ভারতকে বাংলাদেশ গুরুত্ব দেবে

  • খুররম জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা ২৪.কম

ছবি: বার্তা ২৪.কম

বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারতের অবস্থান ও গুরুত্ব অনেক বেশি। এ জন্য ভারতকে বাংলাদেশ গুরুত্ব দেবে এটা বলাই বাহুল্য। এ ক্ষেত্রে ভারতকে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়াই উচিত ন্যায্যতার ভিত্তিতেই।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত তৌহিদ হোসেন বাংলাদেশের ৫০ বছরকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। তার একান্ত সাক্ষাৎকারটির ২য় পর্ব নিয়েছেন স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট খুররম জামান।

বিজ্ঞাপন

তৌহিদ হোসেন বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের কূটনীতি সম্পূর্ণ ভারতকেন্দ্রীক হয়েছে তা আমি মনে করিনি না। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ এটিও আমি বলব না। ভারত তার স্বার্থ দেখে। ভারত কিছুটা ধরে নিয়েছে বাংলাদেশকে যা বলব তাতো শুনবেই। এটা একটা খারাপ জিনিস। এজন্য আমরাও অনেকটা দায়ী। এছাড়া ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো। ভারতে বাংলাদেশের রফতানি বাড়ছে। ৭১’র এর মতো সম্পর্ক সবসময় থাকবে না, তার পরেও ভালো সম্পর্ক।

তিনি বলেন, ২০২১ সালে মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী পালনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যেমন এসেছিলেন তেমনি আরো চারটি দেশের রাষ্ট্রনেতারাও এসেছিলেন। বিজয় দিবসে ভারতের রাষ্ট্রপতিও এসেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারতের অবস্থান ও গুরুত্ব অনেক বেশি। এ জন্য ভারতকে বাংলাদেশ গুরুত্ব দেবে এটা বলাই বাহুল্য। এ ক্ষেত্রে ভারতকে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়াই উচিত ন্যায্যতার ভিত্তিতেই।

বিজ্ঞাপন

সাবেক এ পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট নিয়ে ভারতীয়রা এমন একটা ভাব করে যেন তারা বিরাট একটা পজিটিভ কিছু করে ফেলেছে। এটা মোটেই ঠিক নয়। ভারত ৪২ বছর দেরি করেছে এ চুক্তিটি করতে। ১৯৭৪ সালে যখন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হয় তখনই সিদ্ধান্ত হয় দুই পক্ষই এটিকে রেটিফাই করবে।

বাংলাদেশ কোনোও সময় নষ্ট না করে রেটিফাই করেছে। ৪২ বছর পর ভারত এটিকে রেটিফাই করার জন্য ক্রেডিট নেওয়ার কিছুই নেই বলে আমি মনে করি। অন্যদিকে ছিটমহল বিনিময় নিয়ে যত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা বিষয়টি কিন্তু এত বড় নয়। এটিকে বড় বানিয়েছে ভারত। এটা ১৫০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার মানুষের সমস্যা। ৪৭ বা ৭১ এ সমস্যার সমাধান হয়নি। এ মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। ৪৭ বা ৭১ তাদের সত্যিকারের স্বাধীনতা দেয়নি।

রাষ্ট্রদূত তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে যে হত্যা চলছে এ ধরণের ঘটনা বিশ্বে কোথাও ঘটে না। চীন ও ভারত হচ্ছে একে অন্যের শত্রু, কিন্তু তারও বর্ডারে গুলি ছুঁড়ে না। কিন্তু এ বর্ডারে নিয়মিত গুলি করে মানুষ মারা হয়। এখন ভারত নতুন অজুহাত বের করেছে, তারা বলছে অপরাধ যতদিন থাকবে ততদিন বা বর্ডার বন্ধ হলে এটি বন্ধ হবে।

সাবেক এ পররাষ্ট্র সচিব প্রশ্ন তোলেন, পৃথিবীতে কোন বর্ডার আছে যেখানে অপরাধ নেই? অপরাধ কি, গরু পাচার! বাংলাদেশে গরুর চাহিদা আছে, ইন্ডিয়াতে নেই। এটা অত্যন্ত ছোট জিনিস। মানুষের জীবনের চেয়ে গরুর মূল্য বেশি এটি হতে পারে না।

বাংলাদেশের ভারত সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, সমুদ্রসীমা বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে করেনি। শুধু ভারত নয় মিয়ানমারের সঙ্গে এ বিষয়ে সমাধান না আসায় বাংলাদেশ আদালত যায়। দুই পক্ষই আদালতে গেছে এবং এই রায় মানতে দু'পক্ষই বাধ্য। কিন্তু রায়ের পরও ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমুদ্রসীমা দাবি করে। এটা হল অনার্থক খোঁচানো।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সরাসরি ও কঠোর ভাষায় বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সহজে সমাধান হবে না। সময় লাগবে, যতদিন না পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে পারি। অনেকে বলার চেষ্টা করছে, এটি একটি আঞ্চলিক সমস্যা। এটা মোটেই কোনো অঞ্চলিক সমস্যা নয়। এটা সম্পুর্ণ বাংলাদেশের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ এটিকে অঞ্চলিক সমস্যা বানাতে পারেনি।

তৌহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়া সকলেই শান্তিতে আছে। এ সমস্যাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটিকে অঞ্চলিক সমস্যা সৃষ্টি করতে হবে। খুব খারাপ করে বলি, আমি মনে করি, সমাধান আসবে যদি সত্যিকার অর্থে এটিকে একটি আঞ্চলিক সমস্যায় পরিণত করা যায়। আমরা এটি চেষ্টা করছি না।

এখানে খুনোখুনি, মাদক ও মানবপাচার, গোলমাল সব বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। কোনোও কিছু পার্শ্ববর্তী দেশকে স্পর্শ করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিছুটা টানাপোড়েন চললেও এটি সাময়িক বলে জানান এই অভিজ্ঞ কূটনীতিক। তিনি বলেন, এটির অচিরেই সমাধান হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করা আমরা এফোর্ট করতে পারি না। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ওরা এগিয়ে এসে সম্পর্ক ঠিক করবে আর আমরা বড় বড় কথা বলব এটা হবে না। আমাদের বাদ দিয়ে আমেরিকা চলতে পারবে, আমরা পারব না ।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ৭১ স্বাধীনতার পর অনেক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়েছে তাদের মধ্যে চীন অন্যতম। যদিও চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে নিজের স্বার্থে। এটি ভাবলে চলবে না চীন আমাদের শত্রু ভাবছে। আসলে মিয়ানমার চীনকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করার সুবিধা দিচ্ছে।

তৌহিদ হোসেন বলেন, অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তা খুবই দুঃখজনক। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাশিয়া ছিলো সবচেয়ে বড় সমর্থক। মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল এমনটা নাও হতে পারত যদি না রাশিয়া আমাদের সমর্থন করত। অন্যরকম হতে পারত। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালোই যাচ্ছে তবে সে সময়ের ধারা আমরা ধরে রাখতে পারিনি।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে চলে গেলো। মিয়ানমার রাশিয়ার অস্ত্রের একটা বড় ক্রেতা। এমন ক্রেতাতো আমরাও হতে পারতাম। অন্যদিকে রাশিয়া থেকে আমরা দ্বিগুণ দাম দিয়ে পাওয়ার স্টেশন কিনেছি। তাছাড়া চীন ও রাশিয়া এখন আঁতাত করছে যা যুক্তরাষ্ট্র ৫ দশক ধরে চেষ্টা করেও বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। এ বিচ্ছিন্নতা রাখতে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কি-না সুযোগই দিয়েছে!