্য মহা বিট্রে করে বসল। অথচ কুয়োর মধ্যে চৈত্র মাসের মহাজোছনা গড়াগড়ি যায়...’

কিন্তু মন যতই আনমনা হোক, মন যতই পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাক না কেন, এত সহজে আমরা মনকে ছেড়ে দিতে পারি না। মন নিয়ে যথেষ্ট মনোযোগ আমাদের দিতেই হবে। মনের সঙ্গে বা মনের কাছে হেরে গেলে চলবে না।

মন কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যে তার হুকুম মেনে চলতে হবে? মন কি পুলিশ, যে তেড়ে আসবে যখন-তখন? পুলিশের কথাই যখন এলো, তখন বলব, মন কি বিডিআর, বিদ্রোহ করেছে? মনের বিদ্রোহ দমন হয় একসময়, মনের নাম পাল্টে যায়। মন সীমান্ত প্রহরী হয়ে যায়। মন বর্ডার গার্ড দেয়। মন যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তার মানে মন সেনাবাহিনীও? মনকে কোথায় রাখি?

দেশে আজ মন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হারানো মন অনুসন্ধান কমিটিও কাজ করে চলেছে। মন সংরক্ষণ ও বিকাশে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বাজেটে বরাদ্দ আছে। মন কী চায়, তার ওপরে রিসার্চ-ফেলো চলছে। মনোসমীক্ষকের আনাগোনা বাড়ছে। মন ঢুকে পড়ছে গানে গানে, কবিতায়। মন অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে নো-ম্যানস-ল্যান্ড ছাড়িয়ে পররাষ্ট্রের উঠোন বাড়িতে। মনকে কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছে না। মন যা চাচ্ছে, তা কিছুতেই মিলছে না। মন যা চাচ্ছে না, তাও কিছুতেই সরানো যাচ্ছে না। দিনে দিনে মন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল হয়ে উঠছে। ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে, সর্বদা অদৃশ্য, মন। গগন হরকরা মনের মানুষ খুঁজতে খুঁজতে হন্যে হয়ে গেলেন, লালন ‘মনোবেড়ি’ দিতে চাইলেন, র. ঠাকুর মনের ওপর জমিদারিও দেখালেন, তবু মন কি কারও আয়ত্তে এলো? মনের কথা আমি কাকে বলব? কারে জানাব মনের দুঃখ গো, আমি কারে জানাব জ্বালা? আমার মনের ঘরে তালা।

দেখলাম, স্মরণ করতে পারি, সেই প্রথম, কিংবা তারও আগে ঘটে থাকতে পারে কিন্তু মনে পড়ছে সেই এক প্রথমেষু, আমার তাজা মন ভেঙে গেল। মনভাঙা কাকে বলে, জানা হলো। কারণ কী? মামাবাড়ির ইশকুলেই প্রথম ভর্তি হই, সেখানে বনভোজন হবে, তখনও আমি জানি না, বনভোজন জিনিসটি কী? তো পঞ্চাশ পয়সার চাঁদায় সেই ইশকুলের বনভোজনে আমার নাম লেখা হলো। আমার মন খুশিতে নেচে উঠল। বনভোজন হবে শনিবার। কিন্তু মামাবাড়ি থেকে বনভোজনের তিনদিন আগেই, কী কারণে যেন আমাকে দাদাবাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। তখন আমি পড়ি হয়তো ওয়ানে। দাদাবাড়িতে যাওয়ার দু`দিন পর, বনভোজনের আগের দিন আমার মন খারাপ হলো। সন্ধ্যায় মন আরও খারাপ হতে লাগল। রাত পোহালেই শনিবার, মামাবাড়ির ইশকুলে বনভোজন। মামাবাড়ির ইশকুলের পেছনে সত্যি সত্যি একটা বড় বাগান ছিল। বনভোজন হবে সেই বাগানে।

তো মন আমার যতই খারাপ হোক, বাড়ির বড়রা তা তেমন আমলে নিল না। রাতে আমার ঘুম হলো না। ভাবলাম, সকালে আমাকে ঠিকই নিয়ে যাওয়া হবে মামাবাড়িতে। তারপর আমিও যোগদান করব বনভোজনে। যাই হোক, সকাল হলো। আমার মন খারাপ আরও বাড়ল। আশা করলাম, আমার মন খারাপ দেখে কেউ আমাকে ঠিকই নিয়ে যাবে জোড়াদহে, ভায়নায়। কিন্তু সে রকম কোনো সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে আমি কান্না শুরু করলাম। আমি জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। আমি কাঁদতে কাঁদতে উঠোনে গড়াগড়ি দিলাম। আমার কান্নায় বাড়ির কারও মন গলল না। ফলে আমার মন ভেঙে গেল। ভীষণ মন ভেঙে গেল। সেটাই কি আমার প্রথম মনভাঙা? এর কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই।

দাদাবাড়ির ইশকুলে, মধুপুরের পাশে গাড়াগঞ্জে পাকাপাকিভাবে চলে আসার পর, ক্লাস টুতেই ভালো লেগে গেল ঊর্মিকে। ঊর্মিরা একদিন বদলি হয়ে চলে গেল। খুব মন খারাপ হলো। এক রাতে, বাড়ি থেকে পালিয়ে বাজারে আসা কমলা সার্কাসের তেলেসমাতি খেলা দেখতে গেলাম। যাবার পথে, কোথাও যেন এক ছাতিম ফুলের ঘ্রাণে, সেই জোছনা রাতে, রূপোলি আলোয় ভেসে যাচ্ছিল চরাচর। মন কেমন করে ওঠা রাত। মন হুহু করে যাওয়া রাত। মন পু পু করে যাওয়া জোছনা। মন ধু ধু করে যাওয়া ছাতিমের আগ্রাসী ঘ্রাণ, ঘ্রাণজুড়ে চরাচর কিংবা চরাচর জুড়ে ঘ্রাণ- সেই ঘ্রাণে মন কেমন করে? সে বয়সে, একটি ঘটনা খুব মনকে নাড়া দিয়ে গেল। আমাদের ইশকুলেরই নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী কাকে যেন ভালোবেসে শেষে ধানগাছে দেওয়া ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করল।

সেই মেয়েটির নাম কী? ভুলে গেছি। কিন্তু তার কবর দেখতে গিয়েছিলাম। তার জন্য যে কী পরিমাণ মন খারাপ হয়েছিল সেসময় কিছুদিন, আমি জানতাম, সেই মন খারাপ থেকে আমি আর বেরুতে পারব না। সেই মেয়েটির নাম আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। কিন্তু সে সময়ের ডায়েরি আর আমার এ সময়ের ইতিহাস কত বিস্তর ফারাক। আমি ডায়েরি লিখতাম।


আমার সে সময়েরই কোনো এক ডায়েরিতে পাওয়া যাবে আরও এক মেয়ের নাম, যে মেয়েটিও একদিন পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করল এক সীমান্ত-মালামাল পাচারকারীকে। তাতেই মন খারাপ হলো। খুব মন খারাপ হলো। একদিন তাদের ঘরে একটি সন্তান এলো। একদিন সেই পালিয়ে যাওয়া মেয়েটিকে তার ঘরেই ফ্যানে ঝুলন্ত পাওয়া গেল। তার স্বামীকে পুলিশ জেলে নিয়ে গেল। একদিন জেল থেকে বেরিয়েও এলো সে। বারবার মন খারাপ হলো। কিছুই করার থাকল না।

মন ছমছম করে গেল। পৌর শ্মশানে সারারাত সাহস-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে গিয়ে, আমি আর আমার বন্ধু রাজু ঝুঁকি নিয়ে শ্মশানেই কাটিয়ে দিলাম। ফাঁকা মাঠের মধ্যে গিয়ে হঠাৎ চৌদিকে তাকিয়ে দেখি, কেউ নেই। লোকালয় কত দূরে। সন্ধ্যা আসন্ন। মন নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। মন খুব লোনলিনেসে আক্রান্ত হলো। মন কাগজের নৌকা হয়ে ভেসে চলল। মন ভেসে গেল ভরা বর্ষায়, উঠোনের জমে যাওয়া জলে।

মন ভায়নার কালীতলার পুজোর মেলায় বুড়ো বটগাছের শিকড়ে বসে থাকল। মন ঝিনেদার দেবদারু এভিনিউতে কত কত সন্ধ্যা, বিকেল, রাত বসে বসে নবগঙ্গার জলে তালের ডিঙি হয়ে গেল। মন ভেসে চলল মুরারীদহের দিকে। মন পরিত্যক্ত রাজবাড়ির চিলেকোঠায় হারিয়ে যাওয়া গল্পের পেছনে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে শতবর্ষ পূর্বের এক সন্ধ্যায় পৌঁছে গেল। মন সেখানে যুবরাজ, মনের সামনে যুদ্ধ, মন যুদ্ধে যুদ্ধে ক্লান্ত হলো। তবু মন ক্লান্ত হয় না। মন আবার উঠে দাঁড়ায়। মন রায়মঙ্গলা নদীতীরের জোছনায়, জোয়ারের ঢেউয়ে ঢেউয়ে কল্লোল তুলে গেল। মন চন্দ্রবিন্দুর হাওয়ায় কুড়িয়ে ফের হাওয়ায় হারিয়ে ফেললাম। মাতাল রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মন চাঁদে পৌঁছে গেল। সেখানে চাঁদের দেশে, দলছুট শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী মন নিয়ে গান-সুর বেঁধে চলেছেন। মন দিয়ে শুনি সেই গান...

একবার রুমাবাজার থেকে পায়ে হাঁটা ঝিরিপথে বগা লেক হয়ে পরদিন কেওক্রাডংয়ের চূড়োয় উঠলাম, সুন্দরবনের ভেতরে লালকমল-নীলকমল গিয়েছি, সেন্টমার্টিন দ্বীপাঞ্চল চষে বেড়িয়েছি, কেন? সম্ভবত, হারিয়ে যাওয়া মনটার খোঁজে। কান্তজীর মন্দিরে গিয়ে মন হারিয়ে এসেছি। স্মরণীয়া নদীর ঢেউয়ে মন খুইয়ে ফেলেছি। শীতের কুয়াশায় ছদ্মবেশে মেঘ নেমে এসেছিল একবার, সেবার মনটাও হারালাম সেই ছদ্মবেশী কুয়াশায় আবছায়া নৈঃশব্দ্যে। দেখেছি, নিঃশব্দেই মন রক্তাক্ত হয়ে গেছে। অথচ মনের কোনো আকার-প্রকার নেই। মন অনেকটা ঈশ্বরগোত্রীয়। দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না কিন্তু প্রভাব ক্রিয়াশীল।

কাগজে প্রথম কবিতা ছাপা হওয়ার ফল কী দাঁড়িয়েছিল? মন কতখানি উৎফুল্ল হতে পারে, এর আগে সে ধারণা ছিল? নিজের লেখা, নিজের নাম বর্ণমালায় ছাপানো দেখার সেই কয়েকটা দিন মন আর মন ছিল না। মন হয়ে পড়েছিল অন্য কিছু। অন্য কিছুটা কী? প্রথম পথ ভুল করে অন্য রাস্তায় চলে গিয়েছিলাম, প্রথম রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলাম, প্রথম আত্মরতি করেছিলাম, প্রথম ভেঙে পড়েছিলাম, প্রথম পাখির মতো আকাশে উড়েছিলাম, প্রথম মাছের মতো মরে ভেসে উঠেছিলাম- কবে? সে-সব আর মনে নেই। তাই ‘ব্ল্যাকআউট’ নামে একটা ছবি তৈরি করলাম, বাংলা নাম দিলাম ‘মনে নেই’। কী মনে নেই, যা আমার মনে নেই। যা-টা কী? তা তো মনেই নেই।

মনের অজান্তে’ বলে একটা কথা আছে। তার মানে মন যা জানে না বা জানত না, তাই? কী কী ঘটে গেল মনের অজান্তে? কী কী সায় ছিল মনের? কী কীতে ছিল না? মাঝে মধ্যেই ভাবি, আমার মনের বয়স কত? দুই কুড়ি চার? নাকি তিন নং সাতাশ? কত কবিতায় মন ঢুকে ঘাপটি মেরে আছে। ছাপার অক্ষরে মন লুকিয়ে আছে। আঁকানো রঙে মন রাঙা হয়ে আছে। নির্মিত দৃশ্যে মন সৃজিত হয়ে আছে। তবু মন কি কোথাও আছে, আদৌ? মন জিনিসটা কী?

মনের সঙ্গে আর কত কথা বলব? মনকেও আর কত কথা শোনাব? কত ছবি আঁকলাম, মনে মনে। কত কবিতা লিখলাম, মনে মনে। কত উড়াল দিলাম, পাখির মতো, মনে মনে। কত সাবমেরিন হলাম, জলের গভীরে, মনে মনে। কত না পারাকে পারলাম, মনে মনে। মনে মনে আমি খুনও করেছি। ভালোবেসেছি, মনে মনে। তবু মনের ঠিকানা খুঁজে পাইনি। খোঁজ পাইনি, জানিও না, মন কোথায় থাকে? মন কি খায়? মন কী ঘুমায়, ক্লান্ত হলে? মনের মৃত্যু হলে কবর হয় কোথায়? মনকে কি পোড়ানো হয়? শেষ হবে না। শেষ হয়ও না। তাই শেষ কথা বলি?

‘সিয়েনা শহর পুড়ে গেছে।

সেই পোড়া শহরের কালারই হচ্ছে বার্নটাসিয়েনা। যারা ছবি আঁকে, তাদের কেউ কেউ এই কালারটা পছন্দ করে বটে। হঠাৎ রোদ মিষ্টি লাগে। হঠাৎ চৌচির করে দিয়ে যায় বখাটে হাওয়া। ঠেকানো যায় না, এমন দুর্বার, এমন মাতাল। এমনকি কী নেই কী নেই বলে বুকের মধ্যে উষ্ণজলের গুড়গুড়ি বেজে ওঠে, খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে, স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে একা বসে থাকি। একটা শালিক আরেকটা বালিকা শালিকের খোঁজে ছটফট করতে থাকে। তখন, রোদ মিষ্টি, হাওয়া চৌচির। হঠাৎ ভালোবাসার আঁচে, আভায়, লাভায় মন পুড়ে যায়।


কৃষ্ণচূড়ার ফুল কিংবা ভার্মিলিয়ন রেড ঝুপঝাপ ঝরে পড়ে শূন্যপটে। কুয়াশার আধিক্য এমন যে, এক হাত সামনে-পেছনেও কিছু দেখা যায় না। যথেষ্ট বিভ্রম ছড়ানো পথে বাড়ি ফেরা দায় হয়ে যায়। পুরো শীতকাল ভালোবাসা শিশির হয়ে ঝরে। ভোরবেলা হাঁটতে গেলেই মাথা ভিজে যায়। পা ভিজে যায়। সমস্ত শরীর ভিজে ওঠে। এরপর আসে বসন্ত। কুয়াশা তখনও কিছু অবশিষ্ট উঁকি মারে আর তলে তলে মন বেলেসিঁদুরে লেপ্টে যায়। এক কথায়, ভালোবাসা সন্ত্রাস ঘটাতে চায়।

বনে বনে অর্কেস্ট্রা বাজে। খুব ভালো লাগে, লাগে বলেই হঠাৎ ভালোবাসা রিভার্স হয়, তখন আর মোটেই ভালো লাগে না। লোনলি লোনলি লাগে। ভালোবাসার ফর্ম চেঞ্জ হয়ে যায়। পোড়াশহর, পোড়ামনের আলাদা-আলাদা কালার ফুটে ওঠে। তখন হয়তো কবিতা লেখা হয়, সেই কবিতা ছাপাখানায় যায়। তারপর সেই কবিতা কেউ হয়তো পড়ে, পুড়ে যাওয়ার আশায়, ঘৃণায়, ভালোবাসায়।

মন এমন, কদিন ধরেই ঘুঁই ঘুঁই করছে, সে আমাকে দিয়ে বলিয়ে দিতে চাচ্ছে, তোমাকে খুব ভাল্লাগছে। তোমাকে আমার ভালোবাসতেও ভাল্লাগবে...

অলংকরণে ব্যবহৃত ছবি: রকি হকিন্স, আমেরিকান চিত্রকর

   

নিউ ইয়র্কের মঞ্চে মূর্ত হলেন ‘হাছন জানের রাজা’



শিব্বীর আহমেদ, কথাসাহিত্যিক-সাংবাদিক ও আইটি বিশেষজ্ঞ
নিউ ইয়র্কে মঞ্চস্থ হয় ‘হাছন জানের রাজা’

নিউ ইয়র্কে মঞ্চস্থ হয় ‘হাছন জানের রাজা’

  • Font increase
  • Font Decrease

হাছন রাজার কত কত গান! কত গল্প তাঁকে নিয়ে। বর্ণিল, বৈচিত্র্যময় ঘটনাবহুল তাঁর জীবন। হাছন রাজা (১৮৫৪-১৯২২) বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার একজন সামন্তপ্রভু ছিলেন। পিতা ও মাতা উভয়ের কাছ থেকে পাওয়া বিশাল জমিদারির মালিকানা চলে আসে কিশোর বয়েসে। অর্থ, বেহিসাবি সম্পদ আর ক্ষমতার দাপটে বেপরোয়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। জাগতিক লোভ লালসা, ক্ষমতায়ন, জবরদখল করেও তিনি তাঁর প্রতিপত্তি বাড়ানোর কাজে প্রবৃত্ত ছিলেন। কিন্তু একসময় তাঁর ভেতরের ভ্রান্তি ঘুচে যায়। মধ্য পঞ্চাশে এসে তিনি ভিন্ন এক মানুষে পরিণত হয়ে যান। তাঁর বোধ হয় যে এ জগত সংসারের সকল অনাচারের মূলে আছে অতিরিক্ত সম্পদ। কিছুদিনের জন্য অতিথি হয়ে আসা মানুষেরা আসলে মহাশক্তির কাছে একেবারেই নশ্বর। তিনি তাঁর সম্পদ জনকল্যাণের জন্য উইল করে দিয়ে কয়েকজন সঙ্গিনীকে নিয়ে হাওরে হাওরে ভাসতে থাকেন আর এর মধ্যে খুঁজতে থাকেন সেই মহা পরাক্রমশালী স্রষ্ঠাকে। সৃষ্টি কর্তাকে খুঁজতে খুঁজতে একসময় আবিষ্কার করেন, তাঁর নিজের মধ্যেই তাঁর বাস। তাঁর যে পিয়ারীকে সবাই হাছনজান বলে জানে, সে-ই আসল হাছন রাজা। জগতের মানুষের কাছে যিনি রাজা বলে চিহ্নিত ছিলেন, হাছন রাজার কাছে সে কেউই নয়, বরং পিয়ারী হাছনজানের ভেতরেই প্রকৃত হাছন রাজা বিরাজমান ছিলেন।

পহেলা অক্টোবর সন্ধ্যায় হাছন জানের রাজা মূর্ত হয়েছিলেন নিউ ইয়র্কের জামাইকাস্থ পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে। বৃহত্তর ওয়াশিংটনের জনপ্রিয় নাট্যদল একতারা মঞ্চায়ন করেছে ‘হাছন জানের রাজা’। শাকুর মজিদের লেখা, শেখ মাওলা মিলনের পরিচালনা ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘হাছন জানের রাজা’। অনুষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন রাচনা মিলন, কোরিওগ্রাফি ও নৃত্য পরিচালনা রোজমেরী মিতু রিবেইরো, সংগীত পরিচালনা কালাচাঁদ সরকার, সংগীত পরিচালনা নাসের চৌধুরী, বাঁশিতে বংশীবাদক মোহাম্মদ মাজিদ, তবলায় আশীষ বড়ুয়া, মন্দিরা সরোজ বড়ুয়া, পার্কাশন সুকুমার পিউরিফিকেশন এবং ঝিপিসিতে ছিলেন নীল।

হাছন জানের রাজার চরিত্রে অভিনয় করেন শেখ মাওলা মিলন। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেন শামীম চৌধুরী, আরিফুর রহমান স্বপন, মোহাম্মদ রাহমাতুল্লা, মীর দোজা, তিলক কুমার কর, হাসনাত সানি, আবু বকর সরকার, ছোটন বড়ুয়া, আফরিন ফেন্সি, আনিকা বড়ুয়া, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, ফাহমিদা হোসাইন, মোহাম্মদ আনোয়ার জামান, অহনাফুর রহমান, প্রজ্ঞা আহমেদ, সম্পদ পেরেরা, ও মুক্তা মেবেল রোজারিও। নৃত্যে ছিলেন পিটার, মেহেক, মেঘা, ঈশাল, সুকন্যা, এমিলি এবং মুজরা কোরিওগ্রাফি ও পরিবেশনায় ছিলেন রোকেয়া হাসি। কোরাসে কণ্ঠ দিয়েছেন রুমানা সুমি চৌধুরী, শিখা আহমেদ, আতিয়া মাহজাবীন, জেসমিন আবেদীন এবং সাবরিনা রহমান।



নাটক মঞ্চায়নে শব্দ নিয়ন্ত্রনে ছিলেন জামিল খান, আলোক নিয়ন্ত্রণ প্যাট্রিক গোমেজ, মঞ্চসজ্জা উৎপল সাহা এবং সহযোগিতায় ছিলেন হারুনুর রাশিদ ও আহসান কবির‌। চিত্রাঙ্কন ও আল্পনায় ফাতেমা ফারজানা, ভিডিও সংযোজন তাহাসিন আলম, জজ সাহেব ভূমিকার পাশাপাশি আবহসংগীত সংযোজনে আরিফুর রহমান স্বপন, আবহসংগীত প্রাঙ্গনে মোর নাট্য দল, বাংলাদেশ , কস্টিউম ডিজাইন মেহেরুন নাহার, শামসুন নাহার এবং দিল্লী থেকে ভিনাই ভোলা ও সাতিন্দার কর। কস্টিউম সেটিং, ফিটিং এন্ড ব্যাক স্টেজ ম্যানেজমেন্ট রেহানা দোজা, সিফাত খান, সুজান গোমেজ , মোসাম্মত পারভীন, ও রওনক আজাদ। ফটোগ্রাফি রাজীব বড়ুয়া, তারেকুল হাসান চপল, আব্দুল হাফিজ, ও দেওয়ান বিপ্লব, ভিডিওগ্রাফিতে ছিলেন নুরুজ্জামান হামিদ শুভ এবং শেখ রাব্বানী।

এছাড়াও হাছন জনের রাজা মঞ্চায়নের সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন খাইরুল ভূইয়াঁ পবন, মোহাম্মদ রহমান রিপন, তানজিন আলম, সৈয়দ আব্দুল হাই, ফারহানা হোসাইন, রিজওয়ানা কবির এবং শিমুল সাহা। ইশাত, মিথিলা, আনিকা, আসদিন, সারিম, সাফওয়ান, অংশুলা , হেমালি, মাহি, এডওয়ার্ড, ইউসফ, বুব্বা, সাফা, ফিলিপ, মোহামেদ, সামির প্রমুখ।

প্রগতিশীল ও লোকজ ধারার একনিষ্ঠ সংস্কৃতির চর্চার কেন্দ্র হিসাবে 'একতারা' প্রবাসের মাটিতে বিশেষ ভাবে বৃহত্তর ওয়াশিংটন ডিসি মেট্রোপলিটন এলাকায়  সংস্কৃতির  বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। গ্রাম বাংলার মাটি ও মানুষের কথা বলে যাওয়া লোকজ সংস্কৃতির এতিহ্যাশ্রয়ী নাচ, গান, নাটক সহ সবকটি আনুষঙ্গিক অনুভূতির মাধ্যমগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরা ও তার সংরক্ষণের নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে `একতারা'। একটি স্বীকৃত ৫০১ (সি)(৩) সংগঠন হিসাবে নিছক বিনোদনের বাইরেও সমাজের উন্নয়ন ও ঐক্যবদ্ধ সামাজিক শক্তির ধারাকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে সচেষ্ট থাকে। 'একতারা' এদেশে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা সাংস্কৃতিক চর্চার জন্যে একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম রূপে ভূমিকা রাখতে পেরে গর্ববোধ করে। লোকসংস্কৃতি প্রতি সকল মানুষের সহজাত ভালোবাসার শক্তিময় অভিব্যক্তি আমাদের একতারার সম্মুখপানে চলার অজেয় শক্তির উৎস।


লাউয়ের শুকনো খোলের এক তারবিশিষ্ট লোকবাদ্যযন্ত্র  একতারার ঐন্দ্রজালিক সুরের মূর্ছনার মাঝে অবগাহন করে, বাংলার সোঁদা মাটির ঘ্রানে আবিষ্ট হয়ে, লোকসংস্কৃতির নাড়ির টানে আমাদের প্রিয় "একতারা" সংগঠনটির জন্ম। শুরু থেকেই আমাদের প্রচেষ্ঠা ছিল প্রবাসের মাটিতে বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে।  ২০০৪ সালে একতারার প্রথম অনুষ্ঠান ছিল বাংলাদেশের জননন্দিত টিভি শো 'ইত্যাদি'র আদলে লোক সঙ্গীত, আধুনিক ও লোকনৃত্য, ফ্যাশন শো, এবং কবি জসিম উদ্দিনের অনবদ্য কাব্যোপন্যাস "নকশী কাঁথার মাঠ" এর রূপাই ও সাজুর প্রেম কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নৃত্যনাট্য।

২০১০ সালে 'একতারা' 'বায়োস্কোপ' নামে একটি সফল প্রযোজনা করে যার প্রতিপাদ্য ছিল বাংলা চলচিত্রের রূপালী পর্দায় নানামুখী সামাজিক জীবনের সাংস্কৃতিক প্রতিফলনকে নিয়ে মঞ্চায়িত রূপ। এই অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল আরব্য রজনীর অন্যতম নক্ষত্র বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়  লোকগাথা "আলিবাবা ও চল্লিশ চোর" এর গীতি-নৃত্য-নাট্য রূপ।

২০১১ সালে একতারা লোক উৎসব' আয়োজন করে যেখানে তুলে ধরা হয় কিংবদন্তী সাধক বাউল সম্রাট  শাহ আব্দুল করিমের জীবন ও তাঁর দর্শনের উপর ভিত্তি করে খ্যাতনামা লেখক শাকুর মজীদ রচিত "মহাজনের নাও" গীতল নাটকটির প্রশংসিত প্রযোজনা। ২০১৫ সালে একতারা লোকনাট্য রীতিতে মঞ্চায়িত করে বাংলাদেশের পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যযুগের কবি দ্বিজ কানাই রচিত 'মহুয়া' র পালা নাটকের ডাকাত সর্দার হুমরা বাইদ্যা, মহুয়া সুন্দরী আর নদ্যার চাঁদ এর ত্রিমুখী সাংঘর্ষিক অভিযাত্রার সফল মঞ্চায়নের মাঝে। ২০১৮ 'সালে একতারা মঞ্চায়িত করে ষোড়শ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর  গীতল পালা নাটক "চন্দ্রাবতীর"। একতারা পরিবেশিত জয়ানন্দ-চন্দ্রাবতীর বিয়োগান্তক প্রেম কাহিনী "চন্দ্রাবতীর" মঞ্চায়ন প্রশংসিত হয়েছে নাট্য বোদ্ধা সহ সকল মহলে।

একালের মানস সরোবরের ভাবনায়, কল্পনায়, হাছনের বেপরোয়া জীবন এবং মায়ের মৃত্যুর পর জীবন সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি, মরমি সাধক হয়ে ওঠার গল্প। একালে আমাদের অনেকের ভেতরে একজন ত্যাগী ও ভোগী, সংগীতপ্রিয় ও মাতৃভক্ত, আত্মানুসন্ধানী ও উদাসী বাউলা হাছন রাজা দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে বসত করে। জ্যামাইকার পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে গতানুগতিক ধারায় হাছন রাজার জীবনী তুলে ধরা হয়নি; বরং হাছন রাজা এসেছেন এই প্রজন্মের তারুণ্যের আড্ডায়, ফেসবুকে। তরুণেরা নৌকায় ভ্রমণে বের হন ভরা পূর্ণিমা রাতে। একসময় তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় হাছন রাজার। তরুণদের সেই আড্ডায় সঙ্গিনীদের নিয়ে মিশে যান হাসন রাজা। কখনো তাঁর সঙ্গে সেলফি তোলেন, তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে লিখছেনও তরুণেরা! কখনো বাস্তবে, কখনো কল্পনায়।

গান-সংলাপ-আলো-ছায়ায় বাংলাদেশে ভাটি অঞ্চল হয়ে উঠেছিল মঞ্চ। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, লক্ষ্মণছিড়ি আর রামপাশা মিলিয়ে যে বিশাল ভাটি বা হাওর অঞ্চল, সেখানকার পাঁচ লাখ বিঘায় জমিদারি ছিল যাঁর, মঞ্চে দেখা যায় সেই দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী জমিদারের বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় জীবন। সেই জীবনের এক প্রান্তে হাছন রাজা অত্যাচারী প্রেমিক, স্বেচ্ছাচারী, বেখেয়ালি। অন্য প্রান্তে হাছন ত্যাগী, মানবদরদি। বিশাল জমিদারি ভাগ-বাঁটোয়ারার মাধ্যমে জনহিতকর কাজের জন্য ওয়াক্ফ করে পিয়ারীর সন্ধানে ভাওয়ালি নৌকায় উঠে বসা। যাঁর যাত্রার অন্তিম উপলব্ধি পিয়ারীর মাঝে নিজেকে এবং সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাওয়ার মধ্য দিয়ে। নাটকের শেষে দেখা যায়, আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যেতে থাকেন হাছন রাজা। বাস্তবে ফিরে আসেন তরুণেরা, উপস্থিত দর্শকেরা।

নিউ ইয়র্কের জামাইকাস্থ পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে `হাছন জনের রাজা'র পরিবেশনা একতারার দ্বিতীয় মঞ্চায়ন। এর আগে নাটকটি বৃহত্তর ওয়াশিংটন ডিসিতে মঞ্চায়ন করা হয় এবং দর্শক সমাদৃত হয়। বাংলা লোকসংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব ধ্রুবতারা মরমী সাধক হাছন রাজার জীবন কাহিনী নিয়ে একতারার এই নাট্য মঞ্চায়নে নিউ ইয়র্ক প্রবাসীদের উপস্থিতি ও  সহোযোগিতা একতারাকে অনুপ্রাণিত করেছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের কর্ণধার শেখ ,মাওলা মিলন। একতারার পক্ষ থেকে সবার প্রতি ভালোবাসাময় একরাশ শুভেচ্ছা ও অশেষ কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

;

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন



রামকৃষ্ণ জানা
দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

  • Font increase
  • Font Decrease

রামকৃষ্ণ জানা

[বিশ্ব নদী দিবস প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রোববার। বিশ্ব নদী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘রাইটস অব রিভার'। বিশ্বেরা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। ইতিহাসবিদ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক ড.  রূপকুমার বর্মণ নদী ও ইতিহাসের চর্চায় উন্মোচন করেছেন মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বাহুমাত্রিক বিন্যাস।]

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্য দিয়ে অসংখ্য নদী প্রবাহিত হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত নদী-অববাহিকাগুলোতে ঘটে চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন যা বিশ্বব্যাপী অভিবাসনচর্চার অন্যতম বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে নদীকে বহুমুখী ব্যবহারের মাত্রাবৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত নদীজনিত সমস্যার কারণে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের াা অঞ্চলের মানুষেরা নিজেদের জীবনকে রক্ষা করতে জোরপূর্বক অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে। এইরকম একটি প্রেক্ষাপটকে ড. রূপকুমার বর্মণ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দিয়েছেন।   

মোট তিনটি অধ্যায় এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক সারণীসহ এই বইটিতে একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে নদীমাতৃক বাংলার জেলেসম্প্রদায়ের মানুষের জীবনজীবিকার ওপরে নদীর অপরিসীম প্রভাব। ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে লিখিত বিভিন্ন সাহিত্যগুলি যে তৎকালীন সমাজের দর্পণ-লেখক তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সাহিত্যের নিরিখে  বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামক উপন্যাসকে লেখক উক্ত অঞ্চলের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে শুধু নদীর সম্পর্কের আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে একে কেন্দ্র করে নদী-উপকূলবর্তী মানুষের জীবনসংকট ও তারই প্রভাবে যে তাদের অভিবাসন ঘটেছিল সেই প্রেক্ষিতকে নদীর ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে নতুনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে তিতাস-অববাহিকায় মালোসম্প্রদায়-অধ্যুষিত চরটি একে একে জনশূন্য হয়ে উঠেছিল-তাও এতে পরিস্ফুটিত। বর্তমানে পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় আভ্যন্তরীণ অভিবাসনের একটি প্রামাণ্য দলিল রূপে বর্ণিত এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে মানুষের আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি ও অভিবাসন সংকটের কথাকে স্মরণ করিয়ে ডঃ বর্মণ এই সাহিত্যকে ইতিহাসের এক অন্যতম আধারে পরিণত করেছেন। 

ই. এইচ. কার(E. H. Carr)-এর ইতিহাসচর্চার মূল নির্যাস-‘ইতিহাসকে জানার আগে ঐতিহাসিক কে. জানো’-এ সম্পর্কে গ্রন্থকার পূর্ণমাত্রায় সচেতন। তিনি মালোজাতির ইতিহাসকে তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে বুকানন হ্যামিল্টন(Francis Buchanan-Hamilton), নৃতত্ত্ববিদ জেমস(Dr.James Wise) ও রিসলে(H.H. Risley) প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জেলেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেছেন। পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক সরকারের হীনবিভাজন নীতি থেকে মুক্তি পেতে তারা যে ১৯১৩ সালে ‘ঝালো-মালো ক্ষত্রিয় সমিতি’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতায়ন ঘটিয়েছিল লেখক তা বর্ণনা করেছেন।   

অধ্যাপক বর্মণ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আসাম ও বাংলার নদী-উপত্যকাগুলিতে বসবাসকারী মানুষদের সার্বিক জীবনের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে ঐ অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক সাহিত্যগুলোকে তাঁর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছেন। দেবেশ রায় রচিত ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’-কে লেখক একজন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিয়েছেন যে একটি নদী  কীভাবে আঞ্চলিক স্তরের সংগ্রাম থেকে মানুষকে আন্তর্জাতিক স্তরের সংগ্রামে উত্তীর্ণ করতে পারে। তিস্তা নদী রাজবংশী সম্প্রদায়ের কাছে ছিল এক দেবীস্বরূপা আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ থেকে আগত প্রভূত মানুষের কাছে এই নদী-উপকূল হয়ে উঠেছিল আশ্রয়দাত্রী জননীস্বরূপা। এই প্রসঙ্গে লেখক অত্যন্ত সুচারুভাবে এই অঞ্চলের আদিবাসিন্দা রাজবংশী সম্প্রদায় ও আগন্তুক উদ্বাস্তু বাঙ্গালীর দ্বন্দ্বকে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে  ধরেছেন। যুক্তফ্রন্ট সরকার ও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গৃহীত বিভিন্ন ভূমিসংস্কারমূলক পদক্ষেপ (যেমন-‘অপারেশন বর্গা’) এই রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায় এবং ইউ. কে. ডি. (UKD) ও ইউ. টি. জে. এ. এস. (UTJAS)-নামক আঞ্চলিক দলগুলি অচিরেই তাদের পূর্বতন দাবী তথা কামতাপুর রাজ্যগঠনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তিনি দেখিয়েছেন ভারত ও বাংলাদেশ জলবণ্টনচুক্তি অনুযায়ী তিস্তা নদীতে বাঁধ নির্মাণের দ্বারা সরকার মানুষের উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হলেও সেই উন্নয়নযজ্ঞই কীভাবে নদী-উপকূলবর্তী মানুষগুলোকে বঞ্চনার শিকারে পরিণত করেছিল। অবশেষে ডঃ বর্মণ প্রশ্ন তুলেছেন-বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ কি তবে তিস্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে নাকি এখনও  মানুষ তিস্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে?  

এরই সঙ্গে গ্রন্থকার সাহিত্যিক জিতেন্দ্র দাস লিখিত ‘কলহি নদীর একুল হিকুল’-গ্রন্থের ইতিহাসনির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৎকালীন আসামের বিশেষত দিপার বিলসংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। কালক্রমে এই নদীর চরে অশান্তির বার্তা বহন করে আনে বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন এবং এরই  ফলশ্রুতিতে এখানে শুরু হয় বহিরাগত ও স্থানীয় মানুষদের সমাজের সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য স্থাপনের এক তীব্র অসম লড়াই। অসমের একটি নদীচরের মানুষের আভ্যন্তরীণ সংকট কীভাবে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল তা লেখক বর্ণনা করেছেন। 

এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে ড.  রূপ কুমার বর্মণ তাঁর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, ভুটানের ওয়াং-চু (পশ্চিমবঙ্গে রায়ডাক ও বাংলাদেশে দুধকুমার নামে পরিচিত) নদী কীভাবে ভুটানের প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমশ সমগ্র ভুটানবাসীর জীবনের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ভুটানের বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে কীভাবে এই নদী ভুটানবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল তার ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন।  লেখকের বর্ণনায় প্রাধান্য পেয়েছে রায়ডাক-১ ও রায়ডাক-২ নদীর গতিপথে অসম ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় উদ্ভূত ঝাউকুঠি, বলাভুত ও রামরাই কুঠির মত অসংখ্য চরে বসবাসকারী মানুষের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তিনি দেখিয়েছেন যে এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে কোচ, মেচ, রাভা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে এখানকার অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে রাজবংশী মানুষের বসতি। ঔপনিবেশিক আমলে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডাদের শ্রমিক হিসেবে আগমনের ফলে এই নদী-অববাহিকার বসতিগুলি এক মিশ্র সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব-পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকেও অনেক মানুষকে এই অঞ্চল সাদরে গ্রহণ  করে নিয়েছিল। ডঃ বর্মণের নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এইভাবেই এই নদী-অববাহিকা হয়ে উঠেছিল এক টুকরো ভারতবর্ষ।  

লেখক এই অধ্যায়ে আরও দেখিয়েছেন যে একই নদীর জল বহুধর্ম ও বহুসংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আবহমানকাল ধরে। কোচবিহারের রাজাদের অনুগ্রহে কামাক্ষ্যা মন্দিরের ভিত্তিস্থাপনের ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন। পরবর্তীতে আবার এই রাজারা এই অঞ্চলেই একাধিক শিবমন্দির স্থাপন করে কোচবিহারের প্রধান দেবতা হিসেবে শিবকে স্থান দেন। অন্যদিকে এখানেই শঙ্করদেবের হাত ধরে একসময় যে বৈষ্ণবধর্মের উত্থান ঘটেছিল তা পরবর্তীতে কোচসাম্রাজ্যের রাজধর্মে পরিণত হয়। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে বৈষ্ণবসত্রগুলি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছিল। একদা কোচপ্রশাসনের ওপর বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তাঁরা নিজেদের নামের সাথে ‘নারায়ণ’ উপাধি সংযোগ করেছিলেন ও কোচমুদ্রার নাম ‘নারায়ণী মুদ্রা’ রেখেছিলেন। সেইসঙ্গে এই অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীরও পূজা-পাঠ প্রচলিত ছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে ঔপনিবেশিককালে খ্রিষ্টান মিশনারীরা ‘ইভানজেলিকালিজম্’ ধারণার বশবর্তী হয়ে রাভা ও মেচ উপজাতিদের কীভাবে খ্রিষ্টানধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এইসকল প্রান্তিক মানুষদের জীবনে পাশ্চাত্য ধর্ম ও শিক্ষা প্রবেশের সাথে সাথে তাদের নিজেদের চিরায়ত ঐতিহ্য, ধর্ম-সংস্কৃতির যে পরিবর্তনগুলি ঘটেছিল সে বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন।

তবে আলোচ্য গ্রন্থে এই অঞ্চলের অন্যান্য অনেক নদীর কথা লেখকের আলোচনায় স্থান পায় নি। তিনি এই অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাসকে তুলে ধরলেও তাঁর লেখায় একটি বিশেষ জনজাতির কথা প্রাধান্য পেয়েছে। নদীর অভিশাপ তাহলে কি শুধুমাত্র জেলেসম্প্রদায়ের ওপর পড়েছিল কিংবা ঝালো-মালো সম্প্রদায়ের বর্তমান সামাজিক অবস্থান কেমন-এসকল প্রশ্নের উত্তরসন্ধানে লেখক নীরব থেকেছেন। তিনি অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট এই অঞ্চলের আদি-অধিবাসীদের ক্ষোভের কথা উল্লেখ করলেও বাঙ্গালী উদবাস্তুর যন্ত্রণার কথা তাঁর লেখায় উহ্য থেকেছে। নদীকেন্দ্রিক উন্নয়নযজ্ঞ এই অঞ্চলের জনজাতিবিন্যাসকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল তা আরও স্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হলে তা পাঠকের মনে অধিক আগ্রহের সঞ্চার করত। কামতাপুর রাজ্যের দাবী উত্থানের পশ্চাতে অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকা এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলনের ফলে দেশের অভ্যন্তরে বাঙ্গালীদের অভিবাসনের ঘটনা লেখক ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরেছেন।

ডঃ বর্মণ তাঁর লেখা এই বইটিতে দেখিয়েছেন যে কোন অঞ্চলের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলকেন্দ্রিক রচিত সাহিত্যগুলি কীভাবে ইতিহাস রচনার প্রামান্য দলিল হয়ে উঠতে পারে। সাহিত্যে প্রতিভাত দলিত মানুষের জীবনসংগ্রামকে নদীকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় স্থান দিয়ে লেখক তাঁর অনন্য রচনাশৈলীর পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। নদী কীভাবে জনমানসের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং সেইসঙ্গে মানুষের জীবনধারণের অর্থনৈতিক কাণ্ডারী হয়ে উঠতে পারে তা লেখক তাঁর সুদক্ষ লেখনীর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তাঁর লেখায় নদী হয়ে উঠেছে নদী-অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীগত এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রতীক। আবহমানকাল ধরে নদী মানুষের অভিবাসনের ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সাক্ষী থেকেছে এবং দ্বন্দ্বপ্রসূত অভিবাসনের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট আদি-অধিবাসী ও আগন্তুক সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের দলিল এই উপন্যাসকেন্দ্রিক ইতিহাস-বিশ্লেষণ। উত্তরবঙ্গের কামতাপুরি আন্দোলন(১৯৬৯) এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন(১৯৭৯-১৯৮৫) উদ্ভবের ক্ষেত্রে নদী কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হয়ে ওঠে তা লেখকের ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। সেইসঙ্গে নদী কীভাবে ধর্ম-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে তার এক নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-বিশ্লেষণ লেখকের লেখনীতে পরিস্ফুটিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গ ও অসমের পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় এই বই যে কতখানি মূল্যবান তা পাঠক  বইখানি পাঠের পর সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন।     

......

গ্রন্থ সমালোচনা

Rup Kumar Barman, River, Society and Culture: Environmental Perspectives on The Rivers of Assam and Bengal. Delhi: Primus Books, 2023, xix+95pp, ISBN: 978-93-5687-835-8(Paperback)

.........

রামকৃষ্ণ জানা ,গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

;

গড়তে চান বই পড়ার অভ্যাস?



মোঃ শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

  • Font increase
  • Font Decrease

লাইব্রেরিগুলো আজকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পাসের আড্ডায় বই, সে বড়ই হাস্যকর! বই পড়ার মতো সময় হয়ে ওঠে না কারোরই! আমাদের বর্তমান সময়টা কেড়ে নিয়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেট। অথচ বই পড়ার গুরুত্ব কমবেশ সকলেরই জানা।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বই কতটা জরুরি সেটা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু একটি বই পড়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক বই নির্বাচন।

বই পড়া শুরুর ক্ষেত্রে নতুন পাঠকরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকের আর বই পড়াই হয় না। আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে একটি বই পাঠ করা যায়, গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস।

সময়: বই পড়ার কথা বললেই সবাই এক বাক্যে বলবে, ‘সময় নেই!’ সময় নিয়ে আমাদের অভিযোগের বড় কারণ হলো, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে না করা। প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় দিয়েই কিন্তু গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস। সময় না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া। তাই, সকাল কিংবা সন্ধ্যা হাতের ফোনটা দূরে সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে যান বই নিয়ে।

পরিবেশ: উপযুক্ত পরিবেশ বই পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, বেলকনিতে কিংবা বাসার ছাদে বই পড়ার স্থানটি যেন হয় নির্জন এবং শান্ত। আজকাল বিভিন্ন পার্কে ‘নীরব বই পাঠ কর্মসূচি’ দেখা যায়। চাইলে যোগ দিতে পারেন তাঁদের দলেও। বই পড়ার পাশাপাশি পরিচয় হবে বইপ্রেমী মানুষদের সাথে।

বই নির্বাচন: বই পড়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে যেমন জরুরি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক বই নির্বাচন। এক্ষেত্রে নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। যেসব গল্প আপনাকে আকর্ষণ করে শুরুতে সেই বইগুলোকেই আপনার পাঠ্য তালিকায় রাখুন। 

পাঠাগার: পাঠাগারে গেলেই যে বই পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বইয়ের সাথে সময় কাটালে এক সময় সেটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হবে। আর ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কখন যে দু’য়েক পাতা পড়ে ফেলবেন, নিজেই টের পাবেন না! তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে চলে যান পাঠাগারে। বই না পড়ুন, অন্তত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা তো হবে!

সোশ্যাল মিডিয়া: আমরা সবকিছুতেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার সুষ্ঠু ব্যবহার আপনার অভ্যাস গড়ার বড় সহায়ক। ফেসবুকে সাহিত্য তথা বই বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হয়, হয় বই বিষয়ক আড্ডাও। এসব গ্রুপে যুক্ত হয়ে বাড়াতে পারেন বইয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা।

ধারাবাহিকতা: বলা হয়ে থাকে টানা ২১ দিন কোনো কাজ করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। অভ্যাস গড়তে হলে ধরে রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। সামান্য হলেও প্রতিদিন পড়ুন। এই ধারাবাহিকতায় আপনার বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করবে। 

বই পড়ার অভ্যাস রাতারাতি তৈরি হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদূর পড়ার পর বইটি আর ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে। জোর করে সে বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে উন্নতি সাধন অবধারিত। একাডেমিক পড়ার বাইরেও বইয়ের বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেই জগতে মানুষ জানার জন্য পড়ে, পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। বই পড়লে মানসিক চাপ হ্রাস পায়, হয় মস্তিস্কের ব্যায়াম, বাড়ে শব্দ ভান্ডার ও স্মৃতি শক্তি। বই পাঠকের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, বৃদ্ধি করে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। বই পড়ার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। তাই বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি।

;

মায়ের সমাধির খোঁজে



মহীবুল আজিজ
মায়ের সমাধির খোঁজে

মায়ের সমাধির খোঁজে

  • Font increase
  • Font Decrease

কন্ডাক্টরকে বললাম, এখানে নামিয়ে দিন,
এখানে এই মিয়াপাড়ায় আমি নামবো—
মিয়াপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছে আমার মা।
মায়ের কবর দেখতে এলাম আটান্ন বছর পরে,
জ্যাঠা বলেছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু গেলে
একটা গোলাপ গাছ ঘেঁষে কবরটা,
কবরের আগে আমাকে গোলাপ গাছ খুঁজতে হয়—
জ্যাঠা চলে গেছেন তা-ও বত্রিশ বছর।
ডানদিকে ঘুরতেই জড়িয়ে ধরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ,
পাশাপাশি চারটা কবর, চারটাতেই গোলাপের পাহারা;
এত কবর এত কবর, কবরে ভর্তি কবরস্থান—
কোথায় শেষ শয্যা নিয়েছিলেন আমার মা!
হাওয়ায় পাতা দোলে গোলাপের, চারটাই একসঙ্গে,
চারটা গাছ থেকেই মুখবাড়ানো গোলাপ ডাক দেয়—
এইখানে এইখানে এইখানে—কোন্খানে!
উবু হবো কবরের মাটি নিতে
কিন্তু চারটাই ডানদিকে, চারটাই গোলাপের পাশে,
প্রতিটি কবর থেকে একটি একটি মুঠো নিয়ে
পলিথিনের চারটে ব্যাগে রাখি।
একবার মনে হয় প্রথমটাতে,
তারপর মনে হয় দ্বিতীয়টাতে,
আবার মনে হয় তৃতীয়টাতে
এবং মনে হয় চতুর্থটাতে সন্ধান রয়েছে মায়ের।
মা সুপ্ত থেকে যান অনির্দিষ্ট মাটিতে ,
তবে কোন্ মানবের মাটি ধরে রাখি বুকের কাছে!
ঠিক তখন বিস্ময়ের মতন একটি ফুটন্ত গোলাপ
গাছ থেকে ঝরে পড়ে দ্বিতীয় কবরে,
সংশয়ী মন বলে, তবে কী গোলাপই বার্তাবহ মায়ের!
অদৃষ্টে অবিশ্বাসী মন দোলে সংশয়ে,
তখন আরেকটি গোলাপ ঝরে পড়ে চতুর্থ কবরে।
অর্থাৎ দুই যোগ দুইয়ে এসে আমার আর হিসেব মেলে না,
জ্যাঠা বলেছিলেন, কবরটা গেটের ডানদিকে ঘুরতেই
এবং গোলাপের পাশে।
বত্রিশ বছরে চতুর্গুণ হয়েছে গোলাপ
কিন্তু এক ও অবিভাজ্য আমার মা’কে
এই গোলাপের কারণেই খুঁজে পাই না আমি—
ফিরে আসি শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে।

১১-০৯-২০২৩

;