হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা
ছিঁড়ে ফ্যালো, মুক্ত হও
মন পোড়ে, ধোঁয়া নেই
মনের ভিতরে জ্বলে, কিন্তু কোনো আলো নেই।
মনের আকাশে মেঘ, তার কোনো ছায়া নেই।
এত নেই, কেন নেই, মন লুপ্ত আকাশেই।
দূরাকাশই মনের আবাস, ঝড়ে জলে দীর্ঘশ্বাস।
মন পোড়ে, শব্দহীন
আমি কেন জব্দ হই, বিরহের সুচে বিঁধে স্তব্ধ হই
এই কষ্ট হয়তো তুচ্ছ সামান্যই-
তাও কেন দূরের বাসিনী কোনো স্বৈরিণীর
মনও কেন একইসঙ্গে পোড়ে
বিচ্ছেদের আত্মঘাত অন্তহীন ঘোরে
হায় রে মন, হায় পোড়া মন
মিছেমিছি হও তুমি উচাটন, ছিঁড়ে ফ্যালো জীবনবন্ধন!
পাথরপ্রতিম শাস্তি
কানুর পিরিতি, গোপন সে ভীতি,
রাধা কেন কাঁদে, পড়েছে সে অতন্দ্রিলা ফাঁদে
বাঁধভাঙা আবেগের কোনো দাম নাই
চোরাগোপ্তা ফাঁস হয়ে তোমাকে ডোবায়
এ জীবন আসলেই কুহকিনী মায়া ও অধ্যাস
হায় রাধে, হায় কৃষ্ণ, পরস্পরকে ভালোবাসে
হৃদয়ের তন্ত্রী দিয়ে মনোমাঝে বাঁধে
কানুর পিরিতি, ছিঁড়ে ফ্যালে প্রথা রীতিনীতি
রাধার উপায় নাই, মরমে সে লজ্জিতা ও মরোমর
ভালোবাসা পাথরপ্রতিম শাস্তি, পোড়ায় অন্তর..
ভ্রমের স্ফুটন
তোমার বাগানে আমি ভুল করে ফুটিয়াছি
তুমি স্পর্শ করলে পরে কেন্দে জেগে উঠিয়াছি
আহা ফুল! কী অস্পৃশ্য ভুল!!
জীবনের আয়ুসলতে এত কেন অপ্রতুল!
স্মৃতির লাঞ্ছন
স্মৃতি যদি মাছি হতো
দূর দূর করে তাকে তাড়ানো সম্ভব হতো
কিন্তু স্মৃতি প্রকৃতই ভীতিকর
উৎস জ্বলুনির, আহুতির অনন্ত ইন্ধন!
হোক পরীক্ষণ
তাচ্ছিল্য করেই দ্যাখো
কীরকম অমৃতের স্বাদ পাই,
ভালোবেসে নিঃস্ব হয়ে দ্যাখো
কী সুন্দর বিচ্ছেদের পতাকা ওড়াই!
প্রশ্ন নিরর্থক
মুখ ফুটে বলতে চাওনি কিছু
তল্পিতল্পা গুটিয়েছো অনেক আগেই
বিদায় বলার মত ফুরসতটুকু
দেওয়ার মতন ইচ্ছে উদারতা সুকঠিন ছিল?
অত্যাশ্চর্য খিদে
অভিমানের চাবি
ভালেবাসার দাবি
নিংড়ে নিংড়ে এই অভাগার
প্রাণসত্তার সবটা ছিঁড়ে খাবি?
নিয়তি অমোঘ
হাইব্রিড অবজ্ঞার চাষ করে করে
নিজেই নিজের শত্রু কেন হয়েছো!
প্রায়শ্চিত্ত অনুতাপ যতোই করো না কেন
মোক্ষ ও মুক্তির স্বাদ মিলবে না আর!
বৈপরীত্য
জীবনপাত্রের সুধা উচ্ছলিয়া
সবটুকু দিয়া গেছো কাঙালেরে
কেন এত নিঃস্বতায় নিজেকে নিঃশেষ করা
তোমার মরণে কেন অভাগার আয়ু বেড়ে গেল!
দেবে নাকি?
থোকা থোকা দুঃখফুল
ছুঁয়ে দেখি তোমার মসৃণচুল
সাধ হয় ওই চুলে ফাঁস দিয়ে মরি
দেবে কী অমন দান নর্মসহচরী?
অপূর্ণ খায়েশ
ভালোবাসার গহিন গাঙে
ডুবতে ডুবতে একটাই আফসোস
মৃত্যুসমান বিরহস্বাদ অম্ল এবং কটু
ইচ্ছেমতন চেখে দেখার আর তো সুযোগ নাই।
বিনিময়
তোমাকে সৃজন করি, প্রতিমায় গড়ি
গড়তে গড়তে নিজেই নিঃশেষ
তুমি পাও চিরবাঞ্ছিতার কৃতি বহুল বন্দনা
এই প্রাপ্তি অন্তরালে আমারই মরণ!