হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা
সক্ষমতার আত্মপ্রসাদ
দুঃখ পেলে নদীর কাছে ফিরি
অপমানে দগ্ধ হলে বৃক্ষ শোনায়
সান্ত্বনাগান মিশ্র চারুকেশী
ঠুমরি ও গৎ বন্দিশে পাই
বিস্মরণের স্নেহশান্তি
মেদুর প্রলেপ তাপ
শীতলপুণ্যে হার মেনে যায়
উদ্ধত রোষ পাপ
জীবন বলে একটু থাকি
উড়বে কখন পরানপাখি
এক্ষুনি নয় অন্ধপ্রলয়
স্বেচ্ছাদহন মরণকূপে ঝাঁপ
ভালোবাসার শক্তি এমন
তেজস্ক্রিয় সত্য সরল
হার মানে সব কষ্ট-গরল
মুছে ফেলতে সক্ষম হই-
সর্বনাশের ছাপ।
অপেক্ষমাণ থাকছি আশায়
অনেক ঋণে
গুল্মে তৃণে
নাম লিখেছি ভালোবাসার
একইসঙ্গে অন্ধ আশার
থৈ মেলে না ভুখ পিপাসার
আশা এমন অন্ধ কেন
সংশয়তাপ মুক্ত কেন
নিলাজ আশা সর্বনাশা
বেহায়া খুব ধুঁকতে ধুঁকতে
জীবন পোড়াই জীবন
ঠিক জানা নেই আর কতক্ষণ
পোড়াবে ধূপ তপ্ত মনন
জ্বলতে জ্বলতে
দ্বিধার কথা বলতে বলতে
ভাসাই গাঙে ভালোবাসার
ভরসাডিঙি নাও
বইছে পুবাল বাও
ভাসতে ভাসতে একলা গাঙে
রহস্য আর আঁধার ভাঙে
মন হারিয়ে
সঞ্চিত সব ধন হারিয়ে
নিঃস্ব কাঙাল হই
তারপরেও পাই না কেন
আরাধ্য সে তটের দেখা
ধুকঁছি মনোকষ্টে একা
তাও তো আশায়
অপেক্ষমাণ রই...
কোরো না অন্ধতাচাষ
ধ্বংস থেকে ভস্ম থেকে
এনেছি তোমাকে তুলে
ভালোবাসা,
বলো ভুল ভেঙেছে তোমার ?
অভিমানে অত আর্দ্র নতমুখী
রয়েছে যে, কী তার কারণ ?
রেণু থেকে ভ্রƒণ থেকে
তোমাকে যে করেছি সৃজন,
ভালোবাসা,
বলো তুমি, আচম্বিতে কেন তুমি
আত্মদহনের ভুল
পথ খুঁজতে ব্যাকুল হয়েছো
মিছেমিছি হয়ো না ব্যাকুল
অনর্থক চাষ তুমি কোরো না অন্ধতা স্তুতি
ভেঙেচুরে নতুন নির্মিতি ছাঁদে
সংশোধন করে নাও ভুল !
কোথা সে আনন্দধাম
মনে মনে ছিলাম ভিখিরি
কাঙালপনার দায়
একমাত্র আমারই তো ছিল
সেই দেনা শোধ করতে
একটি জীবন দ্রুত
উপেক্ষিত নিঃশেষিত
যেন ঝরা মরাপাতা
যেন নিঃস্বতার ঢেউ
হারানো গাঙের স্রোতে
অবরুদ্ধ ফাল্গুনবিকেল
কোকিলের নিয়ন্ত্রিত কুহু
আমি চাই হে মানবী
তুমিও ভিখিরি হয়ে দ্যাখো
উপলব্ধি করে দ্যাখো সততই
কাঙালপনার মধ্যে
ঐশী এক আনন্দ বিরাজে !
জেনে রেখো
ফুলের সুরভি দিয়ে বিনিময়ে পেয়েছ কী
অবজ্ঞা ও হেলাফেলা
এই-ই বুঝি নারীর চাতুর্য প্রিয় খেলা !
হে যুবক মনোমেঘে বৃষ্টি হবে
বিচ্ছেদে পাষাণ দ্রব
একদিন সুনিশ্চিত হবে দেখো
জানা নাই, ঠিক কবে
কিন্তু সেই দুঃসময় তোমাকে চিরল
দুঃখবিষে জর্জরিত
করবেই, তবে বৎস
একথাও জেনো তুমি
প্রত্যেক ক্রিয়ারই আছে সমান ও বিপরীত
প্রতিক্রিয়া, বড়ো সে নির্মম !
কেন চোখ ছলোছলো
থামতে হয়, থামি
নত হয়ে চর্চা করি কাঙালিপনার
নামতে নামতে
সংশয়ের কাঁটা বিঁধে
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি
দ্বিধাতুর আমি।
থেমে থেমে
মেঘের আড়াল ফুঁড়ে
আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিকণা
আসুক অঝোরে নেমে
ধারাজলে হতে পারে ¯স্নান সমাপন
গোপন আনন্দটুকু না যায় বর্ণন।
মনোবাঞ্ছা তোমার অঙ্কুরে দিই
সতেজ প্রফুল্ল দ্যুতি
আলো হাওয়া জল
মৃত্তিকা মমতা ¯েœহ
শর্তহীন অপত্য কোমল
তাও কেন মালিন্যমণ্ডিত থাকো
দুই চক্ষু কেন ছলোছলো ?
আর্ত, দীর্ণ, পলাতক
বন্ধুবেশে এসেছিল
মায়াবী সে আততায়ী
ঘাতকেরও মনে ছিল
ভালোবাসা কোমল দ্রবণ
সেই হাত কেন ও কীভাবে
বশীভূত হয়েছে এমন
রক্ততৃষ্ণা কেন হলো
অতটা প্রবল
এই প্রশ্ন ঘুরপাক
এ জিজ্ঞাসা জেগে থাকবে
সমস্ত জীবন -
আশ্চর্য ব্যাপার হলো
আততায়ী যে বান্ধব
তারই জন্য
এই মন অহর্নিশ পোড়ে
গোপন জ্বলুনি কষ্ট
অন্যকে বলার মত
শক্তি ও সাহস কিছু অবশিষ্ট নাই !
নিজেই নিজের কাছ থেকে
অজ্ঞেয় কারণে আর্ত পালিয়ে বেড়াই।