বাড়ি যাবো!
প্রচণ্ড ভিড়, চরম অস্বস্তি, অসহনীয় যানজট, তীব্র গরম, রোজার ধকল, বাড়ন্ত রাহা খরচ, পথের ক্লান্তি, কিছুই কাবু করতে পারছে না মানুষকে। শহর-বন্দর ফাঁকা করে বাস, ট্রেন, লঞ্চে ছুটন্ত মানবমিছিলের কণ্ঠে ব্যক্ত-অব্যক্ত ধ্বণি একটিই: 'বাড়ি যাবো'।
ঈদে, উৎসবে বাংলাদেশের কোটি কোটি জনস্রোত কর্মস্থল থেকে বাড়িমুখো হয়। 'বাড়ি যাবো' বলে ঘর ছেড়ে পাড়ি দেয় অভাবনীয় অনিশ্চয়তার দুর্গম পথ। যাত্রাপথের পদে পদে বিপদ, বিড়ম্বনা ও দুর্ঘটনায় কুটিল ভ্রূকুটি।
কেউ জানে না, ঠিক সময়ে বাড়ি পৌঁছানো যাবে কিনা! জানে না, যাত্রা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হবে কিনা। জানে না, আদৌ বাড়ি যাওয়া হবে নাকি দুর্ঘটনায় ছুঁয়ে যাবে জীবনের শেষযাত্রা! তবুও শঙ্কাহীন চিত্তে এক যুদ্ধসম প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ বাড়ি যেতে চায়।
বাংলাদেশে কয়েক কোটি লোক ঈদে, উৎসবে বাড়ি যেতে গিয়ে পথে পথে সম্মুখীন হয় জানা-অজানা শত বিপদের। জনচাপে ধ্বস্ত হয় যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। পরিবহনের সঙ্গে জড়িত অসাধু সিন্ডিকেট বিরূপতার সুযোগ নিয়ে মানুষের পকেট কেটে সর্বনাশ করে। মানুষের বিপদকে পুঁজি করে ব্যবসায়িক লাভ হাসিলের নিকৃষ্টতম প্রক্রিয়াকেও মেনে নেয় মানুষ। যেকোনও ভাবেই মানুষ বাড়ি যেতে চায়।
বাড়ি যাওয়া মানুষের কাছে কেবল সাময়িক স্থানান্তর নয়। আবেগ, অনুভূতি, হৃদয়বৃত্তিতে ভরপুর এক উপলক্ষ্যও বটে। মায়ের স্নেহের কাছে, প্রিয়তমা বঁধুর ভালোবাসার কাছে, সন্তানের আত্মীক নৈকট্যের কাছে, পূর্বপুরুষের স্মৃতি ও অনুভূতির কাছে সুতীব্র টানে পৌঁছানোর আরেক নাম বাড়ি যাওয়া। বাড়ি যাওয়ার সঙ্গে তেমনি নিবিড়ে জড়িয়ে এক অন্তর্গত টান।
আশি দশকের বিশিষ্ট কবি, প্রয়াত খোন্দকার আশরাফ হোসেন (জানুয়ারি ৪, ১৯৫০ - জুন ১৬, ২০১৩) ছিলেন বাংলাদেশি উত্তরাধুনিক চিন্তক, গদ্যকার, সাহিত্য সমালোচক, সম্পাদক, অনুবাদক, এবং অধ্যাপক। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশ। 'বাড়ি যাবো' শিরোনামের এক কবিতায় তিনি মানুষের গৃহ-প্রত্যবর্তনের অনভূতিমালাকে বর্ণিল শৈলীতে উপস্থাপন করেছেন:
''বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি...
পথ ছাড়ো অন্ধকার, পথ ছাড়ো দূরত্বের দূরগামী পথ
বাড়ি যাবো, বাড়ি...
বৈশাখের বটবৃক্ষ তালুতে কপোল রেখে বলে, 'হায়,
এ ছেলেকে কিছুতেই ফিরতে দেয়া চলবে না'; নগরীর পথ,
দালানের পরভৃত কোকিলের পঞ্চস্বর ডেকে বলে, শোন
তোর কোনো বাড়ি নেই,
অন্তরঙ্গ উচ্চারণে যাকে বলে হোম
সুইট হোম - সে আজ ভেসে গেছে বিস্মৃতির যমুনার জলে।
তোমার আসার জন্য কেউ নেই হাট করে ঘরের দরোজা,
পলাতক সময়ের ঝুঁটিবাঁধা কাকাতুয়া
দাঁড় ছেড়ে পালিয়েছে সেই কবে; ঘাটলার কাঠগুলো
কবে কোন চোর
নিয়ে গেছে অন্তপুরে চুলোর হৃদয় জুড়ে শান্তি দেবে বলে।
তবু বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি....
পথ ছাড়ো সুসময়, প্রতিশ্রুত সুখনিদ্রা, নিমগ্ন বালিশ,
পথ ছাড়ো জীবনযাপন ব্যথা, পথ করে দাও।
আজ যাবো
ঝিনাই নদীর জল হাঁটুতে কাপড় তুলে পার হবো,
মধ্যরাতে ডাক দেবো
মা মাগো এসেছি আমি! সেই কবে গভীর নিশীথে
তোমার নিমাইপুত্র ঘর ছেড়েছিল, আজ কাশী বৃন্দাবন
তুলোধুনো করে ফের তোর দীর্ণ চৌকাঠে এসেছি।
আমার কিছুই হলো না মা, লোকে বলে আমি ভীষণ নারাজ
জীবনের তপ্ত গালে চুমু খেতে,
আমি ভীতু, জীবনের দ্রুতগাড়ি বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে কেন থামাতে পারি না,
হিচহাইকিঙ করে কত লোক চলে গেলো দূরতম গন্তব্যে, তবুও
আমি একা এখানে দাঁড়িয়ে আছি,
বাসভাড়া হয়েছে লোপাট অন্য কারো কলাবতী আঙ্গুলের হাতে
তবু আমি বাড়ি যাবো বাড়ি যাবো, বাড়ি
এ বিশাল পৃথিবীতে এ মুহূর্তে অন্য কোনো গন্তব্য তো নেই!
পথ ছাড়ো অন্ধকার, পথ ছাড়ো দূরত্বরে দূরগামী পথ
বাড়ি যাবো, বাড়ি..''