বন পাহাড়ের কোলে
শ্রীলঙ্কা থেকে: নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ একবার এসেছিলেন এখানটায়। প্রয়াত হওয়ার কিছু আগে। ‘রাবণের দেশে আমি এবং আমরা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন, আমি চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে আছি। আমার সামনে বিশাল কান্ডালামা লেক। আকাশ ঘন নীল। সেই নীল গায়ে মেখে কান্ডালামা হ্রদ হয়েছে নীল। কী আনন্দময় অপূর্ব দৃশ্য!
আজ অবশ্য কান্ডালামা লেকের পানি নীল হয়নি। কারণ আকাশের নীল আড়াল করে রেখেছে ধূসর মেঘের দল। আর কান্ডালামা পর্বতের আড়াল থেকে সূর্যটা সেই ধূসর মেঘের ওপর যেটুকু আলো প্রতিফলিত করছে, তাতে লেকের পানিও ধূসর রূপ নিয়েছে। তাতে অবশ্য শুভ্র সুন্দরীর সাজ নিয়েছে লেক। আর হুমায়ূন আহমেদ যে রিসোর্টের বারান্দায় বসেছিলেন, তার আবেদন কোনো অংশেই কমেনি।
সিংহলী শব্দ কান্ডালামার অর্থ নাকি পর্বতের নিকটবর্তী। অনেক বছর আগে এক রাজা এই লেকটা খনন করিয়েছিলেন ওই পর্বতের পাদদেশে। পর্বতের কাছে বলেই নাকি তার নাম হয়েছিলো কান্ডালামা লেক। কিন্তু ওই পর্বতের নামও এখন কান্ডালামা মাউন্টেইন। পর্বত ঘিরে বিশাল যে বনটা আছে তার নামও কান্ডালামা ফরেস্ট। আর শ্রীলংকার মধ্যাঞ্চলে ডাম্বুলা জেলায় লেকের পাড়ে এই রিসোর্টটার নাম হেরিটেন্স কান্ডালামা।
এই কান্ডালামা পৃথিবীর সুন্দর হোটেলগুলোর একটা। এর ডিজাইন করেছেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্থপতি জেফরি বাওয়া। দুনিয়াজুড়ে অন্যতম সেরা পরিবেশবান্ধব হোটেল হিসেবেও নাম কুড়িয়েছে কান্ডালামা।
শ্রীলংকান ট্যুরিজম এর ট্যুর গাইড লেকচারার সুদেশ বিক্রমারত্নে জানালেন, জেফরি বাওয়া এই হোটেলটার ডিজাইন করার আগে বিভিন্নভাবে জায়গটা সার্ভে করেছেন। হেলিকপ্টার থেকেও জরিপ চালিয়েছেন। এখানকার একটা পাথরও তিনি নষ্ট করেননি।
বাস্তবিকই হোটেলটি গড়ে তোলা হয়েছে প্রকৃতির কোলে। বারান্দায় বসলেই বুনো পরিবেশ। দরোজা খোলা থাকলে বানর এসে এটা ওটা নিয়ে নিমিষে হাওয়া। কোনটা প্রয়োজনের, কোনটা অপ্রয়োজনের তা ভাবারই দরকার মনে করে না। তা না হলে হুমায়ূন আহমেদের চশমা নিয়েছিলো কোন আক্কেলে!
এখানে লেকের ওপর ঝাঁক বেঁধে ওড়ে সাদা বকের দল। হোটেলের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে যখন তখন চোখে পড়বে বয়সি পাথর। সাততলা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরই নির্মিত হয়েছে পাহাড়ের ঢালের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। কখনও তো মনে হবে, কোনো গুহার ভেতরে ঢুকছি বুঝি! শোবার ঘর, ওয়াশ রুম, রেস্তোরাঁ সবখানেই সঙ্গী হবে কুমারি প্রকৃতি। বুনো প্রাণীরা বিরক্ত হবে বলে রাতে এ হোটেলে উজ্জ্বল আলো জ্বালানো হয় না। রিসিপশনেও থাকে টিমটিমে আলো। স্টাফরা পরেন ফতুয়ার মতো টপস আর সেলাইহীন লু্ঙ্গির মতো ঘিয়ে রঙের পোশাক। সব মিলিয়ে এটা যেন অন্যরকম এক দুনিয়া।
১৫৬ প্রজাতির গাছ আছে এখানে। পাখি আছে ১৭৩ প্রজাতির। আছে ৮২ প্রজাতির প্রজাপতি। তিন প্রজাতির বানর। বুনো পথে হাঁটতে হাঁটতে সহসা দেখে হয়ে যাবে মেখম মেলা ময়ূরের সঙ্গে। বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশনের ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল সপ্তাহব্যাপী সফরের প্রথম রাতটা এখানে কাটিয়ে তাই যারপরনাই মুগ্ধ। এ দলের সদস্য আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল, জাকারিয়া মন্ডল, এস.এম. সাজ্জাদ হোসেন, আবীর আবদুল্লাহ, আজিম খান রনি ও শাকিল বিন মুশতাক মনে করেন, বাংলাদেশে ইকো-ট্যুরিজমের ধারণা বাস্তবায়নে এরকম একটা উদহারণ দারুণ সহায়ক হতে পারে।
শাওনের সঙ্গে বিয়েবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এখানে থাকাকালে হুমায়ূন আহমেদকে এখানকার এক স্টাফ বলেছিলেন, তোমরা মারামারিতে খুব ভালো।
কারণ, একবার নাকি বাংলাদেশ ও ভারত ক্রিকেট টিম ছিলো এখানে। তখন দুই দলের মধ্যে মারামারি বেঁধেছিলো। আর সে মারামারিতে জিতেছিলো বাংলাদেশ। এমন জয় নিশ্চয়ই আমরা চাই না। শ্রীলংকার মতো ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন করতে পারলেই বরং আমাদের জন্য ভালো।
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন