সিংহ পাহাড়ে কশ্যপের কান্না

  • জাকারিয়া মন্ডল
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সিংহ পাহাড়ে কশ্যপের কান্না/ছবি: আজিম খান রনি

সিংহ পাহাড়ে কশ্যপের কান্না/ছবি: আজিম খান রনি

শ্রীলংকা থেকে: পাহাড়টা যেনো আকাশের গায়ে চুপটি করে বসে আছে। এমন খাড়া পাহাড় সচরাচর দেখা যায় না। চারপাশের প্রকৃতি আর পরিবেশও অন্যরকম। গল্পটাও রোমাঞ্চে ভরা।

ওটার কাছে যেতে প্রথমেই একটা লেক পার হতে হবে। একসময় এই লেকটাতে নাকি কুমির ছাড়া থাকতো। বস্তুত কুমিরগুলো ছিলো সামনের পাহাড় দুর্গের কাছে যাওয়ার পথে প্রথম প্রতিরোধ। এগুলোকে প্রহরী হিসেবে রেখে লেকটি ছিলো দুর্গটার প্রতিরক্ষা পরীখা।

বিজ্ঞাপন

এখন অবশ্য পরীখাটায় কোনো কুমির নেই। বেইলি ব্রিজ পার হলেই একপ্রস্থ সিঁড়ি। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের সাক্ষী। ওপরের চত্বরে রাস্তার দুপাশে জলাশয়গুচ্ছ। পাড়ে নানা প্রজাতির গাছ। দুর্গের ওয়াটার গার্ডেন হিসেবে পরিচিত। তার ওপাশে বোল্ডার গার্ডেন। সিঁড়িরাস্তার পাশে পুরনো ইটের অগভীর নালাটা নদীর মতো বাঁক খেতে খেতে নেমে এসেছে। এখন শুকনো বটে, কিন্তু বৃষ্টি হলেই পুরো পাহাড়ের পানি ওই পথেই  নেমে এসে জমা হবে জলাশয়গুলোতে।

এমন খাড়া পাহাড় সচরাচর দেখা যায় না। ছবি: আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল

সমতলের সিঁড়ি শেষ হলেই শুরু পাহাড় বাওয়া। দুপাশের বোল্ডার দুপাশ থেকে এগিয়ে এসে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে যেনো পাথরের প্রাকৃতিক তোরণ গড়ে রেখেছে। এখান থেকে শুরু হয়ে একটু পরপরই খাড়া সিঁড়ি। উঠতে উঠতে হাঁফ ধরে যায়। একখানে বিশাল পাথরের মাথা কেটে সমতল আকার দেওয়া হয়েছে। এটার নাম অডিয়েন্স হল। এখানে বসলেই নিচ থেকে আসা যে কাউকে নজরে রাখা যায়।

বিজ্ঞাপন
পাহাড়টা যেনো আকাশের গায়ে চুপটি করে বসে আছে। ছবি: আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল

আরও এগুনোর পর পাহাড়ের গায়ে ঝুলে ঝুলে এগুনোর ব্যবস্থা। ফ্রেসকোস গুহায় উঠে যাওয়ার জন্য প্যাঁচানো সিঁড়ি। ওই গুহার দেওয়ালে অনেক নারী মূর্তি খোদাই করে রাখা। গুহার নিচে গ্রানাইটের দেওয়ালটা মানুষের অবিবেচক আঁড়ছে নষ্ট। একসময় আয়না ছিলো এটা। এরপর পাহাড়ের গায়ে ঝুলে ঝুলে আরও এগিয়ে যাওয়ার পর আরও একপ্রস্থ খাড়া সিঁড়ি। মাথায় সমতন চত্বর। এখান থেকে পাহাড়ের উপরের মাথাটাকে মনে হয় সিংহের মাথা। গোড়ায় সিংহের দুই থাবা এখনও স্পষ্ট। সিংহের এই অবয়বের কারণেই এই পাহাড়টার নাম লায়ন রক। তবে সিগিরিয়া রক নামেই সমধিক পরিচিতি এর। এই পাহাড় নিয়ে অনেক গল্প। সবচেয়ে রোমাঞ্চকর গল্পটার জন্ম দিয়েছেন রাজা কশ্যপ।

সমতলের সিঁড়ি শেষ হলেই শুরু পাহাড় বাওয়া।ছবি: আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল

সাড়ে তিন হাজারেরও অধিক বছর আগে কশ্যপ তার পিতা ধাতুসেনকে দেওয়ালের সঙ্গে প্লাস্টার করে দেন। তারপর নিজেই বসেন সিংহাসনে। কিন্তু, তিনি ছিলেন রক্ষিতার পুত্র। তাই প্রজারা তার চেয়ে তার ভাই মুগুলানকেই বেশী পছন্দ করতো। কারণ তিনি ছিলেন প্রকৃত রাজরক্তের অধিকারী। কিন্তু কশ্যপের অত্যাচারে তিনি ভারতে পালিয়ে যান।

একদিন মুগুলান বড় সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে আসেন। কশ্যপ ততোদিনে পাহাড় কেটে গুহা তৈরি করে তার ভেতরে আশ্রয় নিয়েছেন। পাহাড় ঘিরে গড়ে তুলেছেন দুর্ভেদ্য এক দুর্গ নগরী। সেখানে সবধরনের আরাম-আয়েসের ব্যবস্থা আছে তার। আছে পাঁচশ রক্ষিতা।

ড্রোন শটে সিগারিয়া পাহাড় দূর্গ/ছবি: আজিম খান রনি

কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। একদিন খবর আসে, তার ভাই বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। বাধ্য হয়ে যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে যেতে থাকেন কশ্যপ। দশ হাজার হাতির বাহিনী নিয়ে। হাতির পিঠে হওয়ার হয়ে তিনিই সবার আগে।

সহসা তার হাতিটা দাঁড়িয়ে যায়। ঘুরতে শুরু করে। আর তার সেনারা ভাবে, রাজা পালিয়ে যাচ্ছেন বুঝি! তাই দ্রুতই যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করে সবাই। রাজা কশ্যপ একা দাঁড়িয়ে থাকেন যুদ্ধক্ষেত্রে।

পাহাড়ের শীর্ষে ওঠার ঝুলন্ত সিঁড়ি।ছবি: আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল

রাজার প্রাণ তো যায়ই। সঙ্গে তার স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়, অনুচর সবাইকে হত্যা করা হয়। তারপর পুরো দুর্গটাই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাধনা ও বসবাসের জন্য দিয়ে দেন নতুন রাজা। ভিক্ষুরা ফ্রেসকোস গুহার দেওয়ালে আঁকা নারী মূর্তিগুলোকে মুছে দিতে থাকে। সেগুলোরই কিছু অবশিষ্ট আছে এখনও। ইতিহাস বইছে রাজা কশ্যপের। সিগিরিয়া রকের প্রতিটি খাঁজ, ভাঁজ, গুহা, চাতাল, সিঁড়িপথ, বোল্ডার আর ওয়াটার গার্ডেন স্মৃতি বইছে তার।

সিগারিয়া বা সিংহ পর্বতের অবস্থান শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় প্রদেশের নাতালে জেলার ডাম্বুলা শহরের কাছে। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এই পাহাড় দেখতে প্রতিদিনই ছুটে আসে অগণিত মানুষ।

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন।